অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

পিছু নিয়েছিলেন বিভূতিভূষণ

রবিশঙ্কর দত্ত

দু’একটা চ্যাপ্টা, বেশিরভাগই গোল। ময়দার তৈরি কাঠি। চিনির রসে ডুবিয়ে তোলা। এই তো কটকটি। সেই কটকটি। ট্রেনের দরজায় দাঁড়িয়ে খবরের কাগজের সেই ঠোঙা ভরা কটকটি মুহূর্তে শেষ। একটু আগে গুড়েরটা নিয়ে ঘুরে, হেঁকে গেলেন আরেকজন। সে কাঠির রং আলাদা। লাল বললে বোঝা যাবে না। গেরুয়া মতো। তাতে মিষ্টিটা একটু বেশিই। দশ টাকা শ।

তরুণ ফেরিওয়ালা বলল সেই ঢঙে, ঠিক যেমন শুনেছি আগে। হাওড়া, শিয়ালদার সব ট্রেনেই কটকটি হয়তো কমবেশি পাওয়া যায়। বনগাঁ লোকালে একটু বেশি। সেই কতদিন আগে থেকে এই এক দাম। সব জিনিসের দাম বাড়ে, কটকটির দাম বাড়েনি। চেহারাও বদলায়নি। হাঁটু সমান লোহার ড্রাম। এত ভারী যে ধাক্কায় তা নড়ে না। উপরে মোটা লোহার হাতল আর শক্ত ঢাকনা। চোখের সামনে সেই ঢাকনা খুললে দরজা খুলে যায় আমাদের স্মৃতি। কত কিছু উঁকি আমাদের দিকে। কত অতীত যে বর্তমান হয়ে দাঁড়ায়, দোলে আমাদের মাথায়।

ট্রেনের কটকটি।

কুড়ি বছর হবে। হয়তো তারও কিছু বেশি সময় আগে একবার এইরকম একা একা গিয়েছিলাম বনগাঁ। তার পর কাজের সূত্রে বহুবার। শিয়ালদা-বনগাঁ লাইনের হাবড়া-মছলন্দপুর পর্যন্ত চেনা ভিড়। গাড়ি, বাড়ি, ব্যস্ততা, হুড়োহুড়ি। তারপর ঠিক মিষ্টির দোকানে সার দিয়ে সাজানো ট্রের মতো একটার পর একটা স্টেশন। অথবা ফুলের বাজারের মতো সার দেওয়া সাজানো। গোবরডাঙা, ঠাকুরনগর, চাঁদপাড়া। ট্রেনের গতির সঙ্গে চোখের সামনে সবুজ বাড়ে একেকবার। আর স্টেশনে ট্রেন যখন থামে সেখানে হাওয়া এসে মেখে যায় মুখে চোখে। হাওয়া বললে ঠিক সেই স্পর্শ বোঝানো কঠিন। সেই হাওয়ায় ধুলো থাকে, রোদ থাকে। এখানে একটা নতুন হল্ট স্টেশন হয়েছে। শুধু নামটা চোখে পড়লে সেই আলো আর হাওয়ার অনুভূতি বদলে যায় অজান্তে।

বিভূতিভূষণ হল্ট।

এই ঠিকানা চোখ ছুঁতে না ছুঁতেই রেলের বাঁশি রাস্তা দেখায়। পরে সেই ঠিকানা বনগাঁ। ট্রেনের কামরা থেকে পাশের লাইন-পাথর ছুঁয়ে দৃষ্টি ভেসে যায় সবুজে। আমবাগান, শাপলা বুকে পুকুর, ন্যাড়া উঠোনে জাবরকাটা গরু, মাদুরের গা ঘেঁষে ঘুরে বেড়ানো মুরগি, ভাঙা সাইকেল ঘিরে একঝাঁক বাচ্চা। ট্রেন এগোলে চোখ ফিরতে থাকে ঝকঝকে প্ল্যাটফর্মে। কানে ইয়ারফোন লাগানো তরুণী মনে করিয়ে দেন ট্রেন কত গতিতে এগিয়ে চলেছে। শ্রীপল্লি-বারাকপুর।

বাংলার মুখ।

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক বাড়ি। খুব অস্পষ্ট মনে আছে শ্যাওলা-সবুজ ক্যানভাসে উপর দেওয়াল-দরজার দিকে তাকিয়ে কেমন সবুজ জড়ানো ঠান্ডা অনুভূতি হয়েছিল শরীর জুড়ে। যে বার বিভূতিভূষণের উঠোন ছুঁয়ে এসেছিলাম, সে বারই আমার বড়মাসির সঙ্গে দেখা করে এসেছিলাম। অনেক সময় লেগেছিল। দু’টো ঠিকানায় দূর অনেক। স্পষ্ট মনে আছে গোপালনগরে আমার পিসির বাড়ি। গ্রামের নাম সহেলি। আমাদের বাড়ির গোটা তিন ঢুকে যাবে ও বাড়ির ফাঁকা উঠোনে। গোটা গ্রামই পিসির বাড়ির উঠোন। আমরা পিসির বাড়ি বলিনি কখনও। বলতাম, সহেলি যাব।

একবার মায়ের সঙ্গে গিয়েছিলাম ও বাড়ির এক বিয়ের অনুষ্ঠানে। আমি আর দিদি। ট্রেনে চড়েই গিয়েছিলাম। কিন্তু বিবরণ দিতে পারব গোপালনগর স্টেশন থেকে মাটির রাস্তায় গরুর গাড়ি চড়ে গিয়েছিলাম বাড়িতে। দুর্গামণ্ডপের সামনে ভিড় হয়েগিয়েছিল বসুবাড়ির অতিথিদের ঘিরে।

বিভূতিভূষণের বাংলা। জীবনানন্দেরও।

পিসিমশাইয়ের ভারী চেহারা। ঘাড় ছাপানো চুল। পেট পর্যন্ত সাদা দাড়ি। সন্ত-চেহারায় সবসময় হাসি। একটা শান্তি বোধ হয় দেখলেই। এই বাড়ি আমার মতো আধা শহরে বা গোড়া মফস্বলির কাছে ছিল মোহিনী গ্রাম। সাত-বছরে প্রথম বেগুনের বাগান, কপি খেত ঘুরে হাঁড়ি বাধা খেজুর গাছের নীচে দাঁড়িয়ে রসের গন্ধ পেয়েছিলাম। হাতে পাতা তাজা মূলো নিয়ে ফিরেছিলাম। কপি, মূলত, আলু, বেগুন সব পিসিদেরই। ছোট, বড় অনেক পুকুর এদিক ওদিক ছড়িয়ে। শান্ত, ক্লান্ত গরু যেমন গাছের ছায়ায় শুয়ে থাকে তেমন গাছের ছায়া পড়ে সেই পুকুরের জলে।

বছর কুড়ি আগে সে বাড়িতে গিয়ে দেখেছিলাম শৈশবে দেখা বসুবাড়ির সেই গমগমে ভাবটা কম। সব আছে কিন্তু বিশাল বাড়ি ভাগ হয়ে গেছে আট-দশ ভাগে। একই সুরের পুরনো বাঁধনে আলাদা আলাদা লয়। বড়পিসির কাছে পৌঁছনো পর্যন্ত একজনের মুখ দেখলাম। পৌঁছলাম। ঘরভরা ধানের বস্তা। তার সামনে একটা চৌকিতে বসে উমা বসু। আমার বড়পিসি। গায়ের রং কালো। চোখমুখও খুব টানা, তীক্ষ্ম না। তবে সাদা শাড়িতে ভারী উদাস চেহারায় মা অধিষ্ঠিত। পিসি আমার মায়ের থেকে বয়সে অনেকটা বড়। দিদি ছিল মায়ের মতো, মা বলত।

ধানের গন্ধ আর মায়ের গন্ধে মায়া থাকে।

রেললাইনের পাশে পড়ে থাকে অফুরান সৌন্দর্য।

বনগাঁর বন্ধুরা বলে— বিভূতিভূষণের ভিটে ভুগছে অবহেলায়। যত্ন করার কেউ নাই। বাড়ির উঠোনে জঙ্গল। পুকুরঘাট নোংরা। ভিতরের জিনিসপত্রেরও এক অবস্থা। পিসির বাড়ির বড় উঠোনে গরুর জাবনা দেওয়ার বিশাল মাটির হাঁড়ি। তার গায়ে বহুদিনের কাদা শুকিয়ে। গোড়ায় কোমর সমান একটা বাঁশ পুঁতে রাখা। এই বোধহয় গরু বাঁধার খুঁটি। দেখে মনে হয়, অনেকদিন এ সবের কোনওটাই ব্যবহার হয়নি।

মাটির রাস্তা ধরে ঠিক কোনও দিকে, কতটা যেতে হবে মনে নেই। কিন্তু একটা বাঁওর আছে। পাতলা বরফের মতো চকচকে উপরের জলটা। আর তাতে বেলাশেষের নীরবতাকে কী অসহায় আত্মীয় মনে হচ্ছিল আমার। বড় বড় বকের ডানা ওঠানামা করে দিন ফুরনোর রং। তালগাছের পেট কেটে তৈরি ডিঙিতে সেই জলে ভাসছি দেখে দিদি আঁতকে উঠেছিল। বাঁওরের জলে না গিয়ে এতদিন পরে ফের সেই ডিঙিতেই ভাসলাম।

গ্রামের পসরা।

স্মৃতির সঙ্গে মিলিয়ে নিলাম। তিনটে ছাব্বিশে বনগাঁ স্টেশন ছেড়ে এগোতেই কানের ইয়ার ফোন দিলাম। সসহযাত্রী আব্বাসউদ্দিন, মাঝি বাইয়া চল রে…।

অকূল দরিয়ার বুঝি কূল নাই রে।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *