পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

হেঁটে হেঁটে ফোকটে দারা থেকে সিঙ্গালিলা

কস্তুরী চক্রবর্তী

আমার বেড়াতে যাওয়ার গল্পটা একটু আলাদা। পাহাড়ের গা বেয়ে সবুজ বনানী ছুঁয়ে আকাশের নীল মেখে পাহাড় ডিঙোনোর গল্প। যাকে বলে পদব্রজে পাহাড় ভ্রমণ। এই পথে আমি নব্য পথিক। তাই প্রথম থেকেই উত্তেজনা ছিল তুঙ্গে। অনেক জল্পনা-কল্পনা এবং সার্থক পরিকল্পনার শেষে আমরা ১২ জনের দল রুকস্যাক গুছিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। (Phoktey dara) হয়ে সিঙ্গালিলার উদ্দেশ্যে। আমাদের রুটম্যাপে ছিল উত্তরে (Uttaray), কালিঝাড় (Kalijhar), ফালুট (Phalut), গোর্খে (Gorkhey)ও শ্রীখোলা (Srikhola)।

শিয়ালদহ স্টেশন থেকে রাতের ট্রেন ছিল। পরের দিন আগাম পনেরো মিনিট আগেই নিউ জলপাইগুড়ি পৌঁছে গেলাম। দলের প্রত্যেকে পূর্ব পরিচিত ছিলেন না। তাই স্টেশনে নেমে সৌজন্য সাক্ষাৎ সেরে, দু’টি গাড়িতে ভাগ হয়ে উঠে বসলাম বেলা ১১টা নাগাদ। আমাদের গন্তব্য পশ্চিম সিকিমের উত্তরে। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে প্রায় ১৬০ কিমি। সময় লাগার কথা ছ’ঘণ্টা মতো। কিন্তু বেশিরভাগ রাস্তায় মেরামতির কাজ চলছে। উত্তরে পৌঁছতে সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। একে জাঁকিয়ে শীত তার ওপর পথশ্রমে সকলেই ক্লান্ত। অগত্যা দ্রুত রাতের খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

শুরু হোক হণ্টন।

ঘুম ভেঙে দেখি ঘড়ির কাঁটা ৮টা ছুঁইছুঁই। সামনের বারান্দায় দিয়ে চোখ মেলতেই মন ভরানো দৃশ্য। কাল রাতের অন্ধকারে বিশেষ ঠাওর হয়নি। চারিদিকে পাহাড় ঘেরা আমাদের হোটেলটি। আকাশের নীল রং বেশ গাঢ় এখানে। এর পর ঘণ্টা খানেকের মধ্যে তৈরি হয়ে প্রাতরাশ সেরে প্রথম দিনের হাঁটা শুরু করলাম। উত্তরে থেকে কম বেশি ৬ কিমি হেঁটে আ্যচালে অবধি যাওয়ার পরিকল্পনা। প্রথমদিকের অল্প কিছুটা পথ বেশ খাড়া হলেও বাকি পথ ধীরে ধীরে উচ্চতা নিল। আমরা যে যার সাহায্য সহায়ক লাঠিতে ভর দিয়ে এগোতে থাকলাম। সারাদিনে শীতের প্রকোপ বিশেষ অনুভূত হয় না। তবে দুপুর ৩টের পর থেকেই একেবারে কনকনে ঠান্ডা। গন্তব্যে পৌঁছলাম শেষ বিকেলে।

বেসক্যাম্পে। সৌন্দর্য অন্তহীন।

জানতে পারলাম আ্যচালে নামটি স্থানীয়দেরই দেওয়া। লোকপ্রিয় আ্যচল ফলের নাম থেকেই লোকমুখে আ্যচালে নামটির প্রচলন। পাহাড়ের মাথায় বেশ কিছুটা সমতল জায়গা দেখে আমাদের তাঁবু খাটানো হল। সামনের সবুজ চিরে দূর থেকে তখন উঁকি দিচ্ছে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা। খুব কাছে নয়। তা-ও মোহিনী রূপ নিরাশ করে না মোটেই। অন্ধকার গাঢ় হতেই ঠান্ডা তীব্র হতে থাকল। কয়েক পরত গরম জামা চাপিয়েও বিশেষ সুবিধে বোধ হচ্ছিল না। তাই আগুন জ্বালানোর উদ্যোগ করা হল। কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে আমরা যা কাঠ জোগাড় করেছিলাম তা দিয়ে পর্যাপ্ত ধোঁয়া হলেও সে রাতের মতো আগুন জ্বললো না। সেসবের মাঝেও মাথার ওপর নক্ষত্রখচিত আকাশের দিকে তাকিয়ে মন পরিপূর্ণ হয়ে গেল। যেন কেউ সুদক্ষ হাতে একটা একটা করে হিরে গেঁথে দিয়েছে আকাশময়। রাতের কালো আকাশ ঢেকে ওইরূপ তারার মেলা আগে কখনো চাক্ষুষ করিনি।

চিরকালীন সৌন্দর্য।

রাতের খাওয়া সেরে যে যার দলের তাঁবুতে ঢুকে পড়লাম। তাপমাত্রা হিমাঙ্কের ৩ ডিগ্রি নীচে ছিল। তবে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে ঢুকে পড়তে পেরে বেশ আরাম বোধ হচ্ছিল। ঘুম ভাঙল ভোরের দিকে। সবুজ ঘাসের উপর গুঁড়ি গুঁড়ি সাদা বরফ ছেয়ে রয়েছে। বেলা বাড়তেই আবার শীত কমে এল।

আ্যচালের পাট চুকিয়ে আমাদের দ্বিতীয় গন্তব্য কালিঝাড় বেসক্যাম্প। দূরত্ব ৭ কিমি এবং উচ্চতা ৩৫০০ মিটার। প্রথমদিনের তুলনায় এই পথ বেশ সংকীর্ণ এবং কষ্টসাধ্য। উচ্চতা ধীরে ধীরে বাড়েনি। বরং একেবারে অনেকটা পথ খাড়া হয়ে এবড়োখেবড়ো পাথরের খাঁজ বেয়ে উপরে উঠে গিয়েছে। কাঞ্চনজঙ্ঘা কিছুদূর পরপরই উঁকিঝুঁকি দিতে থাকল। পথে দেখতে পেলাম নাম না জানা সরু সুতোর মতো পাহাড়ি নদীর গতিপথ। দুপুরে তীরপাই পৌঁছে বেশ কিছুক্ষণের বিশ্রাম। তীরপাই থেকে তিনটি পথ তিন দিকে গিয়েছে। একটি আ্যচালে, অন্যটি জিয়াবানজান ও শেষেরটি কালিঝাড়। বিশ্রাম শেষে আরও ৪০ মিনিট হাঁটার পর ক্যাম্পের দেখা মিলল। এখান থেকে কাঞ্চনজঙ্ঘার স্লিপিং বুদ্ধা অবতার যেন ঢিল ছোড়া দূরত্বে। পড়ন্ত রোদ মেখে কাবরু, রাথোং, কুম্ভকর্ণ ইস্ট এবং পান্ডিম সার বেঁধে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

অসাধারণ ভূমিরূপ।

বিকেলের ধোঁয়া ওঠা গরম চায়ে ঠোঁট ডুবিয়ে প্রকৃতির ঝুল বারান্দা থেকে বাঙালির চিরকাঙ্খিত কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখার স্বর্গীয় সুখ উপভোগ করতে লাগলাম। মন বলে উঠল সময় থেমে যাক, এ অনন্ত সুখের শেষ না হয় যেন। এ রাতে কাঠে আগুন জ্বললো আর আসর জমল গানের লড়াইয়ে। রাত বাড়তে আবারও আকাশ ভরে উঠল তারায় তারায়। এমন আকাশের নীচে দাঁড়িয়েই বোধহয় গাওয়া যায়, ‘কথা ছিল হেঁটে যাব, ছায়াপথ’।

পর্বত-অর্কদেবের যুগলবন্দি।

পরদিন ভোর ৪টের আ্যলার্মে ঘুম ভাঙল। চারিদিকে ঘুটঘুটে অন্ধকার। এর মধ্যেই এক হাতে টর্চ ও অন্য হাতে ওয়াকিং স্টিক নিয়ে ফোকটে দারার (৩৭৩৩মি) উদ্দেশ্যে আমরা সানরাইজ ট্রেক শুরু করলাম। মিনিট দশেক চড়াই উঠতে না উঠতেই শ্বাস কষ্ট হতে শুরু করল। মনোবল জুটিয়ে ধীর পায়ে খাড়া পাহাড় বেয়ে কাঁটাঝোপের মধ্যে দিয়ে এক পা দু’পা করে এগোতে শুরু করলাম। দূরে ঘুমন্ত দার্জিলিং শহরের ঝিকিমিকি আলো দেখা যাচ্ছে। মাথার ওপরে আকাশ রং বদলাতে শুরু করেছে। কে যেন কমলাভ লাল আবিরে রাঙিয়ে দিয়েছে তাকে।

অবসন্ন শরীরে যখন উপরে পৌঁছলাম সূর্যদেবের তখনও আলস্য ভাঙেনি। মিনিট খানেক পরে আকাশে লাল কমলার পোঁচ ফিকে হয়ে আস্তে লাগল। সূর্যোদয়ের প্রথম আলো এসে পড়ল রূপোয় মোড়া কাঞ্চনজঙ্ঘা রেঞ্জে। রূপোর আভরণ সরিয়ে নিজেকে একটু একটু করে সোনার চাদরে ঢেকে নিল প্রেয়সী কাঞ্চনজঙ্ঘা। প্রকৃতির নিয়মে এ সূর্যোদয় নিত্য নৈমিত্তিক। তবুও প্রতিটা নতুন সকালের প্রথম আলোর কৌমার্য খণ্ডন করবে এ সাধ্য বিশ্ব ব্রহ্মাণ্ডে কারও নেই। দৃষ্টি বাঁদিকে সরাতেই দেখা পেলাম মাউন্ট লোৎসে, মাউন্ট নুপসে, মাউন্ট মাকালু এবং মাউন্ট এভারেস্টের। এমন মনোমুগ্ধকর পরিবেশ থেকে নামতে ইচ্ছে করছিল না। কিন্তু সময়েরও বাধ্যবাধকতা থাকে। তাই মুহূর্তদের ছবি বন্দি করে এক অনন্য অসাধারণ অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করে উতরাই বেয়ে তাঁবুতে ফিরলাম। প্রাতরাশ সেরে এবার বিদায় সম্ভাষণের পালা। কালিঝাড়কে বিদায় জানাতে মন ভার হয়ে এসেছিল। এমন সুন্দর ক্যাম্পসাইটের কথা জন্ম জন্মান্তরেও ভুলব না।

পথেই দেখেছিলাম।

বেলা ১০টার রোদ ঝলমলে সকাল। আকাশের রং নিখাদ নীল। তার এককোণে তখনও হাসছে বাঁকা চাঁদ। বিপরীতে এবড়োখেবড়ো পাথুরে ঢাল। অনামী গুল্মের প্রাচুর্য আর বিবর্ণ হলুদ ধূসর বাদামির মিশেল। অগণিত চড়াই উতরাই পেরিয়ে সিঙ্গালিলা টপ অবধি এই বৈসাদৃশ্য বিদ্যমান। দুপুর সাড়ে ১২টা ৩০ আমাদের পুরো দল সিঙ্গালিলা টপ (৩৭০০মি) সামিট করল। কাঞ্চনজঙ্ঘা সঙ্গ ছাড়েনি তখনও।

অনেকখানি সময় কাটিয়ে মনের মণিকোঠায় বোঝাই করা স্মৃতি নিয়ে রওনা দিলাম ফালুটের পথে। এইদিনের হাঁটাপথ ১৫ কিলোমিটার। পথ দীর্ঘ হলেও কঠিন নয়। বিকেল ৫টায় পৌঁছে গেলাম ফালুট। সূর্যাস্তের রঙিন আকাশ অভ্যর্থনা জানাচ্ছে যেন। তাঁবু নয়, ফালুট হাটে (Phalut Hut) রাত্রিবাস। ফালুটের এলোপাথাড়ি হাওয়ার তোড়ের মাঝে খোলা আকাশের নীচে আশ্রয় মোটেই সুখকর হত না। দীর্ঘ পথশ্রমের ক্লান্তি দূর করতে তাড়াতাড়ি খাওয়া সেরে ঘুমিয়ে পড়া হল।

আলো-ছায়ার খেলা।

পরদিন বেশ সকাল সকাল সূর্যোদয়কে সাক্ষী রেখে গোর্খের পথে পাড়ি। দূরত্ব ১৪ কিমি। সিঙ্গালিলা জাতীয় উদ্যানের ভিতর দিয়ে সবুজ ঘেরা পথ। কাঞ্চনজঙ্ঘার সঙ্গে দূরত্ব বাড়তে বাড়তে একসময় সে মিলিয়ে গেল। রাস্তার অনেক সংকীর্ণ জায়গা পাহাড়ি ঝোরার জলে ভিজে কাদা হয়েছিল। বিশেষ সতর্কতা নিয়ে পেরোনো গেল সে সব স্থান। পাহাড়ের সর্বত্রই কমবেশি বৌদ্ধধর্মের প্রার্থনার পতাকার উপস্থিতি। কখনও রংবেরঙের কখনও সাদা। শেষ দুপুরে লোকালয়ের কাছাকাছি পৌঁছলাম। দূরে দেখা যায় ছবির মতো ছোট ছোট পাশাপাশি দু’টি গ্রাম, একটি সমানদেন (Samanden) অন্যটি গোর্খে। দু’টি গ্রামই দার্জিলিং জেলার অন্তর্ভুক্ত।

তাকিয়ে থাকা যায় অন্তত সময়।

স্থানীয় জীবনযাত্রার স্বাদ নিতে সেদিন হোম স্টেয় রাত্রিযাপন করলাম। পরের দিন সকালে স্নান খাওয়া সেরে রওনা দিলাম শ্রীখোলার উদ্দেশ্যে। পথের সাথী ছিল বিস্তীর্ণ পাইন বন আর রৌদ্রজ্বল সুনীল আকাশ। ছ’কিমি হেঁটে পৌঁছলাম আর একটি ছোট্ট পাহাড়ি গ্রাম, রামমাম (Rammam)। সেখানে দুপুরের খাওয়া সেরে আবার হাঁটা শুরু। রামমাম থেকে শ্রীখোলা ১২ কিমি। যা অতিক্রম করতে সন্ধ্যে পার হয়ে গেল। রাস্তায় ছোট বড় অনেক ঝরনার দেখা পেলাম। সন্ধ্যের ট্রেকের অভিজ্ঞতা ভয় মেশানো, তবে মন্দ নয়। গল্পে আড্ডায় সকলের মন ভার। হিসেব মতো আমাদের ট্রেক শেষ। শ্রীখোলার হোম স্টেয় রাতটুকু কাটিয়ে সকালে কিছুটা হেঁটে পৌঁছলাম শ্রীখোলা ব্রিজ। ওপারে আমাদের গাড়ি অপেক্ষারত।

সোনার উপত্যকা।

এক পা এক পা করে ব্রিজটা পেরোতে গিয়ে মনে হল প্রকৃতির সঙ্গে মেলবন্ধনের সেতু ছিন্ন করে আবার রোজনামচার ভিড়ে প্রবেশ করতে চলেছি। ফিরতি পথে ধোত্রে’য় কাঞ্চনজঙ্ঘা শেষ বারের মতো বিদায় সম্ভাষণ জানাতে এল। পেরলাম লেপচা জগতের সুবিস্তীর্ণ পাইন বনাঞ্চল। নিউ জলপাইগুড়ি থেকে সন্ধ্যেয় আমাদের ট্রেন। রাতের খাওয়া শেষ করে যে যার বার্থে উঠে বসলাম। অন্ধকার ভেদ করে ঝমঝম শব্দে ছুটে চলল ট্রেন।

ঠিক তখনই কোনও এক ঘুমের দেশে স্মৃতি ও স্বপ্নের দল মিলে মিশে এক হয়ে গেল।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “হেঁটে হেঁটে ফোকটে দারা থেকে সিঙ্গালিলা

  1. লেখাটা খুব সাবলীল। কোথাও হোঁচট খেতে হয় না। আর প্রকৃতির বর্ণনাও বেশ সুন্দর। পড়তে পড়তে ছবিটা ফুটে ওঠে মনের মধ্যে। আর ছবিগুলোও বেশ ভাল। সব মিলিয়ে ভাল লাগল।

Leave a Reply to দীপক দাস Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *