পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ঢের হয়েছে ঢেল—শেষ পর্ব

দীপশেখর দাস

ফুট দশেক চওড়া নড়বড়ে একটি কাঠের সেতু। সেতু না বলে সাঁকো বলাই ভালো। একপাশের রেলিং ভাঙা। সাঁকোর নিচে দিয়ে তিরতিরিয়ে বয়ে চলা পাহাড়ি খরস্রোতা কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ডানদিকে পাহাড়ের কোলে এক প্রবল বাঁক নিয়ে আমাদের দৃষ্টির অগোচর হয়েছে। আর সেই আড়াল থেকে ভেসে আসছে পাহাড়ি ঝরণার ঝংকার। হলপ করে বলতে পারি কোনও প্রকৃতি প্রেমী সঙ্গে থাকলে ক্ষুধা তৃষ্ণা ভুলে এক দৃষ্টে ওদিকেই তাকিয়ে থাকত। তাকে ওখান থেকে নড়ানো অসম্ভব হতো। কিন্তু হায়! আমরা সবাই অভাগা। প্রকৃতির রূপ দর্শন আমাদের আসে না। লেখকের কথায় বলতে গেলে – ‘যতক্ষণ না রবীন্দ্রনাথ দেখিয়ে দেন’। আমরা তো জল দেখেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম তৃষ্ণা নিবারণে। বরফ গলা স্রোতস্বিনীর শীতল ধারা দাঁত-গলা-বুকে অনুভুতি জাগিয়ে পাকস্থলীতে পৌঁছে ক্ষান্ত হয়। পরিশ্রান্ত শরীর কিছুটা হলেও প্রাণ ফিরে পায়।

জলই যে জীবন – আরও একবার উপলব্ধ হয়। তৃষ্ণা নিবারণ হলে মাথা আবার একটু কাজ করতে শুরু করে। দুনিচাঁদের বিজয়ী দৃষ্টির কথা মনে পড়ে। জিজ্ঞাসা করায় যা উত্তর পাই তাতে আনন্দে আত্মহারা হব, না আত্মহারা হয়ে অজ্ঞান হয়ে ধপাস করে পরে যাব বুঝে উঠতে পারি না।

মোড় ঘুরতেই রূপবদল।

দুনিভায়ের এতক্ষণে রাস্তা মনে পড়েছে। তাই তার দৃষ্টিতে বিজয়ীর গর্ব। আমরা এখনও পর্যন্ত প্রায় সাড়ে তিন ঘন্টা পথ চলেছি। আনুমানিক প্রায় সাত কিলোমিটার পথ অতিক্রম করেছি। এতটা পথ চলার পর আমাদের গাইডের বিস্মৃত পথ স্মৃতিতে ফিরে এসেছে। আনন্দ তো হবেই।

অজ্ঞান হবার কথা কেন বলেছি ভাবছেন? দুনিভায়ের কথা গুলো যতটা মনে পড়ছে উদ্ধৃত করে দিলাম – “মুঝে রাস্তা ইয়্যাদ আ গ্যায়া। ইস্কে বাদ সিধা উপর চলনা পড়েগা। ইয়ে জায়সা এক পাহাড় পার কিয়া। এয়সা আউর দো পার করনা পড়েগা। পিছলে বার যব আয়া থা তো ইঁহা টেন্ট লাগায়া থা”। শুনে তো আমরা তিনজনেই থ। ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছে এই যে আমাদের একদিনেই দু’দিনের পথ পার করতে হবে। ঢেলে ফরেস্ট হাট আছে। তাঁবুর দরকার নেই। তাই আমরা তাকে শক্তিতেই ত্যাগ করেছি বোঝার ওজন লাঘব করতে। সুতরাং মাঝরাস্তায় রাত কাটানোর উপায় নেই।

চিরসুন্দর।

দীনেশ স্যার উত্তরাখণ্ডের চামোলির এক পাহাড়ি গ্রামের পাহাড়ি মানুষ। জীবন নির্বাহের প্রয়োজনে ছোটোবেলা থেকেই তাঁর পাহাড় ডিঙানো অভ্যাস। পাহাড়ের যে সব খাঁজে আমরা পা রাখার সাহস পাই না, সেসব পাহাড় উনি অনায়াসেই পদদলিত করেন। সেই দীনেশ স্যারও এই পরিস্থিতিতে বেশ ঘাবড়ে গেছেন। ঘাবড়ে যাবার কারণও অবশ্য ছিল। প্রথমত, সবথেকে ওজনদার ব্যাগটা ওনার পিঠেই ছিল। পাহাড়ি পথের অভিজ্ঞতা সম্পন্ন মানুষ হওয়ায় এবং দলের ‘ক্যাপ্টেন’ হিসাবে দায়িত্বটা নিজেই নিয়েছিলেন। দ্বিতীয়ত, সঙ্গে আমার আর নিকেশের মতো দুই ‘শিশু’। সামনের পাহাড়ের রাস্তাটা বেশ খাড়াই। এরকম খাড়াই পথে চলার অনভিজ্ঞ দুজনকে সঙ্গে নিয়ে এমতাবস্থায় আরও দুই পাহাড় টপকানোর ব্যাপারে তিনি বেশ সন্দিহান। বলা বাহুল্য, আমি আর নিকেশ একেবারেই আত্মবিশ্বাসহীন।

ফুলের দল।

দুরু দুরু বক্ষে পাহাড় চড়া শুরু হল। পাহাড় পথের বর্ণনা করে লেখাকে অযথা দীর্ঘকায় করতে চাইনা। শুধু এটুকু বলার যে পাহাড়ি রাস্তা আমাদের কষ্ট দিয়েছিল কিন্তু আমাদের বিফল করেনি। একেকটি ধাপে নিজেকে উন্মুক্ত করেছিল আমাদের কাছে। সেই রূপমাধুর্য বর্ণনা করার ক্ষমতা আমার নেই। শক্তি থেকে ঢেল পৌঁছতে আমাদের সময় লেগেছিল আট ঘণ্টা। শেষ এক ঘণ্টা আমাদের হাঁটার থেকে বিশ্রাম নিতে হয়েছে বেশি। একশ কি দেড়শ মিটার হাঁটি আর ১০ মিনিট করে বিশ্রাম নিই। পথের জন্য কিছু বিস্কুট নেওয়া হয়েছিল। সেসব কোন খাদে হারিয়েছে! শেষ বেলায় আবার সেই জলকষ্টে জেরবার হয়েছিলাম। সবমিলিয়ে পরিস্থিতি বেশ ভয়াবহ হয়ে উঠেছিল।

কুয়াশায় একাকী।

পাহাড়ের উপরের দিকের সুবিধাটা হল এখানে সূর্য ডোবার অনেকক্ষণ পর পর্যন্ত আলোর রেশটা থেকে যায়। তাই ছটা নাগাদ পৌঁছলেও আলোর অভাব ছিল না। হাটের পাশেই জলের নালা। ফলে যাবতীয় জলীয় কাজ সম্পন্ন হল সহজেই। দুনিভাই করিৎকর্মা ছেলে। আমাদের একটু আগেই সে পৌছে ছিল এখানে। কাঠ জোগাড় করে আগুন জ্বালিয়ে অপেক্ষা করছিল আমাদের। পৌঁছে হাত-পা ধুয়ে বসতেই হাতে এল গরম চা। চুলোয় উঠল ম্যাগির হাঁড়ি। অমৃতের স্বাদ আমার জানা নেই। তবে তা কখনোই ঢেলের প্রথম চা আর একবাটি ম্যাগির সমকক্ষ হবে বলে মনে হয় না।

পরদিন ঘুম ভাঙল বেশ দেরিতে। ঘুম ভাঙতে যে জিনিসটা প্রথম অনুভব করলাম তার অভাব ছিল গত দুদিন ধরে। রোদ্দুর। বাইরে বেরোলাম রোদের আঁচ গায়ে মাখতে। বেরিয়েই চমকিত হলাম। কাল সন্ধ্যায় কুয়াশা যাকে আমদের সামনে প্রকাশ হতে দেয়নি আজ সে আমাদের কাছে বিরাজমান। চোখের সামনে সবুজের গালিচা পাতা। গালিচার পরে সফেদ ‘হিম আলয়’। তারপরে নীল আকাশ। আমাদের হাটটা ছিল একটু নিচের দিকে। সামনের দৃশ্যটা পাইন বনে আটকে যাচ্ছিল। বন টপকাতে আমি একটু উপরের দিকে চলে গেলাম। গেলাম, দেখলাম আর চমকিত হলাম। আমাদের হাটটা প্রায় খাদের কিনারে। পাহাড়টা একদম খাড়াই উঠে এসেছে উপরে। তার শিকড় কোথায় জানা নেই। সেই পাহাড়ের মাথায় আমাদের ঘর। সাহস করে একবার খাদের দিকে চোখ নামিয়ে ছিলাম। ঘন কুয়াশা নিচের অংশকে ঢেকে রেখেছিল। কিন্তু অনুভব করেছিলাম সামনের এই খাদ অতলস্পর্শী।

প্রথম দর্শনে ঢেল।

সকালেই একচোট প্রকৃতির সুধারস পান করা হয়েছিল। বেশ রয়েসয়েই হয়েছিল বলতে হবে। তাই কাজে বেরোতে বেশ খানিকক্ষণ দেরী হয়ে গেল। নটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম কর্মক্ষেত্রের উদ্দেশ্যে। ঠিক হল দুপুর একটা পর্যন্ত যতদুর যাওয়া যায় যাব। তারপর ফেরার পথ ধরব। কিন্তু সবকিছু কি আর পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী চলে! যে পথে চলেছি কোন আহাম্মক সে পথ শেষ করতে চাইবে। ঢেল আল্পাইন অঞ্চল। পাহাড়ের উপরে সমতল ভূমি। চড়াই যেটুকু আছে তা নগণ্য। ইঁটভাটার ওই জমা করা মাটির স্তূপের সঙ্গে তুলনা করা যেতে পারে। তবে আমাদের বিচরণ ভূমিটি মোটেই ওই স্তূপের ন্যায় প্রাণহীন নয়। সমতলের পুরোটাই সবুজে মোড়া। আর সেই সবুজের গালিচায় নকশা কেটেছে পাহাড়ি ফুলের দল। লাল-হুলুদ-নীল-গোলাপি কতই না তাদের রঙ! প্রকৃতি পরম যত্নে লালিত করেছে এদের। নিজের বুকে দিয়েছে তাদের অধিস্থান। উত্তরাখণ্ডের ফুল উপত্যকা দেখেছি। আজ যেন ফুলের পাহাড় দেখলাম।

গা ছমছমে সৌন্দর্য।

যে দৃশ্যের অবতারণা করতে চাইছি তার যথাযথ চিত্ররূপ দেওয়া এই অধমের কম্ম নয়। প্রকৃতির যে রূপ রঙ আমি দেখেছি হয়ত আমৃত্যু তা আমায় বয়ে বেড়াতে হবে। আপনাদের কাছে খোলসা করে যে দায়ভার মুক্ত হব সে উপায় নেই। ঢেল আসার পথে খাড়াই পাহাড় চড়তে চড়তে বারবার মনে হয়েছিল ‘ঢের হয়েছে ঢেল’। আর না, এই প্রথম এই শেষ। কিন্তু এই একটা সকাল বদলে দিয়েছে সবকিছু। ছোটোবেলা থেকেই শুনে এসেছি কষ্ট না করলে কেষ্টকে পাওয়া যায় না। আমি কেষ্টর পরিবর্তে হিমালয়কে বসিয়ে নিয়েছি। হিমালয় যে কেবল ‘হিম-আলয়’ই নয়, সে এক নিবিড় জৈববৈচিত্রে ভরা শান্তিকানন। যার প্রতিটি কোনায় অপরূপ মাধুর্য। সেই মাধুর্যের মাদকতা পেতে বারবার ফিরে আসতে হবে তার কোলে।

সবুজের গালিচা।

অতঃপর, খাবারের সম্বল ছিল দুদিনের। পাহাড়ি পথে চলার দস্তুরই হল অতিরিক্ত ভার লাঘব। তাই দুদিনের মত খাবারের সম্বল নিয়েই পাড়ি জমিয়েছিলাম এখানে। শুধুমাত্র প্রকৃতির সুধারস পান করে জীবিত থাকার কৌশল অজ্ঞাত। সুতরাং মন না চাইলেও ফিরতে হবেই। ফেরার পথে বৃষ্টিটা আবার সঙ্গ দিয়েছিল। আসার সময় যে পথ ছিল প্রায় অনতিক্রম্য খাড়াই তা দুধর্ষ উৎরাইয়ে পরিনত। পিচ্ছিল পথে চারজনেই বেশ কয়েকবার পপাত ধরনীতল হয়ে শক্তি পৌঁছেছিলাম। পরনের জামাকাপড়ের অবস্থা তখন প্রবল বর্ষায় ফুটবল খেলে উঠার মত।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *