ইতিহাস ছুঁয়ে

ছুঁয়ে এলাম ইতিহাস

দীপশেখর দাস

 

ছুটি হল গত ৩১ ডিসেম্বর। বরাবরের জন্য। দীর্ঘ শিক্ষকতা জীবন শেষ হল ওই দিন। এবার অখণ্ড অবসর। মায়ের ছুটির আবেদনেও অফিসের ইতিবাচক সাড়া পেতেই প্ল্যানটা করে ফেললাম। আমরা চারজন। বাবা-মা-আমি আর সহোদরা। সঙ্গে সেজজেঠু আর ছোটদার বড় ছেলে।

জঙ্গল ঘোরার নেশাটা আমার চিরকালের। রাজগীর নাকি পাহাড় আর জঙ্গলের মিশেল। ফলে, রোখ সাকে তো রোখ লো মনোভাব। ২ ফেব্রুয়ারি রওনা দিলাম রাজগৃহের উদ্দেশ্যে। রাজগীর নামটা তো রাজগৃহেরই অপভ্রংশ। হাওড়া থেকে রাত ৮টা ৩৫ এর দানাপুর এক্সপ্রেসে যখন বখতিয়ারপুর জংশন স্টেশনে নামলুম তখন সবে ভোর হয়েছে। ঠান্ডায়, কুয়াশায় জড়ামড়ি করে থাকা একটা স্টেশন। সেখান থেকে গাড়ি করে সোজা রাজগীর। সোজা হলেও সরল নয়। রাস্তাটা প্রায় ৫৫ কিলোমিটার।

হোটেল ঠিক করতে, বিশ্রাম এবং দুপুরের খাওয়া সারতে সারতে বিকেল। তারপর কাছের পাহাড়ের কোলে আশ্রয়। বিকেলের পড়ন্ত রোদ তখন পাহাড়ের গায়ে যেন সোনালি রঙ ছড়াচ্ছে। দৃশ্যটা উপভোগ করার ইচ্ছা ছিল অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত। কিন্তু সেই ইচ্ছা জল ঢালতে হল সফরসঙ্গীদের ভক্তির তাড়নায়। তাঁরা মন্দির দর্শন করতে চান।

আসলে রাজগীর মহাবীর জৈন ও গৌতম বুদ্ধের স্মৃতিধন্য। তাই তাঁদের মন্দিরে মন্দিরে জায়গাটি ছেয়ে আছে। সঙ্গীরা পুণ্য পিপাসু। আমার মতো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য পিপাসু নন। অগত্যা যেতেই হল। গিয়ে অবশ্য বিফল হইনি। মন্দিরগুলি বেশ পরিপাটি করে সাজানো। ফুলের বাগানগুলিও চমৎকার। সে দিগম্বর জৈন মন্দির হোক বা শ্বেতাম্বর জৈন মন্দিরই হোক।

পরের দিনের সূচীতে গয়া গমন পূর্বনির্ধারিতই ছিল। তাই সকালেই গাড়িতে চাপতে হল গয়ার উদ্দেশ্যে। ড্রাইভার দাদা মাহেশজি প্রথমে আমাদের বৌদ্ধগয়ায় নিয়ে গেলেন। কারণ ওখানের মন্দিরগুলির বেশ কয়েকটা ১২টায় বন্ধ হয়ে যায়। ওখানে গিয়ে চমক পেলাম। বিভিন্ন দেশের বৌদ্ধধর্মাবলম্বীদের সমাহার এখানে। গৌতম বুদ্ধ এখানের এক অশ্বত্থ গাছের নীচে বোধি লাভ করেছিলেন। শাক্যসিংহের সিদ্ধার্থ থেকে বুদ্ধে উত্তরণের সাক্ষী এই ভূমিতে তাই ভিড় জমিয়েছেন বিভিন্ন দেশের মানুষ। এখানে আমার প্রাপ্তির ঝুলিটাও ভরে উঠল। বৌদ্ধ ধর্মপ্রধান দেশগুলি এখানে একটি করে মন্দির তৈরি করে। দেশগুলির মধ্যে যেমন আছে জাপান, ভুটান, নেপাল, চিন তেমনই আছে বাংলাদেশ-শ্রীলঙ্কাও। আছে তাইওয়ান সরকারের তৈরি মন্দিরও। সব মন্দিরের গর্ভগৃহেই বিরাজ করছে বুদ্ধমূর্তি। তবুও একটি মন্দিরের সঙ্গে আরেকটি মন্দিরের পার্থক্য সহজেই চোখে পড়ে। প্রত্যেকটি মন্দির গড়ে উঠেছে নিজের নিজের দেশের স্বাতন্ত্র্য নিয়ে।…তুলে ধরেছে সেই দেশের ঐতিহ্যকে।

বৌদ্ধগয়া পরিদর্শন করে এবার যাবার পালা গয়ায়। তবে গয়ায় পুজো দেবার আগে উদরদেবতাকে তুষ্ট করার প্রয়োজন হয়ে পড়েছিল। খুঁজেপেতে একটা রেস্তোরাঁয় ঢুকে সবজি ভাতের প্রসাদ নেওয়া হল। প্রসাদে উদরদেবতা তুষ্ট হলেন বটে। কিন্তু মনোদেবী চটে উঠলেন। সবজি ভাতের প্লেট ৬০টাকা! তবে একটা গ্রাস মুখে তুলতে কষ্টটা একটু কমলো। বাসমতী চালের ভাত আর সবজি তখন যেন অমৃত সমান। খাওয়া দাওয়া শেষে বুঝলুম, উদরদেবতা এবং মনোদেবী, পরস্পরকে চোখ ঠেরে  নিজেদের খুশি জানান দিচ্ছেন।

এরপর গয়ায় পৌঁছালাম। গয়া নিয়ে তো নতুন করে কিছু বলার নেই। কথিত আছে, এখানে নাকি ভগবান বিষ্ণু পদার্পণ করেছিলেন। আর তার নিদর্শন স্বরূপ আছে দুটি চরণচিহ্ন। আর একে ঘিরেই গড়ে উঠেছে বিষ্ণুপাদ মন্দির। মন্দিরের পাশ দিয়ে আছে অন্তসলিলা ফল্গু নদী। আর নদীর ওপারে আছে সীতাকুন্ড। বনবাসে যাবার পথে রাম-সীতা এখানে নাকি থেকেছিলেন কিছুদিন। রামায়ণে কথিত, রামের অভিশাপেই ফল্গুতে কখনওই জলের দেখা মেলে না। কিন্তু বর্তমানে সভ্যতার কল্যাণে মিউনিসিপ্যালিটির নোংরা পচাজল ফল্গুতে কিছুটা প্রাণ সঞ্চার করার চেষ্টায় আছে। হয়ত কয়েক বছর পর নদীর একাংশে প্রাণ ফেরাতে সক্ষমও হবে।

ফল্গু নদী।

বিষ্ণুপাদ দর্শনের পর এবার হোটেলে ফেরার পালা। ফেরার লম্বা রাস্তা। পথের একদিকে পাহাড় আর অন্যদিকে সরষে-গমের খেত। অদ্ভুত দৃশ্য। আরও একটা দারুণ ব্যাপার যে গ্রামের প্রত্যেকটি বাড়ির উঠোনে সজনে গাছ। আর তাতে অজস্র ফুল ধরে এক অপরূপ দৃশ্য সৃষ্টি করেছে। প্রকৃতির এই ছবিগুলি মনের মধ্যে আঁকতে চেষ্টা করছি হঠাৎ গাড়ি থামালেন মাহেশজি। ডানদিকে পাহাড় কেটে একটি রাস্তা চলে গিয়েছে। মাহেশজি বললেন এটাই মাউন্টেনম্যান দশরথ মাঝির পাহাড় কাটা রাস্তা।

বলিউডের নতুন মুক্তি পাওয়া দশরথ মানঝির জীবন কাহিনী নির্ভর সিনেমাই নাকি পর্যটকদের এখানে টেনে আনছে। বলিউডের এমন মহিমা। আসল দশরথ পিছনে। বলিউডি দশরথ নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকিই লোকের মুখে মুখে। বলিউডে এত টাকার বাণিজ্য হল, কিন্তু দশরথ মাঝির গ্রাম সেই অন্ধকারেই। তাই দশরথের গ্রামের মহাদেব যাদবেরা আজও মাটির হাঁড়ি কাঁধে নিয়ে পর্যটকদের গাড়ির কাছে ঘুরে বেড়ায়, বিক্রি হবার আশায়। আর বিক্রি করতে অসফল হলে ভিক্ষা চায়। ওই হাঁড়িগুলো নাকি শ্যুটিংয়ে ব্যবহার করা হয়েছিল। দশরথের ফিল্মি বউ রাধিকা আপ্টে ওই হাঁড়িতে জল নিয়ে আসতেন। কিন্তু, বাংলায় যে হাঁড়ি ৩০-৪০ টাকায় পাওয়া যায় সেটা কেন লোকে ১০০ টাকা দিয়ে কিনবে? রাধিকা আপ্টে তো এখনও মীনাকুমারী বা বৈজয়ন্তীমালা হয়ে ওঠেননি! পর্যটকদের আনাগোনা যদি এদের হাল ফেরায় তবে বলিউড দীর্ঘজীবী হোক।

পরেরদিন টাঙ্গায় চড়ে রওনা দিলাম রাজগীরের দর্শনীয় স্থানগুলির উদ্দেশ্যে। প্রথমে বেণুবন। আসলে বাঁশবন কিন্তু বাঁশগুলি সুগন্ধি। কথিত আছে, রাজা বিম্বিসার প্রথম এই স্থানটিই বুদ্ধদেবকে দান করেছিলেন তার ধর্মচর্চার জন্য। বুদ্ধের মহত্বেই কিনা জানিনা দেখলাম, বন্য জীবদের এখানে যথেষ্ট লালিত্য। এরপর আরও কয়েকটি জায়গায় ঘোরার পর পৌঁছালাম পাহাড়ের পাদদেশে। এখানে পাহাড়ে চড়ার ব্যবস্থা করা আছে। করা হয়েছে রোপওয়ের ব্যবস্থা, পাদদেশ থেকে মাথা পর্যন্ত। তাছাড়াও আছে সিমেন্ট বাঁধানো সিঁড়ির ব্যবস্থা। বাবা-মাকে রোপওয়েতে চাপিয়ে আমি আর বোন সিঁড়ি ভেঙেই ওপরে উঠলুম। সঙ্গে অবশ্য ভ্রাতুষ্পুত্র লেজুড় ছিল। পাহাড়ের মাথার কাছকাছি গিয়ে সিঁড়িটি দুদিকে বেঁকে গেছে। ডানদিক ধরে গেলে পৌঁছানো যায় গৃধকূটে। এখানের গুহাতেই বুদ্ধদেব তাঁর শিষ্যদের নিয়ে সাধনা করতেন।

আর বামদিক ধরে গেলে পৌঁছানো যায় বিশ্ব শান্তি স্তূপে। পাহাড়ের মাথায় এতবড় মন্দির কীভাবে গড়ে তুলেছেন এঁরা কে জানে! তবে পাহাড়ের চূড়ো থেকে নিচের দৃশ্যটা কিন্তু অসাধারণ। যেদিকেই তাকাই, সবুজ আর সবুজ। আর সবুজের শেষে পাহাড়। আর সবুজ চিরে চলেছে লাল-কালো-সাদা রাস্তা। পাহাড় থেকে নেমে টাঙ্গায় চড়ে পৌঁছুলুম এক পাথরের দেওয়াল ঘেরা জায়গায়। এটা বিম্বিসার জেল। বিম্বিসার পুত্র অজাতশত্রু তাঁকে এখানে বন্দি করে হত্যা করেছিলেন। যদিও জেলের একাংশও আস্ত নেই। এরপর পৌঁছুলুম গরম জলের কুণ্ডে। অনেকটা উষ্ণ প্রস্রবণের মতো ব্যাপার। তবে সমস্তটাই ইট গেঁথে মন্দির বানিয়ে তার স্বাভাবিকতা কিছু রাখা হয়নি। এখানে সৌন্দর্যের থেকে কদর্যতাই বেশি। সারাদিনের ভ্রমণ মন ও দেহকে ক্লান্ত করেছিল। তাই হোটেলে ফেরাই সাব্যস্ত হল। কিন্তু এখানে এসে ঘরে কি মন টেকে। পাহাড়ের কোলে অজাতশত্রুর কেল্লা ময়দানে কাটিয়ে দিলুম বিকেলটা।

শেষদিনটা বরাদ্দ ছিল নালন্দার জন্য। মনে মনে উৎফুল্ল ছিলাম আরও একটা ইতিহাস ছোঁয়ার জন্য। নালন্দার পথে যেতেই পড়ল পায়াপুরী মন্দির। মহাবীর জৈন এর সমাধিস্থল। মন্দিরটি স্বর্ণমন্দিরের মত চারপাশে জল দিয়ে ঘেরা আর সেই ঝিলে সাঁতরে বেড়াচ্ছে পরিযায়ী পাখিরা। ভিন্ন তাদের রূপ। ভিন্ন তাদের চরিত্র। কেউ ওড়ে তো কেউ ডুব দেয়। কেউ পালক পরিস্কারে ব্যস্ত তো কেউ অন্যদের পথ দেখিয়ে এগিয়ে নিয়ে চলে। কোন মন্দিরেই ৫ মিনিটের বেশি সময় নষ্ট না করলেও এখানে কাটিয়ে ফেললাম এক ঘণ্টা। এরপর নালন্দায় পৌঁছন গেল। আর্কিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়া বর্তমান রক্ষণাবেক্ষণকারী। ভগ্ন দশায় দাঁড়িয়ে আছে একসময়ের সেরা বিশ্ববিদ্যালয়। যার এক একটি দেওয়ালই একটা ছোট কেবিনের আকারের। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক একটি প্রান্তে একটা করে মন্দির। ভগ্ন দশায় পড়ে আছে শিক্ষাপ্রদানের ক্ষুদ্র কক্ষগুলি। আর আছে ছাত্রাবাসের ভগ্নস্তূপ। ছাত্রাবাসের মাঠে বড় উঠোন আর তার মধ্যেই আধুনিক উপায়ে তৈরি কুয়া, উনুন আর নিকাশি নালা। যা সেই যুগেও তাদের বিজ্ঞানমনস্কতার পরিচয়বাহক। বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরের বিপরীতে তৈরি হয়েছে আর্কিওলজিকাল মিউজিয়াম। যেখানে সংরক্ষিত মাটি খুঁড়ে পাওয়া কিছু অমূল্য সম্পদ। বুদ্ধের ভিন্ন ধ্যান ভঙ্গিমার মূর্তি, খাদ্য মজুতের বিশাল বিশাল কলস, তখনকার চাষবাসের যন্ত্র, হর্ষবর্ধনের মাটির স্ট্যাম্প আরও কতকী! তবে প্রধান আকর্ষণ বোধহয় হর্ষবর্ধনের আমলের মাটির স্ট্যাম্পটাই।

ভ্রমণ শেষে ঘরে ফেরার পালা। মন খারাপ আর মন ভালর মিশেল। পাহাড়গুলো যেন হাতছানি দিচ্ছে বারবার। কিন্তু আমাকে যে ফিরতে হবেই ধান-সিড়িটির কোলে এই বাংলায়।

এখন যে বাংলায় বসন্ত এসেছে। ভোরে কোকিলের কুহুতান মিস করা যায় নাকি!?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *