অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

শীতবেলায় ফুলের সমুদ্রে

ইন্দ্রজিৎ সাউ

সুব্রতর বেড়াতে যাওয়ার পোকাটা মাঝে মাঝেই নড়ে ওঠে। প্রত্যেক সপ্তাহে এক একটা জায়গার সন্ধান করে আর বলে, ‘যাবি?’ এই রকমই এক শুক্রবার ফোন করে বলল, ‘একটা জায়গার সন্ধান পেয়েছি। প্রচুর ফুলের চাষ হয়।’’ শুনেই জায়গাটা আন্দাজ করতে পারছিলাম। ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ আগেই ঘুরে এসেছে। আমাকে বাদ দিয়ে। শোধ নেওয়ার পালা এবার। সুব্রত যাবেই বলে, মন একেবারে বেঁধে ফেলেছে। শীতকালে খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধার মতো করে। জায়গাটার নাম ক্ষীরাই।

চন্দ্রমল্লিকারা।

কথাবার্তা পাকা হয়ে গিয়েছিল। রবিবার যাওয়া হবে। ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ ছাড়া আমার ঘোরাঘুরির আরেকটা ছোটখাট দল আছে। সেই দলের সদস্য, দিব্যেন্দু আর অতনুদা। দু’জনকে ফোন করলাম যাওয়ার জন্য। বিবাহিত দু’জনেই। রবিবারের সাপ্তাহিক সাংসারিক কাজ দেখিয়ে যাবে না বলল। অথচ আমরা কোনও জায়গা থেকে ঘুরে এলেই প্রত্যেক বারেই বলে, ‘‘আমাদের নিতে পারিস না।’’

দল বেঁধে।

অগত্যা আমি আর সুব্রত বেরিয়ে পড়লাম। বাইক নিয়ে। সকাল নটায়। হাওড়া-আমতা রোড ধরে আমতা। সেখান থেকে বাগনান হয়ে উঠলাম ১৬ নম্বর জাতীয় সড়কে। বাগনান থেকে মিনিট আটেক বাইক চালিয়ে থামলাম একটা ধাবার সামনে। কোলাঘাটের আগে এই ধাবা এখন বেশ পরিচিত। শের-ই-পাঞ্জাবে। খাওয়া নিয়ে আমার সুনাম আছে। দলের ছেলেরা জানে। সকালের দিকে নাম করা ধাবার পাশ দিয়ে যাব আর খাব না? ফলে আলুর পরোটা আর চা। পেট ভর্তি, মন খুশ। আবার বাইক চলল।

একাকী।

মিনিট পনেরো আসার পর জাতীয় সড়ক ছেড়ে পাশের লিংক রোড ধরে নিলাম। মেচেদা-পাঁশকুড়া হয়ে সোজা চলে এলাম পাঁশকুড়া সদর ঘাট। কাঁসাই বা কংসাবতী নদীর ঘাট। সদর ঘাটের বামদিকে কাঁসাইয়ের পাড় ধরে এগোতে থাকলাম প্রথমে জয়কৃষ্ণপুর, দক্ষিণ কাঁঠাল হয়ে। একসময়ে পৌঁছলাম দোকান্ডা। ক্ষীরাই স্টেশন থেকে কাছেই। কাঁসাই নদীর উপর রেল ব্রিজের নীচে দূর থেকে দেখলাম, অনেক গাড়ি দাঁড়িয়ে আছে। আমরাও সেখানে বাইক রাখলাম।

নানা রঙের।

তার পর তো শুধু চোখের শান্তি। সামনে যতদূর চোখ যায় দেখলাম, শুধু ফুলের সমারোহ। যেন ফুলের সমুদ্র। উদয়নারায়ণপুরে দামোদরের চরে পলি মাটিতে যেমন আলু, কপি এবং বিভিন্ন শাকসবজি চাষ হয় ঠিক এখানে কাঁসাইয়ের চরে আশেপাশের বেশ কয়েকটি গ্রামে প্রচুর ফুলের চাষ হয়। এখানকার চাষিদের জীবন এবং জীবিকা এই ফুলের উপরেই নির্ভর করে। আমরা ফুলের সমুদ্রে নেমে পড়লাম। সাঁতারের জন্য।

হলুদ বনে।

ফুল দেখে তো সুব্রত আনন্দে আত্মহারা। পারলে সব ফুল তুলে নেয়। কিন্তু আমি আগেই বারণ করেছিলাম, ফুলে যেন হাত না দেয়। প্রত্যেক বছর এখানে চাষিদের সঙ্গে পর্যটকদের ঝামেলা হয়, ফুল তোলা নিয়ে। ফুল দেখে, সেলফি তুলে কারও কারও শান্তি হয় না। তারা জমিতে নেমে বিভিন্ন ভঙ্গিমায় ছবি তোলার চেষ্টা করে। গাছ ভাঙে। লুকিয়ে ফুল ছেঁড়ে। সেই জন্যই সাবধান বাণী।

গাল ভরা নাম এর। গ্ল্যাডিওলাস।

প্রথমে দেখলাম, বিভিন্ন রঙের গাঁদাফুল। সেই সঙ্গে মোরগ ফুল। চন্দ্রমল্লিকা ছাড়া বাকি ফুলে সবে কুড়ি এসেছে। বেশ কিছুক্ষণ ঘোরাঘুরির আর ফটোসেশনের পর কাঁসাই নদীর উপর রেল ব্রিজ পেরিয়ে চলে এলাম নদীর অপর প্রান্তে। পশ্চিম কোলা গ্রামে। এখানে চন্দ্রমল্লিকার সমুদ্র। বিভিন্ন রংযের এবং বিভিন্ন আকারের। এছাড়াও করণ এবং অ্যাস্টর চাষ করেছেন চাষিরা। সেই সঙ্গেই আছে বিভিন্ন রংয়ের গোলাপ। দেখে চক্ষু এবং মন সার্থক করলাম।

শেরহাটির চাষি দম্পতি।

আমরা ঘুরতে গেলে নিজেরা প্রচুর কথা বলি। সে প্রায় মারামারির মতো করে কথা বলা। আবার লোকজনের সঙ্গেও ভাব জমাই। এখানে কথা বললাম ফুলচাষি নারায়ণ পালের সঙ্গে। জানলাম, নতুন চারা তৈরির পদ্ধতি। চাষিরা নতুন গাছ করার জন্য চন্দ্রমল্লিকার পুরানো গাছের ডগা কেটে বিভিন্ন ওষুধ প্রয়োগ করে বিশেষ ভাবে তৈরি জমিতে বসান। বসানো থেকে চারা তৈরি হতে সময় ১০-১৫ দিন। তার পর আগের জমিতে বসানো হয়। এর পর গাছ ধরে গেলে ১০/২৬, ডিএপি এবং টেরামিন সার দেওয়া হয়। এবং পোকামাকড় থেকে গাছ বাঁচানোর জন্য বিষ স্প্রে করা হয়।

ওষুধ দেওয়া হচ্ছে ফুল গাছে।

এ বছর লকডাউনের জন্য ফুল বিক্রি কম। যার জন্য দামও কম। নারায়ণবাবুর সঙ্গে কথা বলে আমরা গেলাম দোকান্ডার পাশের গ্রাম শেরহাটি। এখানে মাঠের পর মাঠ গাঁদা ফুল ফুটে আছে। অসাধারণ দেখতে লাগছিল। এই গাঁদাগুলো সবই বীজের জন্য চাষ করা। শেরহাটিতে দেখা হল গাঁদা ফুল চাষি বাপি জানার সঙ্গে। তাঁর স্ত্রী-ও সঙ্গে ছিলেন। জানা দম্পতি গাঁদা ফুলের বীজ তৈরি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। ফুলগুলো তুলে ১০-১২ দিন রোদ্দুরে শুকনো করে রেখে দেওয়া হয় বীজ করার জন্য। সুব্রত এক চাষির থেকে মাটি চেয়ে নিল। প্রায় পাঁচ-ছ’কিলো মাটি। এক চাষি দু’টো চন্দ্রমল্লিকার চারাও দিলেন। বাড়িতে চাষ করবে সুব্রত। আমি অপেক্ষায় আছি। এর পর আমরা গেলাম তিলন্দপুর। এখানে বেশ কয়েকটি বড় নার্সারি আছে। এদের প্রচুর গাছের সংগ্রহ।

সুব্রতর গাছ সংগ্রহ।

নার্সারি দেখার পর একটু থামা। চোখে তখন ফুলেল। মাথা ফুল ফুল। এবার ফিরতে হবে। আমরা বাড়ির রাস্তা ধরলাম। ফেরার সময় আবার ঢুঁ দিলাম শের-ই-পাঞ্জাবে। টেবিলে বসতে যাব শুনলাম এক ওয়েটার জিজ্ঞাসা করছেন, ‘‘স্যার, কিছু ফেলে গেছেন?’’ ঘুরে দেখি সকালে যিনি অর্ডার নিয়ে ছিলেন উনিই আছেন। ওঁর নাম অসিত মান্না। সুদর্শন ছেলেটি ভারী ভাল। ওঁকে বললাম, ‘‘না না আমরা আবার ইন্ধন নিতে এসেছি। ওটা সকালের কোটা ছিল।’’

কাঁসাই নদী।

কভারের ছবি- নানা রঙের চন্দ্রমল্লিকা

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *