অন্য সফর

দামোদরের গ্রাসে

যথা ইচ্ছা তথা যা

সত্যিটা স্বীকার করে নেওয়াই ভাল। বেরিয়েছিলাম ভরা দামোদরের ছবি তুলতে। আর অবশ্যই ওই এলাকার বিখ্যাত টুটুলের চিকেন পকোড়া খেতে।

ওই এলাকায় অনেকবার গিয়েছে। শীতে-গ্রীষ্মে। মরা দামোদরের ছবি ছিল আমাদের কাছে। ভরা দামোদরকে ধরতে পারিনি। এক মঙ্গলবার বেরিয়ে পড়েছিলাম তিনজনে। দীপক, ইন্দ্র আর দীপশেখর। যেতে যেতেই গন্তব্য পাল্টানো হল। দামোদরের ছবি তুলে আরেকটু এগিয়ে যাব। তাহলে গড়ভবানীপুরে রানি ভবানীর মন্দিরটা দেখে আসা যাবে। নদ-নদীর ভূগোলের সঙ্গে একটুখানি ইতিহাস চর্চা।

কিন্তু দামোদরের তেজ দেখে আঁতকে উঠলাম। অন্যসময়ে খালের মতো পরিধিতে সসংকোচে বয়ে চলা নদটি এখন প্রবল বিক্রমে ধেয়ে চলেছে। ভাসিয়ে দিয়েছে কূল।

তেজি দামোদর

সঙ্গে সঙ্গে সিদ্ধান্ত বদল। রানির মন্দির দর্শন পরে হবে। দামোদরে গ্রাসের খবর নেওয়া যাক। এগিয়ে গেলাম উদয়নারায়ণপুরের দিকে। উদয়নারায়ণপুর বাসস্ট্যান্ড থেকে হাসপাতালের দিকে যাওয়ার রাস্তাটা এক জায়গায় ধুয়ে নিয়ে বেরিয়ে গিয়েছে জলের স্রোত। পাকা সেতুও ভেঙেছে সেই সঙ্গে। গুরুত্বপূর্ণ রাস্তা। ফলে পুলিশ, সিভিক ভলান্টিয়ারদের দিয়ে সারিবদ্ধভাবে রাস্তা পারের ব্যবস্থা করতে হয়েছে।

উদয়নারায়ণপুর হাসপাতালের কাছে।

রাস্তায় আসতে আসতে দেখেছিলাম সাবধানবাণী, আগে কুরচি সেতু ভেঙেছে। বিপজ্জনক। বাইক ছুটল বিপজ্জনকের সন্ধানে। তার আগে উদয়নারায়ণপুর সিনেমাতলায় দেখি, হলের ভিতর দিয়ে জল বইছে।

কুরচি সেতুতেও জলের তাণ্ডবের ছাপ। সেতুর নিচ দিয়ে বইছে কাটাই খাল। সেতুর একদিকে খালের চেহারা দেখলে নিরীহ বলে মনে হবে। চারহাতের জলধারা। কিন্তু সেতুর আরেক পাশে সেই জলধারাই নদীর চেহারা নিয়েছে। আশেপাশের জমিতে জলের বয়ে আনা বালিতে ভর্তি। ওই জমিতে কবে চাষ হবে তার কোনও ঠিক নেই। বালি সরাতে চাষিদের কালঘাম ছুটে যাবে। এখানকার সব জমিই বছরে তিন থেকে চারবার ফসল দেয়।

কাটাই খালের নিরীহ চেহারা।

জলের চাপ কী পরিমাণ ছিল সেটা বোঝা যায় সেতুর চেহারা দেখলেই। মাঝ বরাবর লম্বা একটা ফাটল। ইটের টুকরো দিয়ে বোজানো। ভারী গাড়ি চলাচল নিষিদ্ধ। জলের স্রোত সেতুর একটা বড় স্তম্ভ ভেঙে নিয়ে দূরে ফেলে দিয়েছ।

কুরচি সেতুর হাল।

লোকের মুখেই শুনলাম, ‘এখানে কী দেখছেন? জলের তোড় দেখতে হলে রামপুরের দিকে যান। লেবুতলার আগে কী করেছে দেখে আসুন।’

কাটাই খালের বড় চেহারা।

লেবুতলা পৌঁছনোর আগে জলের ক্রিয়াকলাপ চোখে পড়ল। জায়গায় জায়গায় রাস্তা ভেঙেছে। আল আমিন মিশনের কাছে পাকা রাস্তার একপাশে বিশাল ধস।

লেবুতলার আগে তো ভয়ানক দশা। রাস্তার একটা বিশাল অংশ ধুয়ে সাফ। সেখান কোনওদিন রাস্তা ছিল বলে মনে হচ্ছে না। রাস্তার একদিকে বিশাল জলাশয় হয়ে গিয়েছে। আরেক দিকে শত শত বিঘে চাষের জমি এখন দীঘার সমুদ্রতটের মতো। চাষিদের মাথায় হাত।

রাস্তা ধুয়ে নদী। লেবুতলার কাছে। ওপারে যে ভাঙাচোরা  সিমেন্টের স্ল্যাব জড়ো করা আছে ওখানে একটা দোতলা বাড়ি ছিল। রাতে জল  যখন ঢুকছিল বাড়িটা কাঁপতে শুরু করে। বাসিন্দারা বেরিয়ে আসার ঠিক পরেই সেটা হুড়মুড়িয়ে ভেঙে পড়ে। এক রাতে সারাজীবনের কষ্টের উপার্জন জলে ধুয়ে গেল।   

এই এলাকা প্রতি বছর ডোবে। প্রতি বছরই ক্ষমতাসীন দলের মুখে শোনা যায় দোষারোপের বাণী। হয় ম্যানমেড, নয় ডিভিসি দায়ী। একবার এলাকা পরিদর্শন, একবার ত্রাণ নিয়ে কেন্দ্রকে দোষারোপ। সেই ট্র্যাডিশন সমানে চলিতেছে। কিন্তু লোকগুলোর চিন্তামুক্তির কোনও স্থায়ী সমাধান করার সদিচ্ছা কারও মধ্যে আছে বলে তো মনে হয় না।

এখানে আগে জমি ছিল। এখন সমুদ্রতটের মতো।

ফিরতে ফিরতে দেখছিলাম, ফ্লাডসেন্টারগুলোতে লোকজন আশ্রয় নিয়েছেন। পুজো পার্বণ বছর বছর ঘুরে আসে। এখানে ঘরছাড়া হওয়াই বাৎসরিক পার্বণ!

সমাপ্ত

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *