পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ঘুরতে ঘুরতে মুরগুমা— হুড়কো পর্ব

দীপক দাস

‘তুমি তো মোড়ল আছ! তুমি গিয়া দিখাই দাও না কেনে?’ বাল্ববের হলুদ ঘোলাটে আলোয় তরুণের ক্ষিপ্ত মুখটা ঠিক দেখা গেল না। তবে ঝাঁজালো কণ্ঠে মালুম হল, তিনি চটেছেন।

সপ্তমীর রাত। তিন তরুণ গোটা চারেক জেলা উজিয়ে হাজির মুরগুমার মোড়ে। তিনজনই তরুণ এ কথা বললে সত্যঠাকুর রাগ করবেন। দুই তরুণ আর এক প্রায় চালশে যুবক বলাই শ্রেয়। ত্রয়ীর উত্তমপুরুষটি কে, সেটা সহজবোধ্য। বাকি দু’জন তারই অনুজ এবং ‘মিত্রোঁ’। চলছে রাতের আশ্রয় খোঁজার পালা। আর তাতেই গোলের শুরু।

ঘুরতে গেলে আমরা সবসময়েই পূর্বনির্ধারিত ব্যাপারস্যাপার বিষবৎ বর্জন করে থাকি। ট্রেনে আসন সংরক্ষণ, ভ্রমণস্থলে আশ্রয়স্থান ঠিক করে রাখা ইত্যাদি বিষয়গুলো অনেকটা নেমন্তন্ন খেতে যাওয়ার মতো মনে হয়। তাহলে আর ঘুরতে যাওয়ার মজা কোথায়! সেই মজার লোভেই এবার মজেছি। মুরগুমা আসার কথা ছিল অষ্টমীর দিন সকালে। কিন্তু রাতেই চলে আসতে বাধ্য হয়েছি। কারণ আমাদের প্রথম অভিযানটি স্টেশনেই মারা পড়িয়াছে।

বেগুনকোদরের আগের স্টেশন।

গিয়েছিলাম বেগুনকোদর নামে একটি স্টেশনে ভূত দেখতে। পুরুলিয়ার কোটশিলা এলাকার এই স্টেশনটি আন্তর্জালের কল্যাণে যথেষ্ট কুখ্যাতি কুড়িয়েছে। (‘একটি ভূতুড়ে স্টেশন আর তিন শঙ্করের কাহিনী’তে সেই অভিযানের গল্প আছে)। ঠিক ছিল, ওই স্টেশনেই রাত কাটিয়ে তিনমূর্তি ‘ঘোস্টবাস্টার্স’ হব। কিন্তু সেখানে গিয়ে খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল, ভূতের গল্পটি মুজতবা আলির ভাষায়, নেহাতই ‘গাঁজা কিংবা গুল’। তাই… রাতেই মুরগুমা মোড়ে।

যতটা সহজে বলা গেল, আসাটা যদিও ততটা সহজ হয়নি। পুজোর সময়। এইসব এলাকায় পুজোর সময় বাস কম চলে। বাঁকুড়ায় অষ্টমীর দিনে বাস কমের জন্যই মুকুটমণিপুর থেকে ঝিলিমিলি-রানিবাঁধ যেতে পারিনি। এবার বেগুনকোদর রেলস্টেশন থেকে বেগুনকোদর বাসস্ট্যান্ডে আসতে বেগ পেতে এবং দেরি হয়েছিল। বেগুনকোদর স্টেশনের এক কর্মী জানিয়েছিলেন, কিছুক্ষণের মধ্যেই একটা বাস আছে। তড়িঘড়ি মাঠঘাট ঝাঁপিয়ে, গরুর পাল পেরিয়ে হাজির হয়েছিলাম বামনিয়া বাসস্ট্যান্ডে। আর ঠিক তখনই…তখনই আমাদের দলের পনৌতি মুখ খুলল। হেসে হেসে বলল, ‘‘এখনও পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাকই এগোচ্ছে বলো?’’

ব্যাস! বাসটাই আর এল না! ঝাড়া এক ঘণ্টা অপেক্ষা করলাম। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে আছি দেখে স্থানীয় এক ছোকরা এসে জানাল, ও বাস আজ আর আসবে না। আমার তো তখন ‘পাতালঘর’ সিনেমার সেই গানটা গাইতে ইচ্ছে করছিল, ‘কোথাও খুঁজে পাবে নাকো এমন অপয়া’। গ্রুপে ভাঙন ধরতে পারে। তাই নামটা প্রকাশ করলাম না। এক বাসে বেগুনকোদর যাওয়া যেত। এখন ঝালদা হয়ে যেতে হবে।

অপরূপ বেগুনকোদর স্টেশন।

অনেক অপেক্ষার পরে বাসে ঝালদা এসেছিলাম। সেখান থেকে বেগুনকোদর পর্যন্ত টেম্পো চলে। কিন্তু পুজোর রাতে টেম্পোচালকেরাও বোধহয় ছুটির মেজাজে। চরকি পাক খেতে খেতে একবার সিভিক ভলান্টিয়ারকে জিজ্ঞাসা করি। একবার লোকজনকে। সবাই বলে, ‘ওই তো, ওদিক থেকে ছাড়ে।’ ঝালদা বাসস্ট্যান্ডে জাঁকিয়ে পুজো হচ্ছে। এক জায়গায় প্রচুর খাবারের স্টল। এদিকে পেটেয় পাথরভাঙার কল চালু হয়ে গিয়েছে। তখন পাথর খেলেও আমার পাকস্থলী তাকে গুঁড়িয়ে গণেশ সাত্তু বানিয়ে দেবে। ব্যাগে রেশন আছে বটে। কিন্তু লক্ষে পৌঁছনোর আগে তুচ্ছ খিদের কাছে হার মানা যাবে না। আমাদের তিনজনের অবস্থা তখন টিনটিনের কমিকসের কুট্টুসের মতো। কাজ আগে না হাড় আগে?

অনেক খোঁজাখুঁজির পরে একটা টেম্পোর দেখা মিলল। চালক মুদিখানার মাল কিনছেন। মাল কেনা হলে গাড়ি ছাড়বে। তা কিনুন। গাড়ি ছাড়বে এটাই তো বড় কথা। টেম্পোর পেটে পরপর উঠতে লাগল, আটার বস্তা, চিনির থলে, তেলের টিন। আর কী কী সব যেন। মালপত্রের ফাঁকফোকরে পা ঢুকিয়ে আমি আর শুভ অন্য যাত্রীদের সঙ্গে সিঁটিয়ে বসে রইলাম। ইন্দ্র চালকের পাশে। ওর বরাবরই একটু আরামের দিকে ঝোঁক। সুযোগ বুঝে কেবিনে সেঁধিয়েছে।

‘তিব্বতে টিনটিন’। কুট্টুসের দ্বিধা।

দেখতে দেখতে টেম্পো মালপত্রের সঙ্গে মানুষে বোঝাই হয়ে গেল। বড় বড় ঝোড়াঝুড়ি, কোদাল নিয়ে একদল আদিবাসী মহিলা-পুরুষ উঠেছেন। কোথাও মাটি কাটার কাছ ছিল বা আছে বোধহয়। টেম্পোর খোলে মালের চাপ, বাইরে চাপ চাপ মানুষ। কেউ কেউ ডালায় বসে আছেন। ফেভিকলের পুরনো বিজ্ঞাপনের সেই গাড়ির মতো আমাদের টেম্পো চলতে শুরু করল। এদিকে রাস্তা বেশ খারাপ। গাড়ি গর্তে পড়লেই সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে যাচ্ছি। আর আমার চিন্তাসূত্র ছিঁড়ে যাচ্ছে। টেম্পো যাবে বেগুনকোদর পর্যন্ত। সেখান থেকে মুরগুমা বেশ খানিকটা দূর। যাওয়ার ব্যবস্থা কী হবে?

বেগুনকোদরে টেম্পো খালি। ঘেরাটোপে শুধু আমি আর শুভ। ইন্দ্র সেই চালকের পাশে। ছেলেটা ভারী ঘ্যানঘ্যানে। তবে ওর ঘ্যানঘ্যান অনেক সময়েই কাজে দেয়। এই এখন যেমন দিল। টেম্পোচালক আমাদের মুরগুমা পর্যন্ত ছেড়ে দিয়ে আসতে রাজি হয়েছেন। আমার দৃঢ় বিশ্বাস, ইন্দ্রর ঘ্যানঘ্যান থেকে বাঁচতেই চালক রাজি হয়েছেন।

বেগুনকোদরে মুদিখানার মালপত্র খালাস করে দিলেন টেম্পোচালক। তারপর ফাঁকা টেম্পোয় শুরু হল মুরগুমা গমন। যে এক অসাধারণ অনুভূতি। যুগপৎ শরীরে এবং মনে। রাস্তা খুব খারাপ। টেম্পো একবার দড়াম করে গর্তে পড়ছে আবার উঠছে। একবার ডানদিকে কাত হচ্ছে পরক্ষণেই সামলে নিয়ে গিয়ে পড়ছে বাঁদিকের গর্তে। ধরুন, একটা বড় মিষ্টির বাক্সে মাত্র চারখানা নারকেল নাড়ু নিলেন। তাহলে কী হবে? আপনার প্রতি পদক্ষেপে নাড়ুগুলো গড়গড়িয়ে এপাশ-ওপাশ করবে। টেম্পোর খোলে আমাদের অবস্থাটা তখন সেইরকম।

ফেভিকলের সেই বিজ্ঞাপন।

গাড়ি একটু ঠিকঠাক চললে প্রকৃতির দিকে মুখ ফেরাতে পারছি। জঙ্গুলে পথ। ফলে অন্ধকারটা আরও জমাট হয়েছে। টেম্পোর আলো সেই অন্ধকার পাতলা করে এগিয়ে চলেছে। কানে আসছে পোকাদের একটানা গণসঙ্গীত। একটা ঝাঁকড়া গাছকে ঝেঁকে ধরেছে ঝাঁকে ঝাঁকে জোনাকি। মনে হচ্ছিল, কোনও আদিম প্রকৃতিতে এসে পড়েছি। আমাদের লড়ঝড়ে টেম্পোটা যেন কোনও টাইম মেশিন। ঘর পাওয়া না পাওয়ার উত্তেজনাটা আস্তে আস্তে কাটিয়ে দিচ্ছিল রাতের প্রকৃতি। এত কিছুর মধ্যেও শুভ স্পিকটি নট। মুখ বন্ধ করে বাইরের দিকে তাকিয়ে ছিল। অনেকক্ষণ পরে মুখ খুলল, ‘চারিদিকে কত পাহাড় দেখেছ? হাত বাড়ালেই পাহাড়!’ বুঝলাম, ভাইটি আমার চন্দ্রাহতের মতো পাহাড়াহত হয়ে পড়েছে।

একসময় টেম্পো এসে থামল সেই ঘোলাটে আলোর মোড়ে। খুশি মন আর ব্যথা ভরা শরীর নিয়ে নামলাম আমরা। এবার থাকার জায়গা খোঁজা। একটা সিমেন্ট বাঁধানো চাতালে আড্ডা দিচ্ছিলেন কয়েকজন। তাঁদের সাহায্য প্রার্থনা করতেই প্রায় গোটা পাড়া আমাদের দিকে এগিয়ে এল। সকলেই সাহায্য করতে চান। কেউ বললেন, ড্যামের পাশে রিসর্ট আছে। কারও প্রস্তাব, হোম স্টে। দু’একজন এখানে নিজের বাড়িতে অতিথিশালা খুলেছেন। কড়ি খসিয়ে অতিথি হওয়া যায়। তাঁদেরই কারও বাড়িতে আমাদের পাঠাতে চান। এর মধ্যেই এসে পড়লেন সেই বৃদ্ধ। নির্দেশের সুরে বললেন, ‘কার বাড়ি যেতে চায় দিখাই দাও।’ তাঁর নির্দেশেই ক্ষিপ্ত তরুণের সেই মোড়লবাণী।

একটাই শব্দ, সুন্দর।

সাহায্যের জন্য ঠেলাঠেলির মধ্যেই একটা নাম ভেসে উঠেছিল। একজন আমার কাছে এসে বললেন, ‘অমুকের বাড়ি যেতে চাও তো? ওই তো ওদিকে।’ তিনি যেদিকে দেখালেন সেদিকে একটা চোলাইয়ের ঠেক। যাঁরা আমাদের সাহায্য করতে আগ্রহী তাঁদের বেশির ভাগই ঠেক ফেরত হয়ে চাতালে। ইন্দ্র নাস্তিক এবং টিটোটেলার। মানে আমাদের তাই বলে। ফলে একটু গোঁড়াও। হয়তো কোনও জায়গায় গেলাম। সেখানকার মন্দিরের পুরোহিত প্রসাদ দিলেন। আমরা সবাই নিলাম। কিন্তু ও ঠিক পেট কনকন, দাঁত টনটনের অজুহাত দিয়ে এড়িয়ে যাবে। আরে! প্রসাদ হিসাবে কে খেতে বলেছে? খাবার হিসাবে টুপ করে মুখে পুরে নিলেই তো ঝামেলা শেষ। না নিলেই বরং পুরোহিত ঠাকুরের মহিমা, প্রসাদের দৈবগুণ ব্যাখ্যান করবে আরও বেশি করে! খেয়ে নিলে সেই ঘ্যানঘ্যান থেকে তো রেহাই!

এখানেও ঠেকের কাছাকাছি কোনও বাড়িতে থাকতে রাজি হল না ইন্দ্র। আবার খোঁজ। এবার টেম্পোচালক রিসর্টের কেয়ারটেকারকে ফোন করলেন। রিসর্টের হেব্বি দাম। প্রথমেই বাতিল করলাম। কিন্তু কেয়ারটেকার মহোদয় মানুষ। তিনিই একটা হোম স্টের সন্ধান দিলেন। পেলাম ফোন নম্বরও। হোম স্টে’র মালিক জানালেন, কোনও এক দুর্গামন্দিরের সামনে যেতে। সেখান থেকেই তিনি আমাদের অভ্যর্থনা করবেন।

কিন্তু দুর্গামন্দিরটা কোথায় রে বাবা। আবার উপদেশ, ‘ওই তো সোজা রাস্তা।’ কিন্তু সেই সোজা রাস্তার দিকে তাকিয়ে আমরা তিনজনেই নটনড়নচড়ন। ঘোলাটে হলুদ আলোর বৃত্তের বাইরে ‘নিস্তেল’ অন্ধকার ওঁৎ পেতে রয়েছে। আলোর লক্ষ্ণণরেখা ছাড়ালেই আমাদের খপ করে ধরবে! তাছাড়া গ্রামাঞ্চলের একটুখানির মাপ আমরা ভালই জানি। কারণ আমরাও গাঁইয়া। শেষে প্রবল ঘ্যানঘেনিয়ে চালককে রাজি করিয়ে দুর্গামন্দিরে পৌঁছলাম। সত্যিই একটুখানি রাস্তা। উঠলাম আর নামলাম।

অভীষ্ট দুর্গামন্দির।

টেম্পোচালক তখন বিদায় নিয়েছেন। আমরা পুজোমণ্ডপের চাঁদোয়ার নীচে চেয়ারে বসে। আমি আর শুভ। ইন্দ্র ঘর না পাওয়া অবধি খাড়া থাকার মানত করেছিল বোধহয়। অনাড়ম্বর একটা পুজো। আলোর তেজ বা মণ্ডপ সজ্জা, কোনওটাই কহতব্য নয়। শুধু মাইকটাই প্রবল তেজে চেঁচাচ্ছে। পুরুলিয়া, মানভূম অঞ্চলে আঞ্চলিক কিছু গান, মিউজিক অ্যালবাম বেরোয়। যাতে আদিরসের প্রাবল্য। সেরকমই কিছু একটা বাজছিল। গুটিকয় ছেলেছোকরা আমড়াবোম ফাটাচ্ছিল। আর গুটিকয় লোক তাঁদের পাড়ায় রাতের অতিথিদের দিকে তাকিয়ে ছিল অবাক চোখে।

বেশ কিছুক্ষণ নিরীক্ষণের পরে একজন জানতে চাইলেন, ‘কোথা থেকে আসা হচ্ছে?’ বরন্তি সফরের সময়ে ভাও বাড়ানোর বাড়ি কলকাতা বলে ফেঁসেছিলাম। প্রশ্নকর্তা কলকাতার কোথায় জিজ্ঞাসা করতেই প্রেস্টিজের ঢাক ফুটো। এবার তাই সত্যিটাই বললাম, হাওড়া। তারপর এখানে কেন? কোথায়? ইত্যাদি গতানুগতিক প্রশ্ন ছিল।

যথাসম্ভব উত্তর দিলাম। আমাদেরও কিছু জানার ছিল। এখানে আসার আগে নাগা ক্যাম্প নিয়ে নানা গল্পগাছা শুনেছিলাম। সত্যিমিথ্যে যাচাই হয়নি। জানতে চাইলাম, নাগারা আসার পরে নাকি এলাকার কুকুর কমে গিয়েছে? আলাপি ব্যক্তিটি বললেন, ‘না, না। সেরকম নয়। ওরা একটু কম বয়সী কুকুর পছন্দ করে। এই পাঁচ কিলো, ছ’কিলো।’ তারপর নিজেই গড়গড় করে নাগা জওয়ানদের নানা গল্প বলতে লাগলেন। নাগারা নাকি মাঝে মাঝে কৌটো হাতে নিয়ে গভীর জঙ্গলে ঢোকে। পোকা ধরতে। একটা পোকা নাকি এক শিশি হরলিক্সের সমান। তারপর নিজেই জাতিগত তুলনা করলেন, ‘আমরা কী জংলি! আমাদের থেকে তিনগুণ জংলি ওরা।’ এমন সহজ-সরল স্বীকারোক্তি আমি আগে কখনও শুনিনি।

আলাপি বলেছিলেন, ‘নাগারা আসার পরে এলাকায় কারও বাড়িতে আর সেকেন্ডহ্যান্ড সাইকেল নেই। সব ওরা কিনে নিয়েছে। সেগুলো চেপে আনন্দ করতে করতে এলাকা ঘোরে।’ তারপর উনি যেটা বললেন তার স্বপক্ষে কোনও প্রমাণ আমাদের হাতের কাছে নেই। বললেন, এলাকায় কেউ মারা গিয়েছে শুনলে নাগারা নাকি দেহটা চায়। ভয়ে কিনা জানি না, সেটা শুনেই ইন্দ্র শুভর পাশের চেয়ারে বসে পড়েছিল। আমাদের দলে ওই তো বেশ নাদুসনুদুস।

আরেক সুন্দর।

হঠাৎই কথাবার্তার মাঝেই ঢুকে পড়েছিলেন পাড়ার আরেকজন। তিনি একটু সমালোচক টাইপের। আমাদের শুনিয়ে শুনিয়ে বলতে লাগলেন, ‘যত রাত্তিরেই আসো, আমাদের এখানে ঠিক থাকার ব্যবস্থা হয়ে যাবে। কিন্তু কলকাতায়? তোমাকে কেউ সাহায্য করবে না।’ বলতে যাচ্ছিলাম, এখানে তো তোমরা বিনাপয়সায় অতিথিসেবা করবে না। কলকাতাতেও গ্যাঁটের কড়ি খরচ করলে অতিথিসেবা মেলে।’ কিন্তু আমাকে কিছু বলতে হল না। সেই আলাপি ভদ্রলোকই আমাদের হয়ে লড়লেন। ধমকালেন, ‘আমাদের এখানে পাখি পাহাড় আছে, তুই জানিস?’ লোকটা আমতা আমতা করে বিড়বিড়িয়ে দু’বার পাখি পাহাড় পাখি পাহাড় বলল। তার মুখটা তখন ফেবি কুইকের বিজ্ঞাপনে দামি জিনিস ভেঙে ফেলা ছেলেটার মুখটার মতো। আলাপি ভদ্রলোক তার মুখের ওপরে আরও একচোট দিলেন, ‘কলকাতার লোকেরা জানে।’ এ যে প্রায় রবি ঠাকুরের ভাষায়, দেখা হয় নাই দুই পা মেলিয়া…ধমক।

এর মধ্যেই হোম স্টে’র মালিক এসে হাজির। গিয়ে উঠলাম তাঁর দোতলায়। বিশাল বাড়ি। বেশ কয়েকটা ঘর। তারই একটা খুলে দিলেন আমাদের জন্য। চানটান করে তাজা হলাম। এল রাতের খাবার। রুটি, আলুর তরকারি আর রেডিমেড বোঁদে। তাড়াহুড়োর অতিথিসেবা। বোঁদে রসে খুব বেশি চান করার সুযোগ পায়নি। খাওয়ার আগে বহু দর কষাকষি করে একটা কম ভাড়ার গাড়ি ঠিক করা হল। সাহায্য করলেন সেই রিসর্টের কেয়ারটেকার।

আরও সুন্দর।

যেখানেই যাই রাতে শোয়ার আগে সারাদিনের ঘটনার রোমন্থন করি। আজও শুরু হল। শুভ জানাল, নাগারা ঠিকই বলেছে। পোকার খাদ্যগুণের কথা ও আগে শুনেছে। হাই প্রোটিন। বিজ্ঞানীরা এ নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছেন। সফল হলে আফ্রিকার অভুক্ত দেশগুলোর খাদ্যাভাবের সুরাহা হবে। সারাদিনের ক্লান্তিতে ঘুম পাচ্ছিল। ওর জীবসেবার বাণীতে সায় দিতে পারছিলাম না। শুভ কথা চালিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ বলল, ‘একটা জিনিস খেয়াল করেছ?’ জানতে চাইলাম, কী সেটা। ও বলল, ‘দরজায় খিল নেই। হুড়কো সিস্টেম।’

সত্যিই তো! এ জিনিস আর পাওয়া যায় না। হুড়কো জিনিসটা শুধু দরজা, জানলা থেকে নয়, বাগধারা থেকেও বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছে। আগে লোকে পাড়া-প্রতিবেশী, সহকর্মীদের ক্ষতি করতে হুড়কো দিত। এখন কাঠি করে। স্লিমের যুগ। মানুষ স্লিম, মোবাইল স্লিম। হুড়কোও স্লিম হয়ে কাঠি হয়েছে। হুড়কোবাজরা এখন কাঠিবাজ! তাছাড়া হুড়কো একটা মোটা দাগের প্রাচীন ব্যাপার। সেই আদিযুগের গাবদা মোবাইল ফোনের মতো। কাঠিতে সূক্ষ্মতা আছে। স্মার্টফোনের মতো।

প্রাচীন আগল, হুড়কো।

তবে বাড়ির দরজা-জানলায় হুড়কো থাকলেও বাথরুমে কিন্তু কমোড-বেসিন। প্রাচীন-নবীনের দারুণ মিশেলের কথা ভাবতে ভাবতেই ঘুমিয়ে পড়লাম।

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *