জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

আমঝর্নায় চার আম আদমি-দ্বিতীয় পর্ব

দীপক দাস

বাজার দেখে কোনও এলাকার হাল হকিকত বোঝা যেতে পারে। কিন্তু সৌন্দর্য নয়। পড়ন্ত দুপুরে বেলপাহাড়িতে নেমে বেশ হতাশই হয়েছিলাম। ইন্দিরা চক জায়গাটা আসলে একটা তেমাথার মোড়। তার এদিকে সেদিকে নানা দোকানদানি। আর বাজার। আনাজপাতি বিক্রি হওয়া আর ফলের দোকানগুলোয় একটা জিনিস চোখে পড়বেই। কলা। ছড়া ছড়া কলা ঝুলছে দড়িদড়া থেকে। ঝাড়গ্রাম শহরেও দেখেছি দোকানময় কলা কৌশল। বেশ কলারসিক বলে মনে হল ঝাড়গ্রামের লোকেদের। আমার এক ছানার আছে। ঝাড়গ্রামেরই। যখন কোলের কাছে ছিল তখন তাকে খাওয়ানোর কী সমস্যা! অধিকাংশ সময়েই ধোঁকে। শুনেছি কলা খুব দ্রুত এনার্জি দেয়। কিন্তু ছানাকে কিছুতেই খাওয়ানো যেত না। কলাকারি তার একদমই আসত না।

এমন কলা ঝোলা দোকান, লালচে, রুক্ষ মাটির বাজার দেখতে মনটা দমে গিয়েছিল। বাজারটা দেখে আফ্রিকার যে কোনও দেশের বাজারের মতো মনে হতে পারে। আফ্রিকা যাইনি। কিন্তু ইন্টারনেট, সিনেমায় দেখে সেরকমই মনে হয়েছিল। এই দেখতে এত দূর এলাম!

প্যাগোডা ছাঁদ মনে হয়েছিল চালে। ভুল হতে পারে।

মনটা ভাল হয়ে গেল বৈকালিক টোটো কোম্পানি শুরু হতেই। বেলপাহাড়ি ছাড়িয়ে টোটো যত গ্রামের দিকে ঢুকতে লাগল ততই চোখের শান্তি। সড়ক পাকা। কিন্তু দু’পাশের মাটির বাড়িগুলো বেশির ভাগই কাঁচা। টিনের চাল। কিছু বাড়ি দোতলা। বাড়ির চালগুলোয় নানা ছাঁদ। কোনওটা একেবারেই বাংলা ছাঁদের খড়ের চাল। একতলা বাড়িগুলোর কয়েকটার চাল আবার আটচালা মন্দিরের মতো। একতলার ওপরে একটা চিলেকোঠা করা। তার চাল মিলিয়ে আটচালা। দোতলা বাড়িগুলোর চালে কিছুটা যেন প্যাগোডার চালের ধাঁচ। ভুল হতে পারি। কিন্তু মনে হল। রাস্তার দু’পাশের সবচেয়ে দর্শনীয় হল, প্রচুর সবুজ। ঘন গাছপালা। কোথাও প্রচুর ধানজমি। তার মাঝে মাঝে তাল, খেজুর গাছ একা বা ভাই বেরাদরদের নিয়ে মাথা তুলেছে। শরতের শেষ বিকেলের আলো তালগাছের মাথায় আটকে পড়ে ছড়িয়ে গিয়েছে। কোথাও ধান জমির ওপরে দীঘল গাছের ছায়া। মাঝে মাঝে একটা দু’টো বাড়ি চোখে পড়ছে। কোথায় একটা পাড়া। দু’চারটে ঘরেই পাড়ার শুরু ও শেষ। গাড়ি করে যেতে যেতে এই সৌন্দর্য দেখার নয়। হাঁটতে হাঁটতে আস্বাদন করার। সবচেয়ে ভাল হয় হিচ হাইকিং করার। কিন্তু আমাদের যে বাড়ি রয়েছে।

আমরা চলেছি ঘাগরার দিকে। পথে পড়া গ্রামগুলোর একটা নামও মনে নেই। গ্রামনামের কি আর ফলক থাকে? শুধু মনে আছে, বেশ কিছুটা যাওয়ার পরে মূল রাস্তা ছেড়ে বাঁ দিকের একটা কাঁচা রাস্তায় ঢুকলুম। টুকরো টুকরো জীবন রাস্তায়। রাস্তার পাশে। হরেক মালের এক ফেরিওয়ালা যাচ্ছিলেন। গ্রামের ভিতরের দিকে। এক আদিবাসী গৃহবধূ অ্যালুমিনিয়ামের কলসি হাতে জল আনতে যাচ্ছেন। ফেরিওয়ালাকে দেখে থামলেন। একজন জঙ্গল থেকে কাঠ কেটে ফিরছিলেন। সবচেয়ে সেরা দৃশ্য এক গৃহবধূ তাঁর পালিত শুয়োর শাবককে কোলে করে নিয়ে ঘরের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলেন। আর শাবকটি ঘোঁৎ ঘোঁৎ শব্দে ভীষণ আপত্তি জানাচ্ছিল। মানে সে কোলে যেতে চায় না। নিজের পায়ে ঘরে ফিরতে চায়। আজ পর্যন্ত আমি কোনও রমণীকে শুয়োর কোলে দেখেনি। শহুরে পর্যটকেরা গ্রামে এলে তিড়িং তিড়িং করে লাফানো ছাগলছানা কোলে নিয়ে ঘোরেন। আমাদের গ্রামেই দেখেছি। আত্মীয়ের বাড়িতে আসা আত্মীয়াদের ছাগশিশু প্রেম। মেষশাবক নিয়ে বহু আঁকা ছবি এবং আলোকচিত্র দেখেছি। আমাদের ছোটবেলায় এক পোশাক কোম্পানির বিজ্ঞাপনে মেষশাবক কোলে শর্মিলা ঠাকুরের ছবি মুগ্ধ করত। যেন মাতা মেরি। এক আদিবাসী রমণীক শুয়োর শাবকের প্রতি ভালবাসা চিরকালের ছবি হয়ে রয়ে গেল।

ঘাগরার সেই উনুনের মুখ।

তারপর একটা ঢালু পথ বেয়ে পৌঁছলুম ঘাগরার কাছে। রাস্তায় আমাদের টপকে একটা পেল্লায় গাড়ি গিয়েছিল। তাতে সবুজ বাতি লাগানো। কেউকেটা হবেন। দেখলাম, গাড়ির সওয়ারিরা ঘাগরা দেখতেই এসেছেন। তখন ফটোসেশন চলছে তাঁদের। আমরাও লেগে পড়লুম কাজে।

ঘাগরার রূপ বর্ণনা খুব একটা সহজ কথা নয়। বনজঙ্গল ভেদ করে কোথা থেকে যেন বয়ে আসছে জলধারা। মাঝে শক্ত পাথরের বাধা। তবে অবিরাম চলায় সেই পাথরও হার মেনেছে। জায়গায় জায়গায় পাথর ক্ষয় করে জলধারা নিজের পথ করে নিয়েছে। কোথাও বড় বড় গর্ত হয়েছে পাথরের বুকে। যেন বড় বড় উনুনের মুখ। পাথরের বাধার দু’পাশে সমতল ভূমি। আসলে সেগুলো এই জলধারারই প্লাবন ভূমি। বর্ষার স্রোত আরও পুষ্ট হয়। তখন ক্ষীণ হয়ে চলা স্রোতস্বিণী নব যৌবনার মতো উচ্ছল। ছড়িয়ে পড়তে চায়, প্রভাব ফেলতে চায় চারপাশে। সমতল সেই উচ্ছলতার চিহ্ন। আসলে সেগুলো স্রোতে বয়ে আসা বালি, নুড়ি দিয়ে তৈরি নরম ফরাস।

পাথরের উপরে ইন্দ্রর চেয়ারম্যান হওয়ার চেষ্টা।

আমরা চলে গেলাম স্রোতের ওপারে। সেই জায়গাটা আরও সুন্দর। সেই বালি, নুড়ি, পাথরের বিছানা। একটু আগে জলধারা একটা বাঁক নিয়ে দৃশ্যমান হয়েছে। বাঁকের কাছে, দু’ধারে জঙ্গল। তাই নদীর বিভঙ্গ পুরোটা দেখা যাচ্ছে না। ওই দিকটায় জলের ধারা শান্ত। জলধারা যত শক্ত পাথরের দিকে এগিয়েছে ততই তার পথ উপলময় হয়েছে। ফলে জলধারার গতিও বেড়েছে। শক্ত পাথরের ফাঁক দিয়ে বয়ে চলার সময়ে তো বেশ গতি। অল্প গর্জনও আছে। কিন্তু কিছুটা বয়ে চলার পরে সে আবার অভিজ্ঞ মানুষের মতো মিতবাক, অচঞ্চল। আশপাশের বসতগুলো থেকে মানুষজন জলধারার দু’পাশের সমতল অংশে চান করতে আসেন।

ঘাগরায় অনেকটা সময় কাটিয়ে ফেলেছিলাম। কী করা! এত সুন্দর, নির্জন একটা জায়গা ছেড়ে মন উঠছিল না। তারাফেনি নদীর কাছে যখন এলাম তখন সন্ধে নেমেছে। আলো জ্বলে উঠেছে বাঁধের ওপরে। তার ছায়া পড়েছে নদীর জলে। বাঁধের কাছে আসতে হলে সিআরপিএফের ক্যাম্প পেরিয়ে আসতে হয়। সেই উত্তাল সময়ের স্মৃতিচিহ্নি। ক্যাম্পের আলোর ঝিকিমিকিও নদীর জলে। বাঁধের উপরে চলাচলের রাস্তাটা পার হতেই একটা অদ্ভুত দৃশ্য চোখে পড়ল। খেজুর গাছের পাতা দিয়ে ঘেরা একটা জায়গা। ভিতরে আলো জ্বলছে। কী এটা? আমার মনে হয়েছিল হাঁড়িয়া বিক্রি করার জায়গা। বরন্তিতে এরকম একটা জায়গা দেখেছিলাম। কিন্তু উঁকি ঝুঁকি দিয়ে দেখা গেল, সেটা একটা ঘর। মানুষজনের চলাচল দেখা যাচ্ছে।

তারাফেনি ড্যাম।

তারাফেনির জল এলাকাবাসীর পানীয় হিসেবে ব্যবহৃত হয়। একটা পাম্প ঘরও রয়েছে। জংলা রাস্তা পেরিয়ে টর্চ আর মোবাইলের আলোয় গেলাম সেখানে। দেখা হল, স্বপন মাহাতোর সঙ্গে। তিনি মাওবাদীদের সময়ের পরিস্থিতি, এলাকার হাল হকিকতের তখন-এখনের পরিস্থিতি বোঝালেন। অনেকক্ষণ ধরে কথা হল। তার আগে বাঁধের যে রাস্তাটা গ্রামের দিকে চলে গিয়েছে সেই রাস্তা ধরে হেঁটে এসেছি। রাস্তার এক পাশে জঙ্গল। তবে বিদ্যুৎ রয়েছে। মাঝে একটা দু’টো সাইকেল, বাইক গ্রামের দিকে যাচ্ছিল। গ্রাম থেকে আসছিল। অন্যরকম অনুভূতি।

ইহা একটি বসতবাড়ি।

তারাফেনি ছাড়ার পরে আতঙ্কের অনুভূতি হয়েছিল। এবারের গন্তব্য বামুনডিহা। ওখানে দুর্গাপুজো হচ্ছে। আজ নাকি আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান হতে পারে। হোম স্টের রাহুলদা বলেছিলেন। কিন্তু তারাফেনি ছাড়ার পরেই টোটো ভীষণ আওয়াজ করছিল। যেন তার সারা শরীরে ভীষণ কষ্ট। কোঁকাতে কোঁকাতে চলেছে। মানে আমাদের ভার বইতে পারছে না। গাড়ির কোনও কষ্ট হলে আমরা সাধারণত ইন্দ্রকেই দোষারোপ করি। এখানেও তাই করলাম। ওকে নেমে যেতে বললাম। কিন্তু ইন্দ্রর আরাম প্রিয় শরীর টোটোর থেকে বেশি কঁকিয়ে উঠল। চালকদাদা বললেন, ব্যাটারির চার্জ ফুরিয়ে এসেছে। সর্বনাশ! তারাফেনি থেকে হেঁটে বেলপাহাড়ি ফিরতে হবে! এই অন্ধকার জঙ্গলের পথে কোথায় টোটোর চার্জ দেওয়ার জায়গা মিলবে! এখানে কোনও গাড়িঘোড়া চলে না।

আঁধার পথে। ছমছমে পরিবেশ।

হেঁটে বেলপাহাড়ি ফিরতে হলে সেটা মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রা হবে। তবে মহাভারতের লেখার উল্টো ঘটনা ঘটবে। প্রথম পতনটা যুধিষ্ঠিরের হবে। মানে দলের সবচেয়ে বড় যে, তার। মানে আমার। রাতে মাত্র ঘণ্টাদুয়েক ঘুমিয়েছি। তার ওপর সারাদিনের ধকল। কত দূর আর কত দূর বলার আগেই শুয়ে পড়ব রাস্তার ওপর!

ছবি— দীপশেখর দাস এবং ইন্দ্রজিৎ সাউ

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *