ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

১২৬ পা মেপে দাদাঠাকুরের বাড়ি

দীপক দাস

‘এই লোকটার বাড়ি যেতে চাই।’ আমার কথা শুনে টোটোচালক বেশ অবাক। হওয়ারই কথা। আশেপাশে তো কোনও লোকই নেই। লোকটাকে দেখানোর জন্য আমার আঙুল যেদিকে প্রসারিত সেদিকেও কেউ নেই। একটু দূরে একটি ছেলে একটা মূর্তির সামনে দাঁড়িয়ে ছবি তুলছে। এ ছাড়া যা লোকজন সব গতিশীল। টোটো, অটো, বাইক, সাইকেল, বাসে, হেঁটে চলেছেন। তাহলে কোন লোকটা? টোটোচালক বেশ ঠান্ডা মাথার লোক। মুখে কিছুই বলেননি। আশপাশে চোখ চালিয়ে লোকটাকে খুঁজে না পেয়ে আবার আমার মুখের দিকে তাকিয়েছেন। আমি সেই ছবি তোলা মূর্তির দিকে আঙুল দেখিয়ে বললাম, ‘ওই লোকটার বাড়ি।’ এমন অসাধারণ মজাতেও কোনও ভাবান্তর হল না টোটোচালকের। শুধু বললেন, ‘বাড়ি পর্যন্ত তো যাবে না। প্রেসের সামনে নেমে যেতে হবে।’

১৪ অগস্ট সকাল। থেমেছি জঙ্গিপুরে। মানে মুর্শিদাবাদের রঘুনাথগঞ্জের মোড়ে। থেমেছি বললাম, কারণ সেই ভোর থেকে চরকিপাক খাচ্ছি আমি আর ইন্দ্র। দাদাঠাকুরের বাড়ি যাব। কিন্তু জঙ্গিপুর পৌঁছনোর আগে অর্ধেক মুর্শিদাবাদ সফর হয়ে গিয়েছে। মোটামুটি ভাবে মুর্শিদাবাদে যতরকম যানবাহন চলে তার সব ক’টিতেই সওয়ারি করা হয়ে গিয়েছে। হাওড়া থেকে গণদেবতায় চেপেছিলাম। নেমেছিলাম আজিমগঞ্জ। সেখান থেকে এক টোটোয় গঙ্গার ঘাটে। স্টেশন থেকে ঘাট এক কিলোমিটারও হবে না বোধহয়। টোটোওয়ালা ৫০ টাকা ভাড়া আদায় করে দু’জনের গালে কষিয়ে থাপ্পড় মেরেছে। আর্থিক ক্ষতিতে ইন্দ্রর খুব উল্লাস। ও বহু বছর আগে শুশুনিয়ায় ১০০ মিটারেরও কম দূরত্বের যাত্রায় ৫০ টাকা খরচ করিয়েছিল। আজিমগঞ্জের ক্ষতিটা আমার বোকামি বলে চালানোর চেষ্টা করছে এখন।

রঘুনাথগঞ্জ মোড়ে দাদাঠাকুরের মূর্তি।

পাত্তা দিইনি অবশ্য। শুধু একটাই কষ্ট। ভুটভুটিতে দু’জনে নদী পার হলুম মাত্র চার টাকায়। কিন্তু এর থেকেও কম দূরত্বে টোটোয় ৫০ টাকা! নদীর ওপারে নিমতলা ঘাট। সেখান থেকে টোটোয় জিয়াগঞ্জ দিয়ে ফুলতলি বাসস্ট্যান্ড। গিয়ে শুনি, জঙ্গিপুরের সরাসরি বাস নেই। নামতে হবে লালগোলা। বাস থেকে লালগোলা নেমে ট্রেকার ধরে রঘুনাথগঞ্জ। কিন্তু দাদাঠাকুরের বাড়ির হদিস মিলল না। অটো ধরে চলে এলাম জঙ্গিপুর স্টেশনের কাছে। স্টেশনে ঢোকার রাস্তার মুখে চায়ের দোকানের বেঞ্চে বসে থাকা এক ভদ্রলোক বললেন, ‘আরে রঘুনাথগঞ্জ মোড়ে যিনি দাঁড়িয়ে রয়েছেন তিনি কে? উনিই তো দাদাঠাকুর। বাঁদিকের রাস্তা দিয়ে গেলেই ওঁর বাড়ি।’ তার মানে আবার ফিরতে হবে ট্রেকার থেকে যেখানে নেমেছিলাম সেখানে। কী জ্বালা!

এদিকে ভোর থেকে দৌড়ঝাঁপে ইন্দ্র কাহিল হয়ে পড়েছে। ওর তো কয়লার ইঞ্জিন। কিছু সময় পর পর জঠরাগ্নিতে বেলচা মেরে কয়লা ছুড়ে দিতে হয়। না হলে ইঞ্জিন চলার মতো বাষ্প তৈরি হয় না। ওই গাইডদাদাকেই জিজ্ঞাসা করা হল, একটু পদের হোটেল মিলবে কোথায়? উনি সামনের একটা হোটেল দেখিয়ে দিলেন। সেখানে খেয়ে ইন্দ্রর মুখে আলো ফুটল। আবার টোটো চাপলাম। তার পর সেই মোড়ে মূর্তির কাছে।…

জঙ্গিপুরে দাদাঠাকুর স্থাপিত পণ্ডিত প্রেস।

ততক্ষণে ইন্দ্রর ছবি তোলা হয়ে গিয়েছে। খদ্দের পেয়ে সেই শান্ত মাথার টোটচালক চলে গিয়েছেন। আমরা অন্য একটি টোটোয় চেপে নামলাম পণ্ডিত প্রেসের সামনে। রাস্তার ওপরেই প্রেস। সেই সঙ্গে মনোহারী দোকান। ছবি তুলে ঢুকে পড়লাম দোকানে। এই দোকান এবং প্রেসটি বর্তমানে চালান সমীর এবং প্রকৃতিপ্রসূন পণ্ডিত। দাদাঠাকুরের দুই নাতি। আমাদের জিজ্ঞাসায় দুই ভাই খুলে বসলেন কিংবদন্তী সাংবাদিক এবং সুরসিক শরৎচন্দ্র পণ্ডিতের নানা কীর্তির অমূল্য ঝাঁপি।

দাদাঠাকুর অর্থাৎ শরৎচন্দ্রের প্রকৃত পদবি কিন্তু পণ্ডিত নয়। তাঁরা আদিতে ছিলেন কাঞ্জিলাল। দাদাঠাকুরের নামের সঙ্গে মুর্শিদাবাদ জুড়ে গেলেও তাঁর জন্ম কিন্তু বীরভূমে। ধরমপুর এলাকার সিমলান্ডি গ্রামে। ধরমপুর থেকে একসময়ে মুর্শিদাবাদের দফরপুরে চলে আসেন। দফরপুরে এখনও তাঁদের পৈতৃক ভিটে রয়েছে। সেখানে তখন প্রেস খুলে ব্যবসা শুরু করেছেন। কিন্তু গোল বাঁধল জমিদারের সঙ্গে। চিরকালের মেরুদণ্ড সোজা করে চলা দাদাঠাকুর দফরপুর ছেড়ে চলে এলেন রঘুনাথগঞ্জে। অর্থাৎ জঙ্গিপুরে। দফরপুর থেকে প্রেসও নিয়ে এলেন জঙ্গিপুরে। ১৯০৩ সালে তৈরি হয়েছিল পণ্ডিত প্রেস। ১৯১৪ সালে প্রকাশিত হল ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’। নির্ভীক সাংবাদিকতার অনন্য নজির তখন কলকাতা থেকে বহু দূরের এক জেলা থেকে প্রকাশিত পত্রিকাটি।

দাদাঠাকুরের নাতি সমীরবাবু।

কেমন সেই সাহসিকতা? কলকাতা প্রেস ক্লাব থেকে ‘বাংলা সংবাদপত্রের ২০০ বছর’ নামে একটি সংকলন বেরিয়েছিল। তাতে দাদুর সম্পর্কে লিখেছিলেন সমীরবাবু। সেই সময়ে জঙ্গিপুরের এসডিও ছিলেন চারুচন্দ্র গুপ্ত। তিনি ট্রেনের থার্ড ক্লাসের টিকিট কেটে ফার্স্টক্লাসে চড়তেন। অজুহাত দিতেন ফার্স্টক্লাসের টিকিট শেষ হয়ে যাওয়ায় তিনি বাধ্য হয়ে এই কাজ করেছেন। দাদাঠাকুর এসডিও-র মিথ্যাচার সামনে আনেন। প্রমাণ-সহ। তিনি এসডিও টিকিট কাটার পরে ফার্স্টক্লাসের টিকিট কাটেন। এবং একই সঙ্গে ট্রেনে কলকাতায় যান। তার পর খবরটি প্রকাশিত হয় ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’এ। এসডিও-কে বাংলাদেশের রংপুরে বদলি করা হয়েছিল। পরে জঙ্গিপুরেই একবার দেখা হয়েছিল সেই এসডিও-র সঙ্গে। তিনি দাদাঠাকুরকে জিজ্ঞাসা করেন, তাঁকে কেন শিকার করা হয়েছে? দাদাঠাকুরের জবাব, ‘বাঘ সবাইকে কামড়ায় না, কিন্তু বাঘকে পেলে কেউ ছাড়ে না, সবাই মারে’।

ইন্দ্র তখন ছবি তুলেই চলেছে। আমার আর জিজ্ঞাসার শেষ হয় না। একটা জিজ্ঞাসা বহুদিনের। সেই সময়ে কাগজ ছাপার খরচ তো ভালই ছিল। দাদাঠাকুর সামলাতেন কী করে? সমীরবাবু আর প্রকৃতিবাবু বললেন, জঙ্গিপুর আদালতের নিলামের বিজ্ঞপ্তি ছাপা হত দাদাঠাকুরের কাগজে। এ ছাড়াও কলকাতা থেকে কিছু বিজ্ঞাপন জোগাড় করতে পেরেছিলেন। দীপ্তি লন্ঠন, জবাকুসুম তেলের বিজ্ঞাপন পেয়েছিলেন তিনি। খরচ তো উঠল বিজ্ঞাপনে। কিন্তু বিক্রি? সেই সময়ে পড়াশোনার তো তেমন চল সাধারণের মধ্যে ছড়ায়নি। তাহলে সার্কুলেশন নামক ভয়ের বিষয়টি? দুই ভায়ের জবাব, এলাকার সম্পন্ন লোকেরা ‘জঙ্গিপুর সংবাদ’ কিনতেন।

আরেক নাতি প্রকৃতি প্রসূন।

দাদাঠাকুর দীর্ঘদিন কলকাতায় থেকেছেন। আকাশবাণীতে অনুষ্ঠান করতেন। রেডিও-র পুরনো অফিস তখন গার্স্টিন প্লেস। সেখানে রসিক মানুষটিকে নিয়ে যে কত রসিকতা তৈরি হয়েছে! একটা তো রামকুমার চট্টোপাধ্যায়কে নিয়ে। নবীন রামকুমার একদিন রেডিও অফিসে ঢুকছেন। দাদাঠাকুরের মুখোমুখি। তিনি বললেন, ‘তোমাকে তো চিনলাম না।’ রামকুমারের জবাব, ‘আমি গাই।’ শুনে দাদাঠাকুরের জবাব, ‘তা দিনে ক’সের করে দাও?’ এমন রসিক মানুষটি কিন্তু কখনও অন্যায়ের সঙ্গে আপস করেননি। অসম্ভব জেদ নিয়ে লড়ে গিয়েছেন সামাজিক অবিচার এবং ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে জনমত গড়ার কাজে। কলকাতার রাস্তায় পায়ে ঘুঙুর বেঁধে বিক্রি করতেন বিদূষক। সেসব গল্প আজকের পরিস্থিতিতে কিংবদন্তীর মতো লাগে।

‘বিদূষক’ পত্রিকার মাস্ট হেডের ব্লক।

কখনও দান গ্রহণ করতেন না। লালগোলার মহারাজা যোগীন্দ্রনারায়ণ রাও প্রেস যাতে ভাল করে চলে সেজন্য সাহায্য করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু নেননি দাদাঠাকুর। এখন তো টলিউড, বলিউডে বায়োপিকের ছড়াছড়ি। কিন্তু শরৎ পণ্ডিতই বোধহয় ভারতের প্রথম ব্যক্তিত্ব জীবিত অবস্থায় যাঁকে নিয়ে সিনেমা তৈরি হয়েছিল। সেই সিনেমা নিয়েও একটি ঘটনা ঘটেছিল। বলছিলেন সমীরবাবুরা। ‘দাদাঠাকুর’ সিনেমার প্রিমিয়ার হয়েছিল বহরমপুরের মোহন হাউসে। হলের মালিক ছিলেন মোহনলাল জৈন। তিনি আমন্ত্রণ করে নিয়ে গিয়েছিলেন দাদাঠাকুরকে। সিনেমা শেষে প্রথম দিনের টিকিট বিক্রির টাকা বিরাট একটা কাঁসার থালায় রেখে দাদাঠাকুরকে দিলেন। দরিদ্র ব্রাহ্মণের সেদিন জবাব ছিল, ‘আমি দান নিই না। কিন্তু এই দান আজ গ্রহণ করব। টাকাগুলো গরিব-দুখিদের কাজে ব্যয় করব।’ সাংবাদিকেরা প্রশ্ন করেছিলেন, ‘সিনেমা কেমন হয়েছে?’ দাদাঠাকুরের জবাব, ’১৪ ক্যারটের গোল্ড।’ অর্থাৎ সত্যি-কল্পনা মিশিয়ে। সেই সময়ে ভারত সরকার ১৪ ক্যারট সোনা বাজারে এনেছিল। সোনায় তো খাদ থাকবেই। সিনেমায় দেখানো কার্তিক সাহা কিন্তু বাস্তবেই ছিলেন। তেলেভাজাওয়ালা। যাঁকে দাদাঠাকুর ভোটে জিতিয়ে এনেছিলেন। আর তরুণ কুমার যে নলিনীকান্ত সরকারের ভূমিকাভিনেতা সে কথা বহু আলোচিত। বিপ্লবী ছিলেন নলিনীকান্ত। এই নলিনীকান্ত সরকারের হাসির গান একসময়ে বিখ্যাত ছিল। দাদাঠাকুরের বিখ্যাত ‘মরি হায় হায় রে/কলকাতা কেবল ভুলে ভরা/হেথা বুদ্ধিমানে চুরি করে/বোকায় পড়ে ধরা’।

দাদাঠাকুরের প্রেস।

আমাদের কথার মাঝে হাজির হলেন শুভব্রত পণ্ডিত। ইনি দাদাঠাকুরের পুতি। সমীরবাবুর ছেলে। তিনিও কিছু তথ্য দিলেন। কলকাতার বহু স্বনামধন্য ব্যক্তিত্ব দাদাঠাকুরকে শ্রদ্ধা করতেন। ভালবাসতেন। একবার জঙ্গিপুরের বাড়িতে গভীর রাতে হাজির হয়েছিলেন নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসু। তখন দাদাঠাকুর প্রেসে ছিলেন না। ছিলেন বাড়িতে। নেতাজি জানতে চান, বাড়ি কতদূরে? ছেলেরা উত্তর দেন, ‘ওয়ান টোয়েন্টি সিক্স স্টেপ (১২৬ পা)। হেসে ফেলে নেতাজি মন্তব্য করেন, ‘এই মাপ নিশ্চয় দাদার কথা।’

আমাদের দাদাঠাকুরের বাড়ি দেখার ইচ্ছে হল। নিয়ে গেলেন শুভব্রত। যাত্রা শুরুর আগে ইন্দ্র বলল, ‘পা গুনে গুনে চলো কিন্তু।’ তিনজনেই হেসে উঠলাম। দাদাঠাকুরের বাড়ি, শোবার ঘর দেখলাম। ততক্ষণে সমীরবাবুও হাজির সেখানে। এঁরা দাদাঠাকুরের বেশ কিছু জিনিস সংগ্রহ করে রেখেছেন। কোনও পরিকল্পনা আছে স্বনামধন্য পূর্বপুরুষকে নিয়ে? সমীরবাবু জানালেন, ‘একটা সংগ্রহশালা করতে চান। যদি সরকারি সাহায্য মেলে তাহলে সুবিধে হবে।’’

দাদাঠাকুরের শোবার ঘর। তাঁর পুতি শুভব্রত।

চলে আসার সময় হল। মনে মনে প্রণাম জানালাম চিরকাল দৃঢ়চেতা, মেরুদণ্ড সোজা করে রাখা মানুষটিকে। এই দুনিয়ায় যেটা মানুষের লুপ্তপ্রায় অঙ্গ হয়ে দাঁড়াচ্ছে যে!

ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *