জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

জল-জঙ্গল আর জীবন

ইন্দ্রজিৎ সাউ

‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের মধ্যে সব থেকে বেশি পায়ের তলায় সরষে মনে হয় আমারই। একটা জায়গা ঘোরা শেষ হতে না হতেই নতুন কোথায় যাওয়া যায় তার খোঁজ শুরু করে দিই।

গ্রুপে সৌমিত্র নামে একজন কাঁকড়াঝোর নিয়ে লিখেছিলেন। সেটা পড়ে, আর নেটে কাঁকড়াঝোর সম্পর্কে খোঁজখবর নিয়ে জঙ্গলের প্রেমে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু যাওয়া হয়নি। শান্তিনিকেতন থেকে ফিরে আসার কয়েক সপ্তাহ পরেই সুব্রতর ফোন, ‘কী রে সুন্দরবন যাবি?’ সুব্রত আমার স্কুলের বন্ধু। এর আগেও তিনবার সুন্দরবনে গিয়েছে, এটা ওর চতুর্থবার। প্রথমে তো যাওয়ার দিন ঠিক হয়ে ছিল ২৪ মার্চ। তার পর সময় এগিয়ে এনে করা হয় ১০ মার্চ। অবশ্য এই যাওয়ার দিন এগিয়ে আনার পরামর্শ আমাদের লঞ্চের মালিক কাম চালক অশোক মৃধার। মার্চের যত পরে ওখানে যাব ততই নাকি বিপদ। আর ২৪/২৫ তারিখের আগেই আমরা সুন্দরবনের যেদিকটা যাব ওদিকে নাকি সাধারণের প্রবেশ নিষেধ হয়ে যায়।

আমাদের রুট ছিল গোসাবা। ওখান থেকে ঝড়খালি তারপর বনি ক্যাম্প, কলস ক্যাম্প আর কলস দ্বীপ। ঠিক হল, শিয়ালদহ থেকে সকালে এগারোটা দশের ক্যানিং লোকাল ধরে ক্যানিং তারপর অটো ধরে গদখালি যাওয়া হবে। ওখানে আমাদের লঞ্চ থাকবে। ১০ তারিখ বেরিয়ে পড়া গেল। আমি, মিন্টুদা, দেবদুলালদা, তপনদা, গৌর, সুব্রত, প্রণব রায়, শিলাদিত্য। প্রণববাবু অভিজ্ঞ মানুষ। সুন্দরবনকে ভালবাসেন। এ পর্যন্ত আট-ন’বার সুন্দরবন ঘুরে এসেছেন। সুব্রতর দূর সম্পর্কের মেসোমশাই উনি। উনি বালিগঞ্জে থাকেন।

যখন স্টেশনে পৌঁছলাম তখন এগারটা দশ হয়ে গিয়েছে। ট্রেনের কাছাকাছি যাওয়া মাত্রই সে শেষ বাঁশি বাজিয়ে নড়তে শুরু করে দিয়েছে। আমরা কোনওরকমে দৌড়ে দুটো কামরায় ভাগাভাগি করে উঠলাম। ট্রেনে বেশ ভালই ভিড় ছিল যার কারণে আমরা একটা কামরায় উঠতে পারিনি। ঠিক সময়েই ক্যানিং পৌঁছলাম। ক্যানিং বাজারের ভিতরে একটি হোটেলে দুপুরের খাওয়া সেরে নেওয়া হল। তারপর ক্যানিংস্ট্যান্ড থেকে অটো ধরে গদখালি। এখানে একটা খুব ভাল নিয়ম আছে। রুটের অটো রিজার্ভ করলেও যেখানে খুশি নিয়ে যাওয়া যাবে না। অন্য রুটের এলাকায় এলেই অটো ছেড়ে দিতে হবে। আমরাও তাই করলাম। বাসন্তীতে এসে অটো বদলালাম। অটোচালকই পরের অটো ঠিক করে দিলেন। মাতলা আর হোগল দু’টো নদীর ব্রিজ পেরিয়ে যখন গদখালি পৌঁছলাম তখন প্রায় তিনটে বাজে। রাস্তায় একবার গাড়ি থামানো হয়েছিল। ডাব খাওয়ার জন্য। গদখালি পৌঁছে অশোককে ফোন করা হল। ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই ও চলে এল।

গদখালির ওপারেই গোসাবা। পরেরদিন আমরা ওখান থেকেই জঙ্গলে যাব। ফেরি ঘাটে আমরা দাঁড়িয়ে আছি। শিলাদিত্য হঠাৎ জিজ্ঞাসা করল, ‘সুন্দরবনে কি হাতি আছে?’ ওর এমন জিজ্ঞাসায় একটু অবাকই হলাম। কেন জিজ্ঞাসা করছে সেটা জানার আগেই ও আবার বলল, ‘চিতা পাওয়া যায় এখানে?’ চিতা তো সারা ভারতেই নেই! ও চাইছেটা কী! একটু থেমে আবার বলল, তাহলে ক্যাঙারু নিশ্চয় দেখতে পাব?’ এবার রেগে গেলাম। ও শয়তানির হাসি হেসে একটা ট্র্যাভেল এজেন্সির ব্যানার দেখিয়ে বলল, ‘দেখ না, সুন্দরবনে হরিণ, বাঘ, কুমির ছাড়াও, চিতা, ক্যাঙারু আর হাতি দেখাবে বলে বিজ্ঞাপন দিয়েছে।’ দেখলাম। তারপর হো হো করে হেসে উঠলাম। এই না হলে বাঙালির পেশাদারিত্ব!

আমরা তো বিজ্ঞাপন নিয়ে হাসি মজা করছি। সেখানে যে একটা ছেলে বসেছিল, আমরা কেউ খেয়াল করিনি। সে জানাল, ওটা তার লঞ্চের বিজ্ঞাপন। যে বিজ্ঞাপন করেছে সে ভুল করেছে। ব্যাস আর যায় কোথায়? শিলাদিত্য ততক্ষণে ওর কাজে লেগে পড়েছে। আমার দেখে মনে হল ‘ওয়াক্ত’ সিনেমার রাজপাল যাদবকে দেখছি। যে বোমান ইরানিকে প্রশ্ন করে চলেছে “আপকা লড়কি নে ভাগ কে শাদি কি হ্যায়? কিঁউ ভাগ কে শাদি কি? আপকো নেহি বুলায়া? কিঁউ নেহি বুলায়া?’ শিলাদিত্য জানতে চাইছিল, ‘অ্যাডটা করে আপনাকে দেখায়নি? কেন দেখায়নি? করার পর দেখেও আপনি ওটা লাগালেন? কেন লাগালেন?’ প্রশ্নের পর প্রশ্ন চলতেই থাকল।

যে নদীর চরে দাঁড়িয়ে শিলাদিত্য প্রশ্নবাণ ছুড়ছিল সেটা বিদ্যাধরী নদীর। বিদ্যাধরী এখানে বিশেষ বড় নয়। আমরা ওপারটা পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলাম। আমাদের ঘাটের পাশেই আরেকটি ঘাট। সেখানে ওপারের বিভিন্ন ঘাট থেকে একটার পর একটা ভুটভুটি নৌকা আসছে। মানুষজন তো আছেই। সাইকেল, বাইকও আছে। ফেরি এখানের দ্বীপ অঞ্চলগুলোর একমাত্র যোগাযোগের মাধ্যম। আসার সময় দেখে ছিলাম রাস্তার দু’পাশে বিভিন্ন আকারের নৌকা রাখা আছে। ঠিক আমাদের এখানে যেমন গাড়ি রাখা থাকে। প্রায় এক ঘণ্টা পর অশোক তার লঞ্চ ‘এমভি অঞ্জলি’ নিয়ে হাজির। এদিকে মেসোমশাই তো খেপচুরিয়াস। সুব্রতর কথা শুনে মনে হয়েছিল, উনি খুব রাশভারি মানুষ। বয়স প্রায় ষাট। কেন্দ্রীয় সরকারের অডিট বিভাগে চাকরি করেন। কিন্তু উনি তো শিলাদিত্যের এককাঠি উপরে। যত দেরি হচ্ছিল তত রেগে যাচ্ছিলেন। ওঁর একটাই কথা, যখনই অশোককে ফোন করেন সে নাকি ওঁকে শোনায়, লঞ্চ আর আগের মত নেই। সুন্দর করে সাজিয়েছে। লঞ্চের মেশিন টু সিলিন্ডারের যায়গায় সিক্স সিলিন্ডার করেছে…ইত্যাদি ইত্যাদি। আগেরবার নাকি ব্যবস্থা ঠিক ছিল না। আসলে সুব্রত ফোন করতে দেরি করাতেই অশোক লঞ্চ নিয়ে দেরিতে এসেছে। তাতেই মেসোমশাইয়ের রাগ। যখন অটোয় ছিলাম তখন অশোক একবার ফোন করেছিল। কিন্তু সুব্রত শুনতে পায়নি।

আগেরবার কী ছিল জানি না, লঞ্চের ব্যবস্থা দেখে মনটা খুশিতে ভরে গেল। ওপরের ডেকে সবুজ গালিচা পাতা। সারি দেওয়া বসার চেয়ার। ভিতরে পরিষ্কার বিছানা। মিন্টুদা, দেবদুলালদা শিলাদিত্য, গৌর এবং আমার প্রথম সুন্দরবন আসা। লঞ্চ ছাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই নদীর ঠান্ডা হাওয়ায় এতক্ষণের গুমোট গরমটা কেটে গেল। ক্লান্ত শরীর এবং মনকে তরতাজা করে দিল।

লঞ্চ গোসাবা ঘাটে থামতেই আমরা ব্যাগ রেখে নেমে পড়লাম। কয়েক জনকে জিজ্ঞাসা করতেই দেখিয়ে দিল গাড়ির স্ট্যান্ড। পাঁচ মিনিটের দূরত্ব। সারি সারি অটো দাঁড়িয়ে। অটোয় উঠেই তো খোশগল্পে মশগুল। প্রথমে আমরা কেউই খেয়াল করিনি। মিনিট দশেক আসার পর দেখি যেমন রাস্তা খারাপ তেমন লড়ঝড়ে গাড়ি। স্পিড তুললেই গাড়ি এমন কাঁপতে শুরু করল মনে হচ্ছিল এই বুঝি ভেঙে পড়ল। এমন বিকট আওয়াজ যে নিজেদের কথাই শুনতে পাচ্ছিনা। আরেকটা জিনিস আবিষ্কার করলাম, দিদির দেওয়া যে সাইকেলের এত দুর্নাম সেই সাইকেলও আমাদের পাস দিয়ে সাঁইসাঁই করে বেরিয়ে যাচ্ছে। পঁচিশ মিনিটের রাস্তা শেষ পর্যন্ত আমরা চল্লিশ মিনিটে গেলাম। সুন্দর একটা জায়গা পাখিরালা। একবারে ফাঁকা নদীর চর। রাস্তার দু’পাশে অল্প কয়েকটা দোকান। যেখানে ঘর সাজাবার জিনিস থেকে মেয়েদের রকমারি হার, হাল ফ্যাশনের নানারকম টুপি নিয়ে বসে আছে। সবই আমাদের কলকাতায় মেলে। এখানকার বলতে শুধু, মধু। আশেপাশে বেশ কিছু আধুনিক হোটেল গজিয়ে পরিবেশের চরিত্র হননের কাজ পুরোদমে শুরু করে দিয়েছে। মেসোমশাই বললেন, ‘আগে এখানে কোনও থাকার যায়গা ছিল না। পুরো ফাঁকা নদীর চর ধরে হেঁটে যাওয়া যেত।’

পাখিরালা থেকে নদীর ওপারে সজনেখালি টাইগার রিজার্ভ। ওখানে মিষ্টি জলের ব্যবস্থা করা আছে। সেখানে বাঘ জল খেতে আসে। ওয়াচ টাওয়ার থেকে আগেরবার এসে মেসোমশাই বাঘকে জল খেতে দেখে ছিলেন। পাঁচটার মধ্যে গেট বন্ধ হয়ে যায়। আমাদের আর যাওয়া হয়নি। ফেরার সময় আর এক ফ্যাসাদ। ভেবেছিলাম, যে অটোতে এসেছিলাম তাতেই ফিরে যাব। কিন্তু এখানেও সেই লাইনের নিয়ম। তাতেও হয়তো আপত্তি হতো না। কিন্তু এবারে যেতে হবে ভ্যানোয়। যাকে আমি দানব গাড়ি বলি। আসার সময় রাস্তার যা হাল দেখেছি এই গাড়িতে গেলে আমাদের পিঠ কোমর আস্ত থাকবে না। বিশেষ করে মেসোমশাইয়ের। অনেক বুঝিয়ে তাঁকে গাড়িতে তোলা হল। অবশ্য এদের দোষ দিয়ে লাভ নেই সারাদিনে একটা পুরো ট্রিপ হয় কিনা সন্দেহ। আসার সময় দেখেছি মাঠের পর মাঠ পড়ে আছে। চাষ হয় না। জল প্রচুর। কিন্তু সবই তো নোনা জল।

গোসাবায় যখন ফিরে এলাম তখন সন্ধ্যে নেমেছে। ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম বাজারে। সুব্রত আর মেসোমশাই কিছু জিনিস এনেছিল প্রয়োজন মত। বাকি যা ছিল তালিকা মিলিয়ে দু’দিনের রসদ নিয়ে নেওয়া হল। বাজারটাও ঘুরে দেখে নিলাম। ছোট বাজার। তারই মধ্যে একদিকে দোকানপাট, কাঁচা আনাজ, মাছের বাজার। এবং শহরের মতো ভাগা দেওয়া সিমেন্টের চাতাল। সুব্রতর সঙ্গে কোথাও বেড়াতে গেলে সব ব্যাপারেই নিশ্চিতে থাকা যায়। জলখাবার ও আগেই রেডি করে রেখেছিল। ডেকের উপর নদীর ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়ায় সবাই একসঙ্গে বসে খাওয়া সেই সঙ্গে মেসোমশাইয়ে বিভিন্ন মজার অভিজ্ঞতার কথা কোনওদিনও ভুলব না। রাত্রি সাড়ে আটটায় লঞ্চ ঘাট ছেড়ে মাঝ নদীর কাছে নোঙর ফেলল। এর দুটো কারণ, ঘাটে থাকলে অন্য ভুটভুটির সঙ্গে ধাক্কা হওয়ার ভয়। দ্বিতীয়ত জল কমে গেলে লঞ্চ চরে আটকে যেতে পারে। মিন্টুদার চিন্তিত প্রশ্ন, ‘আমাদের মাঝনদীতেই থাকতে হবে? লঞ্চ যদি ভেসে চলে যায়?’ অশোক মিন্টুদাকে আশ্বস্ত করল, ‘তুমি চিন্তা করো না। আমি আর আমার ভাই সজাগ থাকব।’ রাতে খাওয়া শেষ করে যখন ঘুমতে গেলাম তখন প্রায় এগারটা বাজে। কিন্তু শোয়ার সঙ্গে সঙ্গেই বিপত্তি। এখানে প্রচুর মশা আছে। আমাকে সুব্রত আগেই বলেছিল। সেই মতো আমি মশারি নিয়ে এসেছি। আর কেউ আনেনি। তাতে খুব একটা অসুবিধা হচ্ছিল না। কারণ কয়েল জ্বালানো হয়েছিল। কিন্তু আলো নেভাতেই শুরু হল আরশোলার উৎপাত। আর সেই সঙ্গে মেসোমশাইয়ের চেঁচানি। এই বয়সের কোনও মানুষ যে আরশোলাকে ভয় পেতে পারে আমার ধারণা ছিল না। লাইট জ্বেলে যত আরশোলা দেখেন তত চেঁচান। আর অশোককে বলেন, ‘তুমি লঞ্চ সাজিয়েছ, মেশিনের ক্ষমতা বাড়িয়েছ ও দিয়ে আমার কী হবে? আর এদিকে আরশোলা আর টিকটিকির চাষ করেছ?’ শেষে আমি আমার মশারিতে মেসোমশাইকে জায়গা দিতে শান্তি ফিরল।

রাত তখন ক’টা বাজে জানিনা। একটা বিকট আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। প্রথমে তো বুঝতেই পারছিলাম না, কোথায় আছি। আবার সেই হা-হা-হা-হা করে আওয়াজ। না কোনও হায়না নয়। পাশের বিছানায় মিন্টুদা ঘুমের ঘোরে ভুল বকছে। বিকেলে যখন পাখিরালা গিয়েছিলাম তখন মেসোমশাই বলেছিলেন আগেরবার সজনেখালিতে বাঘ যখন জল খাচ্ছিল তখন কিছু অর্বাচীন হা হা হা হা করে চেঁচিয়ে বাঘ তাড়াচ্ছিল। গৌর মিন্টুদা কে ঠেলা মেরে বলল, ‘মিন্টুদা তোমার বাঘ তাড়ানো বন্ধ কর। আমরা এখন মাঝ নদীতে লঞ্চে শুয়ে আছি।’ তখন রাত পৌনে দু’টো।

ভোর পাঁচটার কিছু আগেই ফেরি চালু হয়ে গেছে। ভুটভুটির আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল। উঠে পড়লাম। বাকিরা তখনও ঘুমচ্ছে। সারা রাতই লঞ্চের আওয়াজ পেয়েছি তখন বুঝিনি। ডেকে উঠে দেখলাম বড় বড় সব ভুটভুটি নৌকা। অশোক বলল, ওগুলো ইমারতি দ্রব্য নিয়ে যাওয়ার ভুটভুটি। এক একটা তে প্রায় চার পাঁচ লরির সমান বালি পাথর ইট নিয়ে যায়। দূরে দূরে আরও অনেক লঞ্চ নোঙর করে আছে। সকালটা একদম অন্যরকম। চারিদিক পরিষ্কার ঠান্ডা হাওয়া বেশ শীত শীত আমেজ। কিন্তু কিছুক্ষণের মধ্যেই চারিদিক কুয়াশায় ছেয়ে গেল। লঞ্চগুলো চোখের সামনে থেকে হারিয়ে গেল। সাতটা নাগাদ আবার আমরা বাজারে গেলাম। দেশি মুরগি, জ্যান্ত গলদা চিংড়ি আর ভেটকি নেওয়া হল বেশ সস্তায়। আর মেসোমশাইয়ের জন্য মশারি। সঙ্গে আরশোলার জন্য হিট।

কুয়াশা কেটে যাওয়ার পর সকাল ন’টায় লঞ্চ বনিক্যাম্পের দিকে যাত্রা করল।

লঞ্চ কিছুটা এগোতেই দেখলাম নদীর দুই পাড়ে খাপলা জাল নিয়ে বিভিন্ন বয়েসের মহিলা পুরুষ মাছ ধরছে। সঙ্গে বাড়ির বাচ্চারাও। জীবিকার তাড়না। ভয়ডরহীন জীবন। নদীর গভীরতা কম নয় এখানে। তা সত্ত্বেও কেউ কেউ জলে নেমে জাল ফেলছে। জীবন এখানে বড় কঠিন। জল থেকে খুঁটে খুঁটে তার উপকরণ সংগ্রহ করতে হয়।

আমরা বালিবিজয় নগর এলাম। এটা অশোকের গ্রাম। এখানে সব বাড়িতে বিদ্যুৎ আসেনি। কোথাও বিদ্যুৎ তো কোথাও সৌরবিদ্যুৎ ব্যবহার হচ্ছে। রাস্তা কাঁচা নয়। ইটপাতা। কিন্তু ইটের রাস্তার জায়গায় জায়গায় নদী খাবলা বসিয়েছে। আমরা পাম্পসেট থেকে রান্নার জল নিলাম। পঞ্চাশ টাকায় দুটো ঢাউস ড্রাম ভরে নেওয়া হল। খাওয়ার জল গোসাবা থেকে কুড়ি লিটারের সাতটা বোতল আগেই নেওয়া হয়েছিল।…

বিদ্যাধরী পেরিয়ে পঞ্চমুখী হয়ে হেড়োভাঙা নদী ধরে লঞ্চ ঝড়খালি এল। পঞ্চমুখী পাঁচটা নদীর মিলনস্থল। তখন বারোটা বাজে। এখানে একটা ইকোপার্ক আছে। সেটা দেখব। এখানেই আমাদের অনুমতি নিতে হবে। কতজন আছি, ক’দিন থাকব তারজন্য। এখানে দুটো বাঘ রাখা আছে। বাঘের খাঁচা ছাড়িয়ে কিছুটা যেতেই মেসোমশাই আমাদের হাতে শসা ধরিয়ে দিল বাঁদরকে দেওয়ার জন্য। প্রচুর বাঁদর এখানে। তাদের শসাসেবা করিয়ে এগিয়েছি, হঠাৎ পিছন থেকে গৌরের চিৎকার, ‘ও ইন্দ্রদা বাঁচাও।’ ঘুরে দেখি একটা বাঁদর ওর প্যান্টস ধরে টানাটানি করছে। ওর গলায় মেসোমশাইয়ের পেল্লায় সাইজের দূরবীন। ওটা নিয়ে যদি পালায়! ওটাকে তাড়াতে না তাড়াতেই আরও দু’তিনটে নেমে এল। শেষে একটা ডাল নিয়ে তাড়া দিতে রণে ভঙ্গ দিল শ্রীরাম সেনারা।

পারমিশান নিতে গিয়ে আরেক ঝামেলা। এখন নাকি নতুন নিয়ম হয়েছে, সঙ্গে একজন গাইড নিতে হবে। এখানে কোথাও জঙ্গলে নামা যাবে না। আমাদের গাছ চেনার দরকার নেই। হামলোগ ঘাসপুস কা ডক্টর নেহি হুঁ। আমাদের দীপুভাই একসময় হবে, জানি। এখন ও যতই গাছ চেনাতে না পারুক। রাস্তা অশোক জানে। শেষমেশ ঘুরপথে রফা হল। আমরা গাইড ছাড়াই চললাম।

হেড়োভাঙা নদী ছেড়ে মাতলা ধরে লঞ্চ এগিয়ে চলল। কিছুক্ষণের মধ্যেই সভ্যজগৎ থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন হয়ে গেলাম। মোবাইলের সিগন্যালও লুকোচুরি খেলতে শুরু করে দিল। মাতলা এখানে কতটা ছড়িয়ে পড়েছে তার ঠিক নেই। তেমনি তার স্রোত। জল পাক খেয়ে ঘূর্ণির মতো এগিয়ে চলেছে। পেল্লাই সাইজের দূরবীন দিয়েও পাড়ের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। সেসব কেঁপে যাওয়া হাতে তোলা ছবির মতো। বসন্তের শেষে যদি নদীর এই রূপ হয় তাহলে ভরা বর্ষায় তার চেহারা কী হয়! সেই জন্যই বর্ষায় কেউ এদিকে আসে না। মাঝে মাঝে জেলেদের ভুটভুটি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। এক জায়গায় দেখলাম ভারত-বাংলাদেশ জল পুলিশের যৌথ লঞ্চ টহলদারি লঞ্চ দাঁড়িয়ে।

বিকেল তিনটের বনি ক্যাম্প পৌঁছে গেলাম। নেমেই ক্যামেরা, দূরবীন নিয়ে দৌড় লাগালাম ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। এটাও একটি ইকোপার্ক। চারিদিক লোহার তার দিয়ে ঘেরা। খুব সুন্দর করে সাজানো। অনেক ঘরও আছে। ভাড়া দেওয়া হয় পর্যটকদের রাত্রিবাসের জন্য। এই জল জঙ্গলে আধুনিক সভ্যতার সব ব্যবস্থাই আছে। তবে এখন থাকতে দেওয়া হয় না।আগেরবার মেসোমশাই এখানে থেকেছিলেন। এখানে মিষ্টি জলের জলাশয় করা যেখানে বাঘ, হরিণ, বুনোশুয়োর-সহ জঙ্গলের সব প্রাণী জল খেতে আসে। চারতলা সমান টাওয়ার থেকে জঙ্গলের যে দৃশ্য দেখা যায় তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। ভাললাগা ভাষায় প্রকাশ করতে গেলে অনেক সময়ে গোলমাল হয়ে যায়। সামনে দেখলাম বেশ কিছু হরিণ ঘুরে বেড়াচ্ছে। চারিদিকে চেনাঅচেনা পাখির কিচিরমিচির। সাড়ে ছ’টা নাগাদ আমরা নেমে এলাম। এরপর ভিতরে থাকার নিয়ম নেই।

বাইরে বেরিয়ে পড়লাম আরেক বিপদে। ভাঁটা পড়ে যাওয়ায় লঞ্চ এতটাই ঘাট থেকে নিচে নেমে গেছে যে আমরা উঠতে পারব না। অগত্যা গেটের বাইরে অপেক্ষা করতে লাগলাম। কিন্তু সেখানেও ভয়ের ব্যাপার। আমরা জঙ্গলের ধারে বসে আছি। খাঁড়িটাও বেশি চওড়া নয়। জল একেবারে নেমে গিয়েছে। ভিতরে এক কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, বাইরে যে হরিণগুলো দেখছিলাম সেগুলোর সব ক’টা বুনো নয়। কিছু গড়চুমুক থেকে নিয়ে আসা। গড়চুমুক! সে তো আমাদের জেলা হাওড়ায়! জেলার হরিণ জেনে বেশ ভালই লাগল। আগে নাকি হরিণগুলো বনি ক্যাম্পের মধ্যে ঘেরার মধ্যেই রাখা থাকত। এক তো খাবার দেওয়ার ঝামেলা। তারপর মাঝে মাঝেই বাঘেরা হানা দিত। একবার তো একটাকে ধরেও নিয়ে গিয়েছে। তারপরই থেকে নাকি হরিণগুলোকে বাইরে ছেড়ে দেওয়া হয়। যে হরিণটাকে বাঘে নিয়েছে সেটা কি আমাদের হাওড়ার হরিণ? জানি না। তবে মনটা খারাপ হয়ে গেল।

মন খারাপের সঙ্গে ভয়ও পাচ্ছিল। আমাদেরও বাঘে ধরবে না তো! ভয়টা আমারই বেশি। মেসোমশাই প্রথমেই বলে দিলেন, ‘আমকে ধরবে না। আমি বুড়ো মানুষ তার উপর গায়ে মাংস কম।’ মিন্টুদা বলল, ‘আমি যা কালো আমাকে অন্ধকারে দেখতেই পাবে না।’ শিলাদিত্যের বক্তব্য, ‘আমাকে ধরলে মজুরি পোষাবে না। দলের মধ্যে আমি সবচেয়ে ছোট।’ সুব্রত বলল, ‘তুই থাকতে আমার দিকে নজর দেবে বলে মনে হয় না।’ আর তপনদা তো আগেই বলে দিয়েছে, ‘পেটমোটা লোককে আবার বাঘে খায়?’

রাত আটটায় আমরা লঞ্চে উঠলাম।

শেষ কবে আমরা খোলা আকাশের নীচে বসে গল্প করেছি, মনে নেই। ব্যস্ততায় সেসব এখন বিলাসিতা। দূষণ মুক্ত পরিষ্কার আকাশ দেখে সকলেই ছেলেমানুষ হয়ে গেলাম। স্কুলে কালপুরুষ, সপ্তর্ষিমণ্ডল আর শুকতারা চিনতে শিখিয়েছিল। আর রাতে তাদের আকাশে খুঁজেছিলাম। আজও খুঁজছি।

ভোর পাঁচটায় ঘুম ভাঙল। ডেকে উঠে দেখলাম, জঙ্গলটা খুব কাছেই। রাতে প্রায় মাঝনদীর কাছে লঞ্চ নোঙর করেছিল। অশোক বলল, রাতে জল বেড়ে যাওয়ায় নোঙর আলগা হয়ে যাচ্ছিল। তাই পাড়ের কাছে লঞ্চ নিয়ে এসেছে।

ছ’টা বাজার আগেই লঞ্চ যাত্রা শুরু করল কলস ক্যাম্পে। যত এগোচ্ছি ততই জঙ্গলের রূপ খুলছে। এই প্রথম হেতাল গাছ দেখলাম। জঙ্গল করে ফেলেছে। গাছটা দেখতে খেজুর গাছের মতো। এই গাছের জঙ্গল সুন্দরবনের বাঘেদের প্রজনন ক্ষেত্র। জায়গায় জায়গায় মাতলা জঙ্গলে ভাঙন ধরিয়েছে। এখানে মাতলা বিশাল। তবে চর পড়ে গিয়েছে। মাঝে মাঝেই আমাদের লঞ্চ আটকে যাচ্ছিল। অবশ্য ভাটার সময় যাচ্ছিলাম বলেই এরকম হচ্ছিল। ফেরার সময় ভরা জোয়ারে কোনও অসুবিধা হয়নি। মাতলা নদীর চওড়া অংশ ছেড়ে একটা সরু শাখা ধরে লঞ্চ এগিয়ে চলল। অনেকটা বড় খালের মতো। পাড়ের জঙ্গলে মাঝে মাঝেই দেখি, গাছে লাল শালু না হয় রঙিন প্লাস্টিকের মালা লাগানো আছে। মেসোমশাই বললেন, ‘লাল শালু মানে এখানে বাঘে মানুষ মেরেছে। অন্যদের সতর্ক করা হচ্ছে।’ যদিও একটা দলকে নির্ভাবনায় নৌকা নিয়ে মাছ ধরতে দেখলাম। তবে আমাদের লঞ্চে লাল শালুর প্রভাব পড়ল। মিন্টুদা, তপনদা আর দেবদুলালাদা সুট করে লঞ্চের উল্টোদিকে চলে গেল। যেন বাঘ এখনই এদিকে লাফিয়ে পড়বে।

দশটাতেই কলস ক্যাম্প। এটাও ইকোপার্ক। তবে বনি ক্যাম্পের মত বড় আর সাজানো নয়। এখানেও বেশ কিছু ঘর আছে পর্যটকদের জন্য। জানতে পারলাম, এখানে নাকি ভীষণ সাপের উপদ্রব। বিছানায় শুয়ে থাকে। এখানেও জীবজন্তুদের জন্য মিষ্টি জলের ব্যবস্থা করা আছে। নদীর পাড়ে প্রচুর লাল কাঁকড়া আর মাছ। একটা নতুন ধরনের মাছ দেখলাম। স্থানীয় নাম ডাহুক মাছ। কেউ কেউ মেনো মাছও বলে। ইংরেজি নাম মাডস্কিপার। মাছটি উভচর। ডাঙায় প্রজনন করে। উইকিপিডিয়ায় খুঁজে দেখি, ম্যানগ্রোভ অরণ্যের প্রতীক এই মাছ।

কলস দ্বীপে যাওয়ার পথে কত প্রজাতির গাছ! বিচিত্র মূলের বাহার। নদীর জল জঙ্গলের ঘনত্বের সঙ্গে সঙ্গে রং পরিবর্তন করেছে। দ্বীপে পৌঁছে আমরা খুশিতে লাফিয়ে উঠলাম। সামনে বিশাল মোহনা আর বালিয়াড়ি। দেখেই তো সুব্রত, শিলাদিত্য আর গৌর নামার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু আগেই জানতাম, এখানে নামা নিষেধ। যদিও কয়েক বছর আগেও নামতে দেওয়া হতো। কিছু সুসভ্য জগতের অসভ্য মদ্যপ এসে একবার এখানকার বাদাবনে আগুন ধরিয়ে দিয়েছিল। তাতে বেশ কিছু অলিভ রিডলে কচ্ছপ মারা যায়। সেই থেকে নিষেধাজ্ঞা। নামা যখন যাবে না তখন ঠিক হল, মোহনার কিছু দূর ঘুরে আসা যাক। সেখানেও মেসোমশাইয়ের আপত্তি। অল্প ঢেউ দিচ্ছিল। আর ঢেউয়ে ভীষণ ভয় মেসোমশাইয়ে। অগত্যা ফেরা।

ফেরার সময় অলিভ রিডলে কচ্ছপ দেখলাম। কাছে গিয়ে দেখি, সেটা মরা। গৌর তো ওটার খোল বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য লাফাতে শুরু করল। সুব্রত বলল, ‘আমাদের জেলে যাওয়ার কোনও ইচ্ছে নেই। তুই একা এসে নিয়ে যাস।’ এখানে নাকি প্রচুর কুমির পাওয়া যায়। একটু শীত পড়লে নদীর পাড়ে তাদের রোদ পোহাতে দেখা যায়। সুব্রত বলল, ‘যদি কোনও কুমির দুপুরের খাওয়া সারবে বলে ওত পেতে থাকে আর গৌর যদি কচ্ছপ আনতে যায় তাহলে ভাগ নিয়ে লড়াই বাঁধবে। সেই দ্বন্দ্ব থামাবে কে?’

খাওয়া আগেই সেরে নিয়েছিলাম। বনি ক্যাম্পে ফিরে স্নান সেরে নিলাম। কেমন যেন একটা পচা গন্ধ পাচ্ছিলাম। যেটা আগের দিন ছিল না। একজনকে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম, বাঘ গণনার জন্য ক্যামেরা লাগানো শুরু হয়েছে আজ থেকে। ক্যমেরার সামনে পচা মাংস আর পচা ডিমের মিশ্রণ ছড়িয়ে দেওয়া হয়। এটা তারই গন্ধ।

আজও টাওয়ারে উঠে বসলাম। যদি বাঘ মামার দেখা পাই। উঠেই আমি শিলাদিত্য আর মেসোমশাই ছাড়া বাকিরা ফুরফুরে মিষ্টি হাওয়াতে নাক ডাকিয়ে ঘুম লাগালো। সন্ধ্যের আগেই অবশ্য নেমে এলাম। নামার কিছুক্ষণ পর চারিদিকে মাছির এত আওয়াজ শুরু হল যে দাঁড়িয়ে থাকাই দায় হচ্ছিল। প্রথমে তো আমরা ভাবলাম মৌমাছি। এক কর্মচারী জানালেন, মৌমাছি নয়। একপ্রকার জংলি মাছির আওয়াজ। তিনি একটা মজার ঘটনা শোনালেন। ঘটনাটা কিছুদিন আগের। কোনও এক জজসাহেব এখানে এসে আবদার করেছিলেন, বাঘ দেখাতে হবে। যেন পোষা বেড়াল ছানা। ওঁর কথায়, ‘কোথায় বাঘ আছে তোমরা তো জানোই। সেখানে নিয়ে চল।’ জানে না বলাতে ওঁদের উপর জজসাহেবের সে কী হম্বিতম্বি। একজন বিচারক যে এরকম অন্যায় বায়নাক্কা করতে পারেন তা ভাবাও যায় না। অভিজ্ঞ মেসোমশাই বললেন, ‘আসলে জজের কোনও দোষ ছিল না। পুরো ডায়লগ তৈরি করে দিয়েছিলেন জজসাহেবের স্ত্রী। হোম মিনিস্টারকে কে না ভয় পায়!’

আগের দিন একটা পরিবারকে দেখেছিলাম, স্বামী-স্ত্রী আর দেড় বছরের বাচ্ছা মেয়ে নিয়ে ছোট নৌকায়। জানলাম, ওরা আজ চারদিন হল এখানে এসেছেন কাঁকড়া ধরতে। আরও তিন চারদিন থাকবেন। কী কষ্টের জীবন এঁদের। ওইটুকু বাচ্চাও এঁদের কষ্টের ভাগিদার। ছোট নৌকা। পাড়ের কাছাকাছি থাকলে যে কোনও সময়েই বাঘ তুলে নিয়ে যেতে পারে। কাগজে পড়ি মৎস্যজীবীদের বাঘে নিয়ে যাওয়ার কথা। কী পরিস্থিতিতে নিয়ে যেতে পারে সেটা আজ চাক্ষুষ করলাম। মনটা ভীষণ খারাপ হয়ে গেল।

আসার সময় থেকেই বারবার মেসোমশাই বলছিলেন, সুন্দরবনের যদি রাতের রূপ দেখতে হয় তাহলে পূর্ণিমা দেখে আসা উচিত। সেটা যে কতটা ঠিক তা একফালি চাঁদ দেখে বুঝলাম। জলের উপর যেখানে আলো এসে পড়েছে সেখানটা রূপোর মত চকচক করছে। মোহময়।

পরের দিন সকাল হতেই লঞ্চ ফেরার পথ ধরল। পথে আমরা কইখালি নামলাম। প্রথমে গেলাম মাছের আড়তে। খুবই ছোট আড়ত। তারপর গেলাম সেখানকার রামকৃষ্ণ মিশনে। মঠ আর আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান একসঙ্গে। আমরা যে যার মত করে ছড়িয়ে ঘুরতে লাগলাম। প্রায় ঘণ্টাখানেক ঘোরার পর গৌর ডাকতে এল। আশোক নাকি তাড়াতাড়ি যেতে বলছে। ঘূর্ণি শুরু হয়ে গেছে। আমরা যখন আড়তে তখনই দেখেছিলাম, একটু ঝড়ের মতো উঠতে। স্থানীয়েরা কেউ কেউ বলছিলেন, ‘এই ঘূর্ণির দিন শুরু হল।’

মাঝনদীতে পৌঁছে বুঝলাম, ঘূর্ণি কী! লঞ্চ তখন হাওয়ার দাপটে আর ঢেউয়ের তালে নাচতে শুরু করে দিয়েছে। মনে হচ্ছে, আমরা লঞ্চে নয়, মোচার খোলের উপর বসে আছি। মাতলা তখন সার্থক নামা। তার মাতনে আমরা সবাই ভীত, সন্ত্রস্ত। সবচেয়ে চিন্তা হচ্ছিল মেসোমশাইকে নিয়ে। ঢেউয়ে কী পরিমাণ ভয় সেটা আগেই দেখেছি। লঞ্চ তো ভয়ঙ্কর দুলছে। সেই সঙ্গে সামনে চার ছয় হাত উপরে লাফিয়ে পড়ছে। জলের ঝাপটা আমাদের ভিজিয়ে দিয়ে যাচ্ছে। মেসোমশাই আর মিন্টুদা নীচে। বাকি সকলে ডেকের উপর। অশোক অভয় দিল, ‘চিন্তা নেই, আমি ঠিক নিয়ে চলে যাব।’ সুব্রত বলল, ‘আমদের চিন্তা কী! তুই সবে বিয়ে করে চারদিনের দিন আমাদের নিয়ে বেড়িয়েছিস। ফিরে শ্বশুরবাড়ি যাবি।’ অশোক আমাদের লঞ্চের সামনে বসে পড়তে বলল। আমরা বসে পড়লাম। মাঝে একবার মিন্টুদার গলা পেলাম, ‘সুব্রত তাড়াতাড়ি নীচে আয়। মেসো কেমন করছে।’ আমি যেতে চাইলাম। কিন্তু সুব্রত বলল, ‘যেতে হবে না। ও সবেতেই বেশি বেশি। থাক যা পারে হোক।’ প্রাথমিক ধাক্কা সামলে প্রায় দশ মিনিট পর আমি উঠে পিছনের দিকে গেলাম মেসোমশাইকে দেখব বলে।

পিছনে এসেই দেখি মিন্টুদা চিত হয়ে শুয়ে আছে। আমি ছবি তুলব বলে রেডি। কাছে গিয়ে যেন একটু অন্য রকম মনে হল। মিন্টুদা অজ্ঞান হয়ে গিয়েছে। ঝাঁকিয়ে ডাকলাম। কোনও সাড়া পেলাম না। চেঁচিয়ে অন্যদের ডাকলাম। সকলে এতটাই আতঙ্কিত যে দেবদুলালদা জলের বোতলটাও হামাগুড়ি দিয়ে নিয়ে এল। বেশ কয়েকবার চোখে জলের ঝাপটা দেওয়ায় পর মিন্টুদা হাত তুলে আশ্বস্ত করল। আমাদের আর নিজেকেও। আমি মিন্টুদাকে ওদের জিম্মায় রেখে ছুটলাম মেসোমশাইকে দেখতে। নীচে এসে দেখলাম, মেসোমশাই একটা মোটা কাঠ ধরে চোখ বুজে বিড়বিড় করছেন। ইষ্টনাম জপ করছেন। কাছে গিয়ে আশ্বস্ত করলাম, ‘ভয় নেই। কিছু হবে না।’ মেসোমশাইকে চোখ বুজে শুয়ে পড়তে বললাম। আরও মিনিট তিরিশেক দোল খেতে খেতে এগিয়ে চললাম।

ভালয় ভালয় ঝড়খালি এলাম। আশোক খালি মেসোমশাইকে বলল, ‘দেখলেন তো, আমার লঞ্চ যদি সিক্স সিলিন্ডার না হতো তাহলে কী হতও?’ মেসোমশাই শুধু এটাই বললেন, ‘বাবা তোমাকে অনেক ধন্যবাদ আমাদের বাঁচিয়ে নিয়ে আসার জন্য।’

দুপুরে স্নান খাওয়া সেরে ফেরার পথ ধরলাম।

শেষ খবর। মিন্টুদা নাকি তার সদ্য উচ্চমাধ্যমিক দেওয়া ছেলেকে বলেছে, বাবা সুন্দরবন খুব সুন্দর জায়গা। কিন্তু আমি তোকে কোনওদিন যেতে দেব না!

শেষ……।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *