বিশালাক্ষী মন্দির
ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

ডাকাতে কালীর মন্দির পেরিয়ে পলতাগড়

দীপক দাস

সিংহপুর। নামটা শুনলেই কেমন যেন একটা সম্ভ্রম জাগে। ইতিহাসের সূত্র ধরলে সিংহপুরের পথেই পড়বে বিজয় সিংহ, সিংহল দ্বীপ ইত্যাদি ঐতিহাসিক মোড়গুলো। এ পথে যাত্রার প্রস্তুতিতে একটা আলাদা আকর্ষণ তৈরি হবে, যদি আর পাঁচজনকে জানানো যায়।

কিন্তু লোকজনকে যদি বলি, আমরা সিঙ্গুর অভিযানের প্রস্তুতি নিচ্ছি তাহলে নানা প্রতিক্রিয়া হয়। ডান, বাম, মধ্যপন্থী প্রতিক্রিয়া। সেসব প্রতিক্রিয়া পাশে রেখেই সিঙ্গুর যাত্রা শুরু হল। অন্য কারণে বর্তমানে বিখ্যাত হওয়া জায়গাটির অন্য ইতিহাসও যে আছে। সে সবের সন্ধানেই পথে নামা। যা দেখব তার একটা তালিকা করে নিয়েছিলাম। ডাকাতে কালী মন্দির, বন বিশালাক্ষীর মন্দির, একটি মনসামূর্তি। আর যদি নতুন কিছু পাওয়া যায়।

ডাকাতে কালী মন্দিরের এলাকা।

হাওড়া জেলার পাতিহাল থেকে সিঙ্গুর ঘণ্টাখানেকের পথ। দুই বাইকে সঙ্গী ইন্দ্র আর দীপুকে নিয়ে পৌঁছতে বেশিক্ষণ সময় লাগল না। ডাকাতে কালী মন্দিরটা পুরুষোত্তমপুরে। সিঙ্গুর বাজার ফেলে কিছুটা যেতে হয়। রাস্তার পাশেই মন্দির। অনেকটা জায়গা জুড়ে। পাঁচিল ঘেরা মন্দির চত্বর। বিশাল নাটমন্দির। পুরো চত্বর বালি-সিমেন্টের মিশ্রণে বাঁধানো। দেবীর ভক্ত আছে, দেখেই বোঝা যায়। কিন্তু মন্দির দেখে আমাদের মন খারাপ হয়ে গেল। একসময়ে মন্দিরের গায়ে টেরাকোটার কাজ ছিল। অলংকরণগুলো হয় নষ্ট হয়ে গিয়েছে। নয় চুরি হয়েছে। যেটুকু ছিল সেসব মন্দির সংস্কারের সময়ে রংয়ে এবং প্লাস্টারে ঢাকা পড়েছে। তবে মন্দিরের নতুন প্রবেশপথের দু’পাশে কয়েকটি স্তম্ভে কিছু পোড়ামাটির অলংকরণ দেখা যায়। এগুলো নতুন করে তৈরি করে সংরক্ষণ করা হয়েছে মনে হয়।

ডাকাতে কালী মন্দিরের গায়ে টেরাকোটা অলংকারের এই হাল।

কবেকার তৈরি মন্দির সে তথ্য মিলল না। যেমন মিলল না এই মন্দিরের প্রতিষ্ঠাতা গগন ডাকাতের কেরামতির কোনও কাহিনি। বইপত্র ঘেঁটে কিছু তথ্য মিলল যা থেকে মন্দির প্রতিষ্ঠার সাল বিষয়ে আন্দাজ মেলে। হুগলি জেলা এক সময়ে ডাকাতির জন্য কুখ্যাত ছিল। বহু ডাকাতের নাম শোনা যায়। তাদের কার্যকলাপও ভয়ঙ্কর। কালীর কাছে নরবলি দেওয়া হত বলেও ইতিহাসকারেরা লিখছেন। ডুমুরদহের বিশ্বনাথ রায় বা বিশে ডাকাত তো কিংবদন্তী। সিঙ্গুরের নামও ডাকাতিতে কুখ্যাত ছিল। সিঙ্গুরের ‘বাবুরা’ অর্থাৎ জমিদারেরাও ডাকাত দল রাখত। এমন এক কুখ্যাত বাবু ছিল নবাব বাবু। এর প্রকৃত নাম শ্রীনাথ রায়। বাবা-মায়ের চতুর্থ সন্তান ছিল। তাই তাকে ন’বাবু বলে ডাকা হত। তা থেকেই নবাব বাবু নাম হয়। বাবুয়ানাও ছিল তার যথেষ্ট। ব্রিটিশ আমলে ডাকাতদের অত্যাচার থেকে জেলাবাসীকে বাঁচাতে ডাকাতি কমিশন প্রতিষ্ঠা করা হয়। সিঙ্গুরের এক দুর্ধর্ষ ডাকাত হল গগন সর্দার। সারা হুগলির জেলার ত্রাস ছিল সে। পুরুষোত্তমপুরের এই ডাকাত কালীর মন্দিরটি গগন সর্দারের প্রতিষ্ঠিত বলে শোনা যায়। আঠারো-উনিশ শতকের কোনও এক সময়ে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল সম্ভবত।

ডাকাতে কালী

এখানে একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। সুধীরকুমার মিত্র লিখেছেন, গগন ডাকাতের ডাকাতে কালীর মন্দির মল্লিকপুরে। বিনয় ঘোষও তা-ই লিখেছেন। আমরা যেদিন গিয়েছিলাম সেদিন নাটমন্দিরে স্থানীয় এক প্রৌঢ় বসেছিলেন। খালি গা, লুঙ্গি পরিহিত। তিনি বললেন, মন্দিরটি আসলে পুরুষোত্তমপুরে। মল্লিকপুর এর পাশের গ্রাম। আমরাও দেখলাম, মন্দির চত্বরে এলাকার নাম হিসেবে পুরুষোত্তমপুরই লেখা আছে।

পুরুষোত্তমপুরেই আছে বিশালাক্ষীর মন্দির। ডাকাতে কালীর মন্দির থেকে কিছুটা এগিয়ে যেতে হয়। আমরা প্রথমে খুঁজে পাইনি মন্দিরটি। কিছুটা এগিয়ে গিয়েছিলাম। জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম, মন্দির ফেলে চলে এসেছি আমরা। তখন বিকেল ৩টের বেশি বাজে। খিদে পেয়ে গিয়েছে। রাস্তার পাশেই একটা হোটেল ছিল। ছিমছাম হোটেল। চারিদিকে গাছপালায় ভরা। তিনজনে মাছ ভাত খেলাম। বিল হল মাত্র ১৭০ টাকা। হোটেল মালিককে জিজ্ঞাসা করেই জেনে নিলাম মন্দিরের অবস্থান।

মন্দিরের প্রবেশপথের সামনে এরকম অলংকরণ রয়েছে।

পুরুষোত্তমপুরের যে সড়কটি গিয়ে জাতীয় সড়কের সঙ্গে মিশেছে বিশালাক্ষী মন্দির সেই রাস্তার পাশেই। একেবারেই ভাঙাচোরা মন্দির। চুড়োয় গাছের জঙ্গল গজিয়েছে। ধসে পড়েছে মন্দিরের বাঁদিকটা। এখন শুধু চোখ টানে টেরাকোটার অবশিষ্ট অলংকরণগুলো। রামায়ণের নানা কাহিনি প্যানেল জুড়ে। আরও প্যানেল ছিল। সে সব ভেঙে পড়েছে। সে জায়গায় বালি-সিমেন্টের প্রলেপ। মন্দিরের প্রতিষ্ঠা প্যানেলটি এখনও রয়েছে। তাতে লেখা ১১৩৮ বঙ্গাব্দ। ২৯১ বছরের পুরনো মন্দির। ওই প্যানেলে আরও কতকগুলো সংখ্যা রয়েছে। এগুলো হল, ১৬৬২। এটি সম্ভবত শকাব্দ। সংখ্যাগুলো খ্রিস্টাব্দে রূপান্তরিত করলে দাঁড়ায় ১৭৪০। তাতে আবার বঙ্গাব্দ অনুযায়ী মন্দিরের প্রতিষ্ঠা কাল ১০ বছর কমে যাচ্ছে।

এত পুরনো মন্দির, সারানো হয় না কেন? কাকে জিজ্ঞাসা করি? মন্দিরের সামনে একটা নলকূপ ছিল। জল নিচ্ছিলেন এক বৃদ্ধ। তিনি বললেন, ‘‘মা চায় না মন্দির সারানো হোক।’’ এ আবার কী কথা! ভাঙা বাড়িতে কে বাস করতে চান? বাধ্য না হলে! আমরা ঘোরাঘুরিতে বহু মন্দির পেয়েছি সেগুলো তৈরির পিছনে স্বপ্নাদেশ কাজ করেছে। দেব-দেবীরা কাউকে না কাউকে স্বপ্নে মন্দির তৈরির কথা জানিয়েছেন। এখানে তো শুনছি উল্টো বিষয়। বৃদ্ধ বলে চললেন, ‘‘একবার সারানোর চেষ্টা হয়েছিল। কিন্তু নানা বিপদ হয়েছিল।’’ কী বিপদ আর জিজ্ঞাসা করিনি। বিপদ থেকে দূরে থাকাই ভাল।

বিশালাক্ষী মন্দির
পলতাগড়ের বিশালাক্ষী মন্দির। পাশে পরিত্যক্ত কারখানা।

বিশালাক্ষী মন্দির চত্বরে বিস্ময়ের অনেক কিছুই ছিল। মন্দিরের ঠিক সামনেই একটা চালা মতো। বাঁধানো তবে চারিদিকে খোলা। অনেকটা আটচালার মতো। চাল পাকা নয়। টিনের ছাউনি দেখেছিলাম মনে হয়। কতকগুলো লোক বসে, শুয়ে আছেন আটচালায়। রান্নার হাঁড়ি কড়াইও দেখলাম। যেরকম ডেকরেটার্স থেকে ভাড়া পাওয়া যায়। চালার মাথায় লেখা আছে, এটি তারকেশ্বর তীর্থযাত্রীদের জন্য বিশ্রামাগার। দেখে রোমাঞ্চ হল। মনে হল, যেন মধ্যযুগের কোনও সরাইখানার সামনে দাঁড়িয়ে আছি। কিংবা ধর্মশালা বা চটি। এ পথেই তারকেশ্বর পড়ে। আধুনিক এই ধর্মশালায় আশ্রয় নেওয়া এক ভক্তকে জিজ্ঞাসা করলাম ব্যাপারটা। উনি বললেন, এই পথ দিয়েই যেতে হয় তারকেশ্বর। এটা তীর্থযাত্রীদের জন্য তৈরি। ওঁরা বাগুইহাটি থেকে আসছেন। প্রায়ই আসেন। এখানকার এক ডেকরেটার্সের সঙ্গে যোগাযোগ আছে। ফোন করে দিলে তিনি হাঁড়ি, কড়াই পৌঁছে দেন এখানে। তীর্থযাত্রীরা নিজেই রান্না করে খান।

আরেক বিস্ময়ের সন্ধান পেলাম, সেই পূর্বের বৃদ্ধের থেকে। বিশালাক্ষী মন্দির আর বিশ্রামাগারের এক পাশে বিশাল একটা লোহা-টিনের পরিত্যক্ত কাঠামো। দেখেই মনে হয়, কোনও কারখানা ছিল। কীসের কারখানা ছিল? বৃদ্ধ বললেন, ‘‘আলুর ময়দা তৈরি হত।’’ বন্ধ হল কেন? বৃদ্ধ চোখ বড় বড় করে বললেন, ‘‘মা (বিশালাক্ষী) চাননি।’’ আপত্তি কেন মায়ের? বৃদ্ধের কথা অনুযায়ী, ওদিকেই ছিল মায়ের স্নানে যাওয়ার পথ। কারখানা সেই পথ আটকেছিল। তাই মায়ের কোপে পড়ে। মালিক পুজোটুজো দিয়ে অনেক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু কারখানা বন্ধ হয়ে যায়। আমরা পরস্পরের দিকে তাকালাম। তার পর বিড়বিড় করে বললাম, ‘‘সিঙ্গুরে কারখানা দেবী বা মানবী কেউই চান না দেখছি!’’

পলতাগড়ের মনসামূর্তি। শিল্পের স্নিগ্ধতায় মূর্তিটি দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

সিঙ্গুর সফরে আমরা গিয়েছিলাম পলতাগড়েও। ফেরার পথে। এই গ্রামে রয়েছে একটি প্রাচীন মনসামূর্তি। কষ্টিপাথরের অনন্য সুন্দর মূর্তি। কতদিনের মূর্তি জানা যায় না। তবে চতুর্দশ বা পঞ্চদশ শতাব্দীতে মূর্তিটি তৈরি ও প্রতিষ্ঠা হয়েছিল বলে অনুমান। কারও মত, একাদশ-দ্বাদশ শতকের মূর্তি। হুগলি জেলার কোথাও মূর্তিটি ছিল। হারিয়েও যায় একসময়ে। ১২৯৯ বঙ্গাব্দে তা আবার পাওয়া যায় চালকেবাটির মোড়ল পুকুরে।

এত সুন্দর ও দীর্ঘ সময়ের ইতিহাস নিয়ে মনসা মূর্তিটি রয়েছে একটি সাধারণ মন্দিরে। একদমই ছোটখাট মন্দির। আমরা পলতাগড় গিয়ে পেয়েছিলাম নিমাই দে-কে। মন্দিরের উল্টো দিকে রাস্তার পাশে সাইকেল সারাইয়ের দোকানে বসেছিলেন তিনি। নিমাইবাবু জানালেন, আগে মন্দির ছিল না। একটা বিশাল বটগাছের নীচে মূর্তিটি বসানো ছিল। দেবস্থান দেখাশোনা করতেন বর্মণরা। তাঁরা জমিদার ছিলেন। এখন আর তাঁরা গ্রামে নেই। পরে ঝড়ে নষ্ট হয়ে যায় বটগাছটি। নিমাইবাবুর দাবি, স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন এক ব্যক্তি। তিনি মন্দিরটি তৈরি করে দেন।

মন্দিরটি কে তৈরি করে দিয়েছিলেন? ‘রূপশালী’ পত্রিকার সম্পাদক রূপক সামন্ত জানাচ্ছেন, অপূর্বপুরের বাসিন্দা কাশীপুর গান-শেল ফ্যাক্টরির কর্মী স্বপন বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্ত্রী স্বপ্নাদেশ পেয়েছিলেন। ১৩৮৯ বঙ্গাব্দে তিনি মন্দিরটি তৈরি করে দেন। যখন খোলা জায়গায় পড়েছিল তখন নাকি এক সাধু একবার মূর্তিটি নিয়ে চলে যাওয়ার চেষ্টা করেন। কিন্তু গ্রামবাসীদের বাধায় তা হয়নি। নিমাইবাবু জানালেন, ভাদ্র মাসে বিশ্বকর্মা পুজোর পরে তিন-চার দিন ধরে পুজো হয়।

পলতাগড়ের মনসা মন্দির।

পলতাগড়ে কিন্তু ধমক খেয়েছিলাম বেশ। মনসা মূর্তির ছবি তুলছে দীপু। ইন্দ্র দাঁড়িয়ে তদারক করছে। আর আমি নিমাইবাবুর সঙ্গে কথা বলছি। এমন সময় আবিভূর্ত হলেন এক ভদ্রমহিলা। সরাসরি প্রশ্নবাণ হানলেন, ‘‘আপনারা কি গবেষক?’’ প্রবল ভাবে অস্বীকার করে উত্তর দিলাম, ‘‘না না আমরা ঘুরে ঘুরে দেখি।’’ পাল্টা প্রশ্ন এল, ‘‘শুধুই দেখেন? নিশ্চয় ছবিটবিও পোস্ট করেন?’’ বুঝলাম, উনি ফেসবুকে পোস্ট করার কথা বলছেন। স্বীকার করলাম ‘‘তা করি। একটু লিখে রাখি ঘোরার স্মৃতি হিসেবে।’’ ভদ্রমহিলা রাগত স্বরে পরামর্শ দিলেন, ‘‘এসব একদম ঠিক নয়। লেখালেখি করলে মূর্তিটা চুরি হয়ে যেতে পারে।’’ মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলাম, ‘‘আমাদের বহু বছর আগে থেকেই তো লেখালেখি হচ্ছে। চুরি তো হয়নি।’’ উনি কোনও কথা শুনলেন না। স্কুটি হাঁকিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আমরাও কিছুক্ষণের মধ্যে ফেরার পথ ধরলাম।

ইতিহাসে পড়েছিলাম, সিঙ্গুরে চিত্রকরেরা নানারকম ছবি আঁকা হাত পাখা তৈরি করতেন। অনেক খুঁজলাম। অনেক লোকজনকে জিজ্ঞাসা করলাম। কিন্তু সন্ধান দিতে পারলেন না কেউই।

তথ্যসূত্র: ১। হুগলি জেলার ইতিহাস ও বঙ্গসমাজ— সুধীরকুমার মিত্র, ২। পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতি— বিনয় ঘোষ, ৩। পলতাগড়ের অনিন্দ্যসুন্দর মনসামূর্তি— রূপক সামন্ত

কভারের ছবি— বিশালাক্ষী মন্দির।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *