জঙ্গল যাপন পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

চণ্ডীদাসের ছাতনা থেকে যমধারার জঙ্গলে— যমদুয়ার পর্ব

দীপক দাস

সন্ধেবেলায় পাহাড়ে ঢোকার মোড়টা একটু জমজমাট হয়। ঠেলা গাড়িতে করে নানা খাবারের পসরা। টুকিটাকি এটাওটা। আমরা আটকে গেলুম খাবারের ঠেলাতেই। চিংড়ির চপ বিক্রি হচ্ছিল। চপের এক প্রান্ত দিয়ে বেরিয়ে রয়েছে চিংড়ির লেজটা। লেজেই মালুম দেহটা বেশ নধর হবে। ইন্দ্র অনেকক্ষণ থেকেই ‘একটা টেস্ট করবে নাকি’ বলে ঘ্যানঘ্যান করছিল। কেনা হল। খাওয়া হল। কিন্তু চিংড়ির নধর বা অপুষ্ট কোনও দেহই খুঁজে পাওয়া গেল না। চপে শুধু লেজটাই লাগানো। সেটা নাড়িয়েই চপগুলো খদ্দের ডাকে।

আরণ্যক গেস্ট হাউসে রান্নার ব্যবস্থা নেই। এদিকে এখানে ভাল দোকান নেই। দুপুরবেলা যেখানে দু’মুঠো জুটেছিল তাকেই রুটির কথা হয়েছিল। সে কী রান্না। সয়াবিনের তরকারি আর ডিমের কালিয়া। সয়াবিনগুলোকে বোধহয় ব্লেড দিয়ে কেটে আলুর সঙ্গে রেঁধেছে। ভাগ্য ভাল থাকায় দু’এক টুকরো মিলল। আর কালিয়া? সেটাকে লালিয়া বলাই ভাল। শুধু লঙ্কার গুঁড়ো নুন আর জল দিয়ে নাড়া। ডিমটা ধুয়ে খেতে পারলে ভাল হতো। কোনও মতে খেয়ে নিয়ে গেস্ট হাউসে ফিরে অল্প গল্পগুজব। পরের দিনের পরিকল্পনাটা সেরে নেওয়া হল। যাব বিহারীনাথ। সেখান থেকে ফিরে সময় থাকলে যমধারার জঙ্গল। সকালে একটা বাস আছে। গেস্ট হাউসের সামনে পিছনের রাস্তা দিয়েই যাবে। তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়লাম।…

গেস্ট হাউসের সামনে ভেজা রাস্তা।

সকালে উঠে মনটা ভাল হয়ে গেল। রাতে বৃষ্টি হয়েছে। আমি টের পাইনি। অফিসে আগের দিন নাইট ছিল। সারাদিন এই ধকল। এক ঘুমে সকাল। ইন্দ্ররা ছবি তুলতে বেরিয়েছে। আমি ব্রাশ হাতে করে হাঁটতে বেরলাম। ভেজা পিচ রাস্তা সোজ চলে গিয়েছে। ভেজা জঙ্গল। পাখির ডাক আসছে। দু’একটা লোক সাইকেলে মাঝে মাঝে যাচ্ছে, আসছে। সেই নির্জন সকালে অন্যরকম অনুভূতি। গেস্ট হাউসের কিছু দূরে একটা নির্মাণকাজ চলছে। পরে জানলাম, ওটা ইউথ হস্টেল। তার মানে লোক সমাগম বাড়বে। তা বাড়ুক। এলাকার চরিত্র নষ্ট না করলেই হল।

তৈরি হয়ে নিয়ে গেস্ট হাউসের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে গল্পগুজব করছিলাম। বাস এসে গেল। সকালের ফাঁকা বাস। ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসা গেল। আমাদের পোটলাপুটলি দেখে এক যাত্রী ঠিক বুঝে গেলেন আমরা ‘ট্যুরিস্ট’। শুরু হল তাঁর গল্প। সে গল্পের বেশির ভাগটাই একটা আন্দোলন নিয়ে। শুশুনিয়ার পাদদেশে যে ঝরনাটার কথা বলেছিলাম সেটি নাকি কেনার চেষ্টা করেছিল কোনও সংস্থা। বোতলে করে বিক্রি করবে বলে। জলের যেহেতু গুণ রয়েছে আর তোলার খরচ নেই, তাতে লাভও হবে দ্বিগুণ। এই ভদ্রলোকেরাই নাকি আন্দোলন করে প্রকৃতির সেই সম্পদ চুরি ঠেকিয়েছেন। বোতল বন্দি জলের ব্যবসা নিয়ে সারা দুনিয়াতেই নানা কথা শোনা যায়। কোন দেশে নাকি একটা নদীই বিক্রি করে দেওয়া হয়েছিল বহুজাতিক সংস্থার কাছে। দুনিয়াটা যে ব্যবসায়ীরাই নিয়ন্ত্রণ করছেন, সেটা অনেক দিন আগেই টের পাওয়া গিয়েছিল।…

বিহারীনাথের পথে। জঙ্গলে রুটি রুজির সন্ধানে বাসিন্দারা

বাস থেকে কোথাকার একটা মোড়ে যেন নেমেছিলাম। এখন আর মনে করতে পারি না। শালতোড়া পেরিয়ে সম্ভবত। একটা মোড়। অল্প বাজার, দোকান। একটা পুজো হচ্ছিল। এইটুকু মনে আছে। বাজারওলার কাছে নতুন ধরনের একটা সবজি দেখেছিলাম। শিম জাতীয়। দোকানদার নামও বলেছিলেন। কিন্তু সেটাও ভুলে মেরেছি। ওই মোড় থেকে অটো ধরে বিহারীনাথ। অটোওয়ালা দারুণ মানুষ। কত গল্প বললেন। আদিবাসীদের গল্প। তাদের শিকারের গল্প। আর সেই সঙ্গে ভয়ও দেখালেন। এই জঙ্গলে খরগোশ, হরিণ আর বুনো শুয়োর আছে। একেকটা শুয়োর নাকি এক কুইন্টালের বেশি ওজন।

গল্প শুনে আমাদের দলে দু’রকম প্রতিক্রিয়া হল। মেজো ভাই হেব্বি খুশি হরিণ দেখতে পাবে বলে। পাহাড় চড়া থেকে শুরু করে ও হরিণের চিহ্ন দেখতে পেল সর্বত্র। ওঠার মুখেই হঠাৎ ‘এই তো এই তো’ বলে এগিয়ে গেল। সবাই উৎসুক। কী রে? রহস্য গলায় মেজোর উত্তর, হরিণগুলো এখানে এসেছিল। কী করে বুঝল? ও বলল, ‘এই দেখ।’ কাছে গিয়ে দেখি, কতগুলো নাদি। সবাই মিলে রে রে করে তাড়া করতে ও ওপরে উঠতে শুরু করে দিল। বন জঙ্গল কাঁটা সরিয়ে কয়েক ধাপ ওপরে উঠেছি, বাবলা এবার গম্ভীর। বলল, ‘আর ওপরে ওঠা ঠিক হবে না।’ কেন রে? বাবলার উত্তর, ‘শুনলে না, অটোওলা কী বলল? এক কুইন্টাল ওজনের শুয়োর। তেড়ে এসে যদি গোঁত্তা মারে গড়িয়ে একদম নীচে।’ বাবলাকে চিরকাল ডাকাবুকো বলে চিনি। ওর এরকম রূপ দেখে আমিও গম্ভীর গলায় বললাম, ‘তাছাড়া যদি দাঁতাল হয় তো আরও খারাপ হবে।’ সবাই জিজ্ঞাসার দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে। বললাম, ‘আরে ওদের ভাই বেরাদরদের যেভাবে লোহার রড গরম করে…মারি! এই পাহাড়ের জঙ্গলে এত মানুষকে পেয়ে ওরাও প্রতিশোধ নিতে পারে। পিছন থেকে দৌড়ে এসে দাঁত জায়গা মতো…।’ বাবলা নীচে নামবে বলে ঘ্যানঘ্যান শুরু করল।

চারমূর্তি।

জঙ্গল মাকড়সার জাল সরিয়ে নীচে নেমে এলাম বটে। কিন্তু তার আগে খুঁজে পেয়ে গেলাম একটা চিঠি। একটা পাথরের ওপরে ছোট্ট একটা পাথর দিয়ে চাপা ছিল। একটা মেয়ের লেখা চিঠি। চিঠির আদ্যোপান্ত জোরে জোরে পড়লাম। কী আকূতি ভরা। এতই তার প্রাবল্য যে কোনও কোনও জায়গায় সেন্সর করা সিনেমার সংলাপের মতো টুই টুই করে মুখে আওয়াজ করতে হল। চিঠিটা কোনও মেয়ের লেখা! নাকি কোনও বদ ছেলের? তবে ভাষার বাঁধুনি ছিল।

বিহারীনাথ জায়গাটা একটা মন্দিরের নামে। পাহাড়ের কোলে মন্দিরটা বেশ। কিন্তু দেবতারা আমাদের টানে না। আমরা মন্দিরে ঢুকি গল্প শোনার জন্য। কিন্তু গল্প শুনব কার থেকে? মন্দিরে তখন বাচ্চা একটা ছেলে পুরোহিত। অতি নাবালক। বাবলা বলল, ছোটা পণ্ডিত। ভুলভুলাইয়ার রাজপাল যাদব। মন্দিরের সামনের দোকানে খাওয়াদাওয়া সারলাম। বিহারীনাথ আমাদের কাছে অনেক কারণে স্মরণীয়। এক, বাবলার ভিতু রূপ। দুই, মেজোর হরিণ, তিন সেই চিঠি পাঠ। চার, এখানেই আবিষ্কার হয়েছিল কাঁচিকল শব্দটার। আমাদের পয়সা কম। তাই খাওয়ার সময়ে মেজো একটু বুঝেশুনে খাচ্ছিল। কৃষ্ণ বলল, ‘ইচ্ছে হলে খেয়ে নাও যা খুশি। খরচ তো সবই কাঁচিকলে পড়বে।’ অর্থাৎ, খাও আর নাই খাও। টাকা তোমাকে সমানই দিতে হবে। কৃষ্ণর ওই বুদ্ধি থেকে আমাদেরও একটা বুদ্ধি গজাল। সফরে নিয়ম করে দেওয়া হল, আলাদা করে কেউ কিছু খেতে পারবে না। যা খাবে সকলে একইরকম খাবে। ও হ্যাঁ বিহারীনাথ আরেকটা কারণে বিখ্যাত আমার ঝোপ খোঁজা। সেই রাতের লাল রঙের ডিমের কালিয়া। নিম্ন উদরে তারা ভীষণ গোলযোগ শুরু করেছিল। প্রবল ছুটে রাস্তার পাশে জলাশয়ের পাড়ে। বিহারীনাথের রূপও আমাদের মনে আছে। ঘন সবুজ পাহাড়। কাছে পাহাড়। পাথুরে রাস্তা, পাশের জঙ্গল সব।…

এই সেই যমধারা।

বাসে বাঁকুড়া ফিরছি। বন্ধু জয়ন্ত বলে দিয়েছিল যমধারার জঙ্গলের কথা। চন্দ্রশর্মার শিলালিপি রয়েছে। না দেখেই ফিরে যাবে। আরণ্যক গেস্ট হাউসের সামনে আবার নেমে পড়লাম। ৫০ টাকার বিনিময়ে ব্যাগ জমা রাখা হল ম্যানেজার তাপসদার কাছে। তারপর গাড়ি ভাড়া করে সোজা যমধারা।

বেশ সুন্দর জায়গা। একেবারে নির্জন। গাড়িতে যেতে যেতে দু’টো তিতির পাখি দেখলাম। তাতেই কী আনন্দ। শুশুনিয়ার মতো এখানেও একটা জলধারা রয়েছে। কিন্তু কেন যে সেই ধারার নাম যমধারা কে জানে। সকলে মিলে হাঁফাতে হাঁপাতে উঠলাম চন্দ্রশর্মার শিলালিপির কাছে। এখানেও মেজো আর বাবলার জয় হল। ইন্দ্র অবশ্য ততক্ষণে ক্ষান্ত দিয়েছে। নীচের দিকে তাকিয়ে ওর নাকি মাথা ঘুরে গিয়েছিল। তাতে সবার কী হাসি। ব্ল্যাকবেল্টধারীর এই অবস্থা।

রাজা চন্দ্রশর্মার শিলালিপি।

চন্দ্রশর্মার শিলালিপির ওপর থেকে দারুণ লাগছিল এলাকাটা। এত ভাল লেগে গিয়েছিল জায়গাটা। পরে আমাদের যমধারা সফর নিয়ে একটা অ্যাডভেঞ্চারধর্মী নভেলা লিখেছিলাম। গল্পের চরিত্র? আমরাই। নতুন যোগ হয়েছিল, দীপু আর শুভ। অতিথি শিল্পী হিসেবে আনা হয়েছিল কচি আর ঋতুপর্ণাকে। যাকে বলে চিত্রনাট্যের প্রয়োজনে।

ছবি— একমাত্র ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত) 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *