পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

সুন্দরী সিকিমের সঙ্গ-যাপন—দ্বিতীয় পর্ব

স্মৃতিমাধুরী দাস

পরেরদিন কলটাইম ছিল সকাল ৮টায়। বাজরা-ছাঙ্গু ট্যাক্সিস্ট্যান্ডে পৌঁছে ড্রাইভারসাবকে ফোন করা গেল। এল অপেক্ষার নির্দেশ। এই ফাঁকে গিয়ে দাঁড়ালাম রেলিংয়ের ধারে। সকালের মিষ্টি রোদ ছেয়ে আছে পাহাড়ের গায়ে। দূরে ধাপে ধাপে ছোট্ট ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম। গাছপালা জঙ্গলে আধ-ঢাকা। দেখতে দেখতেই একটু একটু করে মেঘ জমতে থাকল দূরের গাছগুলির ওপরে। সে মেঘের ছায়া দীর্ঘতর হয়ে ঢেকে দিল কিছু গ্রামকে। হঠাৎ দেখলে ভুল হয় বরফ বলে।…

আমাদের গাড়ি গড়াল নাথুলার পথে। পাহাড়ি রাস্তায় ঘুরে ঘুরে যত উপরে উঠছি অপূর্ব সুন্দর প্রকৃতি পরত মেলছে। চিরহরিৎ অরণ্যের আস্তরণে পাহাড়, রুক্ষ পাহাড়, তাদের গা বেয়ে নেমে এসেছে ছোট বড় অসংখ্য ঝোরার উজ্জ্বল রুপালি প্রবাহ। তাদের কেউ কেউ মাঝে মাঝে রাস্তার গায়ে হাজির। নীচে অসাধারণ উপত্যকার দৃশ্য। ক্ষণে ক্ষণে মেঘেদের জমাটি খুনসুটির আসর দেখতে দেখতে সর্পিল পাহাড়ি পথে উঠে এসেছি প্রায় ১৩ হাজার ফুট।

আপন খেয়ালে।

মাঝে একবার আধঘণ্টার বিরতি। পেটে তখন ছুঁচোর দৌড়। ড্রাইভারদাদা যেখানে নিয়ে গেলেন খাবার বলতে মেলে বাঁধাকপি দিয়ে ম্যাগির ঝোলের মত একটি পদ, ভেজ মোমো আর জ্যাম-পাঁউরুটি। ম্যাগি আর মোমো ‘কানামামা’র শূন্যস্থান পূরণ করল। দোকানের মালকিন বেশ স্মার্ট। এখানে শীতের পোশাক ভাড়াও পাওয়া যায় ১০০ টাকায়। খাওয়ার মাঝেই বৃষ্টি নামল ঝিরঝিরিয়ে। ঠান্ডাও নিজের জোর দেখাতে শুরু করল।

এই প্রায় ১৩ হাজার ফুট উচ্চতায় চেকপোস্টে চূড়ান্ত অনুমতিপত্র নেওয়ার জন্য দাঁড়িয়েছে গাড়ি। কিছুক্ষণ সময় লাগবে। আমরাও গাড়ি থেকে নেমে এলাম। পূর্ব সিকিমের এসব এলাকা পুরোপুরি সেনা অধ্যুষিত। যেখানে সেখানে ফোটো তোলা বারণ। অথচ অপূর্ব প্রকৃতি। দেখতে দেখতে হালকা মেঘ ছেয়ে ফেলল পুরো এলাকা। সঙ্গে সঙ্গে ইলশেগুঁড়ি। দৌড়ে গাড়িতে।

মেঘের বাড়ি।

গাড়ি ছাড়ার মিনিট পনেরোর মধ্যেই নাথুলা পাসের পাদদেশে। এখান হেঁটে উঠতে হবে। ক্যামেরা নিয়ে যাওয়ার অনুমতি নেই। গাছপালা এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। দ্রুত হাঁটলে শ্বাস নিতে রীতিমত কষ্ট হচ্ছে। সেইসঙ্গে কনকনে ঠান্ডা। কেবল মুখটুকু ঢাকা ছাড়া। তাতেই মনে হচ্ছে নাকের উপরের অংশ জমে যাচ্ছে। শেষপর্যন্ত উঠে এলাম সীমান্ত প্রাঙ্গনে। একেবারে লাগোয়া চিনের সীমান্ত অফিস। রয়েছে দু’দেশের যাতায়াতের একটি সিঁড়ি। ও প্রান্তে টহলদারিতে চিনা সেনা। পোশাকের রং একটু হালকা। মানস কৈলাস যাত্রায় এই পথেই চিনে প্রবেশ করতে হয়। তাছাড়া অন্যান্য সময়ে দু’দেশের পর্যটকরাই এই পথটুকু পেরিয়ে অন্য দেশের মাটিতে পা রাখতে পারেন। কিন্তু এবারের ব্যাপার আলাদা। ডোকালাম নিয়ে অশান্তিতে উত্তেজনা রয়েছে। তাই মাঝখানের দরজা বন্ধ। বাতিল হয়েছে মানস কৈলাস যাত্রাও। জওয়ান ভাইদের সঙ্গে হাত মিলিয়ে ভারতের শেষ প্রান্তের মাটিকে আরও একবার ছুঁয়ে নেমে এলাম। গাড়ি রয়েছে কিছুটা দূরে। এই রাস্তাটুকুতে ফোটোসেশন চলল।

চলার পথে।

মেঘের ঘেরাটোপে ভিজতে ভিজতে যখন বাবামন্দির এসে পৌঁছালাম হালকা রোদেলা হাসি ছড়িয়েছে ততক্ষণে। ১৪,৪০০ ফুট থেকে তখন নেমে এসেছি কমবেশি হাজার ফুট। ঘড়ির কাঁটা দুপুর ১২টা ছুঁতে যাচ্ছে। শহিদ হরভজন সিংয়ের স্মরণে নির্মিত মন্দিরপ্রাঙ্গনে তেরঙ্গা উড়তে চলেছে। পতাকা উত্তোলক জওয়ানের সঙ্গে ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের পর্যটকের প্রায় শতকণ্ঠে ধ্বনিত হল জাতীয় সঙ্গীত। জাতীয় সঙ্গীত তো অন্য সময়েও গেয়ে থাকি। তবে এখন অন্যরকম অনুভূতি জুড়ে গেল।

মন্দির পিছনদিকের পাহাড়ে ধাপে ধাপে শহিদস্মৃতি। শহিদদের নাম, রেজিমেন্ট, কার্যকালের ফলক। সামনে বিস্তীর্ণ উপত্যকা, মেঘ-রোদের গলাগলিতে মোহাবিষ্ট করে দিচ্ছে। বাঁদিকে একটু দূরে শিবমন্দির। মন্দিরের মাথায় শিবের মূর্তি। তার পিছনদিকে অনেক উপরের পাহাড় থেকে লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে নামতে থাকা দুগ্ধফেননিভ ঝর্ণা। ডানদিকের রাস্তা ধরে একটু এগোলেই পাওয়া যেত রেশম পথের দিশা। আমরা বাঁদিক দিয়ে উঠে ছাঙ্গু লেকের রাস্তা ধরলাম। পোশাকি নাম সোমগো। অপভ্রংশ হতে হতে ছাঙ্গু। ১২,৪০০ ফুট উঁচুতে স্বাভাবিক প্রাকৃতিক হ্রদ। স্থানীয়রা সাজিয়ে গুজিয়ে ইয়াক নিয়ে দাঁড়িয়ে। রোপওয়েও আছে। আমাদের সঙ্গী এক নবদম্পতি কখন সেদিকে পা বাড়িয়েছেন। গাড়ি ছাড়ার সময় দু’জনকে আর পাওয়া যায় না। খোঁজ খোঁজ রব। অবশেষে একজন নববধূর লাল জ্যাকেট দেখতে পেয়ে উত্তেজিত স্বরে বললেন, ‘ওই ওখানে!’ জ্যাকেটটা সেই দোকান থেকে ভাড়া নেওয়া। ভাগ্যিস!

পতাকা উত্তোলনের সাক্ষী।

শেষ বিকেলে ফেরা। গাড়ি থেকে নামতেই আবার ঝুপঝুপিয়ে বৃষ্টি।

সকাল ৭টা। লক্ষ্য উত্তর সিকিম। আবার চড়াই। পাহাড়ের গা ঘুরে ঘুরে উঠে যাচ্ছি। মেঘেরা তখন নীচে, গাছেদের মাথায় মাথায় জমাট বেঁধে আছে। বাইরে ইলশেগুঁড়ির অবাধ নৃত্য। হঠাৎ আমার ছেলে প্রশ্ন করল, ‘মেঘ তো আমাদের নীচে তাহলে বৃষ্টি কী করে হচ্ছে?’ উত্তর পেয়েই চোখটা গাড়ির কাচে ঠেকিয়ে উপরের দিকে তাকিয়ে মিলিয়ে নিতে চাইল। হাসি মজায় চলতে চলতে গাড়ি দাঁড়িয়ে পড়ল এক জায়গায়। সামনে দু’তিনটে গাড়ি, উল্টোদিকেও। রাস্তা সারানো হচ্ছে। বৃষ্টির মধ্যে, এত ঠান্ডাতেও কাজের বিরাম নেই। এসব পেরিয়ে চা’ বিরতি পাওয়া গেল যেখানে সে জায়গার নাম ‘কবি’। দুটো দোকান পাশাপাশি। খাবার ছাড়াও রয়েছে শীতবস্ত্রও। রয়েছে ছোটখাট জলপ্রপাত। সগর্জনে ঝাঁপ দিচ্ছে। বৃষ্টি দেখছি সারাক্ষণের সঙ্গী। প্রকৃতির অনবদ্য সৌন্দর্যে সে-ও একটা আলাদা মাত্রা বটে। ‘কবি’ থেকে যাওয়ার পথে জায়গায় জায়গায় ধাপচাষ। ধান, ভুট্টার সঙ্গে রয়েছে হরেক ফুলও। বহুবর্ণের বৈচিত্রে চোখ ঝিলমিল। বাঁকে বাঁকে দেখা দিচ্ছে বিস্তীর্ণ পর্বতমালা। নীচের উপত্যকায় বয়ে যাচ্ছে ক্ষীণবপু খরস্রোতা নদী, উচ্চতার ফাঁক রেখে তুষারশুভ্র মেঘও যেন নদীর মতোই ভেসে আছে। মাঝে মাঝেই ছোটোবড় ঝোরা নেমে মিশেছে ক্ষীণকায়া নদীতে।…

মোরা তিনজন।

খাওয়া শেষে বেরিয়ে দেখা এক সারমেয় শাবকের সঙ্গে। ভারি মিষ্টি আর বাধ্য। পিছু পিছু ঘুরছিল। বললাম, ‘বোসো চুপটি করে।’ তা দিব্যি পোজ দিল।

ঘণ্টাখানেক পরে মঙ্গন বাজার পেরোলাম। এই এলাকাটা তুলনামূলক জমজমাট। দোকানপাট সব খোলা। কিছুটা গিয়ে আবার এক উচ্ছ্বল নৃত্যাঙ্গনার সঙ্গে খানিক আলাপচারিতা। পরের চেকপোস্টে উত্তর সিকিমে ঢোকার চূড়ান্ত ছাড়পত্র মিলল। তখন বিকেল ঘনিয়ে এসেছে। রাস্তা মাঝে মাঝে সংকীর্ণ আর অজস্র চুলের কাঁটার বাঁক পেরিয়ে লাচুংয়ে যখন চারিদিকে সন্ধ্যার মতো ঘোর। যে হোটেল ঠিক ছিল তার পিছনে পাহাড় থেকে নেমে আসছে এক কলস্বরা। এরপর যতক্ষণ এখানে থাকব সে দু’কান ভরে থাকবে। অবিরাম ধারাপাত চলছে। পাল্লা দিয়ে ঠান্ডা। হাড়ে কাঁপুনি লাগছে। কাঠের ঘর টিমটিমে বাল্ব, টিনের চালে বৃষ্টির নিক্কন বেশ একটা পরবাসী পরবাসী অনুভব। গরম চা ঘর পর্যন্ত পৌঁছতে পৌঁছতে ঠান্ডা সরবত। রাতের খাবার ডাইনিং হলে গিয়ে খেতে হবে। খানিকটা উঠোন পেরিয়ে যেতে গিয়ে রীতিমত কেঁপে গেলাম। নিচু অথচ চওড়া বেঞ্চে বেশ গদিমত বসার জায়গা তিন দেওয়াল জুড়ে। বেঞ্চের সামনে একই মাপের টেবিল। দেওয়ালে দেওয়ালে বিভিন্ন প্রজাতির অর্কিড, রডোডেনড্রন ও অন্যান্য পাহাড়ি ফুলের ফোটো। তিনজন সাহেবও এসেছেন দেখলাম। গরম গরম রুটি, ভাত আর মাংসের ঝোল। পানীয় মিনারেল ওয়াটার— ঝর্নার জল গরম করা। হাত ধোয়ার জায়গায় একটা বড়  ড্রামে ধরে রাখা বৃষ্টির জল।

ঘরোয়া প্রকৃতি।

পরের দিন ভোর পাঁচটায় বেরোনো। ঘরের বাইরে পা রাখতেই দেখি সামনের পাহাড়ের মাথায় বরফের হালকা টুপি। বৃষ্টি থেমেছে। আলতো আলোয় চারিদিক দৃশ্যমান। বেরিয়ে পড়লাম। এতদঞ্চলের স্বাভাবিক রাস্তায় মাঝে মাঝেই ফুটন্ত তেলে পাঁপড়ের মতো নাচতে নাচতে গাড়ি চলছে। ভিতরে আমাদের অবস্থাও তথৈবচ। হেলিপ্যাড গ্রাউন্ড, সেনাচৌকি, টহলদার সেনা, রাস্তার উপর দিয়ে বয়ে চলা প্রবল জলস্রোত পেরিয়ে ইয়ুমথাং। মহিলাপ্রধান শপ। এখান থেকে প্রত্যেকেই গামবুট ভাড়া নিলাম। কেউ কেউ জ্যাকেটও। যাব জিরো পয়েন্ট বা আইস পয়েণ্ট। আগের দিনও রাত সারাক্ষণ বৃষ্টি হয়েছে। তাই আজ বরফ খেলা যাবে আশ্বাস পাওয়া গেল। এতক্ষণ মখমলি রুপ দেখানো পাহাড়সারি এবার রুপোলি পোশাকে সেজেছে। আইস পয়েন্টের অনেক। আগে থেকেই রাস্তার দু’পাশে বরফ দেখতে পাচ্ছি।

ইয়াক ইয়াক।

এত তুষারপাত হয়েছে শেষ প্রান্তের ৫০০ মিটার আগেই গাড়ি থেমে গেল। তারপর যেদিকে তাকাই পাহাড়ের মাথায় মাথায় রৌপ্যমুকুট ঝলকাচ্ছে। কয়েকটি পাহাড় আপাদমস্তক রুপোয় সেজেছে। তার মধ্যেই কুলকুল করে বয়ে যাচ্ছে এক খরস্রোতা, স্বচ্ছতোয়া। আহা! এত বরফ কখনও আগে দেখিনি। যেন স্বর্গভূমি। হাঁটতে হাঁটতে, বরফ নিয়ে খেলতে খেলতে পোজ দিতে দিতে, ক্যামেরা ক্লিক করতে করতে কেটে যাচ্ছে স্বপ্নের প্রহর। বেরসিক ড্রাইভারভাই ডেকে পাঠাল। গাড়িতে উঠব বলে ফিরছি এমন সময় হালকা তুষারের ছোট্ট ছোট্ট গোল সাবুদানা টুকরো ঝরতে শুরু করল।

বরফের চাদর।

প্রায় সাড়ে সতেরো হাজার ফুট উপরে রয়েছি। দমে একটু টান। ড্রাইভার বললেন, এরপর আরও বরফ পড়লে রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তখন কতক্ষণ আটকে থাকতে হবে ঠিক নেই। অগত্যা ফেরা।

যাবার পথে ইয়ুমথাং ভ্যালিতে নামিনি। এবার নামলাম। ইয়ুমথাং উপত্যকা দিয়ে যে মধ্যকায়া স্বচ্ছতোয়া প্রবহমানা, তার নাম লাচুং চু। সে কিছুটা নেমে গিয়ে মিশেছে তিস্তায়। লাচুং চুয়ের চলার পথে বুক পেতে রয়েছে অজস্র ছোটবড় উপলসারি। উপত্যকায় চরে বেড়াচ্ছে ইয়াকও। স্মৃতিচিহ্নের নুড়ি তুলে নিলাম লাচুং চুয়ের অন্তর থেকে।

ছবি-লেখিকা

(চলবে)

2 thoughts on “সুন্দরী সিকিমের সঙ্গ-যাপন—দ্বিতীয় পর্ব

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *