জঙ্গল যাপন বিশেষ ভ্রমণ

বনরূপসি বাংরিপোষি—শেষ পর্ব

সৌমিত্র

বুধুয়া, প্রফুল্লকানন, মহেশ্বর মৌতাত এবং রানা-ঘাট

হোটেল বাংরিপোষির একটি ঘরে পিঁপড়ের সাংঘাতিক উৎপাত। সঙ্গে ছোট ছোট মাকড়সা। আমার এক বন্ধুর তো প্রায় ঘুম ছুটে গিয়েছিল। জানালার পরদায়, বিছানার চাদরে-বালিশে, ব্যাগ-পত্তরে দলে দলে পিঁপড়ের নীরব ‘হোক কলরব’। কলকাতায় হোটেলের কর্তৃপক্ষকে ফোন-টোন করে কোনওক্রমে অবস্থা সামাল দিতে হয়েছিল। বাংরিপোষিতে আমাদের তাই শুধু প্রকৃতি দেখাই হল না, পিঁপড়েও দেখা হল ঢের।

এবং মানুষ।

দেখলাম বুধুয়া সিংকে (বুদ্ধদেব গুহ-র রচনা-খ্যাত), যাঁর বয়স কম করেও ৮০-র ওপর, অথচ, নিজেকে যিনি জানেন পঁয়ষট্টির এক ‘যুবক’ হিসেবেই! কালো ঋজু দীপ্ত দৃপ্ত এক মানুষ। কম কথা বলেন। তাই কথা বলানোর জন্য নানারকমভাবে গল্প ফাঁদছিলাম ওঁর সঙ্গে। বুদ্ধদেববাবুর কথায় বললেন, ‘উনি আসতেন, এসেই বলতেন, চল্ বুধুয়া, বলে বন্দুক নিয়ে পাখ মারতে যেতেন! আমিও সঙ্গে ঘুরতাম।’

বুধুয়া সিং।

হোটেল বাংরিপোষির চৌহদ্দির ভিতরেই একটা খড়ের চাল-মাটির বাড়িতে তিনি সপরিবার থাকেন। উঠোনে কুয়ো, খাটিয়া, শ্যাওলা— রয়েছে সবই। খুব ভোরে উঠে আশপাশের গাঁও থেকে সবজি সংগ্রহে বেরোন, একদিন সকালে হাঁটতে বেরিয়ে দেখেছিলাম। এখনও সাইকেল চালান। প্রায় সন্ধে নাগাদ খেয়ে নেন। তাড়াতাড়ি শুয়ে পড়েন। সোজা হয়ে হাঁটেন। বড় দল বেড়াতে এলে এখনও রান্নায় হাত লাগান। ওঁর হাতের রান্না নাকি দারুণ(আমাদের অবশ্য ওঁর রান্না আস্বাদের সৌভাগ্য হয়নি)। সব মিলিয়ে এই বুধুয়া এক আশ্চর্য, এথনিক, আদিম, অকৃত্রিম, সুন্দরমানুষ!

বাংরিপোষি থেকে আমরা গিয়েছিলাম কানছিন্দা। বুড়িবালাম নদী। প্রায় কুড়ি কিলোমিটারের মতো পথ। বাঁধানো সুন্দর রাস্তা নয়। গাছপালায় ভরা ‘রাস্টিক রোড’। গহন। নিবিড়। শান্তি ও সৌন্দর্যে ভরা। এখানে, নদীর তীরে প্রফুল্লকুমার নায়েকের সঙ্গে পরিচিত হলাম। ভদ্রলোক প্রায় একক প্রচেষ্টায় একটি স্কুল চালাচ্ছেন ওখানে। বহু লেখালেখি করে নানাদিকের সাহায্য সন্ধান করেছেন। কয়েকটি এনজিও এগিয়ে এসেছে মাত্র। তবু, তারা টাকাটাই জুগিয়েছে। স্কুলের সমস্ত কাজ তাঁকেই দেখতে হয়। শুরুর সময় পুঁজি বলতে তাঁর ছিল অদম্য সাহস, অসীম উৎসাহ এবং সামান্য জমি। সেই সম্বল নিয়েই ভদ্রলোক অনেকদূর চলে এসেছেন। এখন জনাচল্লিশেক ছাত্র রয়েছে তাঁর আবাসে।

প্রফুল্লকুমার নায়েক এবং তাঁর স্কুলের কচিকাঁচারা।

তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনটা ভরে উঠল। প্রস্তুতিহীন আমরা আমাদের পুঁজি থেকে খুব সামান্য একটা চাঁদা-গোছের ওঁর হাতে দিতে পারলাম। উনি সমূহ উচ্ছ্বাসভরে ওঁর স্কুলের কথা, পঠ-পাঠনের কথা, রান্না, খাওয়া-শোওয়ার কথা বলছিলেন। বলছিলেন ছেলেদের কথাও। বলতে-বলতেই মহেশ্বর হেমব্রম নামের এক ছাত্রকে ডাকলেন। দেখে চমকে উঠলাম যে, প্রফুল্লবাবুর ডাক শুনে ছোট্ট ছেলেটি আগে তার চটি খুলে রাখল, তারপর ‘গুরু’র কাছে এল। ওই প্রত্যন্ত অন্ধকার নদীতীরে প্রায় বনমধ্যের কোনও ছাত্রাবাসের এক ছাত্রের এমন ‘জেসচার’ দেখে সত্যিই মুগ্ধ হলাম। বুঝলাম, শিক্ষা মোটেই আড়ম্বরের উপর নির্ভর করে না। নদীতীরের অনাড়ম্বর এই তপোবনে ভিতর থেকে শিক্ষিত হয়ে উঠছে ছোট ছোট ছেলেগুলি। গুরুর আহ্বানে সে এসে দাঁড়াবার পর, প্রফুল্লবাবু ইংরেজিতে তাকে কিছু প্রশ্ন করলেন। মহেশ্বর চটপট ইংরেজিতেই সেগুলির উত্তর দিয়ে প্রফুল্লবাবুর অনুমতি নিয়ে সরে দাঁড়াল। মনে মনে আমরা সবাই প্রার্থনা করলাম, দিনে দিনে আরও প্রফুল্ল হয়ে উঠুক এই বিদ্যায়তন।

এর পরের অভিজ্ঞতাটা অবশ্য আমার ফার্স্ট-হ্যান্ড নয়। রবিবারের দুপুরে আমরা ছেলেরা আর বেরোলাম না; আমাদের দলের মেয়েরা ঘুরে এল ওখানকার বিখ্যাত কুলিয়ানা গ্রাম, ডোকরাশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ। বাংরিপোষি বাজার থেকে মোটামুটি ৩০ কিলোমিটার কুলিয়ানা বাসস্টপ। সেখান থেকে অটোতে আরও কিলোমিটার দেড়েক গিয়ে পার-কুলিয়ানা গ্রাম। ওখানকার সব বাড়িতেই ডোকরাশিল্পের চর্চা।

ভীম রানা।

ভীম রানা নামের এক প্রবীণ শিল্পীর খোঁজ পেয়েছিল ওরা। তাঁর বাড়িতে ঢুকেই যাবতীয় ডোকরা-অভিজ্ঞতার সঞ্চয়ন। সেটা মোটামুটি এরকম: নরম ভাঙা ভাঙা মোম দিয়ে প্রথমে হাতে করে মূর্তি বানাতে হয়। তারপর সেটার সাহায্যে একটা মাটির ছাঁচ বানিয়ে নিতে হয়। পরে ওই ছাঁচেই পেতলের টুকরো ভরে মাটি দিয়ে ছাঁচের খোলামুখ বন্ধ করে তা দীর্ঘ সময় আগুনে ফেলে রাখতে হয়।তারপর ছাঁচগুলিকে সময়মতো আগুন থেকে তুলে রোদে ফেলে রাখতে হয়। জিনিসটা ঠান্ডা হলে ছাঁচ ভেঙে মূর্তি বার করে নিতে হয়। তারপরও মোছামুছি ও পালিশের কাজ কিছু থাকে।একটি মূর্তি তৈরি হয়ে উঠতে তিন-চার দিন সময় নেয়।

ভীম রানার বয়স আশির কোঠায়। সাতপুরুষের শিল্পী এঁরা। এখন এঁর দুই ছেলে জগন্নাথ এবং দশরথ রানাও কাজ করছেন। ওঁরা অনেকটা সময় দিয়ে প্রসেসটা দেখিয়েছেন। শুধু তাই নয়, সঙ্গে কোনও ছেলে আসেনি দেখে ভীমবাবু আমাদের স্ত্রী-টিমকে নিজে এগিয়ে এসে গাড়িতে তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন!

প্রিয় প্রকৃতি। শান্ত-নির্জন।

নানা অভিজ্ঞতার মধ্যে দিয়ে তিনটে দিন কেটে গেল। পরদিনই তল্পিতল্পা বেঁধে ফেরার পালা। শেষদিনের বিকেলটায় আমরা সকলে মিলে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম। পাকা সড়ক ধরে হাঁটা, ঋজু, সো-ও-ও-জা! দু’পাশে দীর্ঘ তরুশ্রেণি। সেই গাছ-শামিয়ানার মধ্যে দিয়ে আসন্ন সন্ধ্যার ছায়া-কল্পের গর্ভে হেঁটে চলা। পাহাড়ের দিকে। পাহাড়তলির বাঁকের দিকে। ‘এলিফ্যান্ট পয়েন্টে’র দিকে। বনদেবীর মন্দিরের দিকে। গতির দিকে। চড়াইয়ের দিকে। রোমাঞ্চের দিকে। আশপাশের সামান্য বসতি এবং দোকান-পাট ফেলে রেখে ক্রমশ পূর্ণিমা মাধুর্যের দিকে।

হেঁটে যেতে যেতে দূরের বাতাস মুখে এসে লাগছে। কানের পাশ দিয়ে সাঁই সাঁই করে চলে যাচ্ছে বড় বড় ট্রাক, টু-হুইলার, বাসও। কালো পিচের ওপর রবারের চাকার সেই চটচটে আওয়াজ— কখনও ভিজে, কখনও শুকনো। সারাক্ষণ ধরে শুধু চাকার চলে যাওয়া আর ফিরে আসা।

সুদূরের স্মৃতি।

সবমিলিয়ে বাংরিপোষি আমাদের স্মৃতিতে একটা গাঢ় লালকালির দাগ দিয়ে গেল। এমন একটা ছুটির মৌতাত ছড়িয়ে গেল যেখানে হাত ধরাধরি করে রয়ে গেল শালসবুজ, মেঘকালো, বৃষ্টিশ্বেত, পাহাড়নীল, পাখিধূসর, চাঁদহলুদ এবং লাল-কালো পিঁপড়ের সতেজ মিছিল!

সমাপ্ত

পুনশ্চ: এই অংশে ব্যবহৃত ছবির বেশ কয়েকটি সরবরাহ করে আমায় উপকৃত করেছেন আমার বন্ধু (এবং বলাই বাহুল্য, আমার সফরসঙ্গীও) শ্রী সুদীপ্ত দে। তাঁকে ধন্যবাদ।

 

One thought on “বনরূপসি বাংরিপোষি—শেষ পর্ব

  1. আমি আপনার সাথে সফরে মানসিক শারীরিক ও প্রযুক্তিগত ভাবে জীবনভর বুধূয়ার মতো প্রফুল্লে রয়ে যেতে চাই

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *