পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ঝিলের পাশে, রাতের বরন্তি

দীপক দাস

‘তাহলে আমরা থাকব কোথায়?’ প্রায় আর্তনাদের মতো বেরলো প্রশ্নটা। এরকম প্রশ্ন, আমাদের প্রায় প্রতিটা সফরের টেমপ্লেট হয়ে গিয়েছে। গন্তব্য নামলেই হল। বা গন্তব্যে পৌঁছনোর কিছুটা আগে থেকে। থাকব কোথায়? জায়গা পাব তো? আগে থেকে থাকার ব্যবস্থা ঠিক করে রাখি না তো আমরা। তবে ব্যবস্থা ঠিক হয়ে যায় কিছু না কিছু।

ঘুরতে গিয়েছিলাম বরন্তি। বছর চারেক আগে। আমি আর ইন্দ্র। বাকিরা সেবার যেতে পারেনি। পুরুলিয়ার এই জায়গাটার রূপের বর্ণনা বহু লোকের মুখে শুনেছিলাম। তাঁরা ভুল কিছু বলেননি। মুরাডি স্টেশন থেকে বেরিয়ে রিকশা নেওয়ার পর থেকে প্রকৃতি মুগ্ধ করে চলেছে। মুগ্ধতা অবশ্য শুরু হয়েছিল আদ্রা থেকে মুরাডি আসার সময় থেকেই। ট্রেন থেকে দু’পাশের প্রকৃতির দিকে হাঁ করে তাকিয়ে থাকতে হয়। প্রথমে অবশ্য হাঁ করে নয়, চোখ বুজে তাকিয়েছিলাম প্রকৃতির দিকে। রাতে হাওড়া থেকে চক্রধরপুর প্যাসেঞ্জারে চেপেছি। কিন্তু এক সহযাত্রীর বাঘ ডাকার মতো নাক ডাকার চোটে সারারাত ঘুম হয়নি। আদ্রা স্টেশনে যখন নামলাম তখন ভোররাত। কিন্তু স্টেশন গমগমে। প্রচুর পাখি স্টেশনে। কলরবে মুখর আধো আলোছায়ার স্টেশন।

সেই পথ।

আদ্রা থেকে সকালে একটা ডেমু ট্রেন ছাড়ে। ওই ট্রেনে মুরাডি যাব। শুনেছি, মুরাডি থেকে বরন্তি পর্যন্ত রাস্তাটা যথেষ্ট সুন্দর। এখন ঘুম ছাড়ানো দরকার। স্টেশনের বাইরে এলাম। পুরসভার বিশাল একটা হাইমাস্ট আলোর নীচে একজন চা তৈরি করছেন। ওমলেট, টোস্টও আছে। আমরা শুধু চা-ই খাব। স্টলটার সামনে একটা দারুণ দৃশ্য দেখলাম। স্টলটা চলছিল ওই হাইমাস্টের আলোয়। দেখলাম, দোকানদার একটা হ্যাজাক বের করে জ্বালার চেষ্টা করছেন। হাইমাস্ট নিভে গেল। আর হ্যাজাক জ্বলে উঠল। কী অদ্ভুত টাইমিং। দীর্ঘদিনের অভিজ্ঞতা থেকেই হয়তো এই টাইমিং সম্ভব হয়েছে।

চা খাওয়ার পরেও অনেকটা সময়। স্টেশনে বসে বসে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। বসে বসে বুঝতে পারছিলাম, ভোরের আলো যত ফুটছে পাখিগুলোর আওয়াজ তত কমে আসছে। আমি ঝিমোচ্ছি আর ইন্দ্র কেকের দিকে তাকিয়ে আছে। আদ্রা স্টেশনে হাজার হাজার কেকের স্টল। এত কেক কে খায় কে জানে! ইন্দ্র কিনবে বলছিল। আমি রাজি হয়নি। তবে ফেরার সময়ে ও আর বারণ শোনেনি। কিনেই ছেড়েছিল। তারপর ওর হাল…আমাদের ‘মিষ্টিমহলের আনাচেকানাচে’তে তার বর্ণনা আছে।

বহু রূপে দেখেছি।

স্টেশনে কিছুক্ষণ বসে থাকার কারণেই একটু জবুথবু ভাব এসে গিয়েছিল। ফলে ট্রেনে উঠে ঝিমুনি এসে গিয়েছিল। ফাঁকা ট্রেন। আমরা বসিনি। দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইন্দ্র ছবি তুলছিল। একসময়ে আমার হাত থেকে টুপ করে ব্যাগটা পড়ে গেল। ইন্দ্র চেঁচিয়ে উঠল, ওই দেখো, দরজার কাছে দাঁড়িয়ে ঘুমোচ্ছে! ওই বকুনিতেই ঘুম শেষ। তাকিয়ে রইলাম বাইরের দিকে। পাহাড়, তেপান্তর, জঙ্গল। আমরা গিয়েছিলাম শীতকালে। কুয়াশার চাদর জড়ানো নরম প্রকৃতির রূপ বর্ণনার ক্ষমতা যে নেই।…

মুরাডি স্টেশনটা ছিমছাম। স্টেশনের বাইরে থেকে বরন্তি যাওয়ার গাড়ি মেলে। আমরা রিকশা নিলাম। গাড়ি তো হুস করে চলে যাবে। রিকশা করে ধীরে ধীরে যেতে চারপাশটা দেখে নিতে পারব। ভাগ্যিস সেদিন রিকশা করেছিলাম। না হলে ওই হঠাৎ সামনে চলে আসা দৃশ্য থেকে তো বঞ্চিত হতাম। পুরো রাস্তা বেশ সুন্দর। সেসব দেখতে দেখতে এগোচ্ছি। একটা পাহাড়কে বেড় দিয়ে রিকশা এগোতেই চোখের সামনে উদয় হল বিশাল এক জলাশয়। আর দূরে পাহাড়। শীতের সকালে সেই অপূর্ব দৃশ্যে মন ভরে উঠেছিল।

আরেক রূপ।

এর কিছুক্ষণের মধ্যেই বরন্তির অতিথি নিবাস এলাকায়। ঝিলের পাশে দু’টো নিবাস। বড় ব্যাপার তাদের। অনলাইনে বুকিং না করলে থাকতে দেয় না। এবার ঝিলকে উস পার জানা পড়েগা। ফুলের বাগান করা একটি অতিথিশালা। তারাও একই নিয়মে চলে। আর তখনই আমার মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল, ‘তাহলে আমরা থাকব কোথায়?’ অতিথিশালার এক সহৃদয় কর্মী বললেন, ‘দেখুন না। পেয়ে যাবেন।’ সত্যি পেয়ে গেলাম। ওই অতিথিশালার কাছেই মানভূম হলিডে হোম। ফাঁকা। আমরা দু’জন একটা ঘরে ঢুকে পড়লাম। তার আগে বিস্তর দর কষাকষি হয়েছিল। কারণ এখন তো মরসুম নয়। লোকে বরন্তি আসে দোলের সময়। সেই সময়ে এখানে প্রচুর পলাশ ফুল ফোটে। তাই দাম কিছু কমানো গেল।

তার পর টিফিন করে ঘোরাঘুরি শুরু। গেস্ট হাউস থেকে কিছুটা গিয়েই বাঁ হাতি রাস্তা। সেখান থেকে একটু গেলে একটা রাস্তা সোজা বেরিয়ে গিয়েছে। জঙ্গুলে মাটির রাস্তা। একেবারেই নির্জন। শুধু নাম না জানা প্রচুর পাখি অনবরত ডেকে চলেছে। এত ভাল লাগছিল। মাঝে মাঝে একটা দু’টো সাইকেল হুস করে জঙ্গলের পথ ধরে গ্রামের দিকে চলে যাচ্ছে। এই জঙ্গল পথ পেরিয়ে কোথাও একটা গ্রাম রয়েছে। রাস্তার পাশে জংলি আম গাছ। দূরে পাহাড়ের উপরের জঙ্গল ঘন হয়ে মাথা উঁচু করে রয়েছে। ওই রাস্তা থেকে ফিরে চলে গেলাম মানপুরের দিকে। একটা প্রাথমিক বিদ্যালয়। দু’একটা বাড়ি। তাতে ফিস্টের আয়োজন। রাস্তার পাশে পোল্ট্রি ফার্ম। তার আগে মাঠে নেমে জঙ্গল ভেঙে এদিক ওদিক দেখে নিয়েছি। সেসব দেখে গেস্ট হাউসে ফিরে আসা।

মাছ ধরতে চলেছেন।

দুপুরে সামান্য একটু ঘুম। বিকেলে আবার ঘুরতে বেরনো। প্রথমে ঝিলের ধারে। দেখা হল দু’জন জেলের সঙ্গে। একটা লাঠিতে বাসের টিউব ঝুলিয়ে মাছ ধরতে চলেছে। ঝিলের জলে টিউব ভাসিয়ে মাছ ধরবে। একপাল গরু চরে বেড়াচ্ছে ঝিলের পাশে। হাঁটতে হাঁটতে চলে গেলাম আরেক প্রান্তে। রাস্তাটা খুবই খারাপ। আমাদের মতো দু’একজন অতিথি ঘুরছেন। এক বৃদ্ধ দম্পতির সঙ্গে দেখা হল। আলাপও হল। ঝিলের পাশ থেকে ফিরে আদিবাসী পাড়ায়। সকালে যে রাস্তায় গিয়েছিলাম তার উল্টোদিকে। পাড়াটা পেরিয়ে আবার পাহাড়, জঙ্গল। নির্জন।

পাখির চোখে। ইয়ে ইন্দ্রর ক্যামেরায়। গেস্ট হাউসের পিছন দিকের পাহাড় থেকে।

এখানে রাস্তার দু’ধারে প্রচুর পলাশ আর কুলের গাছ। অন্য গাছ তো রয়েছেই। ফেরার পথে অসাধারণ একটা জিনিস লক্ষ্য করলাম। ওই যে ফুলের বাগান করা অতিথিশালা, ওখানে কোনও কলেজ থেকে ঘুরতে এসেছে একদল ছেলে মেয়ে। সকলের মধ্যেই কৈশোরের চাপল্য। রাস্তার ওপরে দু’টো ছেলে নাগিন ডান্স করছিল। বাকিরা ওদের উৎসাহ দিচ্ছিল। বেশ কলরব মুখর জায়গা। হঠাৎ এক দিদিমণি একজনের নাম ধরে ডাকলেন। দেখলাম, পুরো দলটাই সেই ছেলেটার পিছন পিছন অতিথিশালায় ঢুকে পড়ল। বোঝা গেল, ওই ছেলেটিই দলের নেতা। তার টিকি ধরে টান দিতেই লেজও চলে এল। দিদিমণির বুদ্ধির তারিফ না করে পারলাম না।

অন্য প্রান্তে। জলাশয়ের একাংশ।

পরদিন ভোর ভোর উঠে আরেক চক্কর দেওয়া গেল। পাড়া পেরিয়ে সেই জঙ্গলে, পাহাড়ে। জঙ্গলের পথে হাঁটতে হাঁটতে অনেক দূরে। ওদিকেও একটা বিশাল জলাশয় রয়েছে। পথে একজনের সঙ্গে দেখা হয়েছিল। তিনি বললেন, এদিকের জঙ্গলে হরিণ আছে। একবার নাকি ওই দূরের পাড়ার লোকেরা হরিণ মেরে খেয়েছিল।

লোকে বলে বরন্তির আসল রূপ দেখা যায় পলাশ ফুটলে। কিন্তু শীতের বরন্তিও আমাদের মুগ্ধ করেছিল। জঙ্গল, পাখির ডাক, পাহাড়ের ওপর থেকে জঙ্গল আর জলাশয়ের ক্যানভাস এখনও চোখে ভাসে। তবে আমাদের সবচেয়ে ভাল লেগেছিল রাতের বরন্তি। সন্ধের পরে গিয়েছিলাম জঙ্গলের কাছে। কী নির্জন। অন্ধকার। একটানা ঝিঁঝিঁ ডাকছে। জঙ্গল থেকে একটা পাখির ডাক ভেসে আসছে। অদ্ভুত ডাক পাখিটার। শুনলে মনে ভয় জাগায়। আমাদের দলের সকলকে নিয়ে একটা রহস্য অভিযানের গল্প লিখেছিলাম, ‘যমধারার জঙ্গলে’। ‘জয়ঢাক’ ওয়েব ম্যাগাজিনে বেরিয়েছিল। যমধারা শুশুনিয়া পাহাড়ের কাছে। কিন্তু গল্পের ভয়ের পরিবেশ তৈরিতে বরন্তির এই নির্জন রাতের প্রকৃতিই সাহায্য করেছিল।

চেনা ছবি।

খাওয়াদাওয়ার পরে আবার গিয়েছিলাম ঝিলের পারে। অন্ধকার। ঝিলের উপর দিয়ে হিমেল হাওয়া চোখেমুখে লাগছে। আমরা দু’জনে চুপ করে দাঁড়িয়ে সেই নির্জনতা উপভোগ করছি। ঝিলের পাশের গাছ থেকেও রাতচরা একটা পাখি ডাকছিল। কিন্তু সেটা ওই জঙ্গলের পাখিটার মতো অদ্ভুত সুরে নয়।

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *