পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

নাস্তিকের অমরনাথ দর্শন

ইন্দ্রজিৎ সাউ

ধড়াম করে আওয়াজ আর জোরে ঝাঁকুনি দিয়ে গাড়িটা আস্তে হতেই সকলে সম্বিত ফিরে পেলাম। গল্পে মশগুল ছিলাম এতক্ষণ। সুব্রত সামনের সিটে। ও জানাল, দু’টো গরু রাস্তার পাশে ছিল। একটা রাস্তা পেরিয়ে যায়। অন্যটা দাঁড়িয়েই ছিল। গাড়ি সামনাসামনি আসতেই ঘুরে রাস্তার দিকে চলে আসে। ফলে ধড়াম। তখন সবে আমরা সন্তোষপুর আর দু’নম্বর সেতুর মাঝামাঝি। জায়গাটা হাওড়ায়। আর আমাদের বাড়ি থেকে মাত্রই কয়েক কিলোমিটার। শুরুতেই বিপত্তি।

কী করব ভাবছি। ইতিমধ্যে অন্য গরুটি ফিরে এসেছে। দুর্ঘটনাগ্রস্ত গরুটির মুখ শুঁকে কানে কানে কী যেন বলল। গরুটি সঙ্গে সঙ্গে উঠে দাঁড়াল। আমরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম। সকাল ৭টা তখন। জুলাই মাসের দশ তারিখ, ২০১৫ সাল। কলকাতা স্টেশন থেকে সকাল ১১.৪৫ মিনিটে জম্মু-তাওয়াই এক্সপ্রেস। ট্রেনের নাম শুনে নিশ্চই বুঝতে পারছেন আমাদের গন্তব্য কোথায়? তবে আমি গন্তব্য না বলে অভিযান বলব। এবারের আমাদের যাত্রা জম্মু থেকে শুরু হয়ে, অমরনাথ, লে-লাদাখ, চাঙলা পাস, প্যাংগং লেক, খারদুংলা পাস, নুব্রা ভ্যালি পর্যন্ত। কাশ্মীরের বাকি অংশ তো আছেই, পুরো একুশ দিনের সফর।

তাওয়াই নদী।

যথা সময়ে স্টেশনে। আর্মি চেকিংয়ের পর সঠিক সময়ে ট্রেন ছাড়ল। মোট সাতজন আছি, সুব্রত, দিব্যেন্দু, বরুণদা, রঞ্জিত, সুরজিৎ, গৌর আর আমি। সুব্রত, দিব্যেন্দু, রঞ্জিত একাধিকবার অমরনাথ ঘুরেছে। বাকিদের প্রথমবার। আমার ২০১৩ সালে চন্দনবাড়ি ও কাশ্মীরের বাকি অংশ ঘোরা।

১২ তারিখ সকাল ১০টার কিছু পরে জম্মুতে হাজির। স্টেশনের বাইরে এসে গাড়িচালক আয়াসকে ফোন করলাম। আয়াস জানালেন, তিনি পার্কিং গেটের সামনেই দাঁড়িয়ে আছেন। গিয়ে দেখি আয়াস আছে গাড়ি নেই। আমরা সুব্রতর দিকে তাকালাম। আয়াসই কৌতূহল মেটাল, এখানকার নিয়ম আনুযায়ী, জম্মুর বাইরের কোনও গাড়ি স্টেশন সংলগ্ন এলাকায় যাত্রী নিতে বা দিয়ে আসতে পারবে না। আমাদের গাড়ি জম্মু বাজারে আছে। বাসে ওখানে যেতে হবে। শুনে সবাই সুব্রতর ওপর হামলা মানে লেগপুলিং শুরু করল। নিশ্চয়ই টাকা কম দিয়েছিস। তাই এখানে গাড়ি নিয়ে আসেনি। রঞ্জিত তেড়েমেরে কিছু বলতে যাচ্ছিল। তার আগেই সুব্রত দুহাত তুলে ঘোষণা করল, ‘‘যে যাবি না এখানে থাক। ফেরার সময় নিয়ে যাব।’’ অগত্যা কিছুটা হেঁটে বাস।

গাড়িচালক আয়াস।

জম্মু থেকে শ্রীনগর এখন নতুন হাইওয়ে হয়েছে। ফলে শ্রীনগর পৌঁছনোর সময় প্রায় তিন থেকে সাড়ে তিন ঘণ্টা কমে গিয়েছে। তবে আমরা শ্রীনগর যাচ্ছি না। আমাদের প্রথম গন্তব্য অমরনাথ। যার জন্য যাব পহেলগাঁও। জম্মু শহর ছেড়ে আমরা প্রকৃতির মধ্যে ঢুকে পড়লাম। উধমপুরের কাছে এসে নেমে পড়লাম বরফ শীতল খরস্রোতা তাওয়াই নদীতে। দু’দিনের ট্রেন যাত্রার ক্লান্তি নিমেষে উধাও। বেশ কিছুক্ষণ নদীতে কাটিয়ে আবার যাত্রা। কিছু দূর আসার পরই যানজট। আয়াস বলল, ‘‘আপনারা খেয়ে নিন। দেরি হবে।’’ তাই করা হল।…

উধমপুর থেকে প্রায় দু’ঘণ্টা এসেছি রামবানে। এখানে প্রথম পাহাড়ি ঝর্ণা। যার জল সকলেই খায় বা স্নান করে। আয়াস গাড়ি দাঁড় করিয়ে বললেন, ‘‘আপনারা কেউ স্নান করবেন? আমি করব।’’ আমরা জুলাই মাসের গরম থেকে গিয়েছি। এখানকার আবহাওয়া আরামদায়ক। কিন্তু আয়াস শ্রীনগরের মানুষ। মাঝেমাঝেই দেখছিলাম তোয়ালে দিয়ে মুখ মুছতে। আয়াসের সঙ্গে আমরা কয়েকজন ঝর্ণার নীচে দাঁড়িয়ে পড়লাম। মজার ব্যাপার হল, আমরা হাড়কাঁপানো বরফগলা জলে কাঁপছি। আয়াস কিন্তু ভিজে পোশাকেই গাড়ি চালাতে শুরু করে দিল।

চন্দনবাড়ি।

গাড়ি এল পত্নীটপ বা পাটনি টপে। বহু প্রাচীন গাছ দিয়ে ঘেরা সুন্দর জায়গা। সেই সঙ্গে মনোরম ঠান্ডা। ২০১৩ সালে প্রথম কাশ্মীর এসে এখানে রাত কাটিয়েছিলাম। পুরো দিন ঘুরেছিলাম আশেপাশে। অপূর্ব লাগল এখানকার প্রাচীন গাছে ঘেরা সূর্যের আলো প্রায় মাটিতে প্রবেশ করতে না পারা একটি পার্কে। এছাড়াও পেরিয়ে এলাম ধাভা, বানিহাল, কাজিগুন্ড, অনন্তনাগ পেরিয়ে পহেলগাঁও। ‘প্রথম গ্রাম’।

আমরা।

এসে দাঁড়ালাম ঝিলম নদীর তীরে, পহেলগাঁও ঢোকার কিছু আগে। প্রকৃতির রূপের জন্যই দাঁড়াতে হয়। তার পর অমরনাথ যাত্রার জন্য প্রথম চেকপোস্ট নাওয়ানে এসে লাইনে দাঁড়ানো। পুরোদস্তুর চেকিং। আমাদেরও। যদি কোনও নেশার জিনিস বা বেআইনি কিছু পায় নিয়ে নেবে। সেই সঙ্গে দেখে নিল অমরনাথ যাত্রার পাশ। আমরা চার মাস আগে হাওড়ার উলুবেড়িয়া মহকুমা হাসপাতাল থেকে মেডিক্যাল সার্টিফিকেট নিয়ে, তার পর জম্মু ও কাশ্মীর ব্যাঙ্ক পাকসার্কাস মল্লিক বাজার ব্রাঞ্চ থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। মোট তিন কপি সচিত্র পরিচয়পত্র দেওয়া হয়েছিল। আমরা একে একে চেকিং পেরিয়ে এলাম। কিন্তু রঞ্জিত আর সুরজিৎ আর আসে না। ওদের কাছে ফোনও নেই। এখানে একমাত্র বিএসএনএল পোস্টপেড সিম ছাড়া অন্য কিছু চলে না। চিন্তায় পড়লাম। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি রঞ্জিতবাবু কাঁচুমাচু মুখ করে আসছে আর পিছনে হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ার উপক্রম সুরজিতের। কী হয়েছে? রঞ্জিতের ব্যাগে একটা জোয়ানের শিশি ছিল। তা নিয়েই বিপত্তি। ভাষাগত কারণে আর্মি অফিসারকে কিছুতেই বোঝাতে পারে না ওটা বাঙালির প্রিয় মুখশুদ্ধি। নামে জোয়ান। কিন্তু ছেলে মেয়ে বুড়ো বুড়ি, সকলেই খায়। জোয়ান হাতে ঢেলে ছাড় মিলেছিল। পহেলগাঁওয়ে হোটেলে উঠলাম তখন প্রায় সন্ধ্যে ৭.৩০ বাজে। হোটেল বুক করা ছিল। প্রথমেই প্রয়োজনীয় কিছু জিনিস বের করে আবার গাড়িতে বড় লাগেজ তুলে দিলাম। কারণ আয়াস শ্রীনগর ফিরে যাবে। লালচকে ওঁর বাড়ি। আমরা বাজারে গিয়ে অমরনাথ যাত্রার পাসে যাত্রী বিএসএনএল সিম নিলাম। সেদিন তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েছিলাম। পরদিন ভোর ৪টেয় উঠতে হবে। ৫টায় লোকাল গাড়ি আসবে আমাদের নিতে। তাড়তাড়ি না গেলে যানজটে আটকে পড়ব।

পিশুটপ।

পরদিন যাত্রা চন্দনবাড়ির দিকে। পহেলগাঁও থেকে চন্দনবাড়ি ১৬ কিমি। উচ্চতা ৯ হাজার ৫০০ ফুট। রাস্তায় বেশ কয়েকবার আইডি এবং যাত্রী পাশ দেখিয়ে ৬.৩০ নাগাদ চন্দনবাড়ি মেন গেটের বেশকিছু আগে নামিয়ে দিল গাড়ি। পাহাড়ি পথের জন্য লাঠি কিনে আমরা লাইনে দাঁড়ালাম গেটপাসের জন্য। গেটের কাছাকাছি যখন পৌঁছেছি হঠাৎ পিছন থেকে একটি পাগড়ী পরা ছেলে আমাদের ধাক্কা মেরে গেটের দিকে ছুটল। এখানকার গেটগুলো লোহার রেলিং দেওয়া গোল। একবারে একজনের বেশি ঢুকতে পারবে না। খুব কড়া চেকিং। এক সেনা জওয়ান তার কলারের পিছনটা ধরে নিয়ে চলে গেল। বাবুর কোনও যাত্রী পাশ নেই। গেট পাস করিয়ে লঙ্গরখানায় খেয়ে নিলাম। পুরো অমরনাথ যাত্রায় এই ধরনের লঙ্গরখানায় বিনা পয়সায় খাওয়ানো হয়। বিভিন্ন রাজ্য থেকে লোকজন আসেন লঙ্গরখানা খোলার জন্য।

পিশুটপে যাত্রীরা।

৮টায় আমরা যাত্রা শুরু করলাম। আমিই মনে হয় একমাত্র ব্যক্তি যে শুধু ভ্রমণের জন্য অমরনাথের উদ্দেশ্যে চলেছে। চন্দনবাড়ী থেকে তিন কিলোমিটার চড়াই করে ১১ হাজার ৫০০ ফুট উঁচুতে পিশুটপ। উচ্চতা এবং কম অক্সিজেনের জন্য শ্বাস নেওয়া কষ্টকর। তার উপর মানুষ আর ঘোড়ার ধুলো। এখানেই প্রথম জীবনে মাস্ক ব্যবহার। পিশুটপের নীচে গিয়ে অনেক দরদাম করে চারশো টাকায় ঘোড়া নিলাম, শুধু পিশুটপ ওঠার জন্য। এক তো খাড়াই সঙ্কীর্ণ রাস্তা। কাদা আর পিচ্ছিল, যার মধ্যে দিয়েই অজস্র মানুষ আর ঘোড়া চলেছে। ঘোড়ার সহিস খুবই ভাল, আমার অবস্থা বুঝে আমাকে ঘোড়ায় চড়ার প্রাথমিক জ্ঞান খুব ভাল ভাবে বুঝিয়ে দিল। তিরিশ মিনিটেই হিলে পৌঁছে গেলাম। বাকিরা হেঁটেই উঠল।

শেষনাগ পাহাড়।

ঘোড়াওয়ালাকে বকশিস দিয়ে ছেড়ে দিলাম। তার পর শুধু চোখ জুড়নো প্রকৃতি। চারিদিকে সবুজ পাহাড়, রৌদ্রউজ্জ্বল আবহাওয়ার জন্য বহুদূর পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। বেশ কিছুক্ষণ পর পাশের ভাণ্ডারায় গিয়ে শরবত খেলাম। বাকিদের জন্য অপেক্ষা করছি, ওদের আসতে দু’থেকে আড়াই ঘণ্টা লাগবে। শরবত খাওয়ার কিছুক্ষণ পরই পেটের মধ্যে দেখি যুদ্ধ শুরু হয়েছে। অবস্থা শোচনীয়। পরিত্রাতা হিসাবে দেখা দিল গৌর। ওর হাতে ব্যাগপত্র ক্যামেরা দিয়েই দৌড় লাগালাম। পুরো সফরে সরকারি ব্যবস্থাপনায় অস্থায়ী টয়লেটের সুবন্দোবস্ত আছে। বেরিয়েই তো চিন্তায় পড়ে গেলাম, আমার কি হিল ডায়রিয়া শুরু হল? সঙ্গে ওষুধ আছে, ইনহেলার পর্যন্ত। গৌরকে বলতে ও চিন্তিত হয়ে বলল, ‘‘তুমি যাবে কী করে?’’ বাকিরা এগিয়েছে। শুধু বরুণদা এখনও আসেনি। ওর থেকে ব্যাগপত্র নিয়ে বললাম, ‘‘তুই এগো। আমি ঠিক যেতে পারব। অসুবিধা হলে ফোন করব।’’

শেষনাগ লেক।

এখান থেকে আমাদের গন্তব্য শেষনাগ। ওখানেই রাতে থাকব। পথে জোজিবাল আর নাগরা কোটি দু’টি পয়েন্ট পড়বে। পিশুটপ থেকে শেষনাগের দূরত্ব ১১ কিমি আর উচ্চতা ১১ হাজার ৭৩০ ফুট। সামান্য চড়াই উতরাই। প্রায় সমতল বলা চলে। রাস্তা বলতে সরু একফালি কোথাও পাথর বিছানো তো কোথাও একটু পাথুরে মাটি। পাশে বরফ গলা জল বয়ে চলা সরু খাদ। যত এগোতে থাকলাম দেখলাম প্রকৃতি এখানে ক্যানভাসে আঁকা ছবির মতো। মুহূর্তে মুহূর্তে রূপ পরিবর্তন করে চলেছে। এক জায়গার সৌন্দর্যের সঙ্গে অন্য জায়গার মিল খুঁজে পাবেন না। যদিও সবুজের লেশমাত্র নেই। হাঁটতে হাঁটতে বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে পরিচিত হলাম। খুব কষ্ট হল দু’জন বয়স্ক মহিলাকে দেখে। মলিন পোশাক। একজনের পায়ে ছেঁড়া হাওয়াই চটি আর একজনের পায়ে লেস হিন ছেঁড়া জুতো। বললাম, ‘‘মাজি আপলোগ কাঁহা সে আয়ে হ্যায়?’’ কোনও এক অজানা গ্রামের নাম বলল। জেলা জানতে চাইছিলাম। বললেন, ‘‘জিলা তো বাবু পতা নেহি।’’ রাজ্যের নাম গুজরাট। গুজরাট থেকে ওঁরা বাসে এসেছেন। দলের বাকি সদস্য আগে পিছে আছে। এই বয়সে কেন আসা? ওঁদের বক্তব্য “কেয়া করে বাবু, বাবা নে বুলায়া হ্যায় আনা তো পড়েগা।’’

মহগুনা পাস।

দলের সবাই এগিয়ে গিয়েছে। খুবই ধীরে ধিরে হাঁটছি, বলা ভাল বাধ্য হচ্ছি। চার পা চললেই হাঁপিয়ে যাচ্ছি। কিছু দূর গিয়ে দেখি বরুণদা আর গৌর বসে পাথরের উপর। ওদেরও কমবেশি আমারই মতো অবস্থা। গৌর বলল, ‘‘তোমার অসুবিধা হলে ঘোড়া নিয়ে নাও।’’ আমি বললাম, ‘‘যত কষ্টই হোক শেষনাগ পর্যন্ত আমি হেঁটেই যাব, এটা আমার জেদ।’’ দীপকদা, আমাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’র ক্যাপ্টেন, থাকলে বলত, ওটা তোর জেদ নয় একগুঁয়েমি। জেদ বললে তোকে তো ভাল বলা হয়ে যাবে। তিনজনে এগিয়ে চললাম। একটি কাঠের পোল পেরতে হবে। এখানে ধাপ করা আছে। সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠে আবার নীচে নামতে হবে। নীচে খুব সুন্দর ঝর্ণা। জায়গাটা সেনারা ঘিরে রেখেছে। কারণ কয়েক বছর আগে জঙ্গিরা গ্রেনেড হামলা করে পোলটি ধ্বংস করে দিয়েছিল। সিঁড়ি দিয়ে উঠতে যাব একজন বয়স্কা বললেন, ‘‘বেটা হাত পকড় কে থোড়া লে জায়েগা? প্যায়ের মে দর্দ হ্যায়। চল নেহি পা রহি হু।’’ হাত ধরলাম। তখন যদি আমার অবস্থা দেখতেন। ভদ্রমহিলার ভারী চেহারা।। নীচ থেকে উপর উপর থেকে নীচে নামতে প্রচুর আশীর্বাদ করে বললেন, ‘‘বেটা অব ছোড় দে। ম্যায় অব ঠিক হুঁ।’’

শেষনাগ পাহাড়।

উনি তো ঠিক হয়ে এগিয়ে চললেন। আমি হাঁফধরা শরীরটা এলিয়ে দিলাম ঝর্ণার গায়ে পাহাড়ে। ঝর্ণার জল ছিটকে ছিটকে টুপটাপ করে চোখে মুখে এসে পড়তে লাগল। কী আরাম! আমার অবস্থা দেখে বরুণদা আর গৌর হেসে কুটোপাটি। আরও কিছুক্ষণ পর চোখেমুখে ঝর্ণার জলের ঝাপ্টা দিয়ে শরীরটাকে একটু তরতাজা করে এগিয়ে চললাম। কিছু দূর এগিয়েছি, গৌর বলল, ‘‘ইন্দ্রদা আমার শরীর খারাপ লাগছে। বমি পাচ্ছে আর মাথা ঘুরছে।’’ সামনেই সেনাছাউনি। ডাক্তার ওষুধ দিয়ে বেশ কিছুক্ষণ শুইয়ে রাখলেন। বললেন, ‘‘উচ্চতার জন্য হচ্ছে। যেতে পারো।’’ আবার আমরা হাঁটা শুরু করলাম। শেষনাগ আর বেশি দূর না।

গুহা।

চলে এলাম শেষনাগ লেকের কাছে। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা। তার মধ্যে নীল জলরাশি। পাহাড়ের মাথায় হিমবাহে সূর্যের আলো পড়েছে। মনে হয় রুপোর পাহাড়। অপরূপ সৌন্দর্য। কাছাকাছি যখন চলে এসেছি দিব্যেন্দুর ফোন এল। ও বলল, ‘‘আমরা তাঁবু নিয়ে নিয়েছি। তোরা চলে আয়।’’ ওকে বললাম চেক গেটের কাছে দাঁড়া। আমরা খুঁজে নেব সে অবস্থা আমাদের নেই। তাঁবুতে পৌঁছেই কোনও রকমে জুতোটা খুলে সটান কম্বলের নীচে। তখন সবে ৬টা বাজে। চন্দনবাড়ি থেকে অমরনাথ গুহার আগে পর্যন্ত বিভিন্ন জায়গায় এরকম তাঁবু দেড়শো থেকে দু’শো টাকা মাথা পিছু ভাড়া পাওয়া যায়। এছাড়াও সরকারি ফ্রি তাঁবু আছে। তবে সীমিত। ঘুম ভাঙল ঘণ্টা দুই পর। উঠেই দেখি সবাই বেশ তরতাজা হয়ে গল্প করছে। জানতে পারলাম আমি, বরুণদা আর গৌর ছাড়া সকলেই পিশুটপের কিছু পর থেকে ঘোড়ায় এসেছে। আমি যখন ঘুমাচ্ছিলাম তখন দিব্যেন্দু আর সুব্রত পরের দিন সঙ্গম পর্যন্ত যাওয়ার জন্য ঘোড়া ভাড়া করে এসেছে সাতশো টাকা নেবে মাথা পিছু। রাত ১০টায় খাওয়া সেরে নিলাম।

গুহার সামনে।

পরদিন ঘুম ভাঙল ৫টায়। তখনও ভোরের আলো ফোটেনি। বাকিদের তুলে দিলাম। যত আলো ফুটতে লাগলো ততই দেখলাম এক অসাধারণ জায়গায় আমরা রয়েছি। সামনেই সাপের ফনার মতো শ্বেত শুভ্র পাহাড়। কিছু খেয়ে সকাল ৭টার কিছু আগেই ঘোড়ায় গুহার দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ঘোড়ায় যখন উঠলাম তখন আমাদের সঙ্গে সাতজন সহিস ছিল। কিছুক্ষণ চলার পর খেয়াল করলাম তিনজন আছে। আমরা নিজেরাই ঘোড়া চালিয়ে নিয়ে যাচ্ছি। শেষনাগ থেকে আমরা ভারবাল হয়ে যাব মহগুনাটপ বা গণেশটপ। দূরত্ব ৪.৬ কিমি আর উচ্চতা ১৪ হাজার ফুট। পথের যে সৌন্দর্য দেখলাম তা বর্ণনা করার মত ভাষা আমার নেই। মহগুনায় পৌঁছে হতবাক হয়ে গেলাম। মনে হল বরফের মরুভূমিতে চলে এসেছি। কয়েক ফুট বরফে ঢাকা অত্যন্ত সুন্দর একটা জায়গা। তবে সুন্দর যেমন ভয়ঙ্করও। এখানে অক্সিজেন খুবই কম। তাই সেনা বেশিক্ষণ থাকতে দিচ্ছিল না। তবে কারও শ্বাসকষ্ট হলে তাদের জন্য বেসক্যাম্পে অক্সিজেন সিলিন্ডার রাখা আছে। দেখলাম সেনারা এক প্রবীণের দেহ নিয়ে যাচ্ছে। আরও কিছুটা এগিয়ে দেখলাম একটি ঘোড়া জীবনযুদ্ধে হেরে বরফে জমে পড়ে আছে।

অমর গঙ্গা।

আমরা বরফের মধ্যে ঘোড়া থেকে নেমে হাঁটছিলাম। সামনে কিছুটা কাদা পিছল রাস্তা পেরিয়ে এলাম। সহিস আমার আর দিব্যেন্দুর ঘোড়া পাল্টে দিল। আমার ঘোড়ায় দিব্যেন্দু তো উঠে পড়ল, কিন্তু যেই না আমি দিব্যেন্দুর ঘোড়ায় উঠতে গেছি ঘোড়া বাবাজি পড়ল বসে। কিছুতেই আমাকে নেবে না। দু’দুবার চেষ্টা করলাম। ঘোড়া সেই শুয়ে পড়ে। সহিস তো তেড়ে মারতে গেল। আমি তাকে থামালাম। তারপর ঘোড়ার গায়ে মাথায় হাত বোলালাম। পুরো শান্ত হয়ে গেল। ভয়ে ভয়েই উঠলাম। তবে ওঠার সময় দিব্যন্দু বলেছিল, ‘‘এটা খুব ভাল ঘোড়া। আমি তো একাই চালিয়ে নিয়ে এলাম।’’ দিব্বি নিয়ে চলল পঞ্চতরণীর দিকে। মহগুনাটপ থেকে পঞ্চতরনীর ৯.৪ কিমি আর উচ্চতা ১২০০০ ফুট। পুরোটাই প্রায় সমতল। এখানে হেলিপ্যাড আছে। যারা হেলিকপ্টারে আসে সোনমার্গ থেকে এখানে নামতে হয়। তার পর বাকিটা হেঁটে বা ঘোড়ায় যেতে হয়। আগে গুহার কাছেই হেলিপ্যাড ছিল। কিন্তু দূষণ হওয়ায় এবং সেই দূষণ থেকে তথাকথিত বরফের শিবলিঙ্গ গলতে শুরু করায় হেলিকপ্টার নামা বন্ধ করে দেয়। পঞ্চতরণীতে আমরা ঘোড়া নেমে বেশ কিছুটা হাঁটলাম। তার পর রওনা দিলাম সঙ্গমের দিকে। এখান থেকে সঙ্গম ৩ কিমি আর সঙ্গম থেকে গুহা ৩ কিমি।

পিশুটপ থেকে শেষনাগ যাওয়ার পথে।

সঙ্গমে এসে আমরা ঘোড়া ছেড়েদিলাম। ঘোড়া ছাড়ার পর আবার বিপত্তি। আমাকে বেশি টাকা দিতে হবে। আমার লাঠি ছাড়বে না সহিস। রঞ্জিত তো লাঠি উঁচিয়ে মারতে গেল, ছাড়ো আগে মাস্টারের লাঠি। টিমের সকলেই মজা করে আমাকে মাস্টার বলে মাঝে মাঝে। দিব্যেন্দু থামাল। আমি বললাম, ‘‘যার সঙ্গে কথা হয়েছে তাকে ডাকো আমাদের ফোন নাম্বার নিয়ে যাও। যা কথা হয়েছে তাই দেব। বেশি দেব না।’’ কিছুটা তর্কের পর কথা মতো টাকা নিয়েই বিদেয় হল। আমরা ঘুহার দিকে এগিয়ে চললাম। সবে এক কিলোমিটার এসেছি সুরজিৎ অসুস্থ হয়ে পড়ল। আমি আর গৌর আছি। বাকিরা এগিয়েছে। বসিয়ে বসিয়ে আরও এক কিলোমিটার নিয়ে এলাম। তার পর তাঁবু নিলাম। গুহার পাদদেশে আমরা রাত্রি যাপন করব। কয়েক ঘণ্টা বিশ্রামের পর দেখলাম সুরজিৎ বাইরে বেরলো। তার কিছুক্ষণ পর আমি আর গৌর বেরলাম। ইতিমধ্যে দিব্যেন্দু ফোন করল, আমি সন্ধ্যাআরতি দেখতে যাব কিনা। আমি যাব না বললাম। গৌর গেল। আমি আশপাশটা ঘুরে দেখতে লাগলাম। চারিদিক ভঙ্গুর আর রুক্ষ পাহাড়ে ঘেরা আর নীচটা কয়েক ফুট বরফে ঢাকা। এছাড়া আর কোনও বিশেষত্ব নেই। অনবরত ছোটখাট পাথরের টুকরো খসে পড়ছে। ওরা ফিরল প্রায় সাতটায়। রাত্রির ৯টায় গেলাম খাবার খেতে। তারপর এসে শুয়ে পড়লাম। পরদিন ভোর পাঁচটায় উঠে পড়লাম। বাকিরাও উঠল ছটা নাগাদ। সুব্রত, রঞ্জিত আর দিব্যেন্দু গেল সামনে বরফ গলা বয়ে চলা স্রোতে স্নান করতে। যাকে ভক্তরা অমর গঙ্গা বলে থাকে। ওদের বিশ্বাস এই জলে স্নান করলে মানুষ অমর হয়ে যাবে। বা সমস্ত পাপ ধুয়ে অনেক দিন বাঁচবে। সুব্রতকে চান করতে বারণ করলাম। ওর আগের দিন হালকা জ্বর হয়েছিল। কথা তো শুনলই না। উল্টে দু’কথা শুনিয়ে দিল। বলল, আমি এটা নিয়ে চারবার আসছি। প্রত্যেকবার এখানে স্নান করেই তবে ভোলেবাবার দর্শন করি। তুই নাস্তিক তুই কী এর মর্ম বুঝবি। আমি তোর থেকে বেশি দিন বাঁচব।’’ জীবনের কী পরিহাস দেখুন। আমরা কাশ্মীর থেকে ফেরার ঠিক দেড় বছরের মাথায় সুব্রতর মতো তরতাজা ছেলের মাত্র তেত্রিশ বছর বয়সে কিডনির সমস্যা ধরা পড়ে। এক মাসের মধ্যে ওকে ডায়ালিসিস শুরু করতে হয়। যা আমাদের সকল বন্ধুর কাছে ভীষণ যন্ত্রণাদায়ক।

গুহা মুখ।

তৈরি হয়ে সকাল ঠিক ৮টায় লাইন দিলাম গুহায় ওঠার জন্য। চল্লিশ ফুট উপরে শিবলিঙ্গ। যা আসেল একটি গ্লেসিয়র ছাড়া আর কিছু না। এবং সেটাকে আকার দেওয়া হয়েছে। পাশে আরও দু’টি আকৃতি আছে গ্লেসিয়েরের। একটি পার্বতী আর গণেশের। বলা বাহুল্য এ দুটিও নিজে আকার নেয়নি। সিঁড়ি দিয়ে যখন উঠছি শুনতে পেলাম মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, কোনও এক মহিলার মাথায় গুহার পাথর পড়ে জখম হয়েছেন। তার বাড়ির লোককে আসার জন্য অনুরোধ করা হচ্ছে। গুহার যা ভঙ্গুর অবস্থা দেখলাম তাতে একদিন অস্তিত্ত হারাবে। তখন হয়তো এখানে মন্দির হবে দেব মাহাত্ম্য প্রচারে। প্রত্যেক বছর অমরনাথ যাত্রায় এসে বেশ কয়েকজন বয়স্কের মৃত্যু হয়।

আমরা নেমে এসে খেয়ে নিলাম। তার পর সকাল ১১টায় বালতালের দিকে রওনা দিলাম। আমি বাদে সকলেই হেঁটে যাত্রা শুরু করল। গুহা থেকে বালতাল যাওয়ার এখন দু’টো রাস্তা। একটা বারারি হয়ে ১১ কিমি। এখান দিয়ে ঘোড়া যেতে পারে না শুধুই হাঁটা পথ। আর একটা সঙ্গম হয়ে ১৪ কিমি। সময় লাগে ঘোড়ায় দু থেকে আড়াই ঘণ্টা। আর হেঁটে ৬ ঘণ্টার মতো। পুরো পথটাই চড়াই উতরাইয়ের খেলা। তবে বেশ চওড়া। আমি আগে পৌঁছে গেলাম এবং আর্মি বেসক্যাম্পের মধ্যে তাবু নিলাম। বাকিরা একে একে এসে হাজির হল। পরদিন আমরা লে-র দিকে যাব।

কভারের ছবি— মহগুনা পাস

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *