অন্য সফর

কেকার কথা শোনে

দীপক দাস

কানে নয়। চোখে এসেছিল কথাটা।

সে অনেক বছর আগের কথা। এক খবরের কাগজে বাচ্চাদের পাতায় বেরিয়েছিল লেখাটা। আমাদের কাছেপিঠে কোথায় যেন ময়ূর পাওয়া যায়। চিড়িয়াখানার ঘেরাটোপের বাসিন্দা নয় তারা। একেবারে ‘সোনার কেল্লা’র রাজস্থানের মতো। রাস্তাঘাটে ঘুরে বেড়াচ্ছে। সেই লেখার শিরোনামটিও ছিল জবরদস্ত— ‘দেখ তো, চালে ময়ূর বসল কি না’। কী কাণ্ড! সেখানে তিনটি শালিখ রান্নাঘরের চালে ঝগড়া করে না। ময়ূর কলাপ বিস্তার করে নেচেকুঁদে বেড়ায়! এমন জায়গায় না গেলে চলে! জায়গাটা তো কাছেই। পাশের জেলা, হুগলি। আমরা যে বড়গাছিয়া স্টেশন থেকে রোজ ট্রেন ধরি তার কিলোমিটার দুয়েকের মধ্যে হুগলি জেলা। ঘরের কাছেই তো!

ভোট, কেন্দ্রীয় বাহিনীর টহল, জোট, প্রতিরোধ, পাল্টা মারের চক্করে অনেকদিন বেরনো হয়নি। ঘরবন্দি আড্ডায় আমাদের প্রাণগুলো শুকিয়ে কিসমিসের মতো হয়ে গিয়েছিল। প্রস্তাব দিলুম, তবে চল ময়ূর দেখে আসি। শুনে দু’একজন নিমরাজির মতো বলেছিল, ‘এই গরমে ময়ূর! বর্ষায় গেলে হয় না?’ বুঝলুম, সবই রবি ঠাকুরের বর্ষামঙ্গলের ফল। মেঘলা আকাশে ময়ূর পেখম মেলবে আর ওদেরও শত বরণের ভাবউচ্ছ্বাস ফেটে পড়বে! কিন্তু ধারণাটি কত ভুল সেটা ময়ূর দেখার পরেই জানতে পারলুম।

সব আপত্তি এবং বেজায় গরমকে উপেক্ষা করে বেড়িয়ে পড়া গেল এক মঙ্গলবার। আমাদের একটাই মুশকিল। আমরা জায়গার নাম শুনি আর দুগ্গা বলে ঝাঁপিয়ে পড়ি। দুগ্গার নাম করলুম বলে ইন্দ্র আবার ক্ষেপে যেতে পারে। ও আজকাল ভারী সেকুলার হয়েছে! ফেসবুকে হেব্বি উদারপন্থী, মানবিক পোস্ট ঝাড়ে। কিন্তু কাজের বেলায়…। যে যাক গে, আমরা বেড়িয়ে পড়ি আর সারা রাস্তার লোকজনের কানের পোকা নাড়িয়ে জায়গাটা কোথায়, কীভাবে যেতে হয়, কোন রাস্তায় গেলে সময় এবং খরচ বাঁচে ইত্যাদি তথ্য সংগ্রহ করি। বেলিয়াতোড়ে যামিনী রায়ের বাড়ি বা কাছাকাছি ছান্দারে আছে ছবিগ্রাম, এসব কানে শুনেই জেনেছিলুম। এবং দলবল নিয়ে পাড়ি দিয়েছিলুম। সে এক, এক নয় অনেক, অভিজ্ঞতা। সময়ান্তরে লেখা যাবেখন।

তবে ময়ূর দেখতে যাওয়ার সময়ে সমস্যা তেমন হয়নি। দু’দুটো ‘অনুসন্ধান কেন্দ্র’ ছিল আমার। একটি অরণিদা (অরণি বন্দ্যোপাধ্যায়)। ‘আনন্দবাজার’-এর প্রাক্তনী। অন্যজন নির্মলদা (নির্মল ঘোষ)। ‘সংবাদ প্রতিদিন’-এর বর্তমানী। অরণিদাকে ফোন করলাম। তিনি তখন খেতে বসেছেন। বেরবেন বলে তাড়াহুড়োয়। নির্মলদার কাউন্টারে দাঁড়ালুম। উনি একেবারে পাখি পড়ানোর মতো করে বুঝিয়ে দিলেন। কিন্তু কিছুদিন যাবৎ লক্ষ্য করছি, আমার স্মৃতিশক্তি ক্রমশ ‘গজিনি’ হয়ে উঠছে। কিছুক্ষণের মধ্যে বেমালুম ফাঁকা। শুধু কার কাছে কত টাকা পাই সেটাই মনে থাকছে। তাই নির্মলদাকে আগেভাগেই বলে রাখা হল, ‘অনেকবার ফোন করে জ্বালাব কিন্তু।’ রসিক মানুষটি অভয় দিলেন, ‘১০০ বার জ্বালিও।’

কথায় বলে শুভারম্ভ। গ্রুপে একজন শুভ থাকা সত্ত্বেও কখনও আমাদের যাত্রা শুরু শুভ হয়নি। এবারেও হল না। দীপু তার নিজস্বতা বজায় রাখল। বাড়ি থেকে বেরতে দেরি করল। তার ওপর বাইক দু’টো। কিন্তু অভিযাত্রী আটজন। আমার বাইক নেই। কিন্তু আমি নিজের ব্যবস্থাটা করে নিতে পেরেছিলুম। ভালকি মাচানে বাস থামাতে না পারলেও বড়গাছিয়া ফিডার রোডে কোম্পানি ট্যাঙ্কের মোড়ে দাঁড়িয়ে, বুড়ো আঙুল উঁচিয়ে বাঁ দিকে চালিয়ে একটা বাইক থামাতে পেরেছিলুম। চলে এসেছিলুম বড়গাছিয়ায়। কিন্তু ওরা আর আসতে পারে না। আধঘণ্টার উপরে দাঁড়িয়ে আছি বাসস্ট্যান্ডে। দু’চারজন পরিচিতের সঙ্গে দেখা হচ্ছে। তারা জানতে চাইছে, কোথায় চলেছি। ‘ময়ূর দেখতে যাচ্ছি’ বললেই অনিবার্য ভাবে দ্বিতীয় প্রশ্নটা ধেয়ে আসবে, ‘বিয়ে করেছিস?’ কেউ বিয়ে না করলে সমাজের ভীষণ দুশ্চিন্তা হয় বোধহয়।

বেশ কয়েকজনকে নানা প্রবোধে-গুলতাপ্পি মেরে শান্ত করে ক্লান্ত হয়ে পড়েছি। ঠিক সময়েই দেখি, তাঁরা এলেন। বলা ভাল, সাড়ে তিনজন নতুন অভিযাত্রী নিয়ে তাঁদের আবির্ভাব ঘটল। সাড়ে তিনজনের একজন দীপুর বোন নন্দিতা। আমরা সকলে যাকে আদর করে নন্দি বলে ডাকি। একজন গৌতম। দিল্লি প্রবাসী গ্রুপবন্ধু। আমাদের গাঁয়ের ছেলে। আরেকজন ঋতুপর্ণা। সে দীপুর বন্ধু। সাক্ষাতের আগেই সে-ও আমাদের বন্ধুই ছিল। ফেসবুকের দৌলতে। বাকি হাফজন হল শুভ। সে-ও দীপুর বন্ধু। শুভ আগে আমাদের সঙ্গে আমতায় গ্রুপের উদ্যান ভোজনে গিয়েছিল। তাই ওকে হাফ ধরলুম। মুশকিল হল, দলে এবার দু’টো শুভ। সৌগতের ডাকনামও শুভ। ঠিক হল, হাফ শুভকে ওর ডাকনাম ধরে ডাকা হবে। ওর ডাকনাম কচি। সত্যিই ও কচি। কথা কম বলে। শুধু বাচ্চাদের মতো হাসে। আর ভীষণ ভাল।

ব্যান্ডেল স্টেশন পর্যন্ত যাত্রা একেবারেই নিরামিষ। ট্রেনে এর-ওর পা টানা ছাড়া তেমন কিছু কহতব্য নয়। শুধু পাঁপড়ের ব্যাপারটা ছাড়া। ট্রেনে প্রায় সব হকারদের হাতেই দেখি, পাঁপড়। নানা আকারের এবং প্রকারের। এদিককার লোক এত পাঁপড় খান!

ব্যান্ডেল স্টেশন থেকে বেরনোর পর আমাদের গ্রুপের প্রকৃত রূপ খুলল। নির্মলদাকে ফোন করে অটোর কথা জেনে নিয়েছি। তারপর এক অটোতে চড়ে বসেছি আটজন। মানে ওরা সবাই ঠেসেঠুসে ঢুকে পড়ার পরে দেখি, আর জায়গা নেই। তবুও অটোচালক প্রবোধ দিয়ে চলেছেন, ‘উঠে আসুন না। হয়ে যাবে।’ হয়ে তো যাবে। কিন্তু কীভাবে? যদি দীপুকে অটোটা চালাতে দিয়ে চালক নেমে যান তাহলে হতে পারে। ইন্দ্র বলছিল, (এই একবারই ওর বুদ্ধির পরিচয় পেলুম) ‘আরেকটা অটো নাও না। চারজন করে যাই।’ কিন্তু তাতে একসঙ্গে যাওয়ার মজাটা দু’ভাগ হয়ে যাবে যে! শেষে দীপু বলল, ‘বড়দা, তুমি আমার কোলে বসো।’

একসময় ওকে আমি পড়িয়েছিলুম। এখন ও বড় হয়েছে। ও নিজেই এখন পড়ায়। বয়স্ক গুরুর দায়িত্ব নিক না। নির্দ্বিধায় ওর কোলে চড়ে বসলুম। না, ঠিক কোলে নয়। এতটা বয়স হয়নি যে কর্ণের গুরু পরশুরামের মতো পুরোপুরি শিষ্যের উপর নিজের দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ব। মানে অটোযাত্রা করব! তাছাড়া দীপু কর্ণের মতো ক্ষত্রিয় নয়। ওর পদবিও আমার মতো, দাস। কর্ণের সহ্যশক্তি ওর থাকবে না বোধহয়। তাই বসলুম, তবে নিজের দু’টো পায়েও যতটা সম্ভব ভর দিয়ে রাখলুম। তাতে হল কী, ওই চেয়ারাসনের ফলে অটো থেকে নামার পরে আমার পা কাঁপতে শুরু করল।

গান্ধীগ্রাম মোড়ে নামার আগেই অটো থেকে এলাকার রূপ দেখে মুগ্ধ। রবিঠাকুর নিশ্চিত এখানকার রূপ দেখেই লিখেছিলেন, ‘ছায়ার ঘোমটা মুখে টানি আছে আমাদের পাড়াখানি।’ খারাপ লাগছিল, ওই গাছে ঘেরা জায়গাগুলোর মাঝে মাঝে ‘এই চিহ্নে ভোট দিন’, ‘অমুকবাবুকে জেতান’ পোস্টারগুলো দেখে। কেন জানি না, মনে হয়, এই স্বার্থচক্রগুলো শান্তির নীড় ভেঙে নষ্টনীড় তৈরির কারিগর।

অটোচালক আগেই বলেছিলেন, ‘গান্ধীগ্রামে নামবেন, না কলেজের সামনে?’ বুঝতে ভুল হওয়ায় আমাদের এখন গান্ধীগ্রামের মোড় থেকে হাঁটতে হবে। মোড়ের এক মিষ্টির দোকানে জিজ্ঞাসা করলুম, ‘দাদা, ময়ূর দেখতে এসেছি। কোনদিকে যাব?’ একজন বললেন, ‘সোজা এগিয়ে যান, দেখবেন, বাঁশবাগানে ৫০টা ময়ূর নেচে বেড়াচ্ছে।’ মনে হল, লোকটা ব্যঙ্গ করছে। উত্তর দিলুম, ‘আপনাদের গাঁয়ে এলুম। আর আপনি দাদা আমাদের সঙ্গে মশকরা করছেন!’ ভদ্রলোক একটু সংকুচিত হয়ে পড়লেন। তারপর বললেন, ‘গিয়ে দেখুন না। ফেরার সময়ে আমাকে বলে যাবেন, সত্যি বলেছি কি না।’

এক ডিটারজেন্টের বিজ্ঞাপনের ক্যাচলাইন হল, ‘দাগ আচ্ছে হ্যায়’। হাঁটতে হাঁটতে আমাদের মনে হচ্ছিল, ভুল আচ্ছে হ্যায়। ভুল না বুঝলে তো প্রকৃতির এই রূপ দেখতে পেতাম না। রাস্তার দু’পাশে কত গাছ। কোথাও বাঁশগাছ ঝুঁকে আছে। কোথাও আমবাগানের ছায়া ছায়া পরিবেশ। শুকিয়ে যাওয়া নদীখাতে ফসল ফলিয়েছেন চাষিরা। হাঁটতে হাঁটতে সেই কলেজের কাছে চলে এলুম। আসলে একটা বিএড কলেজ। বেশ সুন্দর। এই প্রায় জঙ্গলে কলেজ দেখে একটু অবাকই হলুম। তবে অন্য একটা যুক্তিও মাথায় এল। এটা শিক্ষক শিক্ষণ কলেজ। প্রকৃতির মধ্যে রেখে হবু শিক্ষকদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা। কিছুটা শান্তিনিকেতন, কিছুটা বুনো রামনাথের আদর্শ। ভালই তো।

কিন্তু ময়ূরের দেখা নেই। এবার টেনশন শুরু হল। এতজনকে টেনে নিয়ে এলুম। ময়ূরেরা ষড়যন্ত্র করে ঘাপটি মেরে লুকিয়ে থাকলেই তো হয়েছে। আমার মানসম্মান বাঁশবাগানে গড়াগড়ি খাবে! কায়দা করে একটু গাওনা গেয়ে রাখলুম, ‘যদি প্রকৃতির মধ্যে ময়ূর দেখাতে না পারি তাহলে উপেন কল্যার বাড়ির (নির্মলদা নামটা বলেছিলেন) ময়ূরটাকেই দেখিয়ে নিয়ে যাব।’ গাইডের সাবধানবাণীতে দলের লোকের মুখগুলো একটু গম্ভীর হল বলেই মনে হয়েছিল।

হাঁটতে হাঁটতে অনেকটাই চলে এসেছি। কেকার দেখা নেই। কেকার কথা শোনা তো দূর কী বাত। রাস্তার পাশে এক ঠাকুমা বাসন মাজছিলেন। তাকেই জিজ্ঞাসা করলুম, ‘ঠাকুমা, এখানে ময়ূর দেখতে পাওয়া যায়?’ ঠাকুমা হেসে বললেন, ‘হ্যাঁ। নদীর পাড়ে পাড়ে ঘোরে। আমাদের চালে বসে নাচে।’ শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। যাক বাবা! আছে তাহলে তারা। দয়া করে এবার দেখাটি দিলেই আমি সাফল্যের হাসিটা হাসতে পারি।

দলকে বললুম, ‘এক কাজ করা যাক, উপেনদার বাড়িতেই যাওয়া যাক। ওঁর বাড়ির ময়ূরটা দেখি। পরে ময়ূরেরা বেরোলে প্রকৃতির মধ্যে তাদের দেখে নেব।’ ঠাকুমার কাছে বাড়ির খোঁজ নিয়ে হাঁটতে শুরু করলুম। হাঁটছি, হঠাৎ নন্দি বলল, ‘চুপ চুপ, ময়ূর ডাকছে!’ আমরা চুপ করলুম। একটা পাখির ডাক কানে এল। আমি নন্দিকে ভেংচে বললুম, ‘দূর, ময়ূর কোথায়? হাঁড়িচাচা তো।’ ওর দাদার মতো নন্দিকেও আমি একসময় পড়িয়েছিলুম। ভুল ধরিয়ে দেওয়ার পরেও মাস্টারমশাইয়েরা স্বীকার না করলে পড়ুয়াদের যে দশা হয় নন্দিরও তাই হল। মুখটা গোমড়া করে রইল।

এর বাড়ির আনাচ, ওর বাড়ির পাদাড়, তার পুকুরপাড় দিয়ে হেঁটে পৌঁছনো গেল উপেনবাবুর বাড়ির দাওয়ায়। ডাকা হল। বেরতে হেসে বললুম, ‘ময়ূর দেখতে এসেছি। নির্মলদা আপনার নাম বলেছেন।’ উপেনদা বললেন, ‘এইমাত্র বাড়ির পিছনে নেচে বেড়াচ্ছিল। এখন দূরে চলে গিয়েছে।’

এইমাত্র নাচছিল! তাহলে তো খুব ক্লান্ত নিশ্চয়? পরের শোয়ের জন্য মঞ্চে উঠতে কতক্ষণ লাগাবে কে জানে! তাছাড়া শিল্পীরা ভারী গেরামভারি হয়। আমরা চেয়ে চেয়ে রইলুম সারাদিন। আর শিল্পীরা হয়তো বললেন, আমাকে আর নাচতে বলো না। পায়ে ব্যথা।

তখন!?

ময়ূরের মুড ভাল হওয়ার অপেক্ষায় উপেনদার উঠোনে।

ময়ূরদের মুড ঠিক হওয়া পর্যন্ত আমরা অপেক্ষা করব। সবাই মিলে সেটাই ঠিক হল। উপেনদার খোলামেলা উঠোনে, চত্বর বলাই ভাল, অপেক্ষা করতে করতে প্রথম প্রতিশ্রুতি পালন করলুম আমি। উপেনদার বাড়ির ময়ূর দেখালুম। একটা চালাঘর। বাখারির বেড়া দেওয়া। তার ফাঁক দিয়ে দু’টো ময়ূর উঁকি দিচ্ছে। উপেনদা ময়ূর বন্দি করে রেখেছেন নাকি! তাহলে তো ব্যাপারটা ভাল নয়। কিন্তু ভুল ভাঙল পরক্ষণেই। দেখলুম, ওই চালাঘরের দেওয়ালে লেখা, ‘ময়ূরদের চিকিৎসাকেন্দ্র’। উপেনদা পরে জানিয়েছিলেন, ওটা আসলে তাঁদের বাড়ির রান্নাঘর। এখন চিকিৎসাকেন্দ্র। অসুস্থ ময়ূরদের যদি খোলা পরিবেশে ছেড়ে রাখা হয় তাহলে তারা মারা যাবে। সুস্থ হয়ে গেলেই ময়ূর দু’টোকে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হবে। শুনে হাঁফ ছেড়ে বাঁচলুম। হিন্দিতে একটা প্রবাদ আছে না, ‘যো দিখতা হ্যায় বো হোতা নেহি’। তবে এক্ষেত্রে বোধহয় সেই ঠান্ডা পানীয়ের বিজ্ঞাপনি ক্যাচলাইন প্রযোজ্য, ‘দিখাও পে মত যাও, আপনি আকল লাগাও…’। যা আকলমন্দি দেখিয়েছিলুম মনে মনে!

এখন সেলফির চল হয়েছে। তাই সেলফি উইথ ময়ূর হবে না, তা কখনও হয়! দলের সেলফি বিশারদ ঋতু এগিয়ে গেল সে কাজে। সেলফিতে ময়ূরদেরও খুব আগ্রহ, দেখা গেল। একজন তো বেড়ার ফাঁক দিয়ে গলাটা ঋতুর গালের পাশ দিয়ে বাড়িয়ে মোবাইলের দিকে এগিয়ে দিচ্ছিল। ফটোবম্বার্ড ময়ূর! ঋতুর কাছে ওর গাল আর মোবাইল, দু’টোই প্রাণাধিক প্রিয়। একবার ঠুকরে দিলে দু’টোই দাগি। ও একটা নাতিউচ্চ চিৎকারে বেড়ার কাছ থেকে সরে এল। সেলফি উঠল কি?

ঘেরাটোপের ময়ূর।

অন্যের মোবাইল ঘাঁটা সমীচীন নয়।

ঘেরাটোপের ময়ূর দেখতে কতক্ষণ ভাল লাগে? একসময় সরে এলুম চিকিৎসাকেন্দ্র থেকে। ওদিকে উপেনদা ময়ূরদের তোয়াজ করে নাচানোর চেষ্টা করেই যাচ্ছেন। প্রথমে খেতে দিয়ে এলেন। তারপর ‘আয় আয়’ করে, মুখ দিয়ে চুঁ, চুঁ করে ডাকলেন। কিন্তু কেউই পাত্তা দিল না।

আমরা কলতলার কাছে গোল হয়ে বসে আছি। দেবসেনাপতির বাহনের কখন দয়া হয়। হঠাৎ নিচু গলায় ওঁদের বাড়ির ছাদ থেকে ডাকলেন উপেনদা। হাত আর মুখের ইশারায় শব্দ করতে নিষেধ করলেন। আমরা সাবধানী পা ফেলে পৌঁছলুম ছাদে। উপেনদা জানলা দিয়ে দূরের কলাবাগানের দিকে আঙুল দেখিয়ে বললেন, ‘ওই দেখুন।’ আমরা আঁখি পাতলুম। তারপরই সেই রোমাঞ্চকর দৃশ্য। কলাঝাড়ের কাছের ঝোপ থেকে উঁকি মারছে একটা গলা। যে গলাকে সাহিত্যিকেরা ময়ূরকণ্ঠী বলে থাকেন।

উপেনদা নিচু গলায় কথা বলতে বলেছিলেন। বাইরের লোক আছে টের পেলে ওরা নাকি নাচবে না। ময়ূরেরা লাজুক নাকি? জিজ্ঞাসা করতে যাচ্ছিলুম। কিন্তু তার আগেই ময়ূর নিয়ে দু’চার কথা যা আমি জানি, সেগুলো মনে পড়ে গেল। ময়ূর লাজুক নয়, প্রেমিক। তাদের এই সব নাচানাচি তো প্রেমিকার মন জয় করার জন্যই। টলিউড বা বলিউডের নায়করা ছাড়া তো কেউ ভরা হাটে নাচতে নাচতে প্রেমিকার পিছন নেয় না! আমরা একেবারে ষড়যন্ত্র করার ভঙ্গিতে নিচু গলায় কথা বলছিলুম। যাতে প্রেমিকপ্রবর বুঝতে না পারে এতগুলো দর্শক ওর ময়ূরীমোহন নাচ দেখার জন্য ওৎ পেতে আছে।

ছোটবেলায় একটা হিন্দি সিনেমার নাম শুনেছিলুম, দেখিনি। শুধু ক্যাসেটের কভারে ছবি দেখেছিলুম। ‘নাচে ময়ূরী’। নর্তকী-অভিনেত্রী সুধা চন্দ্রনের জীবন নিয়ে সিনেমা। ষষ্ঠ বা সপ্তম শ্রেণিতে ওঁর জীবনী নিয়ে ইংরেজিতে একটা পাঠ ছিল, ‘এ প্রোফাইল ইন কারেজ’। কিন্তু ঘটনা হল, সিনেমার নামটায় একটু গন্ডগোল আছে। ময়ূরীরা কখনও নাচে না। ওরা নাচের বিচারক। কার নাচ ভাল সেটা দেখেই নিজেদের নিবেদন করে। প্রকৃতির এ এক অনন্য মজা। পুং জাতি নেচেকুঁদে মরে। আর স্ত্রীং জাতি মনে মনে অট্টহাসি হাসতে হাসতে কিন্তু মুখে উদাসীনতার পরত মেখে সেই নাচের বিচার করে। এখানেও দীর্ঘসময় ধরে তাই ঘটল।

আমরা জানলা দিয়ে ওৎ পেতে বসে আছি। আর কার্তিকবাহন ঝোপ থেকে গলা উঁচিয়ে আছেন। না বেরোচ্ছেন, না পেখম মেলছেন। দূরে আমবাগানের দিক থেকে আরও একটা ময়ূরের ডাক ভেসে আসছে। বোঝা গেল, ঝোপেরটি এবং দূরেরটি পরস্পরের প্রতিদ্বন্দ্বী। কিন্তু তারা লড়ছে কার জন্য? তাকে তো দেখা যাচ্ছে না।! গৌতম এমনিতে কথা কম বলে। কিন্তু ময়ূর নিয়ে দেখলুম অটো-ভ্যলুমে ওর গলা চড়ে যাচ্ছে। ও বলল, ঝোপের ময়ূরটির কিছু দূরের কলাবাগানে একটা ময়ূরী লুকিয়ে আছে। মাঝে মাঝে গলা বের করছে। ওরই জন্য নাকি এত হাঁকাহাঁকি, নাচানাচি।

তাই নাকি! চোখ দু’টো যতটা বিস্ফারিত করা যায় ততটা করে আমরা আঁতিপাতি খুঁজতে শুরু করলুম। চশমা ছিল বলে চোখ বিস্ফারিত করতে অসুবিধা হচ্ছিল। উত্তেজনায় চশমাটাই খুলে ফেললুম। ও মা! সব যে ঝাপসা। আমার যে দূরদৃষ্টিটাই গিয়েছে, সে খেয়ালই নেই। বড়রা অবশ্য বলে থাকেন, ‘কোনও কালে ছিলই না তো যাবেটা কী করে! আশ্চর্য তো!’ চটপট চশমা এঁটে নিলুম আবার। ফট করে কোনও দৃশ্য চোখ এড়িয়ে যেতে পারে।

তারপর দীর্ঘ অপেক্ষা। নিজেদের ডিসকভারি চ্যানেলের বনেবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো লোকজনের মতো মনে হচ্ছিল। পার্থক্য এইটুকুই যে, আমরা দোতলা ঘরের নিরাপদ মাচানে বসে আছি। এর মধ্যে উপেনদা চা দিয়ে গিয়েছেন। সঙ্গে বিস্কুট, চানাচুর। মুহূর্তে শেষ সে সব। অনেকেই বুভুক্ষু ছিলুম। পরে জানতে পারি, সেদিন গৌতমের সারাদিন খাওয়াই জোটেনি। সে না-ই জুটুক। ধৈর্যের পরীক্ষা দিয়ে যদি নাচের একঝলক দেখতে পাওয়া যায় সাত পেট খিদে মাফ।

সে যেন অন্তহীন অপেক্ষা। আমার তো স্কুলজীবনের কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল। সেই যে গার্লস স্কুলের রাস্তায়…। শুভ অবশ্য অন্য কথা ব‌লল। বলল, আমার মতো হেরো লোকের সামনে বেরোতে ময়ূরটার মানে লাগছে। মনে মনে বললুম, ‘ভাই রে, হারিনি। আসলে পারিনি। লড়াই-ভীতু আমি। হেরে গেলে যদি ব্যথা লাগে।’ মুখে অবশ্য অ্যাটিটিউট মাখিয়ে, বগল ফাঁক করে বললুম, ‘দুর গাধা! হেরেছি নাকি? ছেড়েছি। আর শুনে রাখ, সে ছাড়া ওই ইনিয়েবিনিয়ে তেরি গলিও মেঁ না রাখেঙ্গে কদম আজ কে বাদ, নয়। একেবারে ছোড় আয়ে হাম বো গলিয়াঁ।’

অ্যাটিটিউট কি একটু বেশি হয়ে গেল? ইন্দ্রর হাসিটা একটু বাঁকা মনে হল! সেই সময়েই ময়ূরটা দু’পা হেঁটে ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল। তারপর আবার ঝোপে ঢুকে গেল। কিছুক্ষণের বিরতিতে দুই প্রতিদ্বন্দ্বীর বিস্তর হাঁকডাক চলল তারপর। আমাদের ময়ূরটার, মানে ঝোপেরটার, গলা যেন ভেঙে এসেছে মনে হল। কী ব্যাপার? শুভর প্রাঞ্জল ব্যাখ্যা, ‘আগে জয়ের ৭০ শতাংশ চান্স ছিল। এখন সেটা তিরিশে নেমেছে। তাই কষ্টে গলা ভেঙে যাচ্ছে।’ শুনে আমার বুকে ঘুঘুডাকা বিষণ্ণ দুপুর। পরাজয়ের কষ্ট যে কী…আমি কিন্তু খুব একটা স্পোর্টিং নই, বলে রাখলুম।

কলাপ বিস্তার যাকে বলে।

আমার মনের অবস্থা টের পেয়েই বোধহয় কেকার দয়া হল। কিছুটা এগিয়ে এসে ঝোপের মধ্যে থেকে পেখম তুলল। তারপর কাঁপাতে কাঁপাতে মেলে ধরল নিজেকে। সংস্কৃতে যাকে বলে কলাপ বিস্তার। আহা কী বাহার! জন্মান্তরের কথা জানি নে। এ জন্মে তো ভুলব না। আমার ভুলব কী ভুলব না সিদ্ধান্তের মাঝে ময়ূরটা আবার ঢুকে গেল ঝোপে। তারপর আবার সেই গলা উঁচিয়ে অপেক্ষা।

কিন্তু ময়ূরীটা কোথায়? ক্যামেরার লেন্সে সর্বোচ্চ জুম করে গৌতমের নির্দেশিত কলাবাগানের দিকে তাক করা হল। কেউ কোত্থাও নেই। আমি বললুম, ‘আছে রে আছে। ঠিক লড়াইটা লক্ষ্য রাখছে। মানুষ হলে পরে বলত, তুমি ওই জায়গায় স্টেপ ভুল করেছিলে। তমুক মুদ্রায় ঘাড়টা ৬০-এর বদলে ৬৫ ডিগ্রি বেঁকে ছিল। তবুও কিন্তু তুমিই পেয়েছ বরমাল্য।’ তখন যদি ময়ূরটা চালাকি করে মুচকি হেসে ব্যাপারটা শেষ করে দেয়, ঠিক আছে। কিন্তু নিজের জয়ের কারণ জানতে যদি প্রশ্ন করে বসে, ‘কেন দিলে? আমবাগানেরটা আমার থেকেও ওঁচা ছিল বুঝি?’ ব্যাস। বেজে যাবে বিরহের বাঁশি, প্যাঁ প্যাঁ প্যাঁ…।

এর ফাঁকে দীপু, নন্দি কচি অন্য ঘরে পালিয়েছে। কিছুক্ষণ পরে সেই ঘরে গিয়ে দেখি, দীপু ব্র্যাডলি কুপার হয়ে রয়েছে। ‘আমেরিকান স্নাইপার’ সিনেমার কুপার। উপেনদাদের বিছানায় উবু হয়ে শুয়েছে। ক্যামেরাটা রেখেছে জানলায়। সেটাকে স্নাইপারদের টেলিস্কোপিক রাইফেলের মতো বাগিয়ে ঝোপের দিকে একদৃষ্টে তাকিয়ে আছে। যাতে ময়ূরের একটা নড়াচড়াও ফসকে না যায়। ঋতু অবশ্য বলল, ‘আমেরিকান স্নাইপার না হাতি। পাতিহালান (আমাদের গ্রাম পাতিহালের ম্যারিকা ছোঁয়ানো নাম) স্নাইপার। পরে যেটা গিয়ে দাঁড়াবে পাতি স্নাইপারে।’ জন্মভূমির প্রতি এমন খোঁচাতেও দীপু ধ্যানমগ্ন। নন্দির মুখ দেখে মনে হল, এই অভিযানে ও বেশ উত্তেজিত। শুধু দাদা-দিদি আর প্রাক্তন মাস্টারের রসিকতার সময়ে ওর মুখটা লজ্জায় একটু বেগুনি হয়ে যাচ্ছে।

স্নাইপার ফটোগ্রাফার দীপু।

তারপর আবার শবরীর প্রতীক্ষা। নাকি অহল্যার? কে জানে! কিন্তু ময়ূরচন্দ্রজি ঝোপের মধ্যে গলা উঁচিয়ে নটনড়ন চড়ন। এরকম পোজে তিনি কতক্ষণ রইলেন খেয়াল করতে পারিনি। আমাদের রসিকতার ভাঁড়ারেও টান পড়ছে। একবার কচির পা টানব বলে ঠিক করলুম। কিন্তু তাতে তেমন জুত হল না। কচির পা টানলে ও হড়হড় করে হড়কে সঙ্গে সঙ্গে যাবে। কিন্তু লেগ পুলিংয়ের কোনও উত্তর দেবে না। ওর একটাই উত্তর, শিশুসুলভ মিষ্টি হাসি।

এরকম বোর হচ্ছি। এমন সময় দেখি, তিনি নড়লেন। দু’পা এগোলেন। থামলেন। সন্দেহজনকভাবে গলা উঁচিয়ে চারিদিকটা দেখলেন। তারপর হাঁটা লাগালেন। সে কী হাঁটন! হাঁটতে হাঁটতে খোলা জায়গায় এসে থামলেন। পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে তাঁকে। তাঁর ময়ূরকণ্ঠী, তাঁর মনোলোভা কলাপ, লম্বা লম্বা পা দু’টো। আমাদের দু’চোখ সার্থক। পরস্পরের দিকে তাকালুম। তারপর ক্রিকেটে উইকেট পাওয়া বোলারের মতো হাত মুঠো করে ‘ইয়েস ইয়েস’ করে উঠলুম।

কিন্তু এমন খোলা জায়গায় এসে সে দাঁড়াল কেন? নাচবে? খুল্লামখুল্লা পাঙ্গা? ‘আ দেখে জারা কিসমে কিতনা হ্যায় দম?’ ‘আজা নাচলে’? যে জিতবে তারই বাজি মাত! কিন্তু আমাদের সব জল্পনায় জল ঢেলে তিনি আবার লম্বা লম্বা পা ফেলে ঝোপে সেঁদিয়ে গেলেন। ওই ঝোপে কী আছে রে বাবা!

আবার শুরু হল ‘ওয়েটিং ফর গোডো’। ইন্দ্র এতক্ষণ ক্যামেরা গুটিয়ে চুপচাপ মজা দেখছিল। ওর ক্যামেরার চোখ অতদূর পর্যন্ত দেখতে পাচ্ছে না। গোডোর জন্য প্রতীক্ষা শুরু হতে ও বলল, ‘চলো, উপেনদার সঙ্গে কথা বলি।’ আমরা দু’জনে নীচে নেমে এলুম। ঋতুও নেমে এল।

উপেনদা জানালেন রাজহাটে ময়ূরবসতের ইতিহাস। রাজহাট উত্তরপাড়ায় ডাক্তার নীলমণি চক্রবর্তীর বাড়িতে দু’চারটে ময়ূর ছিল। খোলামেলা জায়গাতেই থাকত তারা। বংশবিস্তারে তাদের সংখ্যা বাড়তে থাকে। একসময় এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে। তখনই তাদের রক্ষার প্রয়োজন বোধ করেন স্থানীয় মানুষ। উদ্যোগী হন নিমাই জানা নামে একজন। একটি কমিটি গড়া হয়। উপেনদার দাদাও তাতে সামিল হন। আস্তে আস্তে জড়িয়ে পড়েন উপেনদাও। কিন্তু একটা সময়ে খাবারের অভাবে ময়ূরেরা উত্তরপাড়া ছেড়ে রাজহাট-গান্ধীগ্রাম এলাকায় ভিড় জমায়। উপেনদা জানালেন, ২৫০টা ময়ূর আছে এখন এই এলাকায়।

ময়ূরদের খাবার দিচ্ছেন উপেনদা।

ময়ূরদের জন্য উপেনদা উৎসর্গীকৃত প্রাণ। লোকের সমালোচনা, ব্যঙ্গ, পুলিশে ধরিয়ে দেওয়ার ভয়, অপবাদ— অনেক কিছু সইতে হয় তাঁকে। তবুও কোনও ময়ূর যদি অসুস্থ হয় লোকের সবচেয়ে আগে মনে পড়ে উপেনদাকেই। প্রশাসনেরও। একবার এক অসুস্থ ময়ূরকে নিজের বিছানায় ঠাঁই দিয়েছিলেন। রাতে হঠাৎ উপেনদার ধুম জ্বর। ডাক্তার দেখে জানিয়েছিলেন অসুস্থ ময়ূরের ক্ষতের সংক্রমণ আক্রমণ করেছে উপেনদাকেও। প্রশ্ন করি, খাবারের সন্ধানে তো গান্ধীগ্রামের দিকে এল ময়ূরেরা। এখন কি খাবারের সমস্যা মিটেছে? উপেনদা বিষণ্ণ হয়ে মাথা নাড়েন। তারপর বলেন, ‘মেটেনি। যদি ওদের দিনে ১০০ গ্রাম খাবার দরকার থাকে তাহলে ওরা পায় ৫ গ্রাম থেকে ১০ গ্রাম।’ একটা চ্যানেলের রিপোর্টার উপেনদা। কত টাকাই বা বেতন। তাঁর পক্ষে ২৫০টা ময়ূরের খিদে মেটানোটা বেশ চাপের। এলাকার লোক, বাইরের লোক মাঝেমধ্যে সাহায্য করেন। সেটাই একটু হলেও ভরসা।

এই এলাকায় তো চাষবাস হয় প্রচুর। এত খিদে নিয়ে ময়ূরেরা ফসলের উপরে হামলা চালায় না? নিজের পেশার জ্ঞান ফলিয়ে বলি, ‘এই তো কয়েকটা রাজ্যে ময়ূর, নীলগাইকে ভারমিন (ফসলের ক্ষতিকারক) ঘোষণা করায় বিস্তর বিতর্ক।’ উপেনদা বলেন, ‘বেশ ক্ষতি করে ফসলের। এলাকার চাষিরা সেই ক্ষতিটা মেনে নিয়েছেন। তবে যদি কোনও ময়ূর ফসলে মুখ দিতে যাচ্ছে ঠিক সেই সময়ে চাষিরা তাড়া দেন, এই পালা এখান থেকে বলে ধমকায়, তাহলে ময়ূরেরা কথা শোনে। বুঝতে পারে, ওই জিনিসটা তাদের কাছে নিষিদ্ধ।’ মাধ্যমিকে পড়া প্যাভলভ প্রতিক্রিয়ার কথা মনে পড়ে।

খিদে ছাড়া আর কী…প্রশ্ন শেষ হয় না, হন্তদন্ত হয়ে ঢোকে শুভ। বলে, ‘আবার তো মিস করে গেলে!’ কী মিস করলাম! শুভ বলল, ‘একেবারেই প্রভুদেবা। নেচেই চলেছে।’ হুড়মুড় করে ওপরে উঠলুম। তখন নাচের শেষ অংশ। দু’চারটে স্টেপ দেখতে পেলুম। জীবনে ফস্কে যাওয়ার সংখ্যা দেখছি ক্রমশ বাড়ছে! ভালকি মাচানে মৎস্য দফতরের গেস্ট হাউসের ভেড়িতে মাছেদের খেতে দেওয়া দেখতে পারিনি। ইন্দ্র আবার জুতো নিয়ে পালিয়েছিল বলে। এখানেও সেই ইন্দ্র। ওর তর সয় না। উপেনদার সঙ্গে কথা পরে বললেও তো চলত!

মন খারাপ করে নীচে এসে উপেনদাকে প্রশ্নের বাকি অংশটা করলুম, ‘খিদে ছাড়া আর কী সমস্যা ময়ূরদের?’ উপেনদা বলল, ‘ট্যুরিস্টদের সমস্যা। ওরা এসে ময়ূরদের সঙ্গে সেলফি তুলতে ময়ূরদের পিছনে ধাওয়া করে। শীতকালে পিকনিক পার্টির লোকেদের অত্যাচার। একবার তো দু’জন বাইকে করে একটা ময়ূর ধরে নিয়ে পালিয়েছিল। তাকে নিয়ে নাচানাচি করায় সেই ময়ূরটার দু’টো পা-ই ভেঙে গিয়েছিল। পুলিশের সাহায্যে তাকে উদ্ধার করা হয়। কেউ কেউ ময়ূরের ডিম চুরি করে। শিয়ালেও ডিম খেয়ে নেয়।’ উপেনদার কথা শেষ হয়নি। কে একজন বলল, একটা মেয়ে আর দু’টো ছেলে মোবাইল বাগিয়ে ময়ূরের পিছনে ছুটছে। ছবি তুলবে। ‘এই হচ্ছে সমস্যা’ বলতে বলতে উঠে গেলেন উপেনদা।

এবার উঠতে হবে। তৈর হচ্ছি, নন্দি ফিসফিস করে বলল, জানলার পাশে কলাবাগানে ময়ূর। ধীরে ধীরে জানলার কাছে গেলুম। দেখলুম, সেই লম্বা লম্বা পায়ে হাঁটা। তারপর বাঁশ চিরে তৈরি খাবারের জায়গা থেকে খাবার খুঁটে খুঁটে খাওয়া। এটা কি সেই নাচিয়ে ময়ূরটা? নেচে নেচে খিদে পেয়েছে? কিন্তু ও হারল না জিতল? হেরে যদি খেতে আসে তো ঠিক আছে। হেরে খাওয়া ছেড়ে পানের দিকে ঝুঁকলেই তো চিত্তির। তখন আবার সেই অমোঘ সংলাপ, ‘বাবুজি নে কহা গাঁও ছোড় দো, সব নে কাহা পারো কো ছোড় দো, পারো নে কাহা শরাব ছোড় দো…’।

ফিরে আসার সময়ে উপেনদার হাতে কিছু টাকা দিলুম আমরা। কিছুতেই নেবেন না। খালি বলেন, ‘আপনারা যখন আসবেন পাঁচ কেজি গম নিয়ে আসবেন।’ আমরা বললুম, বর্ষায় যখন নাচ দেখতে আসব তখন অবশ্যই নিয়ে আসব। উপেনদা হেসে বললেন, ‘বর্ষার থেকে ময়ূর শীতকালে বেশি নাচে। বর্ষায় ময়ূরদের পালক ঝরে যায়।’ সে কী কথা! তাহলে বর্ষার ময়ূর নিয়ে এত কাব্যি, এত কলাপ বিস্তারের কাহিনি কি মিথ নাকি? কী কাণ্ড!

ফেরা শুরু। অনেকটা পথ যেতে হবে। গল্প করতে করতে বেশ কিছুটা এগিয়ে দিয়ে গেলেন উপেনদা। বিদায় নেওয়ার সময়ে বলে গেলেন, ‘যেতে যেতে নদীর চর বা আশেপাশে নজর রাখবেন। ওদের দেখতে পাবেন।’ নদীর নাম, কুন্তী। দ্রৌপদীকে নিয়ে মহাপ্রস্থানের পথে যাত্রার পরে পাণ্ডবদের দিন গিয়াছে। তাঁদের মায়েরও এখন মুমূর্ষু দশা। বর্ষা ছাড়া তাঁর অস্তিত্ব বোঝা অসম্ভব। কেন্দ্রের পুরাণপ্রেমিক সরকার যদি পাণ্ডবমাতার পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করেন তাহলেই এককালের রাজমাতার হৃতসম্মান পুনরুদ্ধার হয়।…

আমরা বিএড কলেজ পেরিয়ে চলে এসেছি। হঠাৎ শুনলুম সেই ডাক, কঁওও…কঁওও। কেকার কথা শুনলুম! কাছেই। পা টিপে টিপে এগোলুম। দেখতে পেলুম তাঁকে। তালগাছের উপরে রাতের আশ্রয়ের সন্ধান করছেন। জুত না পেয়ে উড়ে গিয়ে বসলেন কাছের নারকেল গাছে। তারপর পাতার আড়ালে শরীরটা লুকিয়ে ফেললেন। শুধু বেরিয়ে রইল বিশাল পেখমটা। সন্ধ্যে প্রায় নেমেছে। আবছা আলোয় নারকেল গাছে ময়ূর দেখছি আমরা। রাজস্থানে নয়, হুগলি জেলায়।

কাছেপিঠেই লুকিয়ে থাকে কত রোমাঞ্চ!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *