অন্য সফর

ইছামতীর সীমান্তে

স্যমন্তক ঘোষ

ছোটবেলা থেকে মায়ের কাছে শুনে এসেছি, ‘বাঁদরামো’র একটা ‘সীমা’ থাকে। ‘সীমা’ পার করলেই পিঠে উত্তম-মধ্যম পড়বে।

শুধু পড়বে? শুধু হুমকি? বহু হাতা বহু খুন্তি বহু স্কেল বহু-বহু ছাতা ভেঙেছে পিঠে। আর সে সব শাসনের আশ্রয়ে কবে যেন ওই ‘সীমা’ শব্দটার প্রতি একটা আসক্তি জন্মে গিয়েছে। কেবলই মনে হয়েছে, আছেটা কী সীমান্তের ওপারে যে, পার করতে এত মানা?

বড় বয়সে জেনেছি, সীমানা আর সীমান্তের মধ্যে নাকি একটা তফাত আছে। বুঝতে পেরেছি, যদ্দুর পর্যন্ত বাঁদরামো করলে কেবল বকুনিতেই কাজ চলে, তাকে বলে সীমানা। সীমান্ত পার মানে, কপালে বড়-সড় দুঃখ। ক্রমে ক্রমে বুঝেছি সে সব কথা। যত বুঝেছি, সীমানা এবং সীমান্ত ততই চেপে বসেছে আমার উপর।

সালটা ঠিক মনে পড়ছে না। যদ্দুর সম্ভব ২০১০। ২০১২-ও হতে পারে। সম্ভবত ‘পরিবর্তনে’র পরেই। বাবা-জেঠুরা ঠিক করেছে, কোনওভাবেই কলকাতায় পুজো কাটানো যাবে না। সদলবল যেতে হবে কোথাও। হই-হট্টগোল করে কাটানো যাবে ক’টা দিন। কিন্তু চাইলেই তো আর হয় না! দিনপনেরোর নোটিসে জায়গা দেবে কে? যে হোটেলেই ফোন করা যায়, মুখের উপর রিসিভার নামিয়ে দেওয়ার শব্দ। জায়গা নেই। পূর্ব থেকে পশ্চিম, মধ্য থেকে দক্ষিণ— বঙ্গদেশ পর্যটকে পরিপূর্ণ। অগত্যা! টাকি!

চারদিনের জন্য আস্ত একটা গেস্টহাউস পাওয়া গেল। জেঠুরাও খুশি। এ তো পুরো বাড়ির মতো ব্যাপার! ঠিক যেমন ঘটত ওদের ছোটবেলায়। গ্রামের ঘাটে গিয়ে ভিড়ত নৌকো। গোটা রাস্তা ছইয়ের উপর শুয়ে শুয়ে গান গাইত বড়জেঠু। রবীন্দ্রসংগীত অথবা শচীনকত্তা। ছলাৎছল দাঁড়ের সঙ্গে দিব্যি মিলে যেত তাল। বাড়ির ঘাটে নৌকো ভিড়তেই সুপুরিবন এক ছুটে পার করে ভাইয়েরা চলে যেত ঠাকুরদালানে। কার বাড়িতে কেমন ঠাকুর, দেখতে হবে না! কোথায় বাবুকার্তিক, কোথায় সেনাপতি! সীমান্ত সেই সমস্ত কাহিনিতে ইতি টেনে দিয়েছে। সেই ভয়ই কি পূর্ববঙ্গীয় আমার মাকে এখনও ভাবায়? কথায় কথায় সেই জন্যই কি ‘সীমা’ ঢুকে পড়ত তার বকুনিতে? সীমান্তপারের দুঃস্বপ্ন তাড়া করে ফিরত?

হতে পারে। না-ও হতে পারে। মা তো ‘দেশ’ দেখেওনি কখনও। সিলেট থেকে দাদু যখন শিলং চলে আসেন, মা তখন কোথায়? সে দিক থেকে শিলংই মা’র দেশ। বাবা অবশ্য ওপারে জন্মেছে। তবে জ্ঞানবুদ্ধির আগেই কলেজ স্ট্রিটের কলাবাগান বস্তি— উদ্বাস্তু। ভাগ্যিস বড়জেঠুর রেলের চাকরি ছিল! বস্তির ভিতর মস্ত মস্ত দু’টো বাড়ি ভাড়া নিয়ে ওপারের কর্মচারীদের আচ্ছাদনের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। শুনেছি, সেই মস্ত বাড়ির লম্বা হলঘরে বইপত্র, বিছানাপত্তর দিয়ে সীমানা তৈরি করা হত। একেকটা খোপে একেক রকম কাজ। ওপার থেকে আত্মীয়স্বজন, পাড়া-প্রতিবেশীরাও এসে থেকেছে বাড়িতে। একটু ভাত আর নিশ্চিন্ত ঘুমের জন্য। সময় বদলেছে। বাবা-জেঠুরা একে একে ভেঙে গিয়েছে ছোট ছোট বাক্সবাড়িতে। বড়জেঠু আর নেই।

অনেকদিন পর একসঙ্গে আস্ত একটা গেস্টহাউস পাওয়া তাই নস্টালজিয়ার মতোই। ষষ্ঠীর দিন গাড়ি নিয়ে চলে গেল বাবা-জেঠু-পিসিরা। কিন্তু আমরা ভাই-বোনেরা সঙ্গ দিতে পারলাম না। সকলেরই যে আপিস! ঠিক হল, আমরা যাব দশমীতে। হুল্লোড় ছাড়া আরও একটা আকর্ষণ আছে। দশমীর বিসর্জন। ইছামতীর ধারে সে এক বিপুল আয়োজন।

সীমান্তের ওপার থেকে ভেসে আসছে মাইকের শব্দ। দিকে দিকে ‘টুনির মা’ বাজছে। পাল্লা দিয়ে বাড়ছে এপারের মাইকের ভলিউম। সেখানেও ‘টুনির মা’। পাকানো গোঁফে তা দিয়ে, মেশিনগান কাঁধে ঝুলিয়ে চা খাচ্ছে রাজস্থানি বিএসএফ জওয়ান। আজ তার কিছুই করার নেই। মাইকের শব্দের মতোই মানুষ পারাপার হবে আজ ইছামতী বেয়ে। বিকেল চারটে থেকে পাঁচটা খোলা থাকবে বর্ডার। সীমান্তপারে কোনও রক্তচক্ষু থাকবে না। কোনও বকুনি থাকবে না। এপার যাবে ওপারের মেলায়। ওপার আসবে এপারের জিলিপি খেতে।

দিনের দিনই বুক করা হল নৌকো। গেস্টহাউসের ম্যানেজার বলে দিয়েছিল, বেলা যত গড়াবে, মাঝিরাও দর হাঁকবে তত বেশি। দরাদরি করার সুযোগ অবশ্য মেলেনি। ভিটে ফেলে আসা নস্টালজিয়া দেশের মাটির স্পর্শ পেতে সব দাম দিতে তৈরি। মাঝি সতর্ক করে দিল। ঠিক চারটেয় নৌকো ছাড়বে। কিন্তু ঘাটে পৌঁছে যেতে হবে আড়াইটের মধ্যে। নইলে বিপদ।

বিপদ? গেস্টহাউস থেকে ঘাট সাড়ে পাঁচ মিনিটের পথ। জেঠু-জেঠিমাদের জন্য আরও মিনিটসাতেক গ্রেস ধরা যেতে পারে। কোনওভাবেই তার চেয়ে বেশি নয়। মাঝি কি মজা করছে না কি? প্রশ্নের উত্তর মেলেনি। আড়াইটের মধ্যে পৌঁছনো যায়নি ঘাটেও। একে তো সকলে মিলে দুপুরের খাওয়া শেষ করতে সময় লেগেছে অনেক। শুধু তো খাওয়া নয়, হাত শুকনোর গল্পও তো আছে! তার উপর বৃষ্টি এবং শ্বাসকষ্ট। হাঁপানি নিয়েই টাকিতে এসেছে সেজজেঠু। বৃষ্টি নামতেই কষ্ট বেড়ে গেল। অগত্যা ঠিক হল, তাকে বাদ দিয়েই যাওয়া হবে ওপারে। একটাই শর্তে। ‘বাংলার মাটি’ এবং ‘বাংলার জল’ নিয়ে আসতে হবে জেঠুর জন্য। গেস্ট হাউসের গেটে পৌঁছতেই বিপদটা বোঝা গেল। ঘণ্টাখানেক আগেও নদীর ধারের চেহারা অন্যরকম ছিল। এখন শুধুই মাথা। হাজার হাজার, লাখ লাখ মাথা। সকলেই সকলের আগে যেতে চায়। সকলেরই গন্তব্য নৌকোর ঘাট। ঘাটে কাতারে কাতারে নৌকো। তার মধ্যে থেকে সকালের নৌকোটাকে খুঁজে বার করা প্রায় অসম্ভব। ওদিকে নদিবক্ষে বিসর্জন শুরু হয়েছে। ঢাক-কাঁসর-ক্যানেস্তারার আওয়াজ গিলে ফেলছে মাইকের চিলচিৎকার।

সীমান্ত পার করা কি ভুল হবে এখন? এমনই কোনও ভয়াবহতার ছবিই কি তৈরি করার চেষ্টা করত মা? ছোটবেলায়?

কে দেখে কাকে? যাকে নিয়ে কথা হচ্ছে, সে-ই তো লিড করছে গোটা টিমকে! ভিড় ঠেলতে ঠেলতে এগিয়ে চলেছে ঘাটের দিকে। নৌকো পেতেই হবে। এত যন্ত্রণা নিয়ে যে দেশ ছাড়তে হয়েছিল, তাকে ফিরে পেতে, সামান্য সময়ের জন্য হলেও তার কাছে ফিরে যেতে কষ্ট করতে হবে না?

ঘাটে পৌঁছনো গেল। সত্তরোর্ধ্ব যুবক-যুবতীরা চিনে বার করল মাঝিকে। তারপর নৌকো টপকে টপকে পৌঁছে গেল সবুজ খোলার সাদা পালের নৌকোয়। ছইয়ে পতপত করে উড়ছে ভারতীয় পতাকা। একইরকম দেখতে আরও আরও নৌকো অপেক্ষারত ইছামতীর ওপারে। তফাত কেবল পতাকার রঙে।

নৌকো ছাড়ল। দু’পারেই। মাঝনদীতে বিসর্জন চলছে। ক্রমশ এগিয়ে আসছে ওপারের নৌকো। কাছে আসছে। আরও কাছে। আরও কাছে…।

…বাপরে বাপরে বাপ!

দুমাদ্দুম বোম পড়তে শুরু করল নৌকোয়! না! বোম নয়! ফল। লজেন্স। বড় বড় আখের টুকরো। সে সব কখনও এসে লাগছে চশমায়। কখনও কপালে। কখনও-বা এসে পড়ছে কোলের উপর। এমনই রীতি। দু’পারের মানুষ এভাবেই ছোড়াছুড়ি করে অভিবাদন জানায় একে অপরকে। সুখের কী? বলা মুশকিল! এখন তো সবই ভাল লাগছে! দেশের অপেক্ষায় ছলছলে চোখ। প্রচুর আওয়াজ, রকমারি শব্দের ভিতর থেকে ভেসে আসছে বড়জেঠুর গান। শচীনকত্তা। দূরের, বহু দূরের নারকেল গাছগুলোকেও যেন মনে হচ্ছে সুপুরিবনের সারি। পাড়ে দাঁড়ানো মানুষগুলোকে মনে হচ্ছে পরমাত্মীয়। আমারই মনে হচ্ছে এমন। বাকিদের মনের ভিতর কেমন হচ্ছে তবে? ইতিহাস গুলিয়ে গুলিয়ে উঠছে নিশ্চয়ই!

দেশের মাটি ছুঁল নৌকো। অনুভব করতে পারছি, জাহ্নবী নদীর তীরে কর্ণকে নিজের পরিচয় দিচ্ছে কুন্তী। চোখের কোল ভরে উঠছে ছেলের। জড়িয়ে ধরতে ইচ্ছে করছে মাকে। কিন্তু পারছে কই? না, সম্ভব নয়। মা-ছেলের মধ্যিখানে সীমান্ত তৈরি হয়ে বসে আছে যে!

ঢালু পার বেয়ে একে একে দেশে পৌঁছেছিলাম আমরা। মেজজেঠিমাকে গোলাপ কিনে দিয়েছিল মেজোজেঠু। মাকে নিয়ে গ্রামের বাড়িতে ঢুকে পড়েছিল বাবা। সেজজেঠুর জন্য বোতল বোতল জল আর কাগজে করে মাটি তুলেছিলাম আমরা। আর কেনা হয়েছিল হাতপাখা। ‘বাংলার বায়ু’টাই-বা বাদ যায় কেন!

নদীর জলে মুখ ধুয়ে ফিরতি পথে চোখের জল লুকিয়েছিল বাবা-জেঠুরা। সন্ধে নামছিল ইছামতীতে। ভয় করছিল। জলসীমান্তে ভাসতে ভাসতে ভয়াবহ দেখতে লাগছিল টাকির নদিতীর। লাখ থেকে কোটিতে ছুঁয়েছে মাথা। দৌড়চ্ছে। সবাই দৌড়চ্ছে। তখনও। বিএসএফ আর বিডিআরের স্পিডবোটের সার্চলাইট ঘুরতে শুরু করে দিয়েছে। সময় কমছে। দৌড়ের গতি বাড়ছে। এগিয়ে আসছে বর্ডার বন্ধ হওয়ার সাইরেনের সময়।

সাড়ে পাঁচ মিনিটের পথ পৌনে এক ঘণ্টায় পৌঁছেছিলাম আমরা। ঘাট থেকে গেস্টহাউস। সকলের থেকে সকলে বিচ্ছিন্ন হয়ে। ফিরে এসে ডাক্তার ডাকতে হয়েছিল মেজজেঠিমা আর মায়ের জন্য। সীমান্ত পেরনোর ধকল সহ্য করতে পারেনি মা। ডাক্তার বকুনি দিয়েছিলেন— এই ভিড়ে কেউ যায়? হঠকারিতার তো একটা ‘সীমা’ থাকে! না কি!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *