ইতিহাস ছুঁয়ে পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

চণ্ডীদাসের ছাতনা থেকে যমধারার জঙ্গলে

দীপক দাস

আজ একটা রহস্য গল্প শোনাব। ওহো রহস্য গল্প বললে এখন আবার ঠিক জমে না। বলতে হয় সাসপেন্স থ্রিলার। এটা শুনলে আবার মনে হয়, সাসপেন্স না থাকলে থ্রিলার হয়! যাগ গে সে সব কথা। আমাদের রহস্য গল্পটা বলি। বলিউডের মতোই কাঁচা সে কাহানি।

‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের ভ্রমণ কাহিনি নামে চলা গালগল্পগুলো যারা এতদিন সহ্য করেছেন, তাঁরা আমাদের সব কীর্তিই জানেন। এই যেমন ট্রেনের টিকিট কাটা থেকে আমাদের গন্ডগোল শুরু হয়। কোনও জায়গায় আগে থেকে ঘর ঠিক করি না বলে প্রবল টানাপড়েন চলে। ইন্দ্র বেশি খায়, বাবলা বিটলেমি করে। আমি ঘুমোই। ঘটনা হল, এ সবই আমাদের পরের দিকের ভ্রমণের গল্প। এতদিন প্রথম সফরের গল্পটাই লেখা হয়নি। অথচ পরের পর সফরনামা লিখেছি আমরা। মানে হিন্দি সিনেমার সাসপেন্সের মতো। শুরুতেই ফট করে নায়ক খুন হয়ে গেল। তাহলে ভিলেনদের ঠেঙাবে কে রে বাবা!

স্মারক ছবি। বাবলা আর মেজো।

আমাদের গ্রুপের প্রথম দূর সফর বাঁকুড়া। দুর্গাপুজোর সময়ে। এ গল্পে কিন্তু চেনা চরিত্রদের পাওয়া যাবে না। দলের গুবলেটেশ্বর ইন্দ্র টিকিট কাটার গন্ডগোল করেছিল। তারিখ ভুল করে। ফলে দীপু আর শুভ যেতে পারেনি। কারণ ওদেরও হিসেব গন্ডগোল হয়ে গিয়েছিল। পুজোর সময় তো। বন্ধু-বন্ধুনীদের কথা দিয়েছিল বাঁকুড়া থেকে ফিরে ঠাকুর দেখাতে নিয়ে যাবে। কিন্তু আমাদের বেড়াতে যাওয়ার তারিখ পিছিয়ে যাওয়ায় ওরা আর দু’নৌকায় পা রাখার সাহস পায়নি। আর তখন কচি, জুয়েল বা অরিজিতের জন্ম হয়নি। ফলে ওদের যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। গিয়েছিলাম ছয় জন। আমি, ইন্দ্র, বাবলা ছাড়া ছিল আমার মেজ ভাই আর ইন্দ্রর এক তুতো ভাই কৃষ্ণ।

তো সাঁতরাগাছি থেকে রূপসী বাংলা ধরে বেলাবেলি বাঁকুড়া স্টেশনে। আকাশ শরতের হলে কী হবে রোদের তেজ মারাত্মক। স্টেশন থেকে বেরিয়েই সেটা টের পেলাম। কিন্তু ততক্ষণে চোখে পড়ে গিয়েছে বিডিআর-এর ইঞ্জিন। বিডিআর মানে বাঁকুড়া-দামোদর রেল। ন্যারো গেজের ট্রেন। এত ঢিক ঢিক করে যেত যে যাত্রীরা নাম দিয়েছিল বড় দুখখের রেল। এখন অবশ্য লাইনটা বন্ধ হয়ে গিয়েছে। কাগজে কত লেখা পড়েছি ট্রেনটা নিয়ে। সবাই মিলে পালা করে ইঞ্জিনের সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তোলা হল। তারপর সেখান থেকে বাসে করে বাসস্ট্যান্ড।

প্রথমে ঠিক হয়েছিল, বাসস্ট্যান্ডের কাছে কোনও হোটেলে বেসক্যাম্প করে দু’দিন ধরে বাঁকুড়া ঘুরব। বন্ধু জয়ন্ত একটা হোটেলের নামও বলে দিয়েছিল। বাসস্ট্যান্ড ছাড়িয়ে কিছুটা। শুশুনিয়া যাওয়ার রাস্তার দিকে পড়ে। কিন্তু হোটেলে খাওয়া দাওয়ার পরে মত বদলাল। ঘুরতে এসে শহরে রাত কাটাব? তার থেকে পাহাড়ের কোলে, শুশুনিয়ার গ্রামে থাকব। দু’একজন বলল, আগে থেকে ঘর ঠিক করা নেই। যদি কিছু না পাওয়া যায়! না পাওয়া গেলে ঘুরে ফিরে ব্যাক টু দ্য বেসক্যাম্প।

চণ্ডীদাসের বাসুলী মন্দির।

সেই মতো স্ট্যান্ড ছাড়িয়ে এসে বাসের জন্য অপেক্ষা। কিন্তু বাসের বদলে মিলল ট্রেকার। উঠে পড়লাম। ততক্ষণে আবার ম্যাপে বদল এসেছে। মনে পড়ে গিয়েছে ছাতনার কথা। ছাতনা মানে তো কবি চণ্ডীদাস। অনার্স বা এমএ ক্লাসে কম ভুগিয়েছেন মধ্যযুগের এই কবি! বাংলা সাহিত্যের পড়ুয়াদের একটা বিষয়ে পড়তেই হয়, চণ্ডীদাস সমস্যা। তিনি কোথাকার এবং কোন সময়ের তা নিয়ে বিস্তর বখেরা পণ্ডিতদের মধ্যে। তিনি বড়ু না অনন্ত বড়ু নাকি বড়ু ছাড়া, তা নিয়ে বীরভূমের নানুরের চণ্ডীদাস আর ছাতনার চণ্ডীদাস এক না আলাদা তার হিসেব এখনও মেলাতে পারিনি। নোটপত্তরও কোথায় হারিয়েছে। এমন ঘোরপ্যাঁচে ফেলা কবির গ্রামটা একবার দেখে যাব না!

ট্রেকার থেকে নেমে হতাশই হতে হল। ঘেরা জায়গায় ছোটখাট একটা মন্দির। কবির বাসুলী মন্দির। আশেপাশে কোথাও কবির পরিচয়, এই মন্দিরের সঙ্গে তাঁর সম্পর্ক, কিছুই লেখা নেই। শুধু মন্দিরের চুড়োয় লেখা, ‘সবার ওপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে মানুষ সত্য তাহার উপরে নাই’। তারপর কবির নাম লেখা। তা-ও আবার ভুল বানানে। সম্ভবত চণ্ডীদাস সমস্যা এড়াতেই অন্য সব পরিচয় মুছে ফেলা হয়েছে। কাব্যাংশটাও বেশ বাণী বাণী লাগে। মন্দিরে তখন পুজো চলছিল। কিন্তু পুরোহিতকে খুঁচিয়ে তেমন কিছু মিলল না। তিনি পুজোপাঠের বাইরে যেতে নারাজ। আরেক বিষয়ে জোর দিচ্ছিলেন তিনি। তাঁর পরিবার কত পুরনো এবং চণ্ডীদাসের বংশ-বৃক্ষের কতটা ঘনিষ্ঠ সেটাই বলছিলেন বারবার।

শুশুনিয়া বাসস্টপ থেকে আরণ্যক গেস্ট হাউসের দিকের পথ।

মন্দির থেকে বেরিয়ে শুশুনিয়া মোড়ের দিকে হাঁটা শুরু। ইন্দ্র আর কৃষ্ণ এই সফর সেরে হাওড়া থেকে আবার কোথায় পাড়ি দেবে। সেজন্য বিরাট লটবহর নিয়ে বেরিয়েছে। এবড়োখেবড়ো পিচের রাস্তায় ট্রলি টানতে টানতে চলেছে। সেসব দেখে লোকে হাঁ করে সার্কাসের জীব দেখার মতো করে আমাদের দিকে চেয়ে আছে। পুজোর সময়ে, গরমের মধ্যে বাঁকুড়ায় ঘুরতে এসেছে কারা, সেটাই বোঝার চেষ্টা করছিল। সে সব বিস্ময় দৃষ্টি উপেক্ষা হাঁটছি, হঠাৎ বাবলা দেখতে পেল রাস্তার ধারে একজন মাছ ধরার জাল বিক্রি করছে। ও ব্যাটা এলাকার নামী মৎস্য শিকারি। আর নড়ানো যায় না ওকে। জাল কিনবেই। যত বোঝাই এই পাহাড়, জঙ্গলে মাছ ধরবি কোথায়? আর আমাদের ওখানে তো জাল পাওয়া যায়। বাঁকুড়া থেকে জাল কিনে নিয়ে গেলে লোকে মারবে। আমাদের সব বোঝানো দূরে ঠেলে ও দরদাম করতে ছুটল। তারপর চমকে ফিরে এল। দামটা বেশ আচ্ছা মতো বোধহয়।

বাবলাকে সামলাতে না সামলাতেই ইন্দ্রর বায়ু চড়ে গেল। জালের ফাঁদ কেটে সবে দু’পা বাড়িয়েছি, ইন্দ্র একটা মিষ্টির দোকান দেখে দাঁড়িয়ে পড়ল। খাবেই। আমরা এলাকার নতুন খাবার চেখে দেখতে আগ্রহী। তার ওপর লুচির মতো সাদা কিন্তু রসে চোবানো একধরনের মিষ্টি সাজানো দেখেছি। মিথ্যে বলব না। আমাদের চেখে দেখার ইচ্ছে ছিল। ভয় শুধু ইন্দ্রকে নিয়ে। ও মিষ্টি কিনতে গেছে। কিলোখানেক না কিনে বসে। কম কম খাবার ওর ধাতে নেই। বেশি মিষ্টি খাওয়ার ভয় কেটে গেল ও ফিরতে। গোনাগুনতি কিনেছে। ও আমাদের দলের টেস্টার তো। জিভে ধরেনি নতুন মিষ্টি। সেটার নামটাও ভুলে গেছি এতদিনে। বিস্বাদ জিনিস কি আর মনে থাকে!

পদ্মপুকুরের সামনে তিন কমল কুমার।

শুশুনিয়ার চার মাথার মোড়ে দেখি একটা বিশাল মূর্তি। নামফলক দেখে বুঝলাম। কবি চণ্ডীদাস। মূর্তির উন্মোচন করেছেন মিহির চৌধুরী কামিল্যা। অধ্যাপককে চিনি। বাংলা পড়াটা আবার কাজে লেগে গেল। নারাজ সঙ্গীদের জোর করে কিছু জ্ঞান দিয়ে দিলাম।

চার মাথার মোড়ে বাসের জন্য অপেক্ষা চলছিল। কিন্তু বাস মিলল না। এল ট্রেকার। তাতে চড়েই শুশুনিয়া। ট্রেকার স্টপ থেকে আরণ্যক গেস্ট হাউস মাত্র কয়েক পা। ওইটুকু পথ পেরোতে গিয়েই আমাদের পকেট কাটা গেল।

ছবি-ইন্দ্রজিৎ সাউ

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *