জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

পদ্মাপারের জলঙ্গী জনপদ

ফারুক আব্দুল্লাহ

জলঙ্গী নদীর নাম অনেকে শুনে থাকলেও জলঙ্গী জনপদের কথা হয়ত অনেকের কাছেই অজানা। পদ্মা তীরে বাংলাদেশ সীমান্তঘেঁষা জনপদটি মুর্শিদাবাদ জেলার সদর শহর বহরমপুর থেকে প্রায় ৫২ কি.মি পূর্বে অবস্থিত। এই সমগ্র অঞ্চলটি আজ থেকে কয়েকশো বছর আগে বিশেষ করে নবাবি আমলে নাটোরের রানী ভবানীর জমিদারী এলাকার অন্তর্ভুক্ত ছিল। সুলতানি এবং মুঘল আমলে জলঙ্গীর পার্শ্ববর্তী অঞ্চলগুলি নানা কারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠলেও জলঙ্গী ছিল একটি জঙ্গলাকীর্ণ অঞ্চল। সেখানে নাকি বাঘও থাকত। সেই সময় পদ্মা নদী প্রবাহিত হত জলঙ্গী ভূখণ্ডের প্রায় ৩-৪ কিমি দূরে। তখনকার দিনে পদ্মা নদী ছিল যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম। পদ্মার বুকে ভেসে থাকত বড়, বড় পাল তোলা যাত্রীবাহী ও মালবাহী নৌকা। এছাড়াও বহু ছোট বড় বহু ডিঙি নৌকা পদ্মায় ভেসে চলত মাছের খোঁজে। ইলিশ-সহ আরও নানান মাছ তাতে ধরা পড়ত।

সুন্দরী পদ্মা।

নবাবি আমলের শেষের দিকে বিশেষ করে ইংরেজ আমলের প্রথম দিক থেকেই জঙ্গল পরিষ্কার করে এই অঞ্চলে কিছু জনবসতি গড়ে উঠতে থাকে। যা ধীরে ধীরে একটি সমৃদ্ধ জনপদে পরিণত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ হলে পদ্মার এপারে অবস্থিত জলঙ্গী ভারতের অন্তর্ভুক্ত হয়। অন্যদিকে পদ্মার অপর পারের ভূখণ্ড অন্তর্ভুক্ত হয় পূর্ব পাকিস্থানের সঙ্গে। পদ্মা নদী দুই পারের মানুষকে ভাগ করে দিয়েছে দুই প্রান্তে। এক সময়ে মুক্তিযুদ্ধ শুরু হল। জলঙ্গী সীমান্তের খুব কাছে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলার দৌলতপুর, বাঘা, ভেড়ামারা, চরপাড়ায় পাক সেনা হানা দিল। সেখানকার বহু মানুষ প্রাণ ভয়ে পদ্মা পেরিয়ে এপারে জলঙ্গীর শরণার্থী শিবিরে আশ্রয় নিলেন। এই সমস্ত অসহায় মানুষদের প্রতি পাকিস্তানি সেনাদের অত্যাচারের বহু কাহিনি আজও জলঙ্গীর প্রবীণ মানুষদের মুখে ফেরে।

অপরূপা।

নব্বইয়ের দশকে সর্বগ্রাসী পদ্মার ভাঙনের কবলে পড়ে এই জনপদের বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সলিল সমাধি ঘটে। পদ্মা বহু উর্বর জমি-সহ সমগ্র জলঙ্গী বাজারকে গ্রাস করতে করতে এগিয়ে আসে রাজ্য সড়কের পাশে। বহু পাকা বাড়ি, দোকানপাট পদ্মার কবলে পড়ে। জলঙ্গী জনপদের বহু মানুষ ঘর-বাড়ি,জমি হারিয়ে সর্বস্বান্ত হয়। সর্বগ্রাসী পদ্মা বহু প্রাণও কেড়েছে বিভিন্ন সময়। নব্বইয়ের দশকের একেবারে অন্তিমলগ্নের কথা। কোনও এক শীতের ভোরে লালবাগ থেকে পিকনিক করে বাড়ি ফেরার পথে একটি ছাত্র-ছাত্রী বোঝাই বাস জলঙ্গী বাজারের কাছে নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে পদ্মায় পড়ে গেলে প্রায় ৬৬ জন প্রাণ হারায়। তাই পদ্মার সর্বনাশী রূপ দেখে মনসুর ফকির গান বেঁধেছেন—

‘জলঙ্গী পদ্মা নদী রে তোর বুঝি দয়া মায়া নেই।

কত জমি কত বাড়ি নিয়েছ যে তুমি।

এখনও তোর খুদা মিটেনি

জীবন যৌবন সবই নিলে এখনও তোর আশা মিটেনি।

কেউ বা হারায় মাতা পিতা কেও বা হারায় পুত্র

কেউ হারায় আত্মীয়স্বজন কেউ বা হারায় মিত্র।

ও জলঙ্গী পদ্মা নদী রে তোর বুঝি দয়া মায়া নেই’।

চরবাসী।

পদ্মার সেই ভয়ঙ্কর রূপ আজ আর নেই। সব গ্রাস করে পদ্মা এখন শান্ত। বর্তমানে জলঙ্গীর পদ্মাতট পরিণত হয়েছে একটি পর্যটন কেন্দ্রে। সরকারি উদ্যোগে এলাকার পর্যটনের সম্ভাবনার কথা ভেবে পদ্মা নদীর তীরে গড়ে তোলা হয়েছে ‘পদ্মা ভবন’। যেখান থেকে পদ্মার অপূর্ব রূপ ধরা পড়ে।

কোন সীমান্তের। জানান দেওয়া জরুরি।

মুর্শিদাবাদ ও পাশের নদীয়া জেলার বিভিন্ন প্রান্ত থেকে প্রতিদিন হাজার হাজার কৌতূহলী মানুষ ছুটে আসেন পদ্মা নদী এবং অপর পারের বাংলাদেশের রুপ দেখতে। প্রচুর মানুষ পদ্মার তীরে বসে উপভোগ করে কাটাতারহীন সীমান্ত পারের জীবন। এপার থেকেই স্পস্ট দেখা যায় সীমান্তপারে বাংলাদেশের কুষ্টিয়ার চরপাড়ার টিনের চাল দেওয়া বাড়িগুলি। কখনও হাওয়ায় ভেসে আসে ওপারের কোনও মসজিদের আজানের মিষ্টি সুর। কখনও দেখা যায় ওপারের রাখালদের গরু চরানো, আবার কখনও চোখে পড়ে তাদের পদ্মায় স্নান এবং মাছ ধরার মনোরম দৃশ্য। এপারের সাধারণ মানুষের জীবনেও পদ্মা একটি বড় স্থান দখল করে আছে। অবসর যাপন বা আনন্দ উৎযাপন সবক্ষেত্রেই পদ্মা উপযুক্ত স্থান। এমনকী ভাঙা মন নিয়ে জলঙ্গী পদ্মাতীরে বসলেও পদ্মার উদাসী হাওয়া যন্ত্রণাক্লিষ্ট মনকে উড়িয়ে নিয়ে যাবে তেপান্তরে। সম্বিৎ ফিরতেই যন্ত্রণা উধাও। পদ্মা তীরে বসলে বহু পাখির র্নিদ্বিধায় সীমান্ত পারাপার দেখা যায়। কারণ পাখিদের কোনও সীমান্ত নেই। সীমান্ত যেন শুধু মানুষের।

কাশের চর।

জলঙ্গীর পদ্মা পেরিয়ে দক্ষিণ-পূর্বে সরাসরি পড়ে বাংলাদেশের কুষ্টিয়া জেলা। এবং উত্তর-পূর্বে পদ্মা পেরিয়ে পড়ে বিস্তৃত ভারতীয় চর। সেখানে রয়েছে উদয়নগর চর কলোনি এবং পরশপুর চর নামক বাংলাদেশের সীমান্তঘেঁষা দু’টি ভারতীয় গ্রাম। মূল ভূখণ্ডের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পদ্মা চরের গ্রাম দু’টি পিছিয়ে পড়েছে সবদিক থেকেই। গ্রামের মানুষদের নিত্য প্রয়োজন মেটাতে প্রতিদিন বেশ কয়েকবার নৌকায় পদ্মা পার হয়ে জলঙ্গী বাজারে আসতে হয়। প্রতিবার তাদের নানান প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে। বর্ষার সময় পদ্মায় জল বাড়লে চরবাসীদের জীবনে দুর্যোগ নেমে আসে। পাকা রাস্তা না থাকায় গ্রামের মাটির রাস্তা কাদায় অচল হয়ে যায়। সেই সঙ্গে বৃদ্ধি পায় বিষধর সাপের উপদ্রব। প্রতি বছর চরের বহু মানুষ সাপের কামড়ে প্রাণ হারান। চরের মানুষরা তাঁদের হাজার প্রতিকূলতার মধ্যেও নিজেদের মত করে বেঁচে থাকতে, ভাল থাকতে শিখে নিয়েছেন। নানান ধর্মীয় উৎসবে উপলক্ষে চরে বয়ে যায় খুশির আমেজ। স্বল্প পরিসরে মেলা হয়। যেখানে নানান খাদ্য ও নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকানপাট বসে। মেলা চর এলাকার পিছিয়ে পড়া মানুষের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার করে।

চরের জীবন।

জলঙ্গীর কিছু মানুষের জমি রয়েছে পদ্মার চর এলাকায়। ফলে তাঁদের প্রতিদিন সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর কাছে পরিচয়পত্র জমাদিয়ে যেতে হয় চরের জমিতে চাষ করতে। সারাদিন চাষ করে সন্ধ্যার সময় আবার সীমান্ত রক্ষীদের তল্লাশির পর তাদের অনুমতি মেলে বাড়ি ফেরার। এতেই তারা অভ্যস্ত।

বর্তমানে বহু ছোট বড় নৌকা ও ডিঙিতে করে পদ্মায় প্রতিদিন চলে মাছ ধরার পর্ব। একসময় জলঙ্গীর পদ্মায় বহু ইলিশ পাওয়া গেলেও এখন নাকি ইলিশ তেমন পাওয়া যায় না। স্থানীয় কিছু প্রবীণ মানুষ স্মৃতি হাতড়ে বলেন যে, একটা সময় ছিল, যখন এই জলঙ্গীর পদ্মায় বালতি, বালতি ইলিশ উঠত। প্রতিদিন ইলিশের ঝোল, ভাত খেতে খেতে তাঁদের ইলিশে অরুচি ধরেছিল। পদ্মার জল কমে গিয়ে সেই স্রোত হারিয়ে যাওয়ায় ইলিশ নাকি তেমন আর আসে না। তবে এখনও পদ্মায় প্রচুর মাছ ধরা পড়ে। সেই সব মাছ নিয়ে পদ্মা ঘেঁষা জলঙ্গী বাজারে পসরা বসান মাছ বিক্রেতারা। জলঙ্গী-সহ আশেপাশের সব এলাকায় পদ্মার মিষ্টি মাছের খুব কদর। কর্মসূত্রে বা দূর দূরান্ত থেকে পদ্মা দেখতে আসা মানুষরা এই মাছ নিয়ে বাড়ি ফেরেন। জলঙ্গীর পদ্মার তীরে সারা বছর ধরে কৌতূহলী জনগণের ভিড় লেগে থাকলেও তা কয়েকগুণ বেড়ে যায় ঈদ কিম্বা পুজোয়। এই সময় জলঙ্গী বাজারের কাছে পদ্মার তীরে মেলা বসে। মেলায় জিলিপি, পাপড়, মিষ্টি তো থাকেই। থাকে বিদেশি মোগলাই, রোল, চাওমিন। মেলে ঝুড়ি এবং বাচ্চাদের মন মাতানো খেলনা-সহ বহু নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দোকান। জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সীমান্তবর্তী মানুষদের অংশগ্রহণে এই মেলা পরণত হয় এক মিলন মেলায়।

ঘাটের কাছে।

কী ভাবে যাবেন, কোথায় থাকবেন?

কলকাতা থেকে আসতে হলে কৃষ্ণনগরে নেমে করিমপুরগামী যেকোনও বাসে করিমপুরে নামতে হবে। সেখান থেকে বহরমপুরগামী বাসে করে প্রায় ২১ কি মি পথ জলঙ্গী। বহরমপুর থেকে জলঙ্গী বা করিমপুর গামী বাসে প্রায় ৫২ কি.মি পথ জলঙ্গী।

এছাড়াও জলঙ্গী থেকে মাত্র ৩৫ মিনিটের পথ ডোমকলে এবং জলঙ্গী থেকে প্রায় ৪০ মিনিটের পথ করিমপুরে রয়েছে থাকা খাওয়ার বেশ কিছু হোটেল ও লজ।

ছবি লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *