ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

দীন নবাবি দেশে পথিকের বেশে

সুব্রত বিশ্বাস

ভেঙে পড়া ইট ধ্বসে পড়া ছাদ/এ কোন নবাবী দেশ।/তবুও সদর্পে বলে ওঠে সে,/দেখো মোর দীন বেশ।/ছাদ ভাঙা ওই মুক্ত আকাশ/যেন বিশাল শামিয়ানা।/পথের ধারে ছড়িয়ে আছে/হাজারো নবাবিয়ানা।

কেন যাবেন

অজানাকে জানা ও অচেনাকে চেনার কৌতূহল মানুষের বহুদিনের। আর এই অজানা অচেনা স্থানটি যদি পরিত্যক্ত ইতিহাসের দীর্ণ প্রতিমূর্তি হয়, তবে যে তা কৌতূহল নিবারণের ক্ষেত্রে আলাদা মাত্রা আনে সেটি আর বলার অপেক্ষা রাখে না। পরিত্যক্ত, দীর্ণ ইতিহাসকে চিনে নেওয়ার জন্য আজ আমাদের গন্তব্য মুর্শিদাবাদের ঐতিহাসিক বালাখানায়। এটির অবস্থান তৎকালীন কেল্লা নিজামতের দক্ষিণে। বলা ভাল, নবাবি আমলের গৌরবময় ইতিহাসের এক বিবর্ণ তথা বিষণ্ণ প্রতিমূর্তি এই বালাখানাটি।

বিষণ্ণ বালাখানা।

আমাদের যাত্রা

এবারে আমার ভ্রমণসঙ্গী ভ্রাতৃপ্রতিম ফারুক আব্দুল্লাহ। নবাবি ইতিহাসে ফারুকের গভীর জ্ঞান আমাকে বালাখানা দর্শনে উৎসাহিত করে তোলে। পাশাপাশি ভগ্নপ্রায় নবাবি স্থাপত্যের কিছু ছবি তোলার আগ্রহও আমি উপেক্ষা করতে পারিনি। বর্তমানের হাজারদুয়ারি প্যালেস বা অতীতের নিজামত প্যালেসের বালাখানাটির ইতিহাস অত্যন্ত গৌরবময়। জানা যায় উনিশ শতকের দ্বিতীয় দশকে বালাখানার স্থাপনা হয়েছিল নবাব হুমায়ুন জাঁর হাত ধরে। সুতরাং বালাখানা হল হাজারদুয়ারি প্রাসাদের প্রায় সমসাময়িক। যদিও এটির আড়ম্বর তৎকালীন অন্য প্রাসাদের তুলনায় কিছুটা কমই ছিল। তবুও দৈর্ঘ্যে এটি বর্তমান হাজারদুয়ারি প্রাসাদের থেকেও বড় ছিল। অথচ সময়ের কী নির্মম পরিহাস। আজ যেখানে হাজারদুয়ারি প্রাসাদ ভারতীয় পুরাতত্ত্ব সর্বেক্ষণ বিভাগের তত্ত্বাবধানে স্বমহিমায়, সেখানে বালাখানা যেন অতীত গৌরবের ভগ্ন স্মৃতিমাত্র। পূর্ব পরিকল্পনা মতো গত বছর জুলাই মাসের এক রবিবার আমি ও ফারুক বালাখানা দর্শনের জন্য সকাল ১০টা নাগাদ দেখা করলাম চুনাখালি নিমতলায়। সেখান থেকে বাসে করে লালবাগ বাসস্ট্যান্ড। তার পর টুকটুক ধরে দক্ষিণ দরওয়াজাকে পাশে রেখে সোজা বালাখানায়।

আমি আর ফারুক।

বেগম মহল

ভেঙে পড়া ইট ও খসে পরা পলেস্তরার মধ্যে দিয়ে আমি ও ফারুক এগিয়ে চললাম আমাদের লক্ষ্যে। এরই মধ্যে ফারুক আমাকে বলল, ‘চলো দাদা, প্রথমে আমরা বেগম মহল হয়ে যাব বালাখানায়’। আমরা এগিয়ে চললাম বালাখানার পূর্ব দিকে থাকা বেগম মহলের দিকে। বর্ষাকাল। জঙ্গলাকীর্ণ বেগম মহলের প্রায় ১০০ মিটার দূরেই দাঁড়িয়ে পড়তে হল আমাদের। সুতরাং, ভগ্ন বেগম মহলের অন্তরে প্রবেশের ইচ্ছের সেখানেই জঙ্গল সমাধি ঘটল।  এই বেগম মহলের নবাবি ইতিহাস যথেষ্ট ঈর্ষনীয়। ১৮৯৭ সালের ভূমিকম্পে নবাবি বাংলার অগণিত দালান তথা প্রাসাদ যখন ক্ষতবিক্ষত, তখন নবাব ওয়াশেফ আলী মির্জা এই বেগম মহলের স্থাপনা করেন। একসময় বাংলা তথা ভারতের নামকরা গাইয়েদের আনাগোনা ছিল এখানে। যাদন বাই, গহরজান থেকে শুরু করে বেগম আখতার, কে আসেননি এই বেগম মহলে?

জঙ্গলে ঢাকা বেগম মহল।

বালাখানা

দূর থেকে সামান্য কিছু ছবি তুলে বেগম মহলকে পেছনে ফেলে এগিয়ে চললাম এক সময়ে নবাবদের থাকার স্থান হিসেবে পরিচিত বালাখানায়। দ্বিমুখী গোল সিঁড়ি বেয়ে ওপরে উঠতেই প্রথমে নজরে এল এক বিশাল হলঘর। বাকি ঘরগুলো এই ঘরকে কেন্দ্র করে দুই দিকে বিস্তৃত হয়েছে। চল্লিশটি ঘরবিশিষ্ট এই দ্বিতল বালাখানার অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য হল উত্তল বাগদাদি ছাদ। অথচ হলঘর ও তার সংলগ্ন আরেকটি ছোট ঘর ছাড়া অন্য ঘরের ছাদ ভগ্নস্তূপে পরিণত হয়েছে। ঘরগুলি, সামনে থাকা বিস্তীর্ণ বারান্দা ও সারিবদ্ধ থামগুলি যেন এক মুহূর্তেই মনে করিয়ে দেয় নবাব হুমায়ুন জাঁ, ফেরাদুন জাঁ, হাসান আলি মির্জা তথা নবাব ওয়াশেফ আলী মির্জার পদচারণাকে। বর্তমান দুর্দশাগ্রস্ত বালাখানার অন্যতম প্রধান কারণ হিসেবে ধরা হয় ১৮৯৭ সালের অসমের ভয়াবহ ভূমিকম্পকে। পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণের অভাব বালাখানাকে করে তোলে আরও শোচনীয়। একসময়ের নবাবী বৈভব যেন পরিণত হয়েছে আগাছা পূর্ণ এক ভগ্ন দালানে। ভগ্ন দেওয়াল থেকে জন্মানো বটগাছ ও সেখানে বসে থাকা শালিক পাখিটিও যেন আজ বালাখানার অন্তিম প্রহর গোনায় ব্যস্ত। এদিকে ঘড়ির কাটায় তখন প্রায় ১:৩০। আমিও ফারুক বালাখানা থেকে বেরিয়ে পড়লাম। পথ মধ্যে মিনিট দশেকের চা পান বিরতি ও সঙ্গে ফারুকের পছন্দের বাখরখানি বিস্কুট।

বালাখানার ভিতরে।

ব্যক্তিগত সংগ্রহশালা

সেখান থেকে মিনিট পাঁচেকের হাঁটাপথে আমরা পৌঁছে গেলাম এক বিশেষ ব্যক্তিত্বের সান্নিধ্যে। মূলত তাঁর কিছু দুষ্প্রাপ্য সংগ্রহ চাক্ষুষ করতে। পৌঁছে যা দেখলাম, তাতে বাকরুদ্ধ হয়ে যাওয়ার জোগাড়। ওঁর কাছে রয়েছে কিছু নবাবি আমলের সামগ্রী তো কিছু আরও পুরনো। নবাব মীর কাশিমের তরোয়াল থেকে শুরু করে, নবাবি আমলের শিকার করা বাঘের মাথার খুলি, মধ্যযুগের কুবের ও লক্ষী মূর্তি-সহ বিভিন্ন দুষ্প্রাপ্য বইয়ের পাণ্ডুলিপি। আশাতীত ভাবে দ্রব্যগুলি হাতে নেড়ে দেখার সৌভাগ্য হয়ে গেল আমাদের। যেন মনে হল মুহূর্তেই ইতিহাসকে হাতের মুঠোয় নিয়েছি আমরা। ওঁর সঙ্গে কথোপকথনের মাধ্যমে কেটে গেল প্রায় আরও একটি ঘণ্টা। সমৃদ্ধ হলাম। নবাবি ইতিহাসকে জেনে নিলাম একটু অন্যভাবে। এবারে বাড়ি ফেরার পালা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও আমাদের বেরিয়ে পড়তে হল। প্রাপ্তি নবাবি আমলের সুবর্ণ ইতিহাস ও অজানা নানা তথ্য। সমাপ্তি ঘটল এক ঘটনাবহুল বর্ণময় দিনের।

সংগ্রহশালার একটি রত্ন।

কী ভাবে যাবেন

বহরমপুর থেকে ট্রেনে করে এসে নামতে হবে মুর্শিদাবাদ স্টেশনে। বাসে এলে লালবাগ বাসস্ট্যান্ডে। সেখান থেকে টুকটুক করে সোজা বালাখানা। এ ছাড়াও জিয়াগঞ্জগামী ট্রেনে করে এলে নামতে হবে ত্রিপোলিয়া গেটের সামনে। সেখান থেকে হেঁটেই পৌঁছে যাওয়া যাবে বালাখানায়।

ছবি— লেখক

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “দীন নবাবি দেশে পথিকের বেশে

  1. লেখক তোমার তুলনা হয় না। অপূর্ব। অপূর্ব। দারুন লেখা। আরো এগিয়ে যাও।

  2. আসাধারন লাগলো পড়ে।
    আরও ভালো কিছু আশা করছি।

Leave a Reply to Pradip mandal Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *