পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

দল বেঁধে দলমায়— বুরুডি

ইন্দ্রজিৎ সাউ

হাটে ঢুকে তো সকলেই অবাক! এটা হাট?

আলু, পিঁয়াজ থেকে শুরু করে মনোহারি দ্রব্য, শাড়ি চুড়িদার থেকে শীতের পোশাক, জুতো পর্যন্ত বিক্রি হচ্ছে। মাছ, মাংস তো ছিলই। হাটে আসা মানুষজন দেখেই মালুম হচ্ছিল তাঁদের ক্রয় ক্ষমতার কথা। তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে জিনিস পত্রও সবই সস্তা।

তবে চাকচিক্যের বড়ই অভাব। শহুরে লোকেরা হত দরিদ্রের ছাপই খুঁজে পাবেন। এক জায়গায় দেখলাম মহুয়া আর হাঁড়িয়া বিক্রি হচ্ছে। মহিলা, পুরুষ গোল হয়ে তার চারপাশে বসে। এরা যে কত অল্পে বেঁচে থাকে বা বলা ভাল বেঁচে আছে সেটা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিচ্ছিল। আমি তো একজনও রমণী কে দেখলাম না যাকে নিয়ে কাব্যি করা যায়। লেখক-কবিরা কোথা থেকে যে পান সাঁওতাল রমণীর কমনীয় রূপ! আমরা যখন দুমকা থেকে রামপুরহাট ফিরছিলাম তখন সারসডাঙ্গালের হাট দেখে ছিলাম। সেখানেও একই চিত্র। কোনওভাবেই মেলাতে পারছিলাম না আমার দেখা ছোট বেলার হাটের সঙ্গে।

গ্রামীণের মাথায় বহুজাতিক। দলমার হাটে।

আমি পেঁড়োর হাটের কথা বলছি। হাওড়া জেলায়। এখানেই কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্রের বাড়ি। ছোটবেলায় দাদুর সঙ্গে যেতাম। নিজেদের কয়েক বিঘে জমিতে চাষ তো হতোই, সেই সঙ্গে ভাগের কয়েক বিঘে জমিতে চাষ করতেন। আলু, কপি লাউ, কুমড়ো বিভিন্ন শাক ছাড়াও তরমুজের চাষ হতো। দাদু বড় চাষি। আশেপাশের ১২-১৩টা গ্রামের মোড়লও ছিলেন। আমি ৮৫-৮৮ সালের কথা বলছি। ৬৮ বছর বয়েসেও অনায়াসে একমনি বোঝা নিয়ে দেড় দু’কিলোমিটার হেঁটে হাটে আসতেন। মঙ্গল, শুক্র আর রবিবার হাট বসত। হাটকে আমার রঙিন জগত মনে হত। সবুজ সাদা বেগুনি লাল যত রকমের ফসল তত রকমের রং। আর ছিল আশেপাশের গ্রামের পুকুরের পেল্লাই সাইজের সব রুই, কাতলা মৃগেল মাছ। ভোর ৫টা থেকেই বিকিকিনি শুরু হয়ে যেত। চাষিরা আসত আরও ভোরে। আমি মনের আনন্দে এক প্রান্ত থেকে আর একপ্রান্তে ঘুরে বেড়াতাম। হারিয়ে যাওয়ার কোনও ভয়ই ছিল না। দাদুর নাম বললেই হল। পৌঁছে দেবে। সেই হাটের জৌলুসের কাছে এই হাট তেমন কিছু মনে হল না। রাজধানীর কাছাকাছি হাওড়া জেলা। কাছাকাছি জেলার রূপে যে খোলতাই সে ঔজ্জ্বল্য দেখা যায় না প্রান্তিক জেলাগুলোতে। হাটের ক্ষেত্রেও কি তাই? পেঁড়োর সেই হাটের এখন রূবদল ঘটেছে। হাট বাজারে বদলেছে।

ভাগা দিয়ে বিক্রি হচ্ছে মাছ। সম্বল এইটুকুই।

আমরা হাট দেখা শেষ করে গাড়িতে লোড হলাম। ঘাটশিলার উদ্দেশে। পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়লাম বুরুডি ড্যামে। আজ সারাদিন ওখানেই থাকব এবং ফিস্ট করব।। পথ যত এগোতে থাকল আশেপাশের সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। একজায়গায় তো সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়লাম শালুক ফুলে ভর্তি পুকুর দেখে। সুব্রত তো জলেই নেমে পড়ল ফুল তুলতে। প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর গল্প গুজবে এতই মশগুল ছিলাম যে কারওই মনে ছিল না আমাদের সঙ্গে কোনও রসদ নেই।

সরোবরের শোভা।

তখন প্রায় আট কিলোমিটার চলে গেছি। আদিবাসী গ্রাম শুরু হয়ে গেছে। তখন রাজাই বলল, ‘আজ যে রান্না হবে আমরা যে কিছুই নিইনি। কয়েকজনকে জিজ্ঞাসা করে জানা গেল বাজার করতে হলে আমাদের আবার ঘাটশিলা যেতে হবে। আশেপাশের গ্রামে চেষ্টা করলাম যদি দেশি মুরগি পাওয়া যায়। কিন্তু কেউই বিক্রি করতে রাজি হল না। গরু ছাগল মুরগি এদের কাছে সম্পদের চেয়ে কিছু কম নয় মনে হল। বাজারে মাংস নেব শুনেই তো দুলালদা আর শিলা বলে দিল আমাদের জন্য অন্য কিছু নিও। সেই ছাল-সহ মাংসের ভয়। না, এখানে ছাল ছাড়ানো মাংসই পেয়েছিলাম। আরও প্রায় এক দেড় ঘণ্টা পর বাজার করে ড্যাম পৌঁছলাম।

দূর থেকেই ড্যামের আশেপাশের সৌন্দর্য মালুম হচ্ছিল। যত এগোচ্ছি ততই সবুজ গাছগাছালিতে মোড়া সুউচ্চ পাহাড়ের রূপ ছিল দেখার মতোই। একেকটা বাঁক পেরোচ্ছি আর মনে হচ্ছে কোন জাদুকর তার জাদুর ঝাঁপি থেকে রংবেরঙয়ের ফুলের তোড়া আমাদের সামনে মেলে ধরছে। পৌঁছেই তো রাজা মানে আমাদের ড্রাইভার কাম কুককে রান্নার ব্যবস্থা করে দিলাম। বাকিটা রাজা সামলে নেবে। ও একাই একশ এই ব্যাপারে। আগের দিন রাত্রেই বলে দিয়েছিল, এখানে রান্না ওই করবে।

বুরুডির কাছে এক গ্রামের রাস্তা।

রাজা রান্নার ব্যবস্থা করল। আমরা ড্যামের দিকে গেলাম। চারপাশটাই সবুজ পাহাড়ে ঘেরা একটা ছোট্ট লেক। রোদের তারতম্যে নীল থেকে ঘন নীল আবার কখনও সবুজ হয়ে যাচ্ছে। অপূর্ব সে দৃশ্য। বিদেশে হলে বিখ্যাত হয়ে যেত। ভারতে বলেই এই রকম অনাদরে পড়ে আছে। পর্যটকদের মানসিকতাও বেশ ‘সুন্দর’। খাওয়াদাওয়া, হাবিজাবি সব এখানেই ফেলে গিয়েছে। বিকাল ৪টের পর থেকেই ঠান্ডা বাড়তে শুরু করেছে সেটা বোঝা যাচ্ছিল।

তার কিছু পর থেকেই অবশ্য ওখানকার স্বেচ্ছাসেবকেরা ঘোষণা করছিল, পর্যটকরা যেন যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এখান থেকে রওনা দেন। সন্ধে নামার সঙ্গেই এখানে ঠান্ডার প্রকোপ প্রচণ্ড বেড়ে যাবে। ঠান্ডা একটা কারণ তো ছিলই, এবং সেটা বেশ মালুমও হচ্ছিল। এই ঘোষণার আসল কারণ অবশ্য আমাদের আগেই জানা হয়ে গিয়েছিল। আমাদের বাড়তি খাবার স্থানীয় কয়েকজন মহিলাকে দিয়েছিলাম। তারাই বলেছিল “বাবু সন্ধের আগেই এখান থেকে চলে যাবেন। খুব চুরি ছিনতাই হয়। ৫টার কিছু পরেই আমরা গাড়ি ছাড়লাম। তখন একদিকে সূর্য তো ছিলই আর এক দিকে চাঁদ দেখা দিয়েছে।

ড্যামের সৌন্দর্য।

ঝাড়গ্রামের আগে ফেকোঘাট ব্রিজ ডুলুং নদীর উপর। ব্রিজে উঠতেই সামনের চাকা গেল ফুস হয়ে। সবাই নেমে পড়লাম। নেমেই সকলে দোষারোপ করতে শুরু করল আমাকে। দোষের মধ্যে আমি যে সামনে বসেছিলাম! যেদিকে বসেছিলাম সেদিকের চাকাটাই পাংচার হয়েছে। সুব্রত বলল, ‘তোকে তখনই বলেছিলাম বেশি মাংস খাস না। হল তো! তোর আর কত ওজন নেবে বেচারা চাকাটা।’ আমাদের ‘যথা ইচ্ছা তথা যা’ গ্রুপের সাপ্তাহিক মঙ্গলবারের আড্ডায় যদি চারদিন ফিস্ট হয় তো সাড়ে তিনদিনই মাংস থাকে। মাংস দেখলে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ থাকে না। তা বলে চাকা ফেটে যাবে!

অপরূপ বুরুডি।

চাকা পাল্টে আবার রওনা দিলাম। রাত ৩টের সময় যখন বাড়ি ঢুকলাম তখনও বুরুডি ড্যামের স্মৃতি স্পষ্ট।

ছবি- লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *