পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ছুঁয়ে দিলাম তোমায়, হিমালয়— প্রথম পর্ব

দীপশেখর দাস

যাত্রা শুরু

“আগার তুম কিসি কো বড়ি সিদ্দত সে চাহ তো পুরি কায়নাদ তুমে উসে মিলানে কি কসিস মে লাগ জাতে হে”- কোনও এক বলিউডি নায়ক দর্শকদের মন জয় করেছিল এই সংলাপে। তখন হেসেছিলাম, ব্যঙ্গে। তবে আজ মানছি, হয় হয়, এটাও হয়।

ঘুরতে ভালবাসি অথচ হিমালয় দেখিনি। সফর জীবন সঙ্গে সঙ্গে আধখানা। তেনজিংয়ের এভারেস্ট জয় মুখস্থ করার সময়েই হিমালয় ছোঁয়ার স্বপ্নটা সাজিয়ে রেখেছিলাম সযত্নে। মরচে পড়তে দিইনি। যদিও স্বপ্ন ছোঁয়ার চেষ্টায় ব্যর্থ হয়েছি কয়েকবার। যা হয় আরকী। প্রথমবার কলেজে পড়াকালীন। উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের শিক্ষামূলক ভ্রমণে গিয়েছিলাম ডুয়ার্স। কেউ যেন বলেছিল, ওটাও হিমালয়। আহা কী সৌন্দর্য তার! চেটেপুটে নিয়েছিলাম সবটুকু। হিমালয় ছোঁয়ার আনন্দে আত্মহারা প্রায়। গর্বে বুক ফুলিয়ে এক জ্ঞানীকে শুনিয়েছিলাম আমার হিমালয় ছোঁয়ার কথা। হায় রে! জ্ঞানীর জ্ঞানেই বিদ্ধ হলাম। জানলাম, শুধু হিমালয়ের পায়ের আঙুলই ছুঁয়ে এসেছি মাত্র। গা-ও স্পর্শ করতে পারিনি। মাথা তো দুরস্ত। কেন যে এরা এত পড়াশোনা করে কে জানে! মনটা খুব খারাপ হয়েছিল সেদিন।

দ্বিতীয় সুযোগটা পেলাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এবার কার্শিয়াং। মনে মনে ঠিক করেই নিলাম, এবার ছোঁবই তাকে। কার্শিয়াংয়ের ফরেস্ট রেঞ্জার্স কলেজ থেকে শ্বেতশুভ্র কাঞ্চনজঙ্ঘা চোখকে সাময়িক প্রশান্তি দিলেও তাকে ছুঁতে না পারার দুঃখুটা আমাকে তাড়িয়ে বেড়ালো। অবশেষে হিমালয়কে ছোঁয়ার সুযোগ পেলাম ভারতীয় উদ্ভিদ সর্বেক্ষণের সান্নিধ্যে।

চৈত্রমাস। বঙ্গে সবে সূর্য তার প্রতাপ বাড়াতে শুরু করেছে, বাঙালির একেবারে গলদঘর্ম অবস্থা (যদিও কবিরা একে বসন্ত বলেন)। এমতাবস্থায় বহু বাঙালিরই প্রথম পছন্দ হিল স্টেশন। আম্মো বাঙালি। তাই চললাম এরকম হিল স্টেশনেই। শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে প্রথমে দিল্লি। সেখান থেকে বাসে সিধা হিমাচলে। গন্তব্য কুলুর গ্রেট হিমালয়ান জাতীয় অরণ্য।

জাতীয় অরণ্যে প্রবেশের চাবি কুলুর সামসিতে। সেখানেই অফিস ওই অরণ্যের ডিরেক্টরের। তো সেই চাবি নিয়ে মানে অনুমতি নিয়ে একটা গাড়ি বাগিয়ে চললাম অরণ্যের দিকে। চোখ ঘুমে ঢুলুঢুলু। একটানা ৪০ ঘণ্টার যাত্রায় ক্লান্তি গ্রাস করেছে শরীর ও মনকে। কিন্তু হিমাচল আমায় ঘুমাতে দেয়নি। গাড়ি চলেছে পাহাড় কাটা রাস্তায়। যার একেকটা বাঁক একেক রকমের ছবি এঁকে চলেছে মানসপটে। অদ্ভুত এখানকার পাহাড়। পদতলে একঝাঁক বড় বড় গাছ পাহাড়কে লুকিয়ে রেখেছে। আর তার খানিক উপরে গাছের চিহ্নমাত্র নেই। শুধু কয়েকগাছি ঘাস পাহাড়কে সবুজ রঙ লাগিয়েছে।

১০-১২ কিলোমিটার যাওয়ার পর পৌঁছলাম অট নামে এক জায়গায়। বেশ জমাটি জায়গা। ড্রাইভার দাদা জানালেন এটাই অরণ্য প্রবেশের আগে শেষ শহর। এখনও যেতে হবে প্রায় ২০ কিলোমিটার। পেটে অনেকক্ষণ থেকেই কয়েকটি ইঁদুর বোধহয় ছোটাছুটি করছিল। এখন কয়েকটা ছুঁচোও এসে ডাকাডাকি শুরু করল। তাই অরণ্য জীবনে প্রবেশের আগে একবার শহুরে পেটভরাট করে নিলাম।

পেটপুরণ হতেই দেখি ড্রাইভার দাদা জোর ধরলেন। যে গাড়ি ৩০ তুলতেই নাভিশ্বাস ফেলছিল সে একেবারে ৭০ এর গতিতে ছুটতে লাগলো। গাড়ি ছুটেছে ঝড়ের গতিতে। আর আমার চোখে শনশনিয়ে বইছে বিপাশা। বলিউডের নয়। তিনি অদ্ভুত যত ভূতের সিনেমা করে গতি হারিয়েছেন। ইনি নদী। স্থানীয়েরা বলেন, বিয়াস। গাড়ি চলেছে বিপাশাকে সঙ্গী করে। সবুজ জলের ধারায় বিপাশা মোহময়ী।

তখন বোধহয় অট থেকে আরও কিলোমিটার চারেক এগিয়ে এসেছি। হঠাৎ-ই বিপাশার রূপ বদল। তার সবুজ জলে অদ্ভুত ঘোলাটে মিশ্রণ। আরও খানিক এগোতেই আরও বেশি অবাক হবার পালা। সবুজ-ঘোলার সঙ্গে নীল মিশে তিন রঙা জলধারা সৃষ্টি করেছে। ড্রাইভার দাদা জানালেন, এখানেই বিপাশার সখী হয়েছে ঘোলাটে পার্বতী আর নীল তীর্থন। আমাদের প্রায় ঘরের কাছেই ত্রিবেণী সঙ্গম। দেখা হয়নি। আক্ষেপও আছে তার জন্য। গঙ্গার ত্রিবেণী না দেখার বেদনা কিছুটা হলেও দূর হয় বিপাশার ত্রিবেণীতে।

ত্রিবেণী সঙ্গম পার করে যখন বন বাংলোয় পৌঁছলাম তখন বিকেল হব হব। গাড়ি থেকে বেরোতেই একবার কেঁপে গেলাম। দিনের চড়া সূর্য আর বন্ধ জানালার কাচ শীতের ছুঁচকে রুদ্ধ করেছিল। তার প্রথম স্পর্শ কাঁপুনি ধরাল। পেলাম হিমালয়ের ঠান্ডার প্রথম অনুভূতি। বন বাংলোটা এক পাহাড়ের কোলে দাঁড়িয়ে। বাংলোর সামনেও পাহাড়। আর এই দুই পাহাড়ের মাঝে তীর্থন নদী। তীর্থনই বয়ে নিয়ে আসছে ওই হিমশীতল হাওয়া।

বন বাংলোয় খানিক বিশ্রামের পর একটু সান্ধ্য ভ্রমণের উদ্দেশ্যে পা দিলাম বনপথে। তীর্থনের ঠান্ডা হাওয়া প্রতি মুহূর্তে জানান দিচ্ছে তার উপস্থিতি। পাহাড় কাটা রাস্তা ধরে এগিয়ে চলেছি। আর নিচে দিয়ে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী তীর্থনের রূপ উপলব্ধি করছি। হঠাৎ দেখি একটি ছেলে জলের ধারে দাঁড়িয়ে। তার এক হাতে ধরা ছোট্ট টিনের কৌটৌ। অন্য হাত দিয়ে কিছু একটা ছুড়ে দিচ্ছে জলে। আবার টিনের কৌটৌয় ঘুরিয়ে তুলে আনছে সেটি। বুঝলাম তীর্থনের বিখ্যাত ট্রাউট ধরায় মশগুল সে।

বন্ধু বাবলার সঙ্গে গ্রামে অনেক রুই-কাতলা গেঁথেছি। বাবলাই আমার মাছ শিকারের গুরু। তার মাছের টোপে থাকে সুজি-ময়দা-বিস্কুট গুঁড়ো-কেশর-ঘি-পাউরুটি-ছাতু ও আরও কতকী। আর এ ব্যাটা একটা টিনের কৌটৌয় সুতো জড়িয়ে, কোনও টোপ ছাড়াই শুধু বঁড়শিতে একের পর এক ট্রাউট তুলে আনছে অবলীলায়। গুরুর প্রতি শ্রদ্ধা কমে গেল একে দেখে।

পাহাড়ের কোলে হঠাৎ করে সন্ধ্যা নামে। এতদিন শুনে এসেছি। আজ উপলব্ধি করলাম। সন্ধ্যা নামার সঙ্গে সঙ্গেই হিমের পরশটাও বেশ বেড়ে গেল। এখানকার অন্ধকার বেশ জমাটি। গ্রামের আলো পৌঁছায় না এখানে। বাংলোয় ফেরা সাব্যস্ত হল।…

সকাল হল অন্যরকম। ঘুম ভাঙল হরেকরকমের কলকাকলিতে। কত শত রকমের পাখি ভিড় জমিয়েছে বাংলোর চারিপাশে। নীল-হলুদ-খয়েরি-সবুজ-লাল কত রকমের। আমার সঙ্গী নিজেকে পক্ষী বিশারদ দাবি করেন। কয়েকজনের নাম শোনালেন ইংরেজিতে-সানবার্ড, ম্যাকপাই, ওয়াগটেল, রবিন আরও কতকী। আমি শুধু দেখেই গেলাম আর শুনলাম তাদের সকালবেলার গান। আহা! এমন সকাল যদি রোজ পেতাম।

মোহের মধ্যে ছিলাম। মোহভঙ্গ হল গৌতমজির ডাকে। গৌতমজি এখানকার ফরেস্ট গার্ড। উনিই আমাদের গাইড হবেন জঙ্গলপথে। তাড়াতাড়ি তৈরি হয়ে বেরিয়ে পড়লাম। যেতে হবে যে অনেক দূর।

(চলবে)

 

 

One thought on “ছুঁয়ে দিলাম তোমায়, হিমালয়— প্রথম পর্ব

Leave a Reply to DEBASIS CHAKRABORTTY Cancel reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *