পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

বরফের চাদরে গলানো সোনা রঙা চিত্রে

ঋতুপর্ণা ঘোষ

রোজকার জীবনের ছন্দে মাঝে মাঝে ইচ্ছা করেই ছন্দ পতন করানো দরকার। যাতে লুকিয়ে থাকা ছন্নছাড়া আমি মুক্তি পায়। তাই বেরিয়ে পড়লাম পাহাড়ের ডাকে।

সমস্যা হয়েছিল সঙ্গী নিয়ে। প্রত্যেকেই ব্যস্ত যে যার কাজে। এদিকে আমার প্রবল নেশা। অত:পর সাথীও জুটে গেল। আমার এক পরিচিত। যে দার্জিলিঙে কর্মরত। তার কাজের জায়গায় ফেরা আর আমার পাহাড়ের খিদে মেটানো। সেই কথা মতো তিস্তা তোর্সা এক্সপ্রেসে চড়ে বসলাম দুই সই…পাহাড় অভিযানে। সময় মতো কিন্তু প্রায় মাঝ রাতে এসে পৌঁছলাম নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে। ভোরের অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় কিছুই ছিল না।

গন্তব্য।

পরের দিন ভোর ভোর গাড়ি করে চললাম আমাদের গন্ত্যব্যে, চিত্রে। স্টেশন ছাড়িয়ে হিলকার্ট রোড ধরতেই ধীরে বদলে যাচ্ছিল চারপাশের গাছগুলো, প্রকৃতির রূপ। শুকনা ফরেস্টের বুক চিরে গাড়ি উঠতে লাগল পাহাড়ের আঁকাবাঁকা পথ পেরিয়ে। এসে পৌঁছলাম আমাদের ‘ব্যাগপ্যাকার ক্যাম্পে’।

দূরের কাঞ্চনজঙ্ঘা।

পাহাড়ের কোলে নেপাল সীমান্তে ছোট্ট গ্রাম চিত্রে। গলফ কোর্টের মতো বিস্তীর্ণ ভূমি আর দিগন্তে কাঞ্চনজঙ্ঘার রূপ শুধুই ভাল লাগায় ভরিয়ে দেয়। এই গ্রামটিতে এখনও সে ভাবে কংক্রিটের ছায়া পড়েনি। স্থায়ী নির্মাণ বলতে শুধুই স্থানীয় গুম্ফাটি। তা-ও বেশি দিনের পুরনো নয়। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে ভিতরে প্রবেশ নিষেধ। তাই বাইরে থেকেই দর্শন। সন্দাকফু ট্রেকিং পথে এটি একটি বিশ্রামস্থল। এভাবেই ঘুরে বেড়িয়ে সূর্যাস্ত দেখতে দেখতে ক্যাম্পে ফিরে এলাম। রাতে আড্ডা, গান, খাওয়া দিয়েই কাটল। শুতেই ক্লান্তিতে দু’চোখের পাতা বুজে এল।

পথের ধারে এঁরাও আছেন।

পরের দিন সকালে ঘুম ভাঙল ‘সোনার পাহাড়’ দেখে। কে যেন সাদা বরফের উপর থেকে গলানো সোনা ঢেলে দিয়েছে। লিখতে বসে বুঝলাম, একেই বোধহয় বাকরুদ্ধ হওয়া বলে। আমার কেন জানি মনে হচ্ছিল হাত বাড়ালেই ছুঁতে পারব। এই কথাটা বলায় আমি আবার আমাদের শেরপার কাছে বকাও খেলাম, ‘‘এগিয়ে যাবেন না।’’ যাই হোক, কফি সহযোগে সূর্যোদয় দেখতে দেখতে বেলা বাড়ল।

গুম্ফা।

আমাদের পাহাড় অভিযান পর্বের দ্বিতীয় ভাগ, দার্জিলিং। এসে পড়লাম সেই চেনা, প্রাণের, শহর দার্জিলিঙে। ‘ঘিঞ্জি, কী ভিড়, আর কতবার যাব একই জায়গায়’ এসব কথা সবাই বলে। আমিও শুনি। তা-ও আমার বড় প্রিয়। বারবার যাই। সেদিন ফিরতে ফিরতেই ঝুপ করে সন্ধ্যা নামল। সেদিন বসে বসে মন ভরে যাওয়া রাতের আলোয় ম্যালের রূপ দেখলাম।

দড়ির উপরে।

পরের দিন সকালে আমার ছিল নিজের দিন। সাইড ব্যাগে প্রয়োজনীয় জিনিস নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম চেনা শহরকে আবার দেখতে। খাদের ধারের পরিচিত রেলিং, একলা দাঁড়িয়ে থাকা চার্চ, ক্লক টওয়ার— এদের সঙ্গেই কথা বলতে বলতে বেলা গড়াতে লাগল।

হাত বাড়ালেই।

এক সোয়েটারের দোকানের আন্টির সঙ্গে কথা হল। তাঁর পরিবারের সবাই নাকি উলের ব্যবসা করেন। সোয়েটার বোনেন। ফেরার পথে ঢুকে পরলাম কিউরিও দোকানে। কথা হল তাঁর মালিকের সঙ্গে। কোনও জায়গায় গেলে স্থানীয় মানুষের সঙ্গে কথা বলে তাঁদের জীবনযাত্রা সম্পর্কে জানতে খুব ভাল লাগে। জিনিসগুলো দেখে বেরিয়ে এলাম যখন তখন সূর্য ডুবছে। পেটে ছুঁচো দৌড়চ্ছে। এক কাপ গরম চা, চাওমিন সহযোগে পেট পুজো করে ঘরে ফেরার পালা।

রাতের ম্যাল

পরেরদিন কাঞ্চনজঙ্ঘাকে বিদায় দিয়ে পাহাড়ের গা বেয়ে নেমে এলাম সমতলে। প্রচুর মুহূর্ত ব্যাগে ভরে, এক মুঠো ভাললাগা মনে নিয়ে উঠে পড়লাম ফিরতি ট্রেনে।

সব কিছু ঠিক হলে আবার আসব।

ছবি— লেখিকা

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *