জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

ধূঁয়াধার সফর

 দীপশেখর দাস

বিরক্তিটা বাড়ছিল ক্রমশ। নামেই এক্সপ্রেস। লোকাল ট্রেনও এর থেকে ভাল। এমন স্টেশনে দাঁড়াচ্ছে যেখানে প্লাটফর্ম পর্যন্তও নেই। তার উপর ট্রেনে প্যান্ট্রিকার নেই। স্টেশন থেকে কিছু খাবার নেব সে উপায়ও দেখছি না।

আমরা চারজনই বেশ কাহিল। চারজন মানে সমীরণদা, শুভজিতদা, অর্ণব আর আমি। উপরওলাদের হুকুমে বাস্তববিদ্যার পাঠ নিতে চলেছি মধ্যপ্রদেশে। জবলপুরের পরিবেশ ও বাস্তববিদ্যা পাঠদানের অন্যতম প্রতিষ্ঠান ট্রপিক্যাল ফরেস্ট রিসার্চ ইনস্টিটিউটে। আর তাই শক্তিপুঞ্জ একপ্রেসে চড়া। হেডফোনে হিন্দি গানটা বাজছিল- ‘সফর খুবসুরত হে মঞ্জিল সে ভি…’ মনে ভাবলাম এই যদি ‘খুবসুরত সফর’ হয় মঞ্জিল কেমন হবে কে জানে!

ইনস্টিটিউটের বারান্দা থেকে।

ধুঁকতে ধুঁকতে ট্রেন যখন জবলপুর পৌঁছল ঘড়ির কাঁটায় রাত দশটা। ৫ ঘণ্টা লেট। ইনস্টিটিউটের গাড়ি আমাদের নিতে আসার কথা ছিল। দেরি দেখে ট্রেনিংয়ের হেড রাজকুমার স্যার ড্রাইভারের ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। ড্রাইভারদাদাকে বলে দেওয়া হয়েছিল সাড়ে ন’টায় আসতে। স্টেশনের বাইরে পা দিতেই টিএফআরআইয়ের লোগো দেওয়া টাটা সুমোটা চোখে পড়ল। শেষ পথটা অন্তত আরামের হোক।

জয়রামজি বেশ মজার লোক। বললেন –‘আপ লোগো নে মেরা ৪ ঘণ্টা ডিউটি কম কর দিয়ে।’ আমরা বেশ অবাক হলাম। আমাদের দেরিতে ওঁর কীভাবে ডিউটি আওয়ার্স কম হল! নিজেই খোলসা করলেন, তাঁর আজ নাইট ডিউটি। রাত ১১টা পর্যন্ত। তিনি বিকেল সাড়ে চারটেয় স্টেশনে এসে হাজির হয়েছিলেন। অনুসন্ধানে ট্রেন সাড়ে চার ঘণ্টা লেট জেনে সোজা বাড়ি চলে যান। স্টেশনের কাছেই বাড়ি। খাওয়াদাওয়া সেরে সাড়ে ন’টায় আবার স্টেশনে আসেন। তাই আজ ১০টা থেকে ১১টা ডিউটি দিয়েই তিনি খালাস। যাক, আমাদের কষ্ট হোক, কারও তো ভালো হল।

প্রভাত সঙ্গীত।

জয়রামজি আমাদের প্রতিষ্ঠানের গেস্ট হাউসে পৌঁছে দিয়েছিলেন। পরের দিন থেকেই প্রশিক্ষণ। রাতে পৌঁছনোয় প্রতিষ্ঠান চত্বরের স্বরূপ আমাদের চোখে পড়েনি। শুধু বুঝেছিলাম, অনেক গাছপালা আছে চত্বরে। সকালের সূর্য আমাদের নতুন পরিবেশ দিল। বারান্দা থেকে দেখলাম, সামনে সবুজ প্রান্তর। প্রান্তে ছোট সবুজ পাহাড়। ঝাঁকে ঝাঁকে পাখি উড়ে চলেছে তাদের নিত্যদিনের খাদ্য সন্ধানে। প্রতিষ্ঠান চত্বর গাছে ভরা। তারই মাঝে সুন্দরভাবে পরিচর্চিত ফুলের বাগান। জবলপুর শহরের দূষণের মাঝে এ এক অন্য পরিবেশ। মনে প্রশ্ন এল-পরিবেশচর্চার প্রতিষ্ঠান বলেই কি এরা পরিবেশকে ভালোবাসতে জানে?

পরিযায়ী অতিথি।

আমরা চারজন ছাড়াও আরও সাতজন প্রশিক্ষণ নিতে এসেছেন। একজন বিদেশি। দক্ষিন আফ্রিকা নিবাসী মিস্টার মোসেস। প্রথমদিনের প্রশিক্ষণ চলল স্কুল-কলেজের ক্লাসের মতই। প্রোজেক্টরের আলোয় পর্দায় ফুটে উঠছিল নানান তথ্য আর কৌশল। কিন্তু ওই পর্দা কারোরই মন জিততে পারল না। প্রশিক্ষকরাও বোধহয় বুঝেছিলেন সে কথা। তাই পর্দাপ্রথার অবসান প্রথমদিনেই। দ্বিতীয় দিনে উন্মুক্ত প্রান্তর। আজ আমাদের প্রশিক্ষক এখানকার বাঙালি বিজ্ঞানী সুমিত চক্রবর্তী। সাতসকালেই সবাইকে নিয়ে তিনি রওনা দিলেন নর্মদা নদী তীরে। উদ্দেশ্য জীববৈচিত্র পর্যবেক্ষণ। পিচঢালা চওড়া রাস্তা ফেলে গাড়ি মাটির সরু রাস্তায় নামতেই জবলপুর অন্যরূপের অন্য রূপ। সাদা ধুলো ওড়া রাস্তার দু’ধারে সুসজ্জিত ইউক্যালিপ্টাস-আকাশমণি। গর্বিত শাখাবিস্তারে সূর্যালোকের পথরোধ করেছে তারা। সকালের আগুন রাঙা আকাশ আর সবুজ বন মিলে এক অসাধারণ ল্যান্ডস্কেপ সৃষ্টি করেছে।

নাম ভোলা আরেক অতিথি।

স্যার বললেন এ বনানী তাদের সৃষ্ট। এখানকার সব পতিত জমি চিহ্নিত করে রোপণ করা হয়েছিল আকাশমণি-ইউক্যালিপটাস। ওরাই বড় হয়ে ছায়া সুনিবিড় করেছে জায়গাটিকে। ওদের দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম নদী তীরে। নীল আকাশকে সঙ্গী করে আঁকাবাঁকা পথে এসে নর্মদা এখানে বেশ সুন্দরী। যদিও বর্ষাকাল না হওয়ায় নদীর জল অনেকটাই কম। চিন্তামুক্ত লাল, সবুজ শ্যাওলার দল বাসা বেঁধেছে স্রোতহীন জলের উপরতলে। পাতাঝাঁঝিরা প্রান্তে।

যদিও এখানে আসার মূল উদ্দেশ্য অন্য। এখানে পাখি পাওয়া যায়। হরেকরকম পাখি। সুমিত স্যার পাখি ভালোবাসেন। পাখির ছবি তুলে বেড়ান। বিশ্বকে জানানোর চেষ্টা করেন কোথায় কোন পাখি দেখেছেন। তিনি বললেন-এখানের নর্মদার সৌন্দর্যে পাখিরা আরাম পায়। জনমানবহীন এই প্রান্তরে ওরা নিজের মতো করে থাকতে পারে। ভুল বলেননি কিছু। শহরের কাছে হলেও শহরের কোহাহল গ্রাস করতে পারেনি এই অঞ্চলটাকে। তাই পাখিরা নিশ্চিন্তে বিচরণ করে। দেখলাম নদীর মাঝে জেগে উঠা ছোট চরগুলো পাখিদের খুব প্রিয়। নাম না জানা পাখিরা জমায়েত করেছে সেখানে। কেউ ব্যস্ত ডানা শুকোতে কেউ বা খুনসুটিতে।. স্যার অবশ্য নাম বলছিলেন পাখিগুলো দেখিয়ে। মনে রাখতে পারিনি। তবে ওদের দেখে মন ভরেছিল। আমাদের গ্রামের এক দীঘিতে এরকম পাখি দেখেছিলাম। কিন্তু তারা যাযাবর। শীতকালে আসে। শীত ফুরোলে আবার খুঁজে নেয় অন্য আস্তানা।

বনপথে।

নদীতীরের জীববৈচিত্রের পাঠ শেষে এবার ক্লাসরুমে ফেরার পালা। আমার আবদার ছিল জঙ্গলপথটা হেঁটে ফিরব। সুমিত স্যার প্রস্তাবে সায় দিলেও অন্যরা ছিল নিমরাজি। স্যার মত দিলেন যারা গাড়িতে যেতে চায় তারা আগে গিয়ে বাইরে আমাদের জন্য অপেক্ষা করুক। এমনিতে আমি খুব একটা হাঁটতে পছন্দ করি না। বাড়ি থেকে ৩০০ মিটার দূরের দোকানেও আমি সাইকেল বা বাইকে যাই। কিন্তু কেন জানি না স্নিগ্ধ জঙ্গলপথ আমায় বড় টানে। হাঁটতে ইচ্ছা হয় ওর বুকের ভিতর দিয়ে। ছুঁতে মন চায় ওর প্রতি ধমনীকে। এ এক অমোঘ আকর্ষণ। কী কারণে জানি না, সকলেই আমাদের সঙ্গে এল। বেশ খুশি ওরা। মনের মতো শ্যুটিং লোকেশন পেয়ে সকলে পোজ দিতে ব্যস্ত। আমি খুঁজছিলাম পাখিদের। স্যার বলছিলেন, এ অঞ্চলে দুধরাজ দেখা যায়।

রাতের শিক্ষা।

দ্বিতীয় দিনের ট্রেনিং শেষ। জঙ্গলপথে দুধরাজের দেখা পাইনি। তবে পথে সঙ্গী পেয়েছিলাম ময়না-চন্দনা-টিয়াকে। এ পাওয়াই বা কম কী! নর্মদা পাড় থেকে ফিরতে হয়েছিল ক্লাসরুমে। ক্লাসরুমের ধকল সহ্য করা বেশ কষ্টকর হচ্ছিল। একটু ঘুমঘুম ভাবও এসেছিল বোধহয়। সাঁঝবেলায় ঘরে ফিরে বিছানা নেবার আগেই রাজকুমার স্যার ফোন করে জানিয়ে দিলেন, তৈরি থাকতে। রাত ৮টায় বেরোনো হবে ইনস্টিটিউশন চত্বরের রাতের বাসিন্দাদের দেখতে। ব্যাস আর কী! ঘুমঘুম ভাবটা তখনি কেটে গিয়ে এক অন্য উত্তেজনা।

বাসায় টুনটুনি। রাতে তোলা ছবি।

৮টা বাজতেই হাতে টর্চ নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম রাতচারীদের খোঁজে। সঙ্গী সুমিত স্যার আর রাজকুমার স্যার। সুমিত স্যারের নখদর্পনে নিশাচরদের ঠিকানা। গাছের কোটরে লুকিয়ে থাকা পেঁচা। গাছের ডালে ঝুম মেরে থাকা গন্ধগোকুল। বা ডুমুর গাছে বাসা বাঁধা টুনটুনি সবার আস্তানা। শুধু কী তাই! নিজেই একটা বানিয়ে ফেলেছেন মাকড়সাদের বাগান। ছোট একটি জায়গায় বসিয়েছেন নানারকমের বুনো গাছ। প্রজাতি বিশেষে মাকড়সারা ঘর বেঁধেছে সেগুলিতে। বাগানে রেখেছেন ছোট একটা জলাশয়ও। যাতে জলের মাকড়সারাও বাসা বাঁধে সেখানে।

রাজকুমার স্যার দক্ষিণের লোক। রাত্রি অভিযানে আমদের সঙ্গী হয়ে বুঝলেন ফিল্ডেই আমাদের তাগিদ বেশি। যে দলটা দু’দিন ক্লাসরুমে প্রায় ঘুমিয়ে কাটিয়েছে আজ তারা একেবারে অন্য মানুষ। জল-জঙ্গল কিছুই মানে না। ক্লান্তির লেশমাত্র নেই। তাই রাত্রি অভিযান শেষেই তিনি ‘খুশ’ খবরটা দিলেন। কাল আমাদের শ্রেণিশিক্ষা বাতিল। বদলে আমাদের নিয়ে যাওয়া হবে জবলপুর পরিক্রমায়। সঙ্গে চলবে প্রশিক্ষণও।

সকাল সাতটায় রওনা দিলাম ধূঁয়াধার জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে। ভূগোলে পড়েছিলাম এই জলপ্রপাতের কথা। এবার চাক্ষুষ করার পালা। ঘণ্টা দুয়েকের যাত্রা। গাড়ি থেকে নেমে কিছুটা হাঁটা পথে পৌঁছতে হয় জলপ্রপাতের কাছে। জলপ্রপাত বেশ সুন্দর। নর্মদা প্রবল বেগে এসে সামনে সমতল না পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ছে নীচের দিকে। এতই তার বেগ যে জল ধাক্কা খেয়ে পরিণত হচ্ছে কণায়। আর সেই কণা জলীয়বাষ্পের ধোঁয়াশা সৃষ্টি করে উঠে আসছে উপরের দিকে। ধোঁয়ার আধার- তবেই না এমন নামকরণ।

ধূঁয়াধার জলপ্রপাত।

তবে জায়গাটি পছন্দ হল না মোটেই। এখানকার এটি পর্যটনস্থল। তাই যথারীতি জমজমাট ও অপরিচ্ছন্ন। ভারতীয় পর্যটনের এই এক খারাপ দিক। পর্যটনস্থল মানেই অপরিচ্ছন্ন। আসমুদ্র হিমাচল এটাই সত্য। ইতিউতি জঞ্জালের স্তুপ। প্রপাতের ঠিক সামনের অংশেই চলছে জামাকাপড় কাচা। চলছে সাবান মেখে স্নানও।

সুন্দরের আগে ঘিঞ্জি। জলপ্রপাতের পথে।

পরের গন্তব্য ভেরাঘাট। ভেরাঘাট বিখ্যাত মার্বেল রকের জন্য। মার্বেল রক বুক চিরে পথ করে দিয়েছে নর্মদাকে। পক্ষান্তরে নর্মদা তাকে দিয়েছে অসাধারণ ভাস্কর্য। ভেরাঘাটের বড় আকর্ষণ নৌকাবিহার। ডাল লেকে যাইনি। শুনেছি ওখানে গিয়ে নৌকাবিহার না করলে ভ্রমণ সম্পূর্ণ নয়। এখানেও তাই। নৌকা চড়লেই ধরা পড়ে মার্বেল রকের সৌন্দর্য।

মার্বেল রকের ভাস্কর্য।

দু’ধারে খাড়া মার্বেল পাথরের মধ্যে দিয়ে সে এক আশ্চর্য নৌকাবিহার। যত ভিতরে যাওয়া যায় পাথর রঙ বদলাতে থাকে। একই অঙ্গে ধরা পড়ে রূপভেদ। শ্যাওলা ধরা কালচে সবুজ পাথর রঙ বদলে কোথাও সোনালি, কখনও বা রূপালি। আকরিক ভেদেই যে এই রূপবদল তা অনুমান করি। মার্বেল শিলা নরম। ম্যাগনেসিয়ামের প্রাচুর্য। নর্মদার স্রোতে ক্ষয়ে পাথরে ফুটে উঠেছে ভিন্ন শৈলী। মার্বেল রকে প্রাকৃতিক নিয়মে ফুটে উঠা এইসব ভিন্ন ভাস্কর্য দেখিয়ে সুর করে মজার ছড়া কাটে মাঝিরা। হাসিয়ে মন ভালো করে দেয় সকলের।

মার্বেল রক দর্শন শেষে ঘরে ফেরার পালা। আজ রাতেই ট্রেন। জবলপুরের মোহে মোহিত হয়ে আমরা গেস্ট হাউসে ফিরলাম। মনের মধ্যে নর্মদা, ধুঁয়াধার ফলস, মার্বেল রক তখনও ছবি এঁকে চলেছে। তখনই ব্যাগ গোছাতে গোছাতে কেউ একজন জানিয়ে দিল – শক্তিপুঞ্জ এক্সপ্রেস এক ঘণ্টা দেরিতে চলছে।

নৌকা সফরের পথ। মার্বেল রক।

কল্পনার জগৎ থেকে বাস্তবের রূক্ষ জমিতে আছড়ে পড়লাম। আবার শক্তিপুঞ্জে চড়তে হবে। একরাশ ক্লান্তি ঘিরে ফেলল শরীর ও মনকে।

প্রচ্ছদের ছবি— মার্বেল রক।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *