জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

ছোট মোল্লাখালির যাত্রী—প্রথম পর্ব

শতাব্দী অধিকারী

মেঘলা আকাশ। হাওয়া দিচ্ছে। মৃদু। ঢেউ। যথেষ্ট উচ্ছ্বল। খেয়াঘাটে দাঁড়িয়ে থাকা ভটভটি-নৌকো দুলছে সেই তালে। নৌকোর মাঝে কাঠের পাটাতন আঁকড়ে ধরে বসে রয়েছি আমি। এ আমার প্রথম একলা নৌকোযাত্রা। শুধু ওপার হব। যাব আড়িয়াদহ। তারপর রথতলা। এবার হাওয়াটা একটু বেশিই জোরে দিল। নৌকোটা আরও দুলে উঠল। হাত আরও জোরে আঁকড়ে ধরল পাটাতন। এখানেই এই তো মাঝগঙ্গায় কী হবে! আঙুল এসএমএস টাইপ করল, ‘‘ঈশ্বর তোকে ক্ষমা করবে না কোনওদিন।’’ উত্তর এল, ‘‘হিহি..’’

গোদখালি থেকে নৌকোয় ওঠার সময় ঘটনাটা মনে পড়ল। সেবার প্রথম একা নৌকোয় চড়েছিলাম। আমি সাঁতার জানি না। তাই জলে আমার চিরকালের ভয়। নদী পার হই ওপারের দিকে স্থির দৃষ্টি রেখে। আল্পনা যখন নৌকোর ধারের পাটাতনে বসতে বলল, প্রথমেই না বললাম। পরে ও বলল, ‘‘বসুন না, কিচ্ছু হবে না, আমরা আছি তো।’’ আশ্বাসবাণীতে মজে বসলুম কিনা জানি না, তবে বসলুম। আমার ডানপাশে বসল আল্পনা। যার বাড়ি যাচ্ছি আমি। চড়ক দেখতে। ওর বাড়ি ছোটমোল্লাখালি। আমার বাঁদিকে আল্পনার ভাজ সুস্মিতা। ভারী মিষ্টি মেয়ে! বয়স ওই তেইশ-চব্বিশের আশপাশে। ছোট। আর সামনে দাঁড়িয়ে ওর স্বামী, আল্পনার ছোট ভাই। তার কাছে সুস্মিতার বছর আড়াইয়ের ছেলে। মহা পাকা। বাবু। ধীরে ধীরে নৌকো ভরল। মানুষে, সাইকেলে, বাইকে। বাসের কনডাক্টরের মতো মাঝি বলে চলেছিল, ‘‘এগিয়ে যান, এগিয়ে যান, ওই তো জায়গা আছে, বৌদি একটু চেপে!’’ মনে মনে ভাবলাম এই না ডুবে যায়। আল্পনাকে বলতে ও বলল, ‘‘এখানে সবাই এভাবেই যায়। কিচ্ছু হবে না।’’

রোদে জলে মাখামাখি।

নৌকো ছাড়ল অস্থায়ী খেয়া ঘাট। এগিয়ে চলল ওপারের দিকে। ওপারে গোসাবা। মাঝ নদীতে ঠাঠা রোদ্দুর। ছাতা খুলে দিলাম। নৌকো ভটভট করে এগিয়ে গেল ওপারে। অদ্ভুত ব্যাপার, ভয় পেলাম না। দিব্বি লোকজন, জল, জঙ্গল দেখতে দেখতে চলে গেলাম। নামলাম গোসাবায়।

ছোটমোল্লাখালি যাচ্ছি বটে। কিন্তু কীভাবে এই যোগাযোগ হল সেটা না বললে গল্পটা ঠিকবলা হয় না। আল্পনা মণ্ডলের লেখা ইন্টারনেটে অনেকেই পড়েন। ওঁর ধূপের কারখানা নিয়ে একটা স্টোরি করতে গিয়েই আল্পনার সঙ্গে আমার আলাপ। সেটা ছিল চড়কের হপ্তা দুই আগে। ও-ই বলল, ‘‘চলুন না চড়কে আমার বাড়ি। গ্রামে পুজো হয়। মেলা হয়। খেজুর পেড়ে কুমির তৈরি করে সবাই। ঝাঁপ হয়।’’ আমি তো শুনেই সে প্রস্তাব লুফে নিলাম। বলে দিলাম, আমি আর আমার এক বন্ধু যাব চড়কের দিন। চড়ক শনিবার পড়েছে অতএব আমার ছুটি। রোববার বিকেলের মধ্যে ফেরা। চড়কের আগেরদিন সন্ধেবেলা আল্পনা ফোন করল। বলে দিল পরদিন প্রথম ক্যানিং লোকালে ওরা গৌড়দহ থেকে উঠবে। আল্পনা, আল্পনার ছোট ভাই, তার বৌ এবং ছেলে। তবে কিন্তু কিন্তু করে জানাল, ওদের গ্রামে কিন্তু এখনও ইলেক্ট্রিসিটি পৌঁছয়নি। গত ইলেক্শনে খুঁটি পুঁতে দিয়ে গিয়েছিল বটে, তবে বিদ্যুৎ এখনও আসেনি। সোলার আছে। ওই দিয়ে রাত আটটা পর্যন্ত চলে যায়। পাখা নেই। আর ওদের কিন্তু মাটির বাড়ি। চাল নিচু। কোনও অসুবিধা নেই তো!

ক্যানিং স্টেশন।

উত্তরে জানালাম অসুবিধা থাকার কথাই নয়। মনে মনে আমি বরং উচ্ছ্বসিত। আমার সঙ্গী অবশ্য ততটাও উচ্ছ্বসিত হলেন না। তিনি প্রচণ্ড ঘামেন এবং গরমে কষ্ট পান। অতএব, তাঁকে এই ট্রিপ থেকে পিছিয়ে যেতে হল। আমার তো পোয়া বারো। এই প্রথম একা এতগুলো অচেনা লোকের মাঝে। দারুণ মজা!

পরদিন সময় মতো রওনা দিলাম। শিয়ালদহ থেকে প্রথম ক্যানিং লোকালে। ট্রেনে লোকজন দেখতে দেখতে দিব্বি সময় কেটে যাচ্ছিল। একজন তো দেখলাম ট্রেনে যা উঠছে তাই খাচ্ছেন। পচা জামরুল থেকে শুরু করে কলা, ঘুগনি, লুচি, তরকারি সওওওওব। ঘুগনির গন্ধ আমাকেও মজিয়ে ফেলেছিল প্রায়। অতিকষ্টে সে লোভ সংবরণ করলাম। গৌড়দহ এলে আল্পনারা ট্রেনে উঠল। তবে অন্য কামরায়। তারপর আরও আধঘণ্টা, কিংবা কতটা সময় ঠিক মনে নেই। হঠাৎ দেখলাম একটা স্টেশনে ট্রেন থামল। থেমেই রইল অনেকক্ষণ। আমি পা ছড়িয়ে দিলাম সামনের সিটে, তখন বইয়ে মুখ গোঁজা। হঠাৎ একটি মেয়ে বলল, ‘‘দিদি আপনি কোথায় যাবেন?’’ আমি বললাম, ‘‘ক্যানিং।’’ বলল, ‘‘এই তো ক্যানিং, নামবেন না? এরপর তো উল্টোদিকে যাবে!’’ আমি তো প্রায় হুড়মুড় করে নামলুম। কী মুশকিল। এত আনমনা হলে সোলো ট্রিপ হয় নাকি! ক্যানিংয়েই আল্পনাদের সঙ্গে দেখা হল। বলল, ‘‘একা এলেন!’’ আমি হেসে বললাম, ‘‘হ্যাঁ।’’

ক্যানিং থেকে আমরা ম্যাজিক গাড়ি নিয়েছিলাম। খুব জোর করলাম আমায় যেন ছাদে বসতে দেওয়া হয়, কিন্তু সেই ম্যাজিক গাড়ির ড্রাইভার কিছুতেই বসতে দিলে না। বললেন, ‘‘না না! আপনি মেয়েমানুষ, ভিতরেই বসুন।’’ আমিও মনে মনে সহেলীর সাবধানবাণী আওড়ালাম, ‘‘দ্যাখ, একা যাচ্ছিস, বেশি পাকামি করবি না।’’ যদিও গাড়ির ছাদে আমি আগেও চড়েছি, এখানে চড়তে পারলে মন্দ হত না।

একটু আরামে।

ম্যাজিক গাড়ি মিনিট ৪৫ সময় নিয়ে আমাদের পৌঁছে দিয়েছিল গোদখালি। ভেবেছিলুম, গোদখালি পেরিয়েই বুঝি আল্পনাদের বাড়ি। ভেবেছিলুম, গোসাবারই একটা ছোট জায়গার নাম ছোটমোল্লাখালি। ভাগ্যিস সে অনুমান সত্যি হয়নি! (আমি ভূগোলে গোল, নিজ গুণে ক্ষমা করবেন)

গোসাবা পৌঁছনোর পর হাঁটা শুরু করলাম। বাজারের মধ্যে দিয়ে। তখন বেলা ১০টা বেজে গিয়েছে। আল্পনা বলল, ‘‘কিছু খেয়ে নিই। পরে আর ভাল দোকান পাব না।’’ একটা দোকানে ঢুকলাম। আয়েশ করে ১০০ গ্রাম পেটাই পরোটা উইথ ঘুগনি উড়িয়ে দিলাম নিমেষে। বুঝিনি এতটা খিদে পেয়েছে। খাওয়া দাওয়ার পর ভ্যানগাড়িতে ওঠা গেল। অনেকটা সাইকেলের প্যাডেলওয়ালা গরুর গাড়ির মতো। মাটির ডেলা ফেলা রাস্তায় লাফাতে লাফাতে সে গাড়ি এগলো খেয়াঘাটের দিকে। আল্পনা জানাল, এবার আমরা যাব জটিরামপুর। ততক্ষণে আমার মনে গন্তব্যের মোহ কেটে গিয়েছে। যাত্রাপথই মূল আকর্ষণ। গ্রামের বুক চিরে মাটির রাস্তা চলে গিয়েছে। চারপাশ যত সুন্দর, ততই খারাপ রাস্তা। ওই গনগনে রোদে ভ্যানচালকের সর্বাঙ্গ ঘামে চিকচিক করছে। খুব কষ্ট হচ্ছিল দেখে। দু’টো ভাতের জন্য মানুষকে কিনা করতে হয়। আমরা তো অনেক সুখে থাকি।

যাওয়া আসার জীবন। এভাবেই।

গোসাবা থেকে ফের নৌকা করে জটিরামপুর পৌঁছলাম। মাঝে আবার এক নাম না জানা দ্বীপে স্টপেজও দিল নৌকা। জটিরামপুরে পৌঁছে প্রথম দেখা পেলাম সুন্দরী গাছের। জটিরামপুরে নেমে বাঁধের উপর দিয়ে বেশ অনেকখানি হাঁটতে হল। বাঁদিকে সুন্দরী গাছ, ডানদিকে খেজুর, আরও অনেক গাছ, তাদের নাম জানি না। এবার উঠলাম প্যাডেলওয়ালা ভ্যানোয়। ছাতা খুলে বসে দুলতে দুলতে চললাম এক ঘাটের দিকে, যেখানে বড় নৌকো পাওয়া যাবে। কিন্তু পৌঁছে জানা গেল সময়ের আগেই বড় বোট ছেড়ে দিয়েছে। ছোট বোট ধরতে হলে দ্বীপের আরেক প্রান্তে যেতে হবে। অগত্যা আবার এক সাইকেল ভ্যানোয় চড়া এবং ক্ষেত, মাটির বাড়ি, ইতিউতি তৃণমূল-বিজেপি’র পতাকা, সরষে ক্ষেত দেখতে দেখতে কাঁচা রাস্তা বেয়ে এগিয়ে যাওয়া। আল্পনা গল্প করছিল আমাদের চালক দাদার সঙ্গে। বলল, ‘‘কী গো! রাস্তা তো এখনও পাকা হল না!’’ উত্তর এল, ‘‘এই তো এই ভোটের পর বলেছে পাকা হবে। ইটও বসিয়েছে উধারে।’’ ইট বসানোটা হচ্ছে চারা জাতীয়, বুঝলাম। পৌঁছলাম জটিরামপুরের আরেক প্রান্তে। সেখান থেকে বোটে উঠলাম। সে বোট আমাদের নিয়ে গেল সাতজেলিয়া।

সেলফি লে লি।

সাতজেলিয়া! কী মিষ্টি নাম। আমি শুনলুম সাতঝিলিয়া। কেউ যদি কারও মেয়ের নাম দেয় ঝিলিয়া, বেশ হয়! এছাড়া সাতঝিলিয়া বা জেলিয়ার আর কোনও বিশেষত্ব নেই। সেই গোদখালি থেকেই ফেরিঘাট কাঁচা। অস্থায়ী। অন্তত ছোট বোটগুলোর জন্য। ওখানকার মানুষ স্বপ্ন দেখে একদিন ব্রিজ হবে। প্রত্যেক দ্বীপকে প্রত্যেক দ্বীপের সঙ্গে জুড়ে দেবে সেতু। কী অদ্ভুত প্রত্যাশা, না! অথচ এই আমি কিনা চাই, কোথাও যেন কোনওদিন সেতু না তৈরি হয়। এভাবেই সবাই নদীর পর নদী পেরিয়ে যায়।আমার কাছে যা বিলাসিতা, তা ওদের কাছে স্বপ্ন।

জড়িয়ে থাকা জল জীবন।

সাতঝিলিয়াতেও ওই একইভাবে ভ্যানোয় করে দ্বীপের অপর প্রান্তে পৌঁছলাম। জানা গেল বোট ছাড়বে আধঘণ্টা দেরিতে। বসে পড়লাম কোনও একটা দোকানের দাওয়ায়। ফুরফুর করে হাওয়া দিচ্ছিল। হঠাৎ, খুব ক্লান্ত লাগল। মনে হল ঘুমিয়ে পড়ব। চোখ বুজে আসছে ঠিক এমন সময় বোট এল। ছোটমোল্লাখালির বোট। তারপর সে বোট রওনা দিল। একসময় দেখলাম ওপারে সাদা সাদা কংক্রিটের বাঁধ। কাঁচা মাটি আর সুন্দরী গাছ। আল্পনা বলল, ‘‘ওই যে আমার গ্রাম।’’

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *