অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

জীবনানন্দ দাশের ধানসিরি ডিমাপুরে!

জয়দীপ মুখোপাধ্যায়

‘‘বার্মা ক্যাম্প যাওগে?’’

-আশশি রুপিয়া দেনা পড়েগা…

বার্মা ক্যাম্প এলাকায় একটি হোটেলে উঠেছি ঘণ্টা দুয়েক আগে। সারাদিন পেটে কিছু পড়েনি। খাওয়ার হোটেলের সন্ধানে এসেছিলাম স্টেশন চত্বরে। গুগল ম্যাপ দেখে হেঁটেই এসেছি। খেয়ে যখন হোটেলে ফেরার কথা ভাবছি, তখন দিনের আলো পড়ে এসেছে। শরীরও পরিশ্রান্ত। তাই অটোর খোঁজ। কিন্তু এ ব্যাটা বলে কী! আশি টাকা! গুগল ম্যাপে দেখাচ্ছে মেরেকেটে দেড় কিলোমিটার মতো দূরত্ব! সে কথা জানাতে জবাব এল, ‘ভাইয়া আভি রাত হো গ্যায়া…কৈ নেহি যায়েগা উধার…”

অচেনা জায়গায়, বিশেষত এইসব কথাবার্তা শোনার পর ঝুঁকি নেওয়ার সাহস হল না। অগত্যা! কী আর করা! তা-ই সই! ঘড়ির কাঁটায় তখন বিকেল, থুড়ি ‘রাত’ পাঁচটা পয়ত্রিশ!

ডিমাপুর বিমানবন্দর।

তবে চমকের তখনও বাকি ছিল! অটোয় স্টার্ট দিয়ে বিহারি অটোওয়ালা স্বতঃপ্রণোদিত হয়েই আলাপ জমানোর চেষ্টা করল, “ন্যায়া হো না ইস শহর মে?” সম্মতি জানাতে এল রীতিমতো বিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ, “ইধার না সাম সাত বাজে কে অন্দর সব বন্ধ হো যাতা হ্যায়…ইয়ে জাগাহ আচ্ছা নেহি…রাস্তে মে ঠিকঠাক সে চলনা…জাদা ক্যাশ মাত রাখনা সাথ মে…স্মার্টফোন ভি রাস্তে মে মাত দিখাইয়ে…দিক্কত হো সাকতা হ্যায়…”

হোটেল চলে এল। ভাড়া মিটিয়ে হোটেলের ঘরে ঢুকলাম। আমি তখন বেশ আতঙ্কিত। মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে অটোওয়ালার কথাগুলো।

বাড়িঘরের ছাঁদ কিছুটা বোঝা যায়।

জায়গার নামটা জানার কৌতূহল হচ্ছে নিশ্চয়ই? ডিমাপুর। নাগাল্যান্ডের রাজধানী কোহিমা হলেও সবথেকে বড় তথা আধুনিক শহরটির নাম ডিমাপুর। এবং সেই ‘আধুনিক’ শহরে এই ছিল আমার প্রথম অভিজ্ঞতা!

ডিমাপুরে আমার আসা চাকরিসূত্রে। আর্কিওলজিক্যাল সার্ভে অব ইন্ডিয়ার গালভরা নামে প্রলুব্ধ হয়ে। ৫ অক্টোবর, ২০১৮। কিন্তু ওই যে কথায় আছে না, আমি যাই বঙ্গে কপাল যায় সঙ্গে! পোস্টিং পড়বি তো পড় একেবারে ডিমাপুরে! গুয়াহাটি থেকে ভোর সাড়ে ছ’টার জনশতাব্দী এক্সপ্রেস ধরে যখন ডিমাপুর পৌঁছলাম, ঘড়ির কাঁটা এগারোটা ছুঁই ছুঁই। চাকরি পাওয়ার আনন্দ অবশ্য ততক্ষণে ম্লান। গুয়াহাটির অফিসে ডিমাপুর সম্পর্কে নানা ‘সুখ্যাতি’ ইতিমধ্যেই শুনে ফেলেছি কি না! স্টেশনে নেমে প্রথম নিজের অফিসের জায়গাটা দেখতে গেলাম। পরিচয় করে এলাম স্টাফেদের সঙ্গে। আরও কিছু কাজ মিটিয়ে একটা হোটেলে উঠে তারপর বিকেলে খেতে যাওয়া।

অল্প প্রকৃতি।

খেয়ে ফেরার পর থেকেই মাথায় নানারকম চিন্তা চলছে। অটোওয়ালার কথাগুলো মিথ্যে নয়। সত্যিই লক্ষ্য করলাম, সন্ধ্যে সাড়ে ছ’টার মধ্যে প্রায় আশি শতাংশ দোকানপাট ঝাঁপ ফেলে দিয়েছে। রাস্তায় লোকজনও কমে আসছে। পারব এমন একটা জায়গায় মানিয়ে নিতে? ছেড়ে বাড়ি চলে যাব? পরক্ষণেই মনে হল হঠকারিতা হবে না তো সেটা? শিক্ষিত বেকারের তকমা সেঁটে বাড়ি বসে থাকাটাও কি খুব সুখকর হবে? মন সায় দিচ্ছে না। ভাবলাম, নাহ্, খানিক লড়েই দেখি না!

সুপার মার্কেটের কিছু অংশ।

লড়াই-ই বটে! কলকাতা থেকে আকাশপথে ডিমাপুর ঘণ্টা দেড়েক লাগে বটে। কিন্তু ওই দেড় ঘণ্টার ব্যবধানে আলাদা হয়ে যায় সম্পূর্ণ সংস্কৃতিই। আলাদা ভাষা, আলাদা খাওয়া, আলাদা রুচি, আলাদা মানুষজন। এবং এই প্রাথমিক সাংস্কৃতিক আঘাত কাটিয়ে ধাতস্থ হতেই বেশ কিছুদিন লেগে গেল। ভাবুন তো, সন্ধ্যায় অফিস থেকে ফেরার পথে ধর্মতলার মোড়ে দাঁড়িয়ে যখন আপনি এক ঠোঙা ঝালমুড়ি কিংবা দুটো গরম শিঙারা সহযোগে তারিয়ে তারিয়ে চা উপভোগ করছেন, ডিমাপুরের হোটেলগুলোতে তখন রাতের খাওয়া সেরে ঘরে ঢুকে পড়ার তোড়জোড় চলছে। প্রথমটায় মানিয়ে নিতে বেশ সমস্যা হয়েছিল। শহুরে সুযোগ-সুবিধায় বড় হওয়ার সুবাদে আরও বেশি।

নাগাল্যান্ড সায়েন্স সেন্টার।

নাগাল্যান্ড মূলত উপজাতি এলাকা। প্রায় গোটা চল্লিশ মতো (সঠিক সংখ্যা জানা নেই) উপজাতি গোষ্ঠীতে বিভক্ত এখানকার স্থানীয় মানুষেরা। প্রধান উপজাতি গোষ্ঠীর সংখ্যা ১৬টি। বাকিরা এদেরই শাখা গোষ্ঠী। প্রত্যেক গোষ্ঠীর ঘরবাড়িও অনেক আলাদা। বেশিটাই চোখে পড়বে কাঁচা ঘর। মাথায় বড়জোর একটা টিনের ছাদ। বিশেষত আলাদা ওদের খাওয়াদাওয়া। বস্তুত, আলাদা বললে কিছুই বলা হয় না। এরা মোটামুটি সর্বভুক। এবং ঘটনা হচ্ছে, খাওয়ার ব্যাপারে আমি আবার বেশ রক্ষণশীল। ফলে প্রথম গোলটা বাঁধলো সেখানেই! প্রথমদিন বাজার (এই বাজারটা সুপার মার্কেট বলে পরিচিত। ডিমাপুরের অত্যন্ত নাম করা মার্কেট। প্রতি বুধবার হাট বসে। দূর থেকেও মানুষজন আসেন কেনাকাটা করতে) দেখে মোটামুটি চক্ষু চড়কগাছ হওয়ার জোগাড়!

উৎসবের রাতে।

শুনেছিলাম নাগাল্যান্ডে কুকুর-বিড়াল খাওয়া হয়। শোনা এক জিনিস, আর চোখের সামনে সেইসব কাটতে ও বিক্রি হতে দেখা আরেক! কী খায় না এখানকার মানুষ! এবং বিস্ময়কর শোনালেও সত্য যে, ডিমাপুরে রাস্তাঘাটে জীবজন্তু খুব কমই চোখে পড়বে। গাছে শুনতে পাওয়া যাবে না পাখির কূজন। প্রকৃতি যেন বড় রুক্ষ এখানে। লালিত্যের যেন বড়ই অভাব তার মধ্যে। রাস্তাঘাটের অবস্থা বেশ খারাপ। আধ ঘণ্টার পথ যেতে ঘণ্টা দেড়েক লেগে যাওয়াটাই এখানে দস্তুর। দূষিত শহরের তালিকাতেও ওপরের সারিতে জায়গা পাওয়ার জোরাল দাবিদার এই শহর। মিনিট পাঁচেক হাঁটলেই ধুলো ভক্ষণ এবং ধুলোয় অবগাহন করা নিশ্চিত।

ঐতিহ্যের গ্রাম।

সেইসঙ্গে যোগ করতে হবে যত্রতত্র পান আর গুটখার লাল রং। জনপ্রিয় ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপনের মতো ‘দাগ আচ্ছে’ একেবারেই নয়! বরং তা রীতিমতো বিরক্তির উদ্রেক ঘটাতে বাধ্য।

ছবি— লেখক

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *