খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

বালমিঠাই বনাম রসকদম্ব

দীপক দাস

মিষ্টি নিয়ে তুলনামূলক আলোচনা করতে হবে কোনওদিন ভাবিনি। সাহিত্যে একটা তুলনামূলক শাখা হয়। পড়াশোনা করে ডিগ্রিও পাওয়া যায়। এক সময় খুব ইচ্ছেও ছিল পড়ার। কিন্তু নম্বরে কুলিয়ে উঠতে পারিনি। ফলে…তুলনামূলক মিষ্টি।

গোলটা বাঁধিয়েছে বাল মিঠাই। উত্তরাখণ্ডের মিষ্টি। আসলে আলমোড়ার। আলমোড়ার দু’টো মিষ্টি স্পেশাল। তার একটা হল বাল মিঠাই। না, এর মধ্যে আলমোড়ায় যাওয়া হয়নি। অফিসের এক সিনিয়র সহকর্মী অনমিত্রদা (চট্টোপাধ্যায়) গিয়েছিলেন। ফিরে এসে খুশি হয়ে আমাকে এক পিস বাল মিঠাই দিয়েছিলেন। বালখিল্য ভেবেই হয়তো। সে মিষ্টি হাতে নিয়েই চমক। আরে! এ যে রসকদম্ব। মালদা জেলার দুই বিখ্যাত মিষ্টির একটা। রাতে আমি আর আমার সহনামী সিনিয়র সহকর্মী দীপক মহারানাদা ভাগ করে খেলাম বাল মিঠাই।

রসকদম্বের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ট পরিচয়। চোখে এবং চেখে দেখার স্বাদে। সালটা ২০০৮-১০। তখন ‘উত্তরবঙ্গ সংবাদ’এর মালদা এডিশনে কাজ করি। থাকতাম পুরনো মালদার সাহাপুরে। মহানন্দার ওপারে। সকালের দিকে সময় সুযোগ মিললে সরু খালের মতো মহানন্দা পেরিয়ে হাজির হতাম ইংলিশবাজারে। সঙ্গী সহকর্মী শৌভিক বাগচী। সে-ই প্রথম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিল মিষ্টি দু’টোর সঙ্গে। রসকদম্ব গোলাকার। তার ওপর হোমিওপ্যাথির ওষুধের গুলির মতো দানা মাখানো। ইংলিশবাজারের রতন সুইটস আর পাবনা সুইটসের রসকদম্ব সেরা।

মালদার রসকদম্ব। ছবি অমল রজকের সৌজন্যে।

বাল মিঠাই একেবারে রসকদম্ব। শুধু রসকদম্ব গোল হয়। বাল মিঠাই হয় লম্বাটে। তবে চৌকোণো লম্বা। নতুন মিষ্টি খেয়েছি। সেটা গ্রুপের ছেলেদের জানানো দরকার। অনমিত্রদার ভাণ্ডারে তখনও বেশ কিছু বাল মিঠাই ছিল। অনুরোধ করলাম, ছবি তুলে পাঠাতে। পরদিন ছবি আসতেই ‘যথা ইচ্ছা’র হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে ছবি পোস্ট। তখন রাত ১২টা পেরিয়েছে। দীপুই শুধু জেগে। ও ছবি দেখেই বলল, ‘এ তো মালদার সেই মিষ্টিটা। নামটা ভুলে গিয়েছি?’ বুঝলাম রসকদম্বের কথাই বলতে চাইছে। ওর ভুল ভাঙালাম, মালদার নয়। এটা উত্তরাখণ্ডের মিষ্টি। ও নাম জানতে চাইল। বললাম, ‘নাম বললে তো হাসবি।’ দীপুর জ্ঞানগর্ভ বাণী, ‘হাসি তো ভাল জিনিস। একটু হাসি না?’

যা ভেবেছিলাম, ঠিক তাই। নামটা বলতেই এমন একটা ইমোজি পাঠাল যাতে বোঝাই যায়, ও নাম নিয়ে সন্দেহ করছে। কী বলি? বেশি কিছু বলাও যায় না। দীপু আমার একসময়ের ছাত্র। খেলা ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলাম। ও গবেষণার কাজে মাঝে মাঝেই উত্তরাখণ্ডে যায়। কিন্তু কোনও দিন এই মিষ্টি আনেনি। অভিযোগ জানাতে বলল, ‘আমার গবেষণার সঙ্গী উত্তরাখণ্ডের। সে কোনওদিন বলেনি। আমি জানব কী করে? তা ছাড়া আমি আলমোড়ায় যায়নি।’’ দীপু ঠিকই বলেছে। অন্য জায়গায় মেলে না বাল মিঠাই। এ মিষ্টি একেবারেই আলমোড়ার মিষ্টি। আমাদের যেমন জনাইয়ের মনোহরা, বর্ধমানের সীতাভোগ, মিহিদানা, তেমনই। এখন আলমোড়ার বাইরে কিছু জায়গায় বাল মিঠাই মেলে। তবে তার সঙ্গে আলমোড়ার মিঠাইয়ের তুলনা চলে না।

এবার তুলনা। রসকদম্ব আর বাল মিঠাই বহিরঙ্গে এক হলেও পাকপ্রণালী আর উপকরণে বেশ আলাদা। গিয়ে খাইনি। তাই ইন্টারনেট আর অনমিত্রদার সাহায্য নিতে হল। তাতে জানা গেল, বাল মিঠাই প্রথম তৈরি করেন যোগ শাহ। নির্ভেজাল দুধ ফুটিয়ে ফুটিয়ে ক্ষীর করা হয়। তার পর তাতে মেশানো হয় চিনি। এর পর আবার শুরু হয় পাক। উনুনের আঁচে ক্ষীর আর চিনির মিশেল গাঢ় বাদামি হয়ে যায়। সেই কড়া পাকের ঠাস আঠাল ক্ষীর চৌকোণো করে কাটা দেয়। চৌকোণো টুকরোর উপরে ছড়িয়ে দেওয়া হয় হোমিওপ্যাথির গুলি। আউটলুক বাল মিঠাই নিয়ে একটি খবর করেছিল। সেই খবর বলছে, যোগ শাহ বাল মিঠাইয়ে হোমিওপ্যাথির গুলি ব্যবহার করেননি। তিনি ব্যবহার করছেন খুস খুস। খুস খুসটা কী? নেট বলছে, পপি সিড। তার মানে তো পোস্ত!

কী আশ্চর্য! মালদার রসকদম্বতেও তো পোস্ত ব্যবহার করা হয়। রসকদম্ব দু’রকম মেলে। একটা পোস্ত ছড়ানো। আরেকটা হোমিওপ্যাথি গুলি ছড়ানো। পোস্ত ছড়ানো রসকদম্বের দাম বেশি। দোকানদারেরা বলেন, পোস্ত দেওয়া রসকদম্ব দামে সাধারণের নাগালের বাইরে। তাই একসময়ে হোমিওপ্যাথির গুলি ব্যবহার শুরু হয়। আলমোড়াতেও হয়তো একই যুক্তিতে খুস খুসের বদলে হোমিওপ্যাথির গুলি এসেছে। কিন্তু এর উত্তর দেবে কে? ও হ্যাঁ, রসকদম্বের পোস্ত বা হোমিওপ্যাথির গুলির চাদরের নীচের উপকরণ কিন্তু আলাদা। রসকদম্বের ভিতরে থাকে ছানার গোলাকার একটি মিষ্টি। রসগোল্লার মতো খেতে। সেই গোল্লার উপরে থাকে ক্ষীরের চাদর। তার ওপরে পোস্ত বা হোমিওপ্যাথির গুলি।

বাল মিঠাই।

রসকদম্ব আর বাল মিঠাইয়ে আরেকটি মিল আছে। দুই মিষ্টির সঙ্গেই লোককথার যোগ রয়েছে। বাল মিঠাই তো উত্তরাখণ্ডের লোকগাথা, গল্প, কবিতা জুড়ে রয়েছে। মনে করা হয়, সূর্যদেবতার ভোগে এই মিষ্টি নিবেদন করা হত। এখন সকলের ভোগে লাগে। মানে মানুষের। মালদার রসকদম্বের সঙ্গে চৈতন্যদেবের যোগ নিয়ে একটি কাহিনি প্রচলিত। চৈতন্যদেব একসময়ে গৌড়ে এসে এক কদমগাছের নীচে দীক্ষা দিয়েছিলেন রূপ গোস্বামী আর সনাতন গোস্বামীকে। সেই কদমগাছের স্মৃতিতেই রসকদম্বের উৎপত্তি। তখনকার গৌড়ই এখনকার মালদা। মালদায় একটি স্টেশন আছে। যার নাম গৌড় মালদা।

নাম খারাপ যাতে না হয় তা নিয়ে সচেতন আলমোড়া আর মালদার মেঠাইওয়ালারা। বাল মিঠাই আর রসকদম্ব ভৌগোলিক পরিচয় (জিওগ্রাফিকাল আইডেন্টিফিকেশন) পাওয়ার জন্য লড়ছেন তাঁরা।

কভারের ছবি বাল মিঠাই।

(সমাপ্ত)

One thought on “বালমিঠাই বনাম রসকদম্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *