পাহাড়িয়া বাঁশি

সবুজ রাজার দেশে

দীপশেখর দাস

গ্যাংটক নামটার সঙ্গে প্রথম পরিচয় ফেলুদার গল্পে।

তা সেই ‘গ্যাংটকে গন্ডগোল’ দেখার, থুড়ি, করার একটা তাল খুঁজছিলাম বেশ কিছুদিন ধরেই। তাই সুযোগ পেতেই পাড়ি। আসল কারণ যদিও বা কেজো সেমিনার। কিন্তু রথ দেখতে গেলে তো কলাও বেচা যায় নাকি! তাই শিয়ালদহ থেকে আঁধার কেটে ছুটে চলা ট্রেন পদাতিক-এ। সঙ্গে আরও দু’জন। কর্মসূত্রে আমার সিনিয়র এবং প্রায় শিক্ষক স্থানীয় উত্তরাখণ্ড আগত দীনেশ রাওয়াত এবং উত্তরপ্রদেশের বিকাশ কুমার। তিনজনের মনেই প্রথম সিকিম দর্শনের উত্তেজনা।

সকালেই পৌঁছে গেলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশন। সেখানে ছিলেন আরও দু’জন। দু’জনেই বাংলাবাসী। একজন হুগলির আর একজন কলকাতার। তাঁরা কলকাতা থেকে আলাদা পথে এসে জুটেছেন এখানে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে গ্যাংটক ঘণ্টা চারেকের জার্নি। আমাদের এই ক’জনের জন্য টাটা সুমো আগেভাগেই বরাদ্দ সেমিনার কর্তৃপক্ষের তরফে। মাগনার সুমোয় পিছনের সিটটা দখল করে বসলাম ফটো শিকারের উদ্দেশ্যে। গাড়ি ছাড়ার মিনিট কুড়ি পরেই হাল্কা শীতের অনুভূতি। তখন গাড়ি ছুটেছে শাল-সেগুনের জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। রাস্তা চলেছে মহানন্দা বন্যপ্রাণ অভায়ারণ্যের বুক চিরে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সহপাঠীদের সঙ্গে এই অভায়ারণ্যে ঢোকার সু্যোগ হয়েছিল। সেই উচ্ছ্বাসের স্মৃতিই ঝেঁকে নামছিল মনে।

আরও কিছুক্ষণ চলার পর শুরু হল পাহাড়ের কোলে পথ চলা। পথের এক একটা বাঁক এক এক দৃশ্য তুলে ধরছে চোখের সামনে। আরও খানিক এগোতেই তিস্তার সঙ্গে দেখা। তিস্তা একটি সবুজ নদীর নাম। দু’পাশের সুউচ্চ সবুজ পাহাড়গুলি পরম স্নেহে তিস্তাকে পথ করে দিয়েছে। তাদের কৃতজ্ঞতা জানাতেই বোধহয় তিস্তা সবুজ রঙ ধারণ করেছে।

প্রকৃতির মধ্যে হারিয়ে গিয়ে কখন যে ঘণ্টাতিনেকের যাত্রা হয়ে গিয়েছে বুঝতেই পারিনি। চমক ভাঙল রংপুতে, যখন সিকিম পুলিশ গাড়ি থামাল। বুঝলাম, সিকিমে দোড়গোড়ায় আমরা। পরিচয়পত্র দেখিয়ে ছাড়া পেলাম। নতুন রাজ্যে পৌঁছে নতুন উদ্যমে প্রকৃতিকে উপভোগ করতে শুরু করলাম। কিছুদিন আগেই সিকিম দেশের প্রথম জৈব রাজ্য সম্মান পেয়েছে। সিকিমে প্রবেশ করেই তার অন্যতম একটা প্রভাব চোখে পড়ল। সিকিম ঢোকার আগে রাস্তার দু’পাশে যে প্লাস্টিক বর্জ্যের স্তূপ দেখতে পাচ্ছিলাম তা এখানে পুরোপুরি উধাও। এমনকী অন্য বর্জ্যও এখানে নেই। প্রকৃতিকে এরা মাতৃজ্ঞানে-কন্যাজ্ঞানে সাজিয়ে রেখেছে। কলঙ্ক লাগতে দেয় না একটুও।

সাড়ে চার ঘণ্টার জার্নি শেষে এসে পৌঁছলাম গ্যাংটকে। আমার কচি বন্ধু শুভ বলেছিল, গ্যাংটক অনেকটা নিউ ইয়র্কের মতো। এখানে এসে বুঝলাম কথাটা ফেলবার নয়। বেশ পরিপাটি করে সাজানো একটা শহর। তবে সে সজ্জা প্রকৃতির সঙ্গে তাল মিলিয়েই। পথের পাশে লাল-সাদা রোডোড্রেনড্রন আর রংবেরংয়ের অর্কিডের মেলা।

গ্যাংটক পৌঁছে সেমিনার কর্তৃপক্ষের নির্দিষ্ট হোটেলের ঘরে ঠাঁই নিলাম। খানিক বিশ্রামের পর রাস্তায়। সন্ধ্যায় মোমোর গন্ধে ম-ম করা মহাত্মা গান্ধী মার্গে। সকলে মিলে তার স্বাদ নেওয়া শুরু হল। অদ্ভুত স্বাদ সেই মোমোর। বাড়িতে রাঁধলে কত তোয়াজ করতে খাওয়ার জন্য। তাতে দিতে হয় মাছের মাথা, ঘি। কিন্তু বাঁধাকপিও যে এত সুস্বাদু হতে পারে তা এই প্রথম বুঝলাম। ও বলা হয়নি, দলে একজন শাকাহারী থাকায় নিরামিষ মোমো অর্ডার করেছি। মোমো খেতে খেতে অদ্ভুত দুটো ঘটনা লক্ষ্য করলাম। মোমো খেতে আসা বেশিরভাগ লোকজনই বাংলায় কথা বলছে। গরম পড়তে না পড়তেই বাংলা ঝেঁটিয়ে ঠান্ডা হতে এসেছে গ্যাংটকে। গন্ডগোল আর কাকে বলে! স্ত্রীয়ের শপিংয়ের বায়নাক্কায় জেরবার স্বামী। কচিগুলোও কম যায় না। দুই এবং সবচেয়ে বড় ব্যাপার- এখানকার মানুষগুলো একজনও খাবার পর প্যাকেটটা দু্মরে-মুচড়ে রাস্তার ধারে ছুড়ে পুরসভার সাফাইকর্মীদের কাজ বাড়াচ্ছেন না। মানে আমরা কর দিই। ওরা একটু কাজ করুক মনোভাবটা ওঁদের নেই। সকলেই কষ্ট করে উঠে এসে সবকিছু ডাস্টবিনে ফেলছে। প্রবল সন্দেহ হয়েছিল ওঁরা কি ভারতীয়?! ওঁদের দেখাদেখি আমরাও নিয়মানুবর্তী হয়ে উঠলাম। চক্ষুলজ্জা বলে একটা কথা আছে তো? মোমো খাওয়ার পর কাগজের প্লেটটা আমরাও ডাস্টবিনে ফেললাম।

এরপরের দু’দিন মনে শুধু সেমিনার আর সেমিনার। সেমিনারের প্রধান অতিথি ছিলেন সিকিমের মুখ্যমন্ত্রী পবন চামলিং-সবুজ রাজ্যের সবুজ রাজা। ওঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টাতেই সিকিমের আজ ‘জৈব রাজ্যে’র তকমাপ্রাপ্তি। প্লাস্টিক, আবর্জনাহীন সুন্দর সাজানো রাজ্যের উদাহরণ এই সিকিম। আমরা সমতলের সমস্ত সুযোগ সুবিধা আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকি। কোনওটাই ছাড়ি না, তা সে ভাল হোক বা খারাপ। আর এঁরা ভারতের দুর্গম প্রদেশে আধুনিক সুবিধা না পেয়েও বিষাক্ত সুবিধাগুলিকে দূরে সরিয়ে রেখে সবুজ বাঁচানোর শপথ নিয়েছে। প্রকৃতিকে সাজিয়ে রাখছে নিজের মতো করে। আমরা যে কবে সারা ভারতকে পথ দেখানোর ভাবনা ছেড়ে নিজেদের চারপাশটা ঠিক করে গুছিয়ে রাখতে পারব?

সেমিনারের শেষদিন সন্ধ্যায় গ্যাংটকের বাজার ঘোরার সুযোগ পেয়েছিলাম। ছোট জায়গায় সুন্দর একটা বাজার। হরেকরকমের পসার। চায়ের চামচ থেকে চা পাতা, ডালের বাটি থেকে ডাল, গামছা থেকে শুরু করে শাল- কী নেই সেখানে! বাড়ির জন্য কিছু নেব ভেবেছিলাম। কিন্তু কোনটা নিয়ে যাওয়া যে ঠিক হবে তা ঠিক করতে না পেরে ক্ষান্ত দিলাম। পর মুহূর্তেই একটা উপলব্ধি হল, বুঝলাম বান্ধবীরা কেন আমার সঙ্গে শপিংয়ে যেতে চায় না।…

সেদিন সন্ধে থেকেই আকাশের মুখ ভার। হয়তো আমাদের বিদায়ের দুঃখেই। অতঃপর বাদল ফুঁড়ে বর্ষা এল। সেই সঙ্গে ১৩ ডিগ্রি তাপমাত্রা নেমে এল ৫-এ। এতদিন সিকিমের আসল আমেজটাই পাচ্ছিলাম না। এতক্ষণে হিমালয়ের বরফ শীতল আবহাওয়ার কিছুটা অনুভূতি পেলাম। বিদায় নেবার আগে সিকিম আমাদের উপহার দিল যেন।

এবার ফেরার পালা। না চাইলেও সিকিমকে বিদায় জানাতেই হবে। সিকিম তখনও কেঁদেই চলেছে। কনকনে ঠান্ডার মধ্যেই বেড়িয়ে পড়তে হল। বাংলায় ফিরছি কিন্তু পিছুটান রেখে যাচ্ছি। এবার ছুঁতে পারিনি ছাঙ্গুকে, নাথুলাকে, ইয়ামথাংকে, সিল্ক রুটকে, আরও কতকিছুকে। সময় যে বড় কম ছিল।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *