অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

শিল্পীদের জন্য পথ, রাস্তায় ছবির বাজার বসে বেঙ্গালুরুতে

অ্যালবার্ট অশোক

পশ্চিমবঙ্গের চিত্রশিল্পী, যাঁরা ছবিকে জীবিকা করে রুটি রোজগার করেন তাঁদের অনেকেই জানেন না কর্নাটকের বেঙ্গালুরুর ‘কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদের’, চিত্র সান্থে (ছবির বাজার) একদিনের শিল্প মেলার খবর। প্রতি বছর ৭ জানুয়ারি।

বেঙ্গালুরুতে, কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদের আয়োজনে, রাজ্য সরকারের ১০০ ভাগ সহযোগিতায় ‘চিত্র সান্থে’ নামে একদিনের ছবির মেলা বসায়। সারা ভারতের শিল্পীরা আসেন। এটা একটা জনসাধারণের মেলা যেখানে অল্প দামে স্থানীয় মানুষেরা ছবি কিনে ঘরের দেওয়ালে রাখেন। ছবি উচ্চমানের নয়। ছবির ছাত্র, বা মাঝারি বয়সের শিল্পী যাঁরা ছবিকে জীবিকা করে বাঁচেন তাদের স্বার্থে এক সাধারণ মেলা। গ্যালারির দামী ছবি নয়। ফলে বোধ-দুর্বোধ কথা নেই। ল্যান্ডস্কেপ, মানুষ জীবজন্তু যা হোক ঘর সাজাবার ছবি। আর মানুষের ছবি কেনার অভ্যাস।

এক শিল্পীর স্টল।

কুমার ক্রুপা রোড, মুখ্যমন্ত্রী সিদ্ধারামাইয়ার সরকারি বাড়ি ‘কৃষ্ণা’র কাছেই, কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদ। আগের দিন থেকেই প্রস্তুতি চলছিল, ৭ জানুয়ারি সকাল ৭টা থেকে রাস্তার দু’পাশের সব দোকান বন্ধ রাখা হয়, শুধু শিল্পের জন্য। সব যান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হল ওই রাস্তায়, শুধু শিল্পের জন্য। বিশাল বড় এলাকা নিয়ে রাজপথ একদিনের শিল্পমেলার মাঠ বা প্রাঙ্গণে পরিণত হয়ে গেল। কয়েকশো ভলান্টিয়ার। পুলিশ, প্রশাসনের লোক সবাই দক্ষতার সঙ্গে এই বিশাল মেলা সামলাতে ব্যস্ত। ছবি ৫০ টাকা থেকে ৩লাখ টাকা দামেরও ছিল। মেলার শুভারম্ভ করেন বিজ্ঞানী ও ভারতরত্ন সি এন আর রাও।

কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদ প্রত্যেক শিল্পীর কাছ থেকে রেজিস্ট্রেশনের জন্য মাত্র ৩০০ টাকা নিয়েছে। তারা ৬ ফুটের মত লম্বা একটা টেবিল ও ২টি চেয়ার দিয়েছে। শিল্পী যদি তাঁর কোনও সহযোগী নিয়ে আসেন তাঁর জন্য। সকালে খিচুড়ি আর উপমা সঙ্গে চা দিয়েছে। দুর্দান্ত খেতে। পেট ভরে। দুপুরে দায়িত্ব নিয়ে প্রত্যেক শিল্পীর স্টলে খাবার পৌঁছে দিয়েছে। ভলান্টিয়াররা যত্ন নিয়েছে সুবিধা অসুবিধার। প্রত্যেককে সার্টিফিকেট দিয়েছে। আমাদের এখানে চারুকলায় কত টাকা করে নেয় জানেন নিশ্চয় আপনি।

হাওড়ার জগৎবল্লভপুরের শিল্পী চিন্ময় সরকারের স্টল।

আমি এখানে বেঙ্গালুরুর চিত্র সান্থের এই বছরের একদিনের মেলার তথ্য দিয়েছি। এই তথ্য আমার বানানো নয়। কম করেও ৮ জানুয়ারির গোটা দশেক ইংরেজি নিউজ পেপারের তথ্য থেকে তুলে দিয়েছি। পড়ুন আর ভাবুন, আমাদের পশ্চিমবঙ্গে এমন মেলা সরকার কবে করতে পারবে? আদৌ পারবে কিনা!

ডেকান হেরাল্ড লিখেছে, ৫ লাখ লোক কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদের আয়োজিত ১৫তম চিত্র সান্থে এসেছিল। গতবার ছিল ৩ লাখ ২০ হাজার। ৪ কোটি টাকার বিক্রি হয়েছে। স্টল ছিল ১৪০০, শিল্পী ছিলেন ৩০০০। ছবি লোকে নগদে কিনেছেন, কেউ পেটিএম ব্যবহার করেছেন খুচরোর অভাবে। স্থানীয় তিনটি এটিএম থেকে এক কোটি টাকা তোলা হয়েছে ওই দিন। সবাই শিল্পীকে নগদ দেওয়া পছন্দ করেছেন। গঙ্গাধর মূর্তি তাঁর বন্যজীবন সিরিজের একটা বাঘ-তেল রংয়ে বাস্তব রীতিতে আঁকা ২ লাখ ৩০ হাজারে ও একটা ময়ূর দেড়লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। মণিপুরের সুরেশ হুইড্রম তাঁর মিক্সড মিডিয়ার একটি কাজ ৩ লাখ টাকায় বিক্রি করেছেন। মেলার দিন বিক্রির পেইন্টিং এর সংখ্যা ছিল ৯০ হাজারের বেশি। কারও কোনও অভিযোগ বা পরামর্শ থাকলে তা লেখার ব্যবস্থা ছিল। ছবির মেলায় নানা আকর্ষণ বাড়ানোর বিষয়ও যুক্ত ছিল, নাচ গান, লোকগান ইত্যাদি। ছিল পটারি।

শিল্পরসিকদের সমুদ্র।

চিত্র সান্থে মানে হল চিত্রের বাজার। সান্থে মানে বাজার। আগে এটা বছরের প্রথম রবিবারে হত। কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদের প্রতিষ্ঠাতার প্রতি শ্রদ্ধা ও ঋণ স্বীকার হিসাবে নাঞ্জুন্দা সিরি – একটা উৎসব হত। সেটাই এখন এত বড় কলেবরে দাঁড়িয়েছে। শিল্পীরা এসেছেন কলকাতা, গুরগাঁও, গুলবর্গা, বেলগাঁও, উদুপি, চেন্নাই, মেদিনীপুর দিল্লি-সব বিভিন্ন জায়গা থেকে।

কমিটির সদস্য হরিশ পদ্মনাভ জানালেন, এবার লোকের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য আবেদনপত্র তেমন করে যাচাই করা হয়নি। যাঁরা আসতে চেয়েছিলেন প্রায় সবাইকে তাঁরা আমন্ত্রণ জানান। এ বছরের থিম ছিল পরিবেশ দুর্ঘটনা ও আবহাওয়া পরিবর্তন।

মজা পেয়েছে খুদেও।

আমার খুব ভাল লেগেছে। যদিও আমারা কোনও প্রস্তুতি নিয়ে যাইনি। কিছু কাঠকয়লার কাজ নিয়ে গেছিলাম। তা-ও ফ্রেম ছাড়া। আর আমি ন্যূনতম দাম না পেলে বিক্রি করব না। তাই বিক্রি করিনি। আমি পুরো মেলা ঘুরে ঘুরে দেখলাম। আর তাজ্জব হয়ে গেলাম। এত লোক, আর তাঁদের ছবির প্রতি ভালবাসা। এই ভালবাসা বাংলায় সৃষ্টি করা যায় না? প্রায় ৮০০ পশ্চিমবঙ্গের খাটো শিল্পীরা-ছাত্র, মাঝারি পেশাধারী শিল্পী, সখের শিল্পী সকলে ৪ ও ৫ জানুয়ারি দুরন্ত এক্সপ্রেসে চেপে যশবন্তপুরে নেমেছেন। চারুকলায় দর্শক যায় না ৮০০ জনও। সরকার ১০০ স্টলের ব্যবস্থা করতে পারে না।

আমাদের পশ্চিমবঙ্গের চারুকলা পরিষদ, তথ্য ও সংস্কৃতি দপ্তরের বড় বড় দাদাদের মগজ আকর্ষণ করে কিছু পরামর্শ দিতে চাইছি; আপনারা পশ্চিমবঙ্গের শিল্পীদের জীবিকার দিকে একটু নজর দিন। চারুকলা মেলার চরিত্র আমরা যা দেখছি, তাতে সব শিল্পীরাই অন্তরে সরকারের উদাসীনতার বিরুদ্ধে ক্ষোভ পোষণ করে আছি। সরকারে কাছ থেকে এটা সাধারণ মানুষের প্রাপ্য নয়। প্রতিবারই মেলা হয় তার কোনও প্রচার থাকে না। ভাল ব্যবস্থা থাকে না যে, সেখান থেকে শিল্পীরা দুটো পয়সা উপায় করে তাদের অন্ন জোগাবে ও শিল্পকর্ম ধারা বয়ে নিয়ে যাবে।

আমাদের বিশিষ্ট নামী দাদারা, যাঁরা বিখ্যাত বিখ্যাত শিল্পী, আধিকারিক, আমলা হয়ে প্রশাসনের কোষাগার ব্যবহার করছেন সংকীর্ণ স্বার্থে, তাঁরা একটু কর্নাটক চিত্রকলা পরিষদের একদিনের মেলা দেখে আসুন। না হলে মাথা খুলবে না।

রাতেও জমজমাট মেলা।

পশ্চিমবঙ্গে চারুকলা মেলাতে ১০০টা স্টল দিলেও এক হাজার ক্রেতা থাকে না। বাংলার মানুষ জানতেই পারে না একটা ছবির মেলা হচ্ছে। কারণ প্রচার থাকে না। ফলে চারুকলা মেলা করে সরকারের অর্থ খরচ না করে বন্ধ করে দেওয়াই ভাল। সরকারের যদি সদিচ্ছা থাকে তবে শিল্পীদের ছবি বিক্রির দায় নিক। যাতে আমরাও ৫০০ টাকা থেকে শুরু করে কিছু সস্তা দামের ছবি আমাদের শহরের নাগরিকদের কাছে বিনিময় করতে পারি।

ছবি- লেখক এবং শিল্পী চিন্ময় সরকার।

(সমাপ্ত)

2 thoughts on “শিল্পীদের জন্য পথ, রাস্তায় ছবির বাজার বসে বেঙ্গালুরুতে

    1. তুমিও গিয়েছিলে এটা জানা ছিল না। গ্রুপে লিখে দিচ্ছি আমি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *