খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

কমিকস-কার্টুনের খাওয়াদাওয়া

দীপক দাস

প্লেট থেকে স্প্যাগেটি লাফিয়ে উঠে ভিলেনের গলা পেঁচিয়ে ধরল। দম বন্ধ হয়ে আসছে ভিলেনের। দু’হাতে টেনে ধরেও প্যাঁচ আলগা করতে পারছে। খাদ্য-খাদক সম্পর্কের এমন উল্টোপথে যাত্রা এর আগে ‘মজার দেশ’এ দেখেছিলাম শুধু। সেই প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ‘কিশলয়’ বইয়ে যোগীন্দ্রনাথ সরকারের ছড়া। যে মজার দেশে জিলিপি তেড়ে এসে কামড় দিতে চায়। কচুরি আর রসগোল্লা নাকি ছেলে ধরে খায়। তার পর এই স্প্যাগেটিকে দেখছি। ভিলেন মারছে।

জাদুকর ম্যানড্রেকের কমিকসে একটা বিদেশি খাবারের সন্ধান পেয়েছিলাম। এই স্প্যাগেটি। ম্যানড্রেকের জাদুবলে যা গলার ফাঁস হয়ে গিয়েছিল। কমিকস যখন পড়ি তখন স্প্যাগেটি কী? কী ভাবে খেতে হয় জানতাম না। তবে একটু বোধ হয়েছিল, খাবারটা টিভিতে দেখা বা আনন্দমেলার বিজ্ঞাপনে পড়া ম্যাগি জাতীয়। এর বেশি খোঁজখবর নেওয়ার সাহস হয়নি। সুযোগও তেমন ছিল না। কারণ তার আগে ম্যাগি নিয়ে ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয়েছিল।

অরণ্যদেবের শিকার ও বনভোজন।

তখন দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণি। টিভিতে বা খবরের কাগজে দেখেছিলাম ম্যাগির বিজ্ঞাপন। সেই দু’মিনিটের লোভ। আর খাবারটা নতুন। সুতরাং বায়না শুরু। একদিন বাবা নিয়ে গেল বাজারে। আমাদের এলাকায় ওটাই বড় বাজার। বিভিন্ন দোকানে খোঁজ হল। কেউ চিনতেই পারল না। এখনও স্পষ্ট মনে আছে, এক দোকানদার সয়াবিনের প্যাকেট বের করে দেখিয়েছিলেন, এইটা? ব্যর্থই হয়েছিলাম সেদিন। পরে পাড়ার এক পিসি ম্যাগি করে খাওয়ায়। ওই পিসির বিয়ে হয়েছিল কলকাতার মানিকতলায়।

অনেকে বিশ্বাস করবেন না, এখন। অনেকেই আমাকে বুড়ো বলে। এসব শুনে ভাববে, আমার আবির্ভাব ত্রেতা যুগে। বয়সের শংসাপত্র আদায়ে নয়, আজ খুঁজতে বসেছি, বইপত্রের খাবার। বিশেষ করে কমিকস আর কার্টুনে খোঁজ পাওয়া বিভিন্ন খাবার। ম্যানড্রেকের কথা যখন উঠল তখন লি ফকের আরেকটা চরিত্রও আসুক। অরণ্যদেব, ফ্যান্টম। অরণ্যদেবে একটা খাবার পেয়েছিলাম মাছের সুরুয়া। অনেকদিন আগে পড়া। সম্ভবত অরণ্যদেব আর ডায়না কিলাউইয়ের স্বর্ণময় বেলাভূমিতে ছুটি কাটাতে গিয়েছিল। সেখানেই সুরুয়া খাচ্ছিল। সুরুয়া নিয়েও বেশ কিছুদিন হতভম্ব ছিলাম। জিনিসটা কী? আমাদের বাঙালির মাছ খাওয়া তো জানি। ঝোলের আলু, আনাজ দিয়ে বা ঝালের কাই দিয়ে ভাত চটকে মাছ ভরে ভরে খাওয়া। ফ্যান্টম আর ডায়না যে বাটি ধরে চুমকে খাচ্ছে! এখন সুরুয়া জানি। ইন্টারনেট-বাবা হ্যায় না! সুরুয়া মানে ঝোল। যেমন স্প্যাগেটিও জানি। ইতালির খাবার। বানানটা স্প্যাগেত্তিও হতে পারে। মোট কথা এক ধরনের নুডলস।

পেটুক গাবলু।

অরণ্যদেবের কমিকসে খাওয়াদাওয়ার ক্ষেত্রে কিন্তু একটা পরিবর্তন দেখেছি। প্রথম দিকের কমিকসে অরণ্যদেব শিকারে বেরোতেন। হরিণ, শুয়োর মারতেন। তার পর সেই মাংস ঝলসে খাওয়ার ছবিও আছে। পরের দিকে কিন্তু ইডেন উদ্যানে অরণ্যদেব বাঘ, সিংহকেও মাছ ধরে খাওয়া শিখিয়েছেন। কেন এই পরিবর্তন? সম্ভবত, বন্যপ্রাণ সংক্রান্ত আইন ও অধিকার আন্দোলন কড়াকড়ি হওয়ার কারণে।

ছোটবেলায় বাড়িতে আনন্দমেলা আসত। গল্প-উপন্যাসের টান তো ছিলই। গাবলু নামক ‘মিউট’ খুদেটি কম টানত না। গাবলু ভীষণই পেটুক। নানারকম ভাবে খাবার ফন্দিফিকির করে। একটা কমিকসে ছিল, খাবারের দোকানের সামনে লোক দেখলেই গাবলু কাঁদছে। এক ভালমানুষ ভদ্রলোক ওকে হ্যামবার্গার কিনে দিলেন। সেটা খাওয়া হয়ে গেল। ভদ্রলোক খুশি হয়ে চলে গেলেন। তার পর এক ভদ্রমহিলা দোকানে এলেন। আবার গাবলুর কান্না। না, হ্যামবার্গার কাকে বলে, কেমন খেতে, তখন সত্যিই জানতাম না। যেমন জানতাম না চেরি ফলের কথা। সেই যে এক বৃদ্ধকে চেরি ফল পাড়তে সাহায্য করছিল গাবলু আর তার বন্ধু। ছোট বালতি নিয়ে দুই বন্ধু গাছে উঠেছিল। গাছ থেকে নামার পরে বৃদ্ধ ফাঁকা বালতি দেখিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, চেরিগুলো কোথায়? দুই বন্ধু নিজেদের পেটে হাত দিয়ে দেখিয়েছিল। কার্ল অ্যান্ডারসন তাঁর কমিকসে বাল্যপ্রেমের আলতো ছোঁয়া রেখেছেন কিছু কিছু কমিকসে। সেখানে অ্যান্ডারসনের হেনরি ওরফে বাঙালির গাবুল ওরফে গুণধরের (কিছু কমিকসে) এক গার্লফ্রেন্ডও রয়েছে। ছেলেবেলার খেলার সাথী আরকী। আবার তা নিয়ে এক বন্ধুর সঙ্গে অল্পস্বল্প টানাপড়েনও রয়েছে। এক কমিকসে মেয়েটি গাবলুর সঙ্গে কোনও আইসক্রিম পার্লারে গিয়েছে। অর্ডার দিয়েছে আইসক্রিম সোডার। সেই সময়েই হাজির সেই প্রতিদ্বন্দ্বী। সে আইসক্রিম সোডার থেকেও ভাল কিছু অর্ডার করেছিল। আর মেয়েটি বসার টুল ঘুরিয়ে নিয়েছিল ছেলেটির দিকে। কিছুক্ষণ পরে মেয়েটি ঘুরে দেখে, গাবলু তার জন্য অপেক্ষা করেনি। দু’টো আইসক্রিম সোডাই খেয়ে নিয়েছে।

গাবলুর কেরামতি।

গাবলুতে পড়া চেরি বা হ্যামবার্গার চিনেছি অনেক পরে। আইসক্রিম সোডা এখনও জানা হয়ে ওঠেনি। তবে চেরি আসল চেনার আগে নকল চিনেছিলাম। টিভি দেখে। বারুইপুরে করমচার বীজটা চিনির রসে ফুটিয়ে, রং করে চেরি তৈরি করা হয়। পাড়া-গাঁয়ের ফলের দোকানে আগে কাচের বয়ামে, পরে প্লাস্টিকের বোতলে লাল লাল জিনিস যা চেরি হিসেবে বিক্রি হয় তা ওই করমচার বীজের প্রক্রিয়াকরণ।

টিনটিনে নানা ধরনের খাবারের ছড়াছড়ি। সে বহু দেশ সফর করেছে। নানা খাবার খেয়েছে। খুদে রিপোর্টারের সঙ্গে আমার পরিচয় আনন্দমেলাতেই। তবে বাড়িতে নয়, মামার বাড়িতে। দু’টো পুরনো আনন্দমেলা উদ্ধার করেছিলাম মামাদের বইয়ের তাক থেকে। তাতে ‘তিব্বতে টিনটিন’ ধারাবাহিক চলছিল। এই কমিকসের একটা খাবার তো খুব জনপ্রিয়। না, খাবার নয়, পানীয়। ছাং। যা খেয়ে ইয়েতি নাকি ঘুমিয়ে পড়ে। আসলে নেশার দ্রব্য। ক্যাপ্টেন হ্যাডকের দৌলতে টিনটিনে বহু বোতলের আবির্ভাব ঘটেছে। সে কথা থাক। আমি পেয়ে গেলাম নতুন খাবার, শাম্পা। হ্যাডকের ভাষাতেই বলা যাক, শাম্পা বস্তুটা আসলে কী? চা আর মাখনের সঙ্গে বার্লির মণ্ড। তিব্বতি খাবার। তখন জানতাম না। এখন জানি।

সালামি কী দিয়ে তৈরি হয়? আমেরিকায় টিনটিন।

পরে নিজেদের বাড়িতে নেওয়া আনন্দমেলায় ধারাবাহিক চলছিল ‘আমেরিকায় টিনটিন’। তাতে প্রথম জানতে পারি, টিনের কৌটোয় খাবার পাওয়া যায়। মাংসের মতো খাবার। কিন্তু সালামি কাকে বলে জানতে পারিনি। তবে কৌটোয় কীসের না কীসের খাবার ভরে দেয়, এমন একটা সংশয় তৈরি হয়ে গিয়েছিল। এই কমিকসেই তো আছে এক খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ কারখানায় যারা সালামি তৈরির জন্য ইঁদুর, বিড়াল সরবরাহ করে তারা ওইসব প্রাণীর দাম বাড়ানোর জন্য ধর্মঘট করেছিল!

টিনটিনে কিন্তু পুরো মাল্টি কুইজিন রেস্তরাঁ। এই তো আমেরিকার সালামি খেলেন। এবার ইতালিয়ান খান। ‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’ ভিড়ুন। সান থিওডোরাসে ট্যাপিওকার হাতে বন্দি মিলানের কোকিলকণ্ঠী বিয়াঙ্কা কাস্তাফিয়েরো। তিনি অত্যন্ত তেজোদীপ্ত মহীয়সী। থিওডোরাস সম্ভবত লাতিন আমেরিকার দেশ। সেখানকার খাদ্যাভ্যাস আলাদা। কিন্তু বন্দি বিয়াঙ্কাকে দেওয়া হয়েছে তাঁর দেশীয় খাবার পাস্তা। তিনি বেশি সিদ্ধ পাস্তা আবার খেতে পছন্দ করেন না। ফলে পাস্তা ঢেলে দিয়েছেন বাটলারের মাথায়। এই পাস্তা আবার আমাকে সংশয়ে ফেলে দিয়েছিল। ‘এবেলা’ অফিসে দু’একজন সহকর্মিনী পাস্তা আনতেন। অল্পস্বল্প ভাগ মাঝে মধ্যে পেয়েছি। কিন্তু সে তো টুকরো টুকরো। কখনও প্যাঁচানো। তবে টুকরোই। বাটলারের মাথায় ঢালা পাস্তার মতো লম্বা নয়!

বেশি সিদ্ধ পাস্তার প্রভাব। মিলানের কোকিলকণ্ঠী।

খাবার নিয়ে আমাকে একটা শিক্ষা দিয়েছে টিনটিনের কমিকস। সেটা হল, অন্যের খাবারকে শ্রদ্ধা জানানো। আবার ‘বিপ্লবীদের দঙ্গলে’। উপজাতি গোষ্ঠী আরামবায়াদের অতিথি টিনটিন, ক্যাপ্টেন আর ক্যালকুলাস। একজন টিনটিনকে খাওয়ার আগে শিখিয়ে দিলেন, খেতে ভাল না লাগলেও ভাল লাগার ভান করতে হবে। না হলে গৃহস্বামী অপমানিত বোধ করবে। টিনটিন, ক্যালকুলাস যথাসাধ্য চেষ্টা করেছিল। কিন্তু খাবারে ছিল প্রচণ্ড ঝাল। টিনটিনে আরও একটা জিনিস দেখা যায়। নিজের দেশের রীতিনীতির প্রতি ভালবাসা। সেই সঙ্গে খাবারের প্রতিও। সেই জন্যই বিয়াঙ্কা বন্দি থেকেও পাস্তা বেশি সিদ্ধ হওয়ার জন্য রেগে যায়। আবার ‘লোহিত সাগরে হাঙর’এ আরব শেখের ছেলে আবদুল্লার দেহরক্ষীরা মার্লিনস্পাইকের প্রাসাদের ঘরের ভিতরে তাঁবু খাটিয়ে বসে থাকে। রান্না হয় আরবীয় রীতিতে। অনেকের মনে থাকতে পারে ভারতে খেলতে আসা অস্ট্রেলিয়ার শেন ওয়ার্নের কথা। সেবার ওয়ার্ন সচিনের হাতে প্রচুর ঠ্যাঙানি খেয়েছিলেন। একবার খবর হল, ভারতীয় খাবার নাকি ওয়ার্নের সহ্য হচ্ছে না। তাই ভাল বল করতে পারছেন না। তাঁর জন্য নাকি অস্ট্রেলিয়া থেকে স্পেশ্যাল সিদ্ধ বিনস আনানো হয়েছিল। এই জন্যই বোধহয় বাঙালি ঘুরতে গেলে মাছ-ভাতের জন্য বায়না জোড়ে।

কী ঝাল! আগ্নেয়গিরি।

প্রতি রবিবার টিভিতে আধ ঘণ্টা টম অ্যান্ড জেরি কার্টুন হত। ছোটবেলায় ক্লাবে, পড়শির বাড়িতে গিয়ে দেখতাম। এই কার্টুনে তো প্রচুর খাবার। আমিষ, নিরামিষ, ফলপাকুড় সবই রয়েছে। কিন্তু সে সব কি মুখে দেওয়ার? সে সব তো নষ্ট করার। ইঁদুর-বেড়ালের লড়াইয়ের সমরাস্ত্র তো সেগুলোই।

বাংলা কমিকস হাঁদা-ভোঁদার কথা না বললে কি চলে! নারায়ণ দেবনাথ শিখিয়েছিলেন, বানরুটি, প্যাটিস, প্যানকেক। আমাদের গ্রামাঞ্চলে তখন কেকের খুব একটা চল ছিল না। কেক বলতে বাপুজি, টিফিন কেক। তা-ও সেই বড়দিন বা প্রথম জানুয়ারি ছাড়া কেক খাওয়ার কথা চিন্তা করা যেত না। তবে হাঁদা-ভোঁদায় মাঝে মাঝে সসেজ চুরির গল্প থাকত। তা কি তখন শহরেও বেশি পাওয়া যেত? ‘বাঁটুল দ্য গ্রেট’এর খাওয়াদাওয়া একটু বেশি। রকমারি কিছু ছিল কি? নাকি সাধারণ খাওয়া পরিমাণে একটু বেশি!

অ্যাসটেরিক্সের কমিকসে খাবারের তেমন বৈচিত্র নেই। শুয়োরের রোস্ট আর পানীয়। তবে মন জয় করে নেয় ‘গলদেশ পরিক্রমায় অ্যাসটেরিক্স’ কমিকস। রোমানরা বেড়া তুলে দিয়েছিল গলদের গ্রামের চারপাশে। অ্যাসটেরিক্স চ্যালেঞ্জ জানিয়েছিল, ওই বেড়া ভেঙেই তারা বেরোবে। সমস্ত গলদেশ ঘুরে যেখানকার যা বিখ্যাত খাবার সংগ্রহ করে আনবে। তার পর নেমন্তন্ন করে রোমানদের খাওয়াবে। চ্যালেঞ্জের মতো চ্যালেঞ্জ।

কাণ্ড দেখো! প্রাসাদের ভিতরে তাঁবু। রান্নাও হচ্ছে।

কথা রেখেছিল দুই দেশপ্রেমিক গল, অ্যাসটেরিক্স আর ওবেলিক্স। লুতেশিয়ার হ্যাম, কামারাকামের বেতিস, নিসের স্যালাড, মাসিলিয়ার বুইয়াবেস নিয়ে ফিরেছিল। এগুলো কী খাবার জানি না। এসব চেখে দেখার মতো ক্রেডিট বা ডেবিট কার্ডও আমাদের নেই। তবে আমাদের দলও একটা চ্যালেঞ্জ নিয়েছে। বাংলার প্রতিটি জেলার যা বিখ্যাত খাবার সব আমাদের জিভের নাগালে নিয়ে আসব। চোখে এবং চেখে দেখব।

কিন্তু হতভাগা করোনা ভাইরাস! এখন শুধু মানসভ্রমণে বাধ্য করছে!

এরকম চ্যালেঞ্জ বারবার নিতে চাই।

কভারের ছবি— ‘অ্যাসটেরিক্স ও গথ দস্যু’ থেকে। প্রকাশক আনন্দ পাবলিশার্স।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *