পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

কিসসা সিকিম কা—শেষ পর্ব

শ্রেয়সী সেন শর্মা

২ সেপ্টেম্বর

আবার জ্বর সারিয়ে, ফোনের ওপারে মায়ের আতঙ্ক মাখা আওয়াজ ঠেলে এবারের গন্তব্য ছাঙ্গু আর জুলুক (পূর্ব সিকিম)।

 রাস্তা প্রচণ্ড খারাপ। তার সঙ্গেই খবর পেলাম কোনও এক গাড়ি উল্টে আরও যানজট। মিলিটারিরা প্রচণ্ড ক্ষিপ্রতায় জট কাটাচ্ছে। ঠান্ডা বাড়ছে ধীরে ধীরে। শুরু হচ্ছে ঠান্ডা হাওয়া। গাছপালা কমছে। রঙিন ফুলের সমারোহ বাড়ছে। একটা সময় কফি আর ব্রেড ওমলেট ঠুসে ছাঙ্গু এসে পৌঁছলাম।

ছাঙ্গুর পথে।

চারিদিকে ঘন কুয়াশায় ঢাকা। কিন্তু ওরই মধ্যে কী সুন্দরী সব ফুলের বন। এইখানে নাকি এশিয়ার সবোর্চ্চ রোপওয়ে, ১২০০০ ফুট। আমার আবার উচ্চতা মাথা ঘুরিয়ে দেয়। তা সত্ত্বেও সাহস সম্বল করে উঠলাম, যাব ১৪০০০ ফুট পর্যন্ত। নীচে দেখছি উপত্যকা পুরো যেন ফুল দিয়ে সাজিয়ে আমাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। এই রোপওয়ে উপরে উঠে মিনিট পাঁচেক দাঁড়ায়।

ছাঙ্গু লেক আর আমি।

বেলা ১২ টা। লেকের জল কাঁচের মতো স্বচ্ছ, মাছ নির্ভয়ে খেলা করছে। পতপত করে রঙিন পতাকা উড়ছে। সঙ্গে ইয়াকের দল। পর্যটকেরা সব তাঁদের পিঠে চড়ার তোড়জোড় করছেন। ছাঙ্গু লেকে একদল তরুণের আগমন ঘটল। হঠাৎ করে কেউ কোথাও নেই, পোলাপানের দল জামা খুলে বাইসেপ প্রদর্শনী শুরু করল। খুব ইচ্ছে হল বলতে, মশাই এত ঠান্ডায় নিমুনিয়ার জন্য হাসপাতালের একটা সিট বুক করে এসেছেন তো? বলতে যাচ্ছিলাম, দুই বন্ধুর কটমটে দৃষ্টি দেখে কেমন চুপ মেরে গেলাম। আপাতত এক প্লেট চাউমিনের মতো কী একটা খেয়ে চললুম গাড়ি চেপে।

বাবার মন্দির।

এখানকার দোকানে দোকানে চুপড়ি ঝোলে। চুপড়ি খানিক ইয়াকের দুধ জমিয়ে পনিরের মালার মতো। খেতে অবশ্যই ভাল লাগবে না। এর পরের গন্তব্য নাথু লা, জুলুক, সিল্করুট। নাথু মানে কান, লা মানে পার্বত্য পথ। কুয়াশা, আর্মি পেরিয়ে প্রান্তর কেবল সবুজ ঘাসে ঢাকা। আমরা থামলাম বাবা হরভজন সিং এর মন্দিরে। ভারতের একমাত্র ভূত মন্দির। চিন বর্ডার কাছেই। হু-হু করে হাওয়া দিচ্ছে। যে আর্মি ভাইয়ের ডিউটি তাঁর বাড়ি নাকি কৃষ্ণনগরে। এক জেলার ইমোশনে বেশ গদগদ হয়ে অনেক গপ্পো করে ফেললাম। উনি বেশ খুশি হয়ে ভূত মন্দিরের প্রসাদ দিলেন, এক প্যাকেট কিসমিস। এ কিসমিস ন্যাতানো বাঙালি নয়, বরং পাহাড়িয়া শক্ত। ওই কিসমিসে ছ’মাসের আমসত্ত্ব চাটনি দিব্যি চলে।

এখানে মেঘ ইয়াকের মতো চরে।

এর পরে এখানে মেঘ গাভীর মতো চরে। নাথুলা হয়ে জুলুক যাওয়ার রাস্তায় প্রাচীন রেশম পথ পড়ে। কথিত, বাংলাদেশের রেশম নাকি চিনে পাড়ি দিত এক কালে এই রাস্তায়। ফুলের দল, ইয়াক, ইয়াক পালক, অজস্র পরিত্যক্ত বা্ঙ্কার অনেক যুদ্ধের কাহিনী নীরবে বলে যায়। ফদমচেন হয়ে কেনজোলা হোমস্টে, রাত্রিবাস এবং ডিনারে কষা চিকেন খেয়ে একটা বাঙালি ঘুম।

প্রাচীন রেশম পথ।

৩ সেপ্টেম্বর

সকালে আজ গ্যাংটক ফেরা। ঘাস কুমারী আর কুমারী (পড়ুন এদের আরাধ্য গাছ) হেব্বি ক্লান্ত, কারণ প্রচুর খাটনি গেছে ওঁদের। নীড়ে ফেরা পাখিদের মতো ফিরলাম আমাদের চারতলার কুঠুরিতে। এর পর একদিন বিশ্রাম নিয়ে পরশুদিন লাচুং। তবে ধসের জন্য লাচেন আর গুরুদোংমারের রাস্তা বন্ধ। আর সেখানে নাকি অন্য গাড়ি, নতুন ড্রাইভার।

পাহাড়ি পথের শোভা।

৫ সেপ্টেম্বর

সকাল সকাল সুমোতে উঠে বসলাম, কিছু দূর না যেতেই, গাড়ি খারাপ। ড্রাইভার বদল হয়ে গেল। পথে পড়ল নিমাচেন খোলা ফলস। একটা সময় শুরু হল দারুণ বৃষ্টি। এপাশ ওপাশ ঝাপসা। তার মধ্যে দুই স্কুল ফেরত কুচো দেখি বৃষ্টি ভিজেছে। গাড়িতে তুলে তাদের লজেন্স দেওয়ায় এক ফোকলা নিষ্পাপ হাসি। লাচুংয়ে যাওয়ার পথে সব জলের বোতল জমা হয়ে গেল। জল পিপাসা পেলে জানি না কী করব। লাচুং প্লাস্টিক ফ্রি জোন। যা হোক করে লাচুংয়ে প্রবেশ করলাম। বিকেল বেলা হয়ে গেল। আমাদের নতুন চালক বড় হুড়োহুড়ি গাড়ি চালায় এবং তার ভাব গতিক আমার ভাল লাগেনি। পথে পড়ল অনেক নাম না জানা বাঁধ, টানেল, আর ব্লু পাইন। লাচুংয়ে সব নীচের থেকে সরবরাহ আসে, সরবরাহ না আসলে খাওয়া নেই কপালে নাকি। যা হোক করে সে রাতে ডিমের ঝোল ভাতে কাজ চালালাম।

ইয়ুমথাং।

৬ সেপ্টেম্বর

পরের দিন সকাল ৬টায় রওনা দিলাম। না হলে বেলায় কুয়াশায় কিছু দেখতে পাব না। এবার ইয়ুমথাং যাওয়ার পথে অসাধারণ একটা রডোডেনড্রনের বন পড়ে। এর আদর্শ সময় নাকি এপ্রিলে। খারাপ রাস্তা খুব, শরীরে আর কলকব্জা কিছু আস্ত নেই। ইয়ুমথাংয়ে পৌঁছে জ্যাম রুটি জুটল। আশেপাশে অসাধারণ পাইন বনের সারি আর লাইকেনের ঝুরি। ইয়ুমথাং থেকে জিরো পয়েন্ট। জিরো পয়েন্ট যাওয়ার পথে পড়ে সিকিম সুন্দরীর দল (Rheum nobile)। যে পাহাড়ে মানুষের পা পড়েনি সেখানে এরা দল বেঁধে জটলা করেছে।

জিরো পয়েন্ট।

অবশেষে জিরো পয়েন্ট, কনকনে ঠান্ডা। কুয়াশার চোটে কেবল এক ঝলক তিস্তার হিমবাহ দেখতে পেলাম। বেলা দশটার মধ্যে ওখানকার দোকানিরা পাট উঠিয়ে টুরিস্ট গাড়ি করে লাচুং ফেরে। এরকম তিনজন উঠলেন, ফিরবেন আমাদের সঙ্গে। এবার ইয়ুমথাং, খরস্রোতা তিস্তা আর একটা একলা সবুজ বেঞ্চ। ভ্যালি অব ফ্লাওয়ারস বলা হয় একে। এর পাশেই এক উষ্ণ প্রস্রবণ আছে। একটি সেতু পেরিয়ে যেতে হয় তাতে। ওই ইয়ুমথাং থেকেও আরও চারজন উঠলেন। যখন লাচুং পৌঁছলাম আমাদের সব আরাধ্য দেবতারা চিড়ে চ্যাপ্টা। আগুন মাথায় গটমট করে ঘরে ঢুকে গেলাম। আর আমাদের ড্রাইভার কারণবারি সেবন করে কোথায় পালাল জানা নেই। রাতের খাবার শেষে আমরা স্লিপিং ব্যাগে। এমন সময় দরজায় ধাক্কা দুমদাম, আর চিৎকার।পড়ে বুঝলাম পাশের ঘরে কয়েকজন মাতালের আবির্ভাব ঘটেছে। তারাই দরজা ভুল করেছে। অবশ্যই বাঙালি মাতাল। ভয়ে কাঁটা হয়ে সারা রাত আর তিনজনের চোখে ঘুম আসেনি।

ফুলের মেলা।

৭ সেপ্টেম্বর

ভোরেই বেরবো মনস্থির করলাম। আমাদের ড্রাইভার কান এঁটো করা হাসি হেসে গাড়ি শুরু করল। ব্যাস একবার করে গাড়ি থামায়। মদ খেয়ে আসে আর লোক তোলে গাড়িতে। আমরা এতটাই অসহায় ছিলাম উপরন্তু তিনদিন কোনও নেটওয়ার্ক ছিল না। যা হোক করে গ্যাংটক ফেরা হল। একরাশ তিক্ততা নিয়ে গাড়ির মালিককে নালিশ করা হয়েছিল। দেরি হওয়াতে কিছু কাজই হয়নি।

তিস্তার জন্মভূমি।

৮ সেপ্টেম্বর

ফিরছি বাড়ির পানে। ফিরছি নিজের ঘরে। যে ঘরের প্রতিটা কোণা প্রিয়। পিছনে থাকলো তিন সপ্তাহের দুর্দম কিছু সময়।

কভারের ছবি— সিকিম সুন্দরী

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *