দীপক দাস

টানাপড়েনটা শুরু হয় গাড়ি থেকে নেমেই। ট্রেন হোক বা বাস। বেগুনকোদর হোক বা মলুটি। প্রথমেই তো ইধার চলা না উধার চলা। তার পর কীসে চলা? মাঝে মাঝে আতঙ্ক তৈরি হয়, জায়গা কোথায় চলা! বেগুনকোদর অভিযানে তো তাই হয়েছিল। বাস কন্ডাক্টর বলছিলেন, বেগুনকোদরে কোনও স্টেশনই নাই। এবারের ভ্রমণে রূপসী বাংলা থেকে শালবনি স্টেশনে নেমে একই সমস্যা। টোটোচালক জানতে চাইলেন, কোন আরাবাড়ি? এ আবার কেমন কথা! আরাবাড়ি ফরেস্ট তো একটাই। ঐতিহাসিক সেই জঙ্গলে তো শালবনি রেলস্টেশন থেকেই যাওয়া যায় শুনেছি।
টানাপড়েনের সময়ে ত্রাতা মধুসূদন ঠিক আবির্ভাব হয়ে যান। এবার অবশ্য তাঁকে আবাহন জানাতে হল। ফোন করলাম কোনও দিন না দেখা বন্ধু তথা শিক্ষক তথা গবেষক তরুণ সিংহ মহাপাত্রকে। আবাহনে তরুণ-মধুসূদন সাড়া দিলেন না। আমরা কাছের আরাবাড়িতে যাব সিদ্ধান্ত নিয়ে টোটোচালকের সঙ্গে কথা বলছি তরুণবাবু ফোন করলেন। বাজারে গিয়েছিলেন বলে ফোন ধরতে পারেননি। জানতে চাইলেন, আমরা ক’জন এসেছি? বললাম, ভাঙা দল। মাত্র তিন জন। সঙ্গী শুধু দীপু আর ইন্দ্র। তরুণবাবু কাছের আরাবাড়ি যাওয়ার পরামর্শ দিলেন। আরও কোথাও আরাবাড়ি আছে বলে তিনি শোনেননি। তাঁর স্কুলের আর আমাদের ঘোরার তাড়া ছিল। কথা বেশি হয়নি। তবে স্কুলে গিয়ে সফরসূচি একটা তৈরি করে দেবেন বলে জানিয়েছিলেন। এবং তৈরি করেও দিয়েছিলেন। এই সফরে ঘোরাঘুরিতে তাঁর অবদান অনেকখানি।

শীতের পরে জঙ্গলের রূপ।
আরাবাড়ি রেঞ্জ অফিসে ঢোকার সদর দরজা রাস্তার পাশেই। টোটো গিয়ে থামল দরজা থেকে সামান্য ঢুকেই। তখন ফেব্রুয়ারি মাসের শেষে। ফেলে আসা শীতের শুষ্কতা জঙ্গলের চেহারায়। শালগাছের শুকনো পাতা জমে আছে মাটিতে। ঘাস ইত্যাদি জংলা বন বিবর্ণ। এ দিকে বসন্ত সমাগত। কিছু কিছু শিমুল গাছে ফুল এসেছে। সে এক অন্য রূপ জঙ্গলের। এই জন্যই কোনও সুন্দর জায়গায় ঋতু পাল্টে যাওয়া দরকার। তা হলে একই জঙ্গলের একাধিক রূপ দেখা যায়। তিন জনে হাঁটছিলাম মোরামের রাস্তা দিয়ে। বেশ লাগছিল। একটা পাখি শাল জঙ্গলের ভিতর থেকে অনবরত ডেকে চলেছে। বউ বসন্ত। দীপু পাখির ডাকটা নকল করছিল। বারণ করলাম, ‘‘কারও হৃদয় ভাঙিস না। ও হয়তো মনে করতে পারে, সঙ্গী বা সঙ্গিনী সাড়া দিচ্ছে। কাছে এসে তোকে দেখলে আশাহত হবে।’’
হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম আরাবাড়ি নার্সারি এলাকায়। সিলভি কালচার বিভাগ। বিশাল নার্সারি। প্রতি বছর হাজার হাজার গাছের চারা তৈরি হয় এখানে। তৈরি চারা লাগানো হয় জঙ্গলে। বিতরণও করা হয়। মূলত শালগাছের চারা। এর সঙ্গে অন্য গাছের চারাও তৈরি হয়। দু’জন চারা তৈরির কাজে ব্যস্ত ছিলেন। আরাবাড়ি শুধু রেঞ্জ অফিস নয়, গবেষণাকেন্দ্রও। কিছুক্ষণ ঘুরে ঘুরে চারা তৈরি দেখলাম। তার পর এগিয়ে গেলাম রেঞ্জ অফিসের দিকে।

আরাবাড়ির নার্সারি এলাকা।
ঘুরতে ঘুরতে একটা বিষয় মনে হচ্ছিল, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়কে কি ভুলে গেল আরাবাড়ি? এতক্ষণ ঘুরলাম। কোথাও কোনও চিহ্ন দেখতে পাইনি। সরকারি উদ্যোগ ছিল। ব্যক্তিপুজো হতে পারে। সে কারণে অজিত বন্দ্যোপাধ্যায় নাও থাকতে পারেন। কিন্তু আরাবাড়ি যে জন্য ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে সেই উল্লেখ তো কোথাও নেই! অন্তত একটা ফলক থাকা উচিত ছিল। ইতিহাসের আরাবাড়ির বিষয়টা একটু বলা যাক। গত শতকের ৭০ দশক। আরাবাড়ি জঙ্গল তখন স্থানীয় বাসিন্দাদের কারণেই ধ্বংসের পথে। জ্বালানি ইত্যাদি নানা প্রয়োজনে জঙ্গলের গাছ কেটেছেন নির্বিচারে। চোরাচালানকারীরা তো ছিলই। সেই সময়েই মেদিনীপুরের ডিএফও হয়ে এসেছিলেন অজিত কুমার বন্দ্যোপাধ্যায়। আরাবাড়িকে বাঁচাতে উদ্যোগী হলেন। তিনি বুঝেছিলেন, স্থানীয় বাসিন্দাদের সঙ্গে না নিলে এই জঙ্গল রক্ষা করা যাবে না। ধ্বংস হয়ে যাবে বিশাল বাস্তুতন্ত্র। মানুষের ক্ষতি হবে। এলাকার পশুরাও খাবার পাবে না। তিনি এবং সঙ্গী বন আধিকারিক সুবিমল রায় গ্রামে গ্রামে ঘুরতে শুরু করেন। লোকজনকে বোঝান। তাঁদের নিয়ে তৈরি হয় কমিটি। জঙ্গলে গাছ লাগানো, পরিচর্যা এবং রক্ষার কাজে লাগানো হয় তাঁদের। ঠিক হয়, জঙ্গল থেকে শুকনো জ্বালানি সংগ্রহ করতে পারবেন বাসিন্দারা। কিন্তু গাছ কাটবেন না। বন দফতর পুরনো গাছ কাটলে সে সব বিক্রির একটা অংশ কমিটি পাবে। তা দিয়ে গ্রামের উন্নয়ন করা হবে।

তৈরি হচ্ছে গাছের চারা।
ধীরে ধীরে আরাবাড়ি আবার সজীব হয়। ১৯৯২ সালে পশ্চিমবঙ্গ বন সুরক্ষা কমিটি পল গেটি পুরস্কার পায়। পল গেটি পুরস্কার সংরক্ষণের নোবেল হিসেবে মান্যতা পায়। বন বাঁচাতে যৌথ বন ব্যবস্থাপনার আরাবাড়ি মডেল এখন সারা পৃথিবীতে গ্রহণযোগ্য। পাঠ্য বইয়ে স্থান পেয়েছে এই সংরক্ষণ ব্যবস্থা। আরাবাড়িতে অন্তত এই তথ্যটা জানানোর কোনও ব্যবস্থা রাখা উচিত ছিল। রেঞ্জ অফিসে থাকতে পারে কি?
অফিসে গিয়ে রেঞ্জার সাহেবকে পাওয়া গেল না। একটু আগেই বেরিয়ে গিয়েছেন। আমরা আসার সময়ে রাস্তায় একটা গাড়ি দেখেছি বেরিয়ে যেতে। কম বয়সি কয়েকজন ছিলেন অফিসে। তাঁদের জিজ্ঞাসা করা হল। অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের ছবি, স্মারক কিছু আছে কিনা। বা আরাবাড়ি মডেল সম্পর্কে পর্যটকদের জানানোর বিষয়ে কোনও ফলক? নেই বলেই জানালেন। খারাপই লাগল এই ইতিহাস বিমুখতায়।

রেঞ্জ অফিস। পাশের রাস্তাটা চলে গিয়েছে গেস্ট হাউসের দিকে।
এবার থাকার চিন্তা। কাছাকাছি থাকার জায়গা খুঁজছিলাম। নার্সারিতে একজন বলেছিলেন, জঙ্গলের কাছে কোনও হোমস্টে বা গ্রামে কোনও বাড়ি যদি এক রাতের জন্য ভাড়া পাওয়া যায়। আমাদের পছন্দ জঙ্গলের কাছাকাছি রাত কাটানো। বন দফতরেরই ফরেস্ট গেস্ট হাউস আছে। কিন্তু সেটা ডিএফও অফিস থেকে বুকিং করতে হয়। রেঞ্জ অফিসের কর্মীরা জানালেন, জঙ্গল লাগোয়া একটা রিসর্ট আছে। আমরা যে রকম চাইছি সেরকমই পাব। সেই সঙ্গেই তাঁরা একটা সাবধানবাণী শোনালেন। এলাকায় দলছুট একটা হাতি ঘুরে বেড়াচ্ছে। পথ চলতে সাবধান। প্রমাদ গুনি আমরা। অফিস কর্মীরা আশ্বাসও দিয়েছিলেন, আমাদের কাছ থেকে চোলাইয়ে বা মহুয়ার গন্ধ না পেলে কোনও বিপদ নেই।

আরাবাড়ি গবেষণা রেঞ্জ।
আশ্বাস বাণীতেও খুব একটা সহজ হতে পারিনি। ‘হাতির সঙ্গে হাতাহাতি’ সহজ কথা নয়। রেঞ্জ অফিস থেকে চিন্তা নিয়েই বেরলাম। অফিস থেকে একটু দূরেই একটা মাটির পথ। জঙ্গলের আরেকদিকে চলে গিয়েছে। এই পথ ধরেই আমাদের রাতের আস্তানা খুঁজতে যেতে হবে। হাঁটতে হাঁটতে ভয়টা কিছুটা কেটে গেল। সাইকেলে করে দু’একজনকে যেতে দেখলাম। একজন স্বামী-স্ত্রীও ছিলেন। ক্যারিয়ারে বসিয়ে স্ত্রীকে নিয়ে চলেছেন।
জঙ্গল পথে হাঁটতে বেশ লাগছিল। অনেক রকম গাছ। চিরাচরিত উইঢিবি। তবে একটা ঢিবি দেখে একটু আশ্চর্য লাগল। সাধারণত ঢিবিগুলো বর্ষার জলে ক্ষয়ে যায়। এই ঢিবিটা যেন পাথরের মতো আর বেশ খানিকটা উঁচুও। দীপু বলল, ‘‘এটা বোধহয় কোনও গাছের অংশ। সেটার উপরে উই বাসা করায় ঢিবির আকার নিয়েছে।’’ দেখলাম ছোট ছোট পাতার কাঁটাওয়ালা বাঁশ গাছ। এরকম গাছ দেখেছিলাম গড় পঞ্চকোটে।

সেই আশ্চর্য উইঢিবি।
এক সময়ে বড় রাস্তার কাছে এসে পড়া গেল। রেঞ্জের জঙ্গল এলাকা শেষ আর রাস্তার মাঝে একটা গুমটি দোকান। চা, তেলেভাজাও পাওয়া যায়। অনেকে খাচ্ছেন দেখলাম। অনেকক্ষণ বেরিয়েছি। ট্রেনে খাওয়া ঝালমুড়ি অতলে তলিয়েছে। কিছু খেয়ে নেওয়ার সিদ্ধান্ত হল। কখন ঘর পাব তার ঠিক নেই। চপ-মুড়ি খেয়ে নেওয়া গেল। খেতে খেতে দোকানদার এবং সহ-খাইয়েদের সঙ্গে আলাপ জুড়লাম। এলাকা, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, বন কমিটির কথা শোনা গেল। সন্ধান মিলল ঘরেরও। একজন জানালেন, রেঞ্জ অফিস থেকে সন্ধান দেওয়া রিসর্ট বন্ধ। একবার দেখতে পারেন। না হলে চন্দ্রকোনা রোডে চলে যেতে হবে। কিন্তু সে তো বাজারের মধ্যে। ওই রকম জায়গায় আমরা থাকতে চাইছিলাম না। একবার দেখেই নেওয়া যাক।

সোনালি রিসর্টের অবস্থা।
সকলে বিদায় জানিয়ে হাঁটতে হাঁটতে এগোলাম রিসর্টের দিকে। রাস্তার ডান দিকে জঙ্গল। বাঁ দিকে চাষের জমি। কিছু শেষ শীতের আনাজ ফলে আছে। কাছাকাছি বাড়িঘর প্রায় নেই। কিছুটা হেঁটে পৌঁছনো গেল সোনালি রিসর্টে। ঢোকার লোহার দরজাটা হাঁ করে খোলা। পরিত্যক্তই মনে হচ্ছে। লোহার গেটে লেখা দেখলাম লেখা, পরিচালনায় গড়বেতা-৩ পঞ্চায়েত সমিতি। মানে সরকারি টাকায় তৈরি। রিসর্টটির অবস্থান অসাধারণ জায়গায়। একেবারে জঙ্গল লাগোয়া। এক দিকে একটা খালের মতো রয়েছে। একটা প্লাস্টিকের নৌকা উল্টে আছে খালে। মানে একসময়ে অতিথিদের জন্য নৌকাবিহারের ব্যবস্থা ছিল। তৈরি হয়েছিল ফুলের বাগান। কাছেই পাকা রাস্তা। নির্জন জায়গা। এমন জায়গার রিসর্ট বন্ধ হয়ে গেল? চায়ের দোকানের একজন বলছিলেন, প্রথমে প্রচুর ভিড় হত। কিন্তু পরে নানা অনৈতিক কাজকর্মের কথা শোনা যেত। তার পরে লোক আসা বন্ধ হয়ে গেল। আমরা ঘুরে ঘুরে দেখছিলাম। রিসর্টের একটা ঘরেও দরজা জানলা নেই। চুরি হয়ে গিয়েছে নিশ্চয়। রান্নাঘরের অংশটাও ভাঙাচোরা। জনগণের টাকার কী অপচয়!

কুয়াশামাখা সেই প্রবেশপথ।
আমরা থাকিনি চন্দ্রকোনা রোডেও। ঠিক করে নিয়েছিলাম, বাকি সফর শেষ করে নেব। রাতে বা সন্ধ্যায় ফিরে আসব আরাবাড়িতে। ওখানে জঙ্গলের কাছে একটা রিসর্ট আছে। রিসর্টের মতো ব্যাপারসাপারে আমরা থাকি না। কিন্তু এবার উপায় নেই।
চান করার সুযোগ হয়নি সারাদিন। রিসর্টের ঘরে ঢুকে চানটান করে খেতে বেরোলাম। রিসর্টের খাবার নয় রাস্তার ওপাশে একটা ধাবায়। সেখানে মাতালদের বেশ আনাগোনা। ট্রাক থামিয়ে চালক, খালাসিরাও দেখি এই ধাবায় খেতে আসছেন। বনকর্মীরা বাইক আর বিশাল টর্চ নিয়ে টহল দেওয়ার ফাঁকে এখানে খেয়ে যাচ্ছেন। তিনজনে বাইরের এক চৌকিতে বসে খাবার দিতে বললাম। ইন্দ্র সারাদিন আমিষ বর্জিত ছিল। ও মাংস খাবেই। আমরা ভাজাভুজি আর তরকা নিলাম। তখনই শুনলাম, একজন জানাচ্ছেন, আমরা বাস থেকে নামার একটু আগেই নাকি একটা হাতি এখানে রাস্তার উপরে ছিল। টর্চের আলো ফেলতে বনে ঢুকে যায়। একটু আগেই আমরা রাস্তার পাশ দিয়ে জঙ্গলের দিকে হাঁটছিলাম। ভুল করেছি।

শীতের শেষ রেশটুকু মেখে বসন্তের আগমন বার্তা।
এই ভুল করেছিলাম পরদিন সকালেও। কুয়াশা ঘেরা অল্প অল্প শীতের আমেজ (আমাদের হাওড়ায় তখন রীতিমতো গরম) নিয়ে রাস্তা ধরে জঙ্গলের পাশ দিয়ে হাঁটছিলাম। ইচ্ছে ছিল, আগের দিনের সেই চায়ের দোকানে গিয়ে চা খাওয়া। ট্রেন ধরার তাড়া থাকায় আমার ঘ্যানঘ্যানানিতে দীপু আর ইন্দ্র বাসে উঠে পড়েছিল বটে, কিন্তু সারা রাস্তা নানা ভাবে খোঁচাচ্ছিল দু’জনে। কেন এত ফেরার তাড়া জানতে চাইছিল।
কিন্তু ভোরে আর রাতে জঙ্গলের রাস্তায় হাঁটাটা ভুল ছিল। এরকম আর কখনও করব না।
কভারের ছবি— আরাবাড়ির জঙ্গল
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)