জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

শম্ভু আর তিন বন্দিনী প্রেমিকার গল্প

দীপক দাস

লোকটা পেনসিলে নাম-ধাম টুকছে কেন!

রাতে কোনও বড় অফিসারের হঠাৎ উদয় হলে ইরেজার দিয়ে ঘষে প্রমাণ লোপাট! তারপর তল্পিতল্পা বাইরে ছুড়ে ফেলে আমাদেরও কিক অন দ্য ব্যাকসাইড অ্যান্ড ওয়াচ টাওয়ার থেকে আউট! কিন্তু কিছুক্ষণ আগেই তো খাতাপত্র ঘেঁটে আমাদের আশ্বস্ত করা হয়েছে, ওয়াচ টাওয়ারের কোনও বুকিং নেই, আজ-কাল।…

স্থান-জয়পুর, উপস্থান- বন বিভাগের অফিস। কাল-পয়লা মে, গরম কাল। উপকাল-বেলা সাড়ে ১১টা। বিট অফিসারের টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আমি আর ইন্দ্র। বাকিরা মধুচক্রের ছবি তুলতে ব্যস্ত। গাছগাছালি আর বনস্পতির ছায়া ঘেরা অফিস। গাছে গাছে বিশাল বিশাল মৌচাক! ওরা মৌ-লোভী আর আমরা ওয়াচ টাওয়ার বাগাতে ওয়াচম্যানের মতো চোখের পলক না ফেলে বিট অফিসারের পেনসিলের দিকে তাকিয়ে। খাতার শেষ খোপে পৌঁছেছে পেনসিল। মোবাইল নম্বর জিজ্ঞাসা করছেন অফিসার। তার মানে হয়ে গিয়েছে…তখনই ফোন বের করলেন অফিসার। জনৈক হারুকে ধরলেন। চাবির কথা জিজ্ঞাসা করলেন। তারপর আমাদের আশার ফানুসে আলতো করে পিন ফুটিয়ে অফিসারের স্বর ধেয়ে এল, ‘সে কী! বিকেল চারটে পর্যন্ত ওঁরা কোথায় থাকবেন?’

সেই মধুচক্র।

এর আগে পর্যন্ত সফর কহতব্য কিছু নয়। সে শুধু ডট ডট ডট। আমাদের বড়গাছিয়া থেকে জয়পুরের দূরত্ব যদি ১২০ কিলোমিটার হয় তাহলে সেই ডটের দৈর্ঘ্য প্রায় ৬০ কিলোমিটার। সেই ডট পূরণ করেছে ঘুম, ঘুম আর ঘুম। মাঝে বলার মতো শুধু দু’টো ঘটনা। এক ষাঁড়ের গোবর আর দুই, জলতরঙ্গের মতো মিঠে হাস্যরোল। খুলেই বলি। এবারের অভিযানের দু’টো শাখা। একটা রুরাল, আরেকটা সিটি। গ্রামীণ শাখায় আমি, ইন্দ্র আর দীপু। ভোর ৪টের সময়ে উঠে যাত্রার প্রস্তুতি শুরু করেছিলাম। আগেরদিন আমার অফিসে নাইট শিফট ছিল। সারারাত ঘুমোইনি। দীপুরও ধকল গিয়েছে। ইন্দ্র শীতে-গরমে সদা কাতর আলুকাবলি। ফলে বড়গাছিয়া থেকে হরিপালের বাসে উঠেই ঘুম।

কলোসিয়াম বাস।

সে বাসও এক আশ্চর্যের। সিটে বসে অভ্যুদ্দয় আর পতনের যুগলবন্দি চলছিল। সমস্যাটা বাসের সিট সাজানোয়। মিনিবাসে সাধারণত দু’টো দু’টো করে সিট পরপর সাজানো থাকে। মাঝে দাঁড়ানোর চিলতে জায়গা। কিন্তু এ বাসে সিটগুলো পাটা। মাঝে যাত্রী দাঁড়ানোর খোলা চত্বর। সেই চত্বর ঘিরে অনেকটা ইংরেজি ইউ আকারে সাজানো হয়েছে সিট। মনে হচ্ছিল, রোমের কলোসিয়ামে বসে আছি। মাঝের ফাঁকা জায়গায় দাঁড়িয়ে যাত্রীরূপী গ্ল্যাডিয়েটর, সিংহ, মত্ত হস্তিরা আমাদের মনোরঞ্জন করছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই অবশ্য ওইসব সাম্রাজ্যবাদী উপমা মন থেকে তাড়িয়ে ঘুমে ঢলে পড়েছিলাম। এমন সিট, কিছুক্ষণ পরেই সেখান থেকে হড়কে পড়ার উপক্রম। পশ্চাদ্দেশ সিটচ্যুত হওয়ার আগেই চমকে উঠে সামলাতে হচ্ছিল।

ওদিকে সিটি শাখাও ঘুমে ঢলে পড়েছে। দীপুকে একটা ছবি পাঠিয়েছিল অরিজিৎ। জুয়েল আর কচির ট্রেনে ঘুমনোর ছবি। সঙ্গে ক্যাপশন, ‘পাঁচ রাত ঘুমোয়নি এরা।’ জুয়েল, অরিজিৎ আর কচি সিটি শাখার তিন কর্ণধার।

তারকেশ্বরে মিলেছিল সিটি আর রুরাল শাখা। কিছুক্ষণের জন্য চাঙ্গা সবাই। সম্ভাষণ, পরস্পরকে খোঁচানো শুরু করে, ওভারব্রিজে। তখনই দেখলাম তাকে। ওভারব্রিজের উপরে উঠে নিশ্চিন্তে বিশ্রাম নিচ্ছেন। তার আগে উদরপূর্তিটা যে ভালমতন হয়েছে সেটা বোঝা গেল ওভারব্রিজের জায়গায় জায়গায় থকথকে গোময় দেখে। এটা বাবার ধাম। এখানে তার বাহনের যে বাড়বাড়ন্ত হবে তাতে আর আশ্চর্য কী! তারপর তারকেশ্বর থেকে বিষ্ণুপুরগামী বাসে। বাস শুধু ছাড়ার অপেক্ষা। টিকিট কেটে কন্ডাক্টরের কাছে জেনে নেওয়া কতক্ষণ লাগবে। তারপরেই ছ’জনের ঘুমের ছক। ঘুম ভাঙল সেই মিঠে হাস্যরোলে।

চোখ খুলে দেখি, তিনটি মেয়ে জুয়েল আর কচির সিটের সামনে দাঁড়িয়ে প্রবল হেসে চলেছে। তাদের হাসির রোলে সারা বাস সচকিত। ব্যাপারটা কী? আমাদের দু’সিট আগে বসেছে ওরা। গলা বাড়িয়ে দেখি, ওরা নিজেদের মধ্যে মাথা ঠেকাঠেকি করে ঘুমোচ্ছে। মাতালেরা গলা জড়াজড়ি করে ‘ইউনাইটেড উই স্ট্যান্ড, ডিভাইডেড উই ফল’ হয়ে থাকে। জুয়েল আর কচি মাথা ঠেকিয়ে ইউনাইটেড আছে। এমন পোজের দুই স্লিপিং বিউটিকে দেখে হাসি আর গিলতে পারেনি সুস্মিতারা।…

দুই স্লিপিং বিউটি।

সুখ-দুখখু নাকি মুদ্রার এপিঠ-ওপিঠ। টপ করে উল্টে যায়। গুরুজনেরা কহেছেন। ফলে হাসির পরেই কান্না। সেই মিঠে জলতরঙ্গের পরে বিট অফিসারের সংক্ষিপ্ত মাথা নাড়া। যার অর্থ, ওয়াচ টাওয়ার মিলবে না। কেন মিলবে না? কারণ টাওয়ারের তত্ত্বাবধায়ক সেই হারুবাবু বিয়েবাড়ি গিয়েছেন। এবং চাবির গোছাটিও গিয়েছে তাঁর সঙ্গে। তিনি বিকেল ৪টে নাগাদ দর্শন দিতে পারেন। এখন মধ্যাহ্ন। ঘণ্টাচারেক কোথায় ঘুরব? এই গরমে চান হয়নি, খাওয়া হয়নি! এক সহৃদয় বনকর্মী বললেন, ‘শ্রেষ্ঠায় চলে যান।’ আরেকজনের পরামর্শ, বনলতা। দু’টোই মেয়েদের নামে। ছেলেদের সুন্দর নাম হয় না? কে জানে!

অফিস থেকে বেরিয়ে আমাদের ফোঁস ফোঁস শুরু হল। যার মর্মার্থ, একেই বলে সরকারি ব্যাপার। সরকারি কর্মী। শ্বশুরের পুত হারুর যদি কাণ্ডজ্ঞান থাকে! অক্ষমের ফোঁস ফোঁস আর কী। কিন্তু এখন থাকি কোথায়? বন বিভাগের অফিসের উল্টোদিকেই যে দুই কন্যার আশ্রয় পেতে পারি তাদের এক ঝলক দেখা হয়ে গিয়েছে। বনলতা বড়লোকের দুলালি। উঠতে, বসতে, পাশ ফিরতে তার দামি উপকরণ। বাহুল্য। রিসর্ট আরকী। অন্যদিকে শ্রেষ্ঠা মধ্যবিত্ত। চেষ্টা করলে নাগাল পেতে পারি। উঠলাম শ্রেষ্ঠায়। একটা ঘরে ছ’জন। ম্যানেজারকে বলে রাখলাম, ওয়াচ টাওয়ার পেলে বিকেলে ঘর ছেড়ে দেব। না হলে ঘর বাড়িয়ে নেব। খাবও এখানে। চার ঘণ্টার জন্য মাসুল যেন একটু কম হয়। অফ সিজন। ভদ্রলোক কথা রেখেছিলেন।

এবার জয়পুর আগমনের বৃত্তান্ত বলা যাক। মে মাসের এই গরমে কেন আমরা বাঁকুড়ায়? দ্বিতীয় কারণ, জায়গাটা কাছে। একদিনের ছুটিতেই ঘোরা হয়ে যায়। আর প্রথম কারণ, আমাদের অভ্যুদ্দয়। ফেসবুকের ক্লোজড গ্রুপ থেকে ওয়েবসাইটে ঢুকছি আমরা। গ্রুপের প্রথম দূরের সফর ছিল ভালকি মাচানের জঙ্গল। ওয়েবসাইটও জংলি হোক, এটাই ছিল দলের সদস্যদের ইচ্ছে। জঙ্গল আমাদের প্রিয়। সেখানের কানুন আলাদা। ভান নেই, ভণিতা নেই, ভদ্রতা, সৌজন্যের লুকোছাপায় মনের চেহারা চাপা দেওয়ার চেষ্টা নেই। মন আর মুখ সেখানে ডাইরেক্ট লাইনে বাঁধা। মনে বুদবুদ জাগলে মুখে হেঁউ করে উদগার। স্বাভাবিক, শারীরবৃত্তীয় ঢেঁকুরের পরে নো সরি। মার্ক টোয়েনের বিশ্ব বাউন্ডলে হাকলবেরি ফিনকে দত্তক নিয়েছিল পলি মাসি। তাকে সহবত শেখানোর চেষ্টা করেছিল। একদিন ভদ্রতার ভানে বিপন্ন হাক নিকুচি করে সভ্য সমাজ বলে পালিয়ে গিয়েছিল। বন্ধু টম সাইয়ারকে এইরকমই একটা বাণী ঝেড়েছিল, আরে! তোদের কী শিষ্টাচার রে মাইরি! গা চুলকোলেও লোকের সামনে চুলকনো যায় না!

তাই এক জাঙ্গলিক উদ্বোধনে, ভাল বাংলায় যাকে বলে লঞ্চ, এসেছি আমরা।

রূপের বিথার।

সব কাজ ফেলে মাসখানেক ধরে সকাল-রাত ওয়েবসাইটে লেখা, ছবি আপলোড করছিলাম। দু’বছর ধরে লেখা দিয়ে গ্রুপকে সচল রেখেছেন বহুজন। অনেকেই একাধিক লেখা লিখেছেন। চেষ্টা ছিল, সকলের অন্তত একটা করে লেখা আপলোড করতে। চাইছিলাম, ওয়েবসাইটে সফরের যে ক’টা বিভাগ করা হয়েছে তার প্রত্যেকটিতে অন্তত যেন একটা করে লেখা থাকে। সময়সাপেক্ষ এবং ধৈর্যের কাজ। ফলে গেস্ট হাউসে বসেও আপলোডের কাজ চলছিল। দুপুরে খাওয়াদাওয়ার পরে কচি, জুয়েল আর অরিজিৎ উধাও হয়ে গেল। বিছানায় দীপু ঝিমোচ্ছে। আমি আপলোড করছি আর ইন্দ্র পাশে বসে কাজ দেখছে, সাহায্য করছে।…

৪টে বাজতেই মনের দ্বারে ওয়াচ টাওয়ারের বাসনা আবার জাগ্রত। আবার হানা বন দফতরের অফিসে। এবারেও ব্যর্থ। হারু অফিসে ফেরে নাই। এক বনকর্মীর কানের কাছে ঘ্যানঘ্যান করে তাঁর অন্য ফোন নম্বর জোগাড়ের চেষ্টা হল। না পেয়ে হারুর মাকে ফোন। কিন্তু হারুবাবু নাগালের বাইরে। ঘর নিয়ে রগড় আমাদের সব সফরের অঙ্গ। কাঁধ ঝুলিয়ে বেরিয়ে এলাম অফিস চত্বর থেকে।

সকালেই জেনে নিয়েছিলাম, ঘোরার জায়গাগুলো। বাসুদেবপুরে বন বিভাগের আরেকটা অফিস আছে। সেখানে একটা পরিত্যক্ত রানওয়েও নাকি আছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে তাতে বিমান নামত। লোকমুখে এলাকাটা চাতাল নামে পরিচিত। টাওয়ার না হোক, চাতালই সই। উঁচুতে উঠে লাভ নেই। শেষপর্যন্ত তো নেমে আসতে হবে। নেমে আসার ভয়ে আমার গুরু শিব্রাম পাহাড়ে চড়তে চাইতেন না। চাতালের মস্ত সুবিধা হল, তা থেকে পতনের ভয় নেই। অপ্রাপ্তির বেদনার মৌন স্রোতে ভেসে যাওয়া আটকাতে মানুষ কত যে তুচ্ছ ব্যাখ্যার খড়কুটো আঁকড়ে ধরে!

বাসস্ট্যান্ডে যানের খোঁজে ঘুরছিলাম। চাতালে যাওয়ার মতো যান। সেইসময়েই ইন্দ্রর ফোন বাজল। আর ফোন রেখেই ইন্দ্র বলল, ‘হয়ে গেছে।’ আবার কী হল? জানলাম, বিট অফিস থেকে ফোন। ওয়াচ টাওয়ারের ব্যবস্থা হয়েছে। আমরা গিয়ে দখল নিলেই হবে। চট করে মত বদলে ফেললুম। উঁচুতে কে না উঠতে চায়! চাতাল কাল সকালে হবে। বাসস্ট্যান্ডেই এক ভুটভুটি ভ্যানওলাকে পেয়ে গিয়েছিলুম। তাকেই বরাত দেওয়া হল আমাদের চাতাল দর্শন করানোর। হায় রে মানবমন! নীতি আর প্রাপ্তির দ্বন্দ্বে কেন যে দ্বিতীয় কন্যেটিকেই জিতিয়ে দাও!

জয়পুর বন বিভাগের অফিস চত্বর।

হুড়মুড়িয়ে বিট অফিসে ফিরে এলাম। কিন্তু তখনও হারুবাবু আসেননি। তিনি নাকি রওনা দিয়েছেন। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে এসে পড়বেন। যাত্রা শুরু যখন হয়েছে শেষ হবেই। আমরা বিট অফিস ছেড়ে নড়ব না ঠিক করলাম। বসে পড়লাম সিমেন্টের বেঞ্চে। বাঙালির মিনিটপাঁচেকের হিসাব অনেক সময়েই গোলমেলে হয়। তাই হল। পাঁচ মিনিটটা সকাল থেকে হারুবাবুর অনন্ত পর্বের নাটকের মতো বাড়তে বাড়তে ২৫ মিনিটে গিয়ে থামল। বসে থাকতে থাকতে যা হয়। পরস্পরের পা টানাটানি। বেশকিছু ছবি। আর এক পতনের সাক্ষী। সত্যি বলছি, সারা জীবনে ওইরকম পতন আর দু’টি দেখিনি।

এক যুবা সাইকেলের ক্যারিয়ারে এক প্রৌঢ়কে চাপিয়ে নিয়ে ঢুকছিলেন। হঠাৎই ভদ্রলোক ক্যারিয়ার থেকে সাইকেল বেয়ে নেমে এলেন পথে। উঁচু জায়গা থেকে জল যেমন কোনও কিছুকে অবলম্বন করে গড়িয়ে বা বেয়ে নামে সেরকম। পড়লেন একেবারে ষাষ্টাঙ্গে প্রণিপাতের মতো। যেন মোরাম ফেলা বনবীথিতে নিজেকে বিছিয়ে দিলেন। তকতকে নিকোনো দাওয়ায় গরমকালে মা-ঠাকুমারা যেমন করে শীতলপাটি বিছিয়ে দেন, সেইরকম। ওদিকে ছেলেটি সাইকেল চালিয়ে এগিয়ে গিয়েছেন। গাড়ি হঠাৎ হালকা লাগায় বোধহয় থেমেছিলেন। আমরা ছুটে গেলাম তুলতে। ততক্ষণে ভদ্রলোক নিজেকে সামলেছেন। দাঁড়িয়ে বললেন, ‘মাল খেলে এরকম হয়ে যায়।’ এমন সহজ স্বীকারোক্তিতে আমরা অভিভূত হয়ে চিত্রার্পিত!…

তল্পিতল্পা গুটিয়ে ওয়াচ টাওয়ারের দিকে মার্চ শুরু হল আমাদের। তখনই দেখলাম বনলতার ঠমকচমক। বিশাল এলাকা জুড়ে ছড়িয়ে রেখেছে নিজেকে। সড়কের পাশে রেস্তোরাঁ। রেস্তোরাঁ পিছনে রেখে এগোলে খামারবাড়ি। ডানহাতি দোতলা ঘেরাটোপ। তার একতলায় পাতি এবং রাজ হাঁস। দোতলায় কোয়েল। বাম হাতে লোহার গেট লাগানো অনেকটা ঘেরা জায়গা। গেটে লেখা এমুপাখি, টার্কি পোষা হয়। গোখামারও আছে। আরেকটু এগোতে দেখি, একটা পুকুর। বেশ গাছপালা, আলো লাগানো। দু’একজন ছিপ ফেলছেন। দীপু বলল, ‘বাবলাটা এলে ভাল হতো। ছিপ নিয়ে বসা যেত।’ পুকুরের পাড়ে সবজি খেত। পটল, ঝিঙে আরও কত সবজির চাষ। রেস্তোরাঁয় বিজ্ঞাপন দেখেছিলাম, এখানে নাকি জৈবসারে সবজি চাষ করা হয়। মানে গ্রামের মধ্যেও এক টুকরো কৃত্রিম গ্রাম সাজিয়েছেন কর্তৃপক্ষ। সবজিডাঙার উল্টোদিকে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত কটেজ। সেখানে বড় বড় গাড়ি ঢুকছে।…

মোহময়ী।

সেসব ছাড়িয়ে কিছুটা যেতে জঙ্গুলে পথ। এক পাশে আমবাগান। বিশাল। তারপর জঙ্গল। আরেক পাশে জঙ্গল-মাঠে মেশানো। অনেক দূরে বাড়িঘর। ওয়াচ টাওয়ারের সামনে এসে পৌঁছতে মন ভরে গেল। নির্জন জায়গায় মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আমাদের অভীষ্ট। আশেপাশে কোনও বাড়িঘর নেই। দূরে সাগরবাঁধের জলাশয়। তার পাড়ে আকাশে উঠেছে একটা চিমনি। ইটভাটার বোধহয়। তখন আলো কমে এসেছে। হারুবাবু টাওয়ারের ভিতরে আলো জ্বেলে দিয়েছেন। জঙ্গুলে পরিবেশে আলোআঁধারির সেই খেলা বড় মায়াময়।

ঘরে ঢোকার আগে গেটের কাছে ক্যামেরাম্যানদের হঠাৎ হুড়োহুড়ি। একটা ব্যাঙ। গেছো বোধহয়। ব্যাটা দেওয়াল বেয়ে উঠছে। ক্যামেরার হঠাৎ আলোর ঝলকানিতে মিটারবক্সের মাথায় চড়ে বসল। আমরাও সিঁড়িতে চড়লাম। কী সুন্দর নাম ঘরগুলোর। দোয়েল, ফিঙে আর শ্যামা। নিয়েছিলাম দু’টো ঘর। আমাদের জন্য তিনখানা ঘরই খুলে দিয়েছেন হারুবাবু। অপেক্ষা করানোর খেসারত বোধহয়। ঘর আর বিছানার বিস্তার দেখে এখন মনে হচ্ছে, একটা ঘর নিলেই হতো। টেনিস কোর্টের মতো ডবল বেডে অনায়াসে ছ’জন এঁটে যায়।

দেওয়াল দাদুর।

টাওয়ারে টঙে একটা খোলা চত্বর আছে। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই সেখানে। তখন আকাশ কালো করে এসেছে। হাওয়া দিচ্ছে ঠান্ডা ঠান্ডা। দেখতে দেখতে আকাশ ঘোর কালো। হাওয়ার গতি বেড়ে ঝড় তখন। হঠাৎ জুয়েলের কথা মনে পড়ল। চিৎকার করে বললুম, ‘ভাই, সাবধান। ছাদের বেশি ধারে যাবি না।’ ব্যাটা রোগাস্য রোগা। দীপু অনেকবার বলেছে, এই জঙ্গলে ভালুক আছে। আমরা একটুআধটু চিন্তিত হয়ে পড়লেও জুয়েল ছিল অকুতোভয়। ও জানে, জঙ্গলে যদি বাঘও থাকে ওর ভয়ের কিছু নেই। কারণ বাঘ জানে, একদা তারই কোনও পূর্বপুরুষের গলায় হাড় ফুটেছিল। এক বককে পারিশ্রমিকের প্রতিশ্রুতি দিয়ে সেই হাড় তুলিয়েছিল। কিন্তু পরে আর পারিশ্রমিক দেয়নি। জুয়েলও হাড় সর্বস্ব। খেতে গিয়ে গলায় ফুটলে কোনও বক তুলে দেবে না। পূর্বপুরুষের বদনামের ভার তারা এখনও বয়ে নিয়ে চলেছে। এখন এই ঝড়ের সময়ে ওর বারমুডার পকেটে হাওয়াটাওয়া ঢুকে সেটা যদি হঠাৎ প্যারাসুট হয়ে যায়! জুয়েল উড়ে গিয়ে ল্যান্ড করবে সাগরদিঘির জলে। আমার চিৎকারে বাকিরা জুয়েলের কাছাকাছি চলে গেল। উড়ে গেলেও যাতে খপ করে ধরে ফেলা যায়।…

মজার মধ্যেই বৃষ্টি নামল ঝেঁপে। সেই সঙ্গে ঝড়। দুদ্দাড় করে নেমে এলাম। ঘরে বসেও টের পাচ্ছিলাম ‘সঘনে দামিনী চমকই’। পরিবেশ ঠান্ডা হতে গল্প করতে করতে কখন যেন ঘুমিয়ে পড়েছিলাম সকলে। ইন্দ্রর ডাকে ঘুম ভাঙল। খেতে বেরোলাম। যেতে সেই আমবাগান আর পেরোতে পারি না। ঝড়ে প্রচুর আম পড়েছে। আশেপাশে বাড়িঘর নেই। কুড়োনোর লোকও নেই। আমাদের দল নেমে পড়ল আম কুড়োতে। কাউকে আর সেখান থেকে নড়ানো যাচ্ছে না। টর্চ, মোবাইলের আলোয় একটা করে আম চোখে পড়ছে আর উচ্ছ্বাসে ফেটে পড়ছে তারা। আম তো কুড়নো হল কিন্তু নেবে কীসে? রাস্তার পাশে একটা গর্তে পাতাটাতা ঢাকা দিয়ে সলোমন রাজার রত্নভাণ্ডার তৈরি করা হল। রাতের অন্ধকারে যাতে বোঝা যায় সেজন্য রাস্তার উপরে ভিজে মাটিতে দাগ টানা হল।

সাগরদিঘি।

শ্রেষ্ঠাতেই খেলাম। খেয়েদেয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটা। হরিণ চলার রাস্তা পেরিয়ে গেলাম। রাস্তার পাশে পুলিশের একটা জিপ দাঁড়িয়ে ছিল। লরি থামিয়ে তাদের দিকে হাত বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন পুলিশকর্মীরা। কী করছেন ওরা? কে যেন বলল, কাগজপত্র দেখছে। কিন্তু সেগুলো তো আর ফেরত দিচ্ছে না! হাতটা পকেটে ঢুকছে বলে মনে হল। যা অন্ধকার! তার ওপর চশমাটাও ওয়াচ টাওয়ারের বিছানায় ফেলে এসেছি! আমরা একটু এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালাম। শুনেছি, এখানে নাকি হরিণ আর শুয়োরেরা চলে আসে। জঙ্গলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ঘন অন্ধকার। এক ভাবে তাকিয়ে থাকলে কেমন যেন ঘোর লেগে যায়। মাঝে মাঝে টর্চ জ্বেলে চোখের অন্ধকার দূর করছিলাম। কিন্তু কোন এক অজানা ভয়ে ইন্দ্র থাকতে চাইল না।

হরিণের খোঁজে।

ফিরে এসে কিছুক্ষণের মধ্যে ঘুম। অনেক রাতে কীসের ডাকে ঘুম ভাঙল। হরিণ ডাকছে! টাওয়ারের পাশের জঙ্গলে বয়ড়া গাছ আছে। হরিণেরা নাকি বয়ড়া খেতে আসে। কিন্তু হরিণ তো এত কলরব করে ডাকে না! যারা সুন্দর তাদের রব কম। ঘুমের ঘোর কিছুটা কাটতে বুঝতে পারলাম, জম্বুক বাহিনীর কলরব।

জয়পুরের জঙ্গলেও শেয়াল আমার পিছু ছাড়ে না দেখছি!

(চলবে)

2 thoughts on “শম্ভু আর তিন বন্দিনী প্রেমিকার গল্প

    1. ছুটি ছিল তো। যেতেই পারতিস আমাদের সঙ্গে। বন্ধুরাও ছিল।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *