ভিনদেশি ভ্রমণ

প্রবাসে পরমাদ

স্বরূপ দে

বহু প্রতীক্ষিত “ঘরে ফেরার” সময় প্রায় হয়ে এল। তাই হঠাৎ করে আজ মনে হল এখানে আসা ইস্তক যে অদ্ভুৎ কিছু রীতিনীতি, অভ্যাস বা ঘটনা দেখেছি সেগুলি ফেসবুক-বন্দি করার আইডিয়াটা মন্দ নয়।

এক — খাদ্যাভাস।
আমি কলকাতা থেকে রওনা দিয়েছিলাম ২৪শে জুলাই, ২০১৫ তারিখে। অন্যান্য ব্যাপারে যেমন তেমন, টাইমের ব্যাপারে আমেরিকা ভারতের থেকে প্রায় অর্ধদিবস পিছিয়ে থাকার সুবাদে আমি আমেরিকায় নামি ২৪শে জুলাই সকাল ৮টা নাগাদ – ওয়াশিংটন রাজ্যের সিয়াটেল এয়ারপোর্টে। সৌভাগ্যক্রমে দুবাই থেকে আমার ইকনমি ক্লাসের টিকিট বিজনেস ক্লাসে আপগ্রেড হয়ে যাওয়ায় এমিরেটস সুন্দরীদের আপ্যায়নের সাথে সাথে লোভনীয় খাবার-দাবার প্রচুর মিলেছিল। কিন্তু যত ইউ এস এ এগিয়ে আসছিল লক্ষ্য করছিলাম ব্রেকফাস্ট বা লাঞ্চে ব্রেড বা ভাতের সাথে সাথে প্রচুর কাঁচা শাক-পাতা, সবজি ইত্যাদি পাচ্ছি।

প্রথম প্রথম তো ভাবলাম “এত হাই ফাই ক্লাসে যখন দিচ্ছে তবে তো এ শাক-পাতা সুস্বাদু না হয়ে যায় না”। কিন্তু একবারে অনেকটা শাকপাতা মুখে পুড়ে দিয়ে মোহভঙ্গ হল, বুঝলাম যে কেনার পর জলে ধোওয়া ছাড়া আর কোনও রন্ধনশিল্প তার ওপর প্রযুক্ত হয়নি, এমনকি নুন বা লঙ্কার গুড়োর প্রয়োগও নয়। মানে এককথায় পুরদস্তুর ভার্জিন। যাইহোক, কিছুটা “এত হাইফাই সবকিছুর মধ্যে খাবার এত বাজে হতেই পারেনা, বিশেষ করে এতক্ষণ যখন এত ভাল খাবার দিয়েছে, কাজেই আমারই মনের ভুল হবে” আর কিছুটা “এটা হয়ত বিজনেস ক্লাসের স্পেশাল খাবার, সংশয় প্রকাশ করলে আমার আসল পরিচয়টা প্রকাশ হয়ে যাবে”র ভয়ে চুপ করে রইলাম।

সিয়াটেলে আমার প্রায় ৫ঘন্টা মত লে-ওভার টাইম ছিল। মনে আছে প্রথমবার যখন বাবার সাথে কলকাতা আসি তখন ভাঁড়ের চা আর কচুরি খেয়ে খুব খুশি হয়েছিলাম, কারন আমাদের উত্তরবঙ্গে কচুরি মানে বোঝানো হত খাস্তা কচুরিকে যেটা খানিক সিঙ্গারার মত খেতে আর চা সাধারনত চিনামাটির কাপ, প্লাস্টিকের গেলাস বা শালপাতার কাপে দেওয়া হত। আবার প্রথমবার মুম্বাইতে গিয়ে বড়া-পাও খেয়েও খুব ভাল লেগেছিল (পরে অবশ্য আমাদের হস্টেলের মেস ধারনাটা পালটে দেয়)। আমার ধারণা ছিল, যে দেশ সব বিষয়ে সাড়া বিশ্বের ওপর দাদাগিরি খাটায় সে খাবারের স্বাদে তো আলবাত অনন্য হবে। সিয়াটেল এয়ারপোর্ট এমনিতে খুব একটা বড় নয়, একটু ঘোরাঘুরি করতেই একটা স্টল দেখলাম “Seattle’s best sandwitch and coffee” বলে। হাতে চাঁদ পাওয়ার মত করে এগিয়ে গিয়ে হ্যাম স্যান্ডউইচ অর্ডার করে দিলাম। হাতে যে ঠান্ডা বস্তুটি পেলাম, সিয়াটেলের ঠান্ডায় সেটা খেতে বিশেষ রুচি না থাকলেও মাইক্রোওভেন বা ওই জাতীয় গরম করার কিছু খুঁজতে হবে বা কাউকে জিগ্যেস করতে হবে এই জড়তায় আর “আমেরিকার খাবার এমনিতেই স্বাদে অনন্য হবে” এই ধারণা থাকায় এককোণে বসে আয়েশ করে কামড় মারতেই ফ্লাইটের খাবারের রহস্য পরিস্কার হয়ে গেল। দুটো পাউরুটির মধ্যে একগাদা কাঁচা লেটুস, খানিক পেঁয়াজ, টমাটো এবং এক খন্ড সেদ্ধ হ্যামের পাতলা স্লাইস। কফির মগের ক্ষেত্রেও একই জিনিস।

এখানে সাধারনত কফি বা অন্য কোনো পানীয় চাইলে দোকানদার দাম নিয়ে সংশ্লিষ্ট মাপের গেলাস দিয়ে দেয়, তারপর পানীয়টি মেশিন থেকে নিজের ইচ্ছামত পরিমানে নিয়ে নেওয়ার সুবিধা থাকে। বাঙালি, তাই দুধ-চিনি দিয়ে বানানো গুরুপাক কফি খেয়েই অভ্যাস, কিন্তু এখানকার কফিতে মেশানর জন্য আলাদা করে চিনি ও গুঁড়ো দুধ রাখা থাকলেও তার আন্দাজ না থাকায় সরাসরি চুমুক আর প্রথম চুমুকেই আরেক ছ্যাকা – বিস্বাদ তেতো কফি। এমনিতেই কফি আমার কাছে চায়ের বিকল্প নয়, একান্ত আপদকালীন বিকল্প; তার ওপর অমন কফি! কিন্তু আশেপাশের সহযাত্রীরা দেখলাম ব্ল্যাক কফি সহযোগে ওই ঘাসপাতাই সোল্লাসে খেয়ে চলেছে। এদিকে $5 দিয়ে কেনা খাবার আমেরিকানদের কাছে সুলভ হলেও আমার কাছে প্রায় 350/- টাকার জিনিস অখাদ্য হলেও মূল্যবান।

পরবর্তী দেড় বছরে প্রথমদিনের এই অভিজ্ঞতাই দৃঢ় থেকে দৃঢ়তর হয়েছে। জেনেছি এবং উপলব্ধি করেছি যে আমেরিকানদের নিজস্ব কোনও সংস্কৃতি না থাকার মতই নিজস্ব কোনও খাবারও প্রায় নেই বললেই চলে। তার ওপর এরা যন্ত্রনির্ভর, স্বাস্থ্যসচেতন এবং সময় সংক্ষেপে আগ্রহী হওয়ায় যে কটি নিজস্ব খাবার আছে তার মধ্যে কাঁচা এবং সেদ্ধ এই দুপ্রকার রন্ধনশৈলীর প্রয়োগই সর্বত্র। যা কিছু রান্না করতে নূন্যতম পক্ষে দাঁড়িয়েও থাকতে হয় এরা সেটাও পরিহার করে চলে।.

প্রায় দেড় বছর হয়ে গেল মার্কিন মুলুকে। এই দেড় বছরে এই দেশ সম্পর্কে যা জানলাম, দেখলাম ও উপলব্ধি করলাম, তা লেখার একটা তাগিদ অনেকদিন ধরেই অনুভব করছিলাম।

কাছের কয়েকজন বন্ধুর অনুরোধ আর থ্যাঙ্কস্গিভিং (থ্যাঙ্কস্গি‌ভিং প্রধানত আমেরিকা ও কানাডার একটি সুন্দর উৎসব, এটা নিয়ে আগামী কোনও সংখ্যায় লিখব) এর ছুটির কারনে কেমিক্যালের অর্ডার আসায় বিলম্ব – এই দুয়ের গুঁতোয় শুরুটা অবশেষে করেই ফেললাম। আগের দিন লিখেছি খাদ্যাভ্যাস নিয়ে যা আমেরিকার মাটি ছোঁয়ার আগে থেকেই শুরু হয়েছিল এবং আমায় বেশ খানিকটা হতাশ করেছিল। তবে সেই সাথে আরও একটি জিনিস অনুভব করতে শুরু করেছিলাম ফ্লাইটে থাকতে থাকতেই যেটি আমার এখানকার অন্যতম সুখকর অভিজ্ঞতা এবং আমার মতে সারা বিশ্বের কাছে অনুকরণীয়। তা হল আমেরিকানদের ভদ্রতা ও শিষ্টাচার।

দুইঃ ভদ্রতা ও শিষ্টাচার।

আতিথেয়তার দেশ থেকে আমার আসা। “অতিথি দেবো ভবঃ”র আদর্শে বেড়ে ওঠা আমার ছোটবেলা সাক্ষী থেকেছে মায়ের অমলিন হাসি মুখে অতিথি সৎকারের জন্মলব্ধ ক্ষমতার। আমাদের বাড়িতে আমার মায়ের খাওয়ার সময় ছিল সবসময় সবার পড়ে, ভারতীয় মায়েদের এই বদভ্যাস বোধহয় সর্বকালীন ও সার্বজনীন। এখনকার মত ফোন, মেসেজ অথবা ইমেলে আগে থাকতে জানিয়ে আসা নয়, সত্যিকারের অ-তিথিতে হাজির হওয়া আত্মীয়-বন্ধু সৎকার করতে মায়ের আগে তাকে বসিয়ে বাড়ির গাছ থেকে লেবু এনে লেবুর শরবত, ঘরে রাখা নাড়ু-মুড়ি বা পাশের বাড়ি থেকে চেয়েচিন্তে জোগাড় করে আনা হাঁসের ডিমের অমলেট খাওয়ানো আর তারপর নিজের ভাগের ভাত ও তরিতরকারি দিয়ে তাকে খাইয়ে আবার “আরে আরেকটু ভাত নাও না, এত লজ্জা করে খাচ্ছ কেন?”র অনুযোগ খুবই পরিচিত আমাদের কাছে। আবার বন্ধুর উপকারে কখনও ‘থ্যাঙ্কস’ বললে “শালা বন্ধুকে থ্যাঙ্কস্‌ দিচ্ছে! ভাগ!” যে জুটবে তাও বেশ জানাই থাকে।

এইদিক থেকে কিন্তু আমেরিকানরা সম্পূর্ণ বিপরীত। যে কোনও কিছুর প্রত্যুত্তরে ‘thanks’ বলাটা এখানে শুধুমাত্র রীতি নয়, রক্ষনশীল আমেরিকানরা এ বিষয়ে বেশ সচেতন। তাই রাস্তাঘাটে চলতে অজস্রবার ‘thanks’ যেমন শুনতে পাবেন তেমনই জায়গামতো নিজেও বলার কথা ভুলে গেলে আর কোনও রক্ষনশীল আমেরিকান সেখানে উপস্থিত থাকলে মনেও করিয়ে দিতে পারেন। এয়ারহস্টেজরা তো এমনিতেই অমায়িক স্বভাবের হয়, তাই প্রত্যেকবার মাথার ওপর সুইচ টিপলেই এসে অমায়িক ভাবে সার্ভিস দিয়ে ফিরে যাওয়ার সময় তাদের ‘thanks’ গুলো ততটা অস্বাভাবিক ঠেকেনি।

কিন্তু সিয়াটেলে নামার পর থেকেই ইমিগ্রেশন দপ্তরের রাশভারী পুলিশ অফিসার থেকে শুরু করে পথচলতি লোকজন, দোকানদার প্রত্যেকেই যখন ‘thank you’, ‘you are welcome’ ইত্যাদি শব্দগুলো ব্যবহার করছিল সেগুলো তাদের চিরাচরিত অভ্যাসবশত হলেও কেমন যেন একটা উষ্ণতার ছোঁয়া পাচ্ছিলাম তাতে। ছোট থেকে ইতিহাসে পড়েছি ইংরেজদের সম্পর্কে, কালো চামড়ার ভারতীয়দের তারা কিভাবে লাঞ্ছিত, অপমানিত করত তার বিবরণ শুনেছি, দেখেছি সর্বত্র। তাছাড়াও মাঝে মাঝেই বর্ণবিদ্বেষের টুকরোটাকরা যা খবর পড়তাম তাতে আমেরিকা সম্পর্কে সত্যিই অনেক ভয়মিশ্রিত সংশয় ছিল। গ্রাম থেকে শহরে পড়তে যাওয়ার সুবাদে অথবা উত্তরবঙ্গের প্রত্যন্ত জায়গা থেকে মহানগরে পা রাখার সুবাদে নাকউঁচু টিটকিরি জীবনে অনেক সইতে হয়েছে। আর এ তো তৃতীয়বিশ্বের উন্নয়নশীল দেশ থেকে একবারে প্রথমবিশ্বের সুপার পাওয়ারের চৌকাঠে পৌঁছে যাওয়া। কিন্তু আমার এই দেড় বছরের অভিজ্ঞতায় যা দেখেছি তাতে আমার উপলব্ধি – আমেরিকানদের মত মিশুকে, অমায়িক আর বন্ধুবৎসল জাতি পৃথিবীতে খুব কমই আছে। নিজস্ব সংস্কারের গোঁড়ামি না থাকার কারনেই হোক বা এদের বিশ্বখ্যাত উদারপন্থার কারণেই হোক এদের গ্রহন করার ক্ষমতা অসামান্য।

সিয়াটেল থেকে ফিনিক্সের ফ্লাইটেই স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে আলাপ জমালেন এক ভদ্রলোক, তার নামটা এখন আর মনে নেই। মাত্র ২২ বছর বয়সে আমি পি এইচ ডি করার জন্য সম্পূর্ণ অন্য একটি দেশে এসেছি এই নিয়ে তার বিস্ময়ের শেষ নেই। আলাপ শেষে একেবারে সটান নিজের ফোন নম্বর, বাড়ির ঠিকানা দিয়ে বললেন যে কোন সময় ঘরোয়া পরিবেশের অভাব বোধ করলেই যেন সটান ফোন করে ওর বাড়িতে চলে আসি। ভেবেছিলাম হয়ত ভদ্রতার খাতিরে বলছেন, আসলে হয়ত পড়ে মনে রাখবেন না। মনে আছে এখানকার লোকাল সিম নেওয়ার পর যখন সেই ভদ্রলোককে মেসেজ করেছিলাম তিনি শুধু রিপ্লাইই করেননি, সত্যিই কাছের লোকের মত জানতে চেয়েছিলেন ক্লাস কেমন চলছে, মানিয়ে নিতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে কিনা।

যাইহোক এয়ারপোর্ট থেকে দুই রুমমেট দাদা – বালা দা আর মানস দার সাথে সাথে সুদীপ্ত দাও বেশ আন্তরিক অভ্যর্থনায় বাড়িতে নিয়ে এসেছিল। বালা দা আমাকে প্রথমদিন ডিপার্ট্মেন্টে পৌঁছে দেওয়ার সময় যখন বলেছিল যে, “এখানে কিন্তু কোনও দরজা খুলে ঢোকার বা বেরনোর সময় পেছনে কাউকে আসতে দেখলে দরজা খুলে দাঁড়ানোর নিয়ম”, আমার বেশ অদ্ভৎ লেগেছিল। কিন্তু পরে দেখলাম সত্যিই এরা চরম ব্যস্ততার সময়েও দরজা খুলে ঢোকা বা বেরনোর সময় পেছনে কাউকে আসতে দেখলে যেমন হাসিমুখে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে থাকে তেমনই অন্যজন তাকে হাসিমুখে ‘thank you’ আর তার প্রত্যুত্তরে প্রথমব্যক্তি একদম সুর করে ‘you are welcome’ জানাতে ভুল করে না। দৈনন্দিন অভ্যাসের মধ্যে যদি এরকম টুকরো টুকরো সহমর্মিতা আর ভাল লাগার রংতুলি বুলিয়ে দেওয়া যায় তো মন্দ কি?

প্রথমদিন বালাদা’র সাথে যাওয়ার পর দ্বিতীয়দিন আমার নিজে নিজে চিনে ডিপার্টমেন্টে যাওয়ার পালা। তো সকাল সকাল হেঁটে হেঁটে যাচ্ছি, দেখি রাস্তায় এক ভদ্রমহিলা আমার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন। আমি তো অবাক, প্রথমে আশপাশ, পেছন ঘুরে একবার দেখে নিলাম, তারপর ভদ্রমহিলা আমাকে উদ্দ্যেশ্য করেই হেসেছেন বুঝে নিজের জামা, প্যান্ট (এমনকি চেন খোলা আছে কিনা তাও চেক করেছিলাম পাশ কাটিয়ে যাওয়ার পর 😀 ) চেক করেও কিছুতেই বুঝলাম না হাসির কারণ। উপরন্তু ভদ্রমহিলার হাসি মোটেই তাচ্ছিল্যসূচক ছিল না, আর কোনওভাবেই ওনাকে চিনি মনে করতে না পাড়ায় সারাদিন মনটা খচখচ করছিল। সন্ধ্যেতে মানস দা’কে জিজ্ঞেস করতে ও বলল, “এখানে যে কারো চোখে চোখ পড়ে গেলেই হেসে ঘাড় নাড়াটা একটা শিষ্টাচার।”

পরে সবসময়ই লক্ষ্য করেছি আমরা সাধারনত পরিচিত কারো সাথে দেখা হলে যেমন হেসে “কেমন আছেন? সব ঠিকঠাক তো” বলে কুশল বিনিময় করি, আমেরিকান রা পরিচিত-অপরিচিত নির্বিশেষে হেসে, “Hey! How’s it going/how are you doing” এবং প্রত্যুত্তরে “great! what about you?” এর মাধ্যমে কুশল বিনিময় করে থাকে। এই যে পরিচিতি নির্বিশেষে সবাইকে আপন করে নেওয়ার রীতি তা বোধকরি আমেরিকানদের মজ্জাগত। আর এই গ্রহনের অকুন্ঠ ক্ষমতাই বোধহয় তাদের সারা বিশ্বের এক সারমর্ম সংস্কৃতি ও মেধার ভাণ্ডার আহরণে সহায়তা করেছে।

খাদ্য ও বাসস্থানের চেয়ে বেশি না হলেও সমাজবদ্ধ জীব মানুষের কাছে জীবনধারণের জন্য ভাষা এবং আদবকায়দার গুরুত্ব কিছু কম নয়। গ্লোবালাইজেশনের যুগে (যদিও ডোনাল্ড ট্রাম্প আস্ফালিত, ব্রেক্সিট মধুরিত যুগে গ্লোবালাইজেশন কথাটা ঠাকুমার ঝুলিতে যেতে আর বেশিদিন নেই) ভাষা, বিশেষ করে ইংরেজি ভাষা ব্যাপারটা এখন আর খুব বড় সমস্যা নয়। ছোটবেলা থেকে ইংরেজিতে বিশেষ সুবিধা করতে না পারলেও ফেসবুক, গুগল আর কিঞ্চিৎ (?) জি.আর.ই- টোয়েফেলের গুঁতোয় আমেরিকাগামী ভারতীয়দের কাজ চালানোর মত ইংরেজি জ্ঞানের অভাব থাকে না।

কিন্তু গোল বাধে আদবকায়দার ক্ষেত্রে। ভাষা, খাবার, পোশাক, বিদেশনীতি, শিক্ষানীতি, অর্থনীতি, সমরনীতি এমনকি বিবাহনীতি (ফেসবুকে বাবাও আজকাল পোস্টে লাইক-কমেন্ট করে, তাই এর থেকে বেশি গভীরে আর গেলাম না  😀 ) পর্যন্ত গ্লোবালাইজ্‌ড হয়ে গেলেও, গোলমেলে বলেই হোক বা Google Translator এর মত Google Habits বলে কিছু নেই বলেই হোক এই আদবকায়দা বিষয়টার বিশ্বায়ন এখনও বিশ বাঁওয়ের থেকেও বেশি জলে বলেই আন্দাজ।

বাড়ি থেকে এখানে আসার সময় এই বিষয়টা সম্পর্কেও কোনও ধারণা ছিল না, আর গত একবছর ধরে প্রতি পদে পদে না হলেও মাঝেমধ্যেই হোঁচট খেয়ে খেয়ে যে অভিজ্ঞতা হয়েছে USA Diaries এর তৃতীয় সংখ্যায় সেটা ভাগ করার চেষ্টা করছি। কোথায় একটা যেন পড়েছিলাম যে স্মৃতি নাকি সবসময় সুমধুর হয়, কারণ আমাদের মন খারাপ জিনিসগুলোকে সঞ্চয় করে রাখতে চায় না। তাই অনেক অম্লমধুর ঘটনা হয়ত এখানে এড়িয়ে যেতে পারি, কেউ মনে করিয়ে দিলে বা পড়ে মনে পড়লে অন্তর্ভুক্ত করব কথা দিলাম।

।।তিনঃ মেশামেশির ফাঁকফোকর

আগেই বলেছি আদবকায়দার তারতম্যে এই দেড় বছর সময়কালে হোঁচট খেয়েছি অনেক, আর সেই থেকেই শিখেছি – খানিকটা নিজের পরবর্তী অভিজ্ঞতার যুক্তিসম্মত বিশ্লেষণ আর খানিকটা জিজ্ঞাসা করে। সবচেয়ে বেশি অসুবিধার সম্মুখীন হয়েছিলাম ফার্স্ট সেমেস্টারে ল্যাব TA করতে গিয়ে ছাত্রদের থেকে।

দাদাদের অভিজ্ঞতা শুনে এবং এবছরের জুনিয়রদের দেখে মোটামুটি এই ব্যাপারটা বুঝে গেছি যে যত চালাকচতুর ছেলে-মেয়েই হোক না কেন ফার্স্ট সেমেস্টারে ল্যাব TA করতে যথেষ্টই বেগ পেতে হয় (যারা TA বিষয়টার সঙ্গে পরিচিত নয় তাদের বলে দিই – ভারতের মত এখানে পি এইচ ডির ছাত্রদের ‘সাম্মানিক’ কেন্দ্রীয় সরকার দ্বারা সরাসরি প্রদত্ত হয় না, হয় তাদেরকে undergraduate (B.Sc) ছাত্রদের Teaching Assitant (TA) হিসেবে পড়িয়ে ইউনিভার্সিটি থেকে ‘বেতন’ নিতে হয় অথবা ভাগ্যবান হলে, রিসার্চ গাইডের পর্যাপ্ত ফান্ডিং এবং উদারতা থাকলে Research Assitant (RA) হিসেবে গাইডের থেকেই বেতন পাওয়ার সৌভাগ্য হয়। ভারতের আই আই টি গুলোতে TA সিস্টেমটা চালু থাকলেও তা টাকার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত না হওয়ায় এখানকার মত বাধ্যতামূলক নয়)।

তবে আমার ক্ষেত্রে এই বেগের প্রাবল্যটা ছিল আরও অনেকগুন বেশি। কারণ আমি যে কোর্সটার ল্যাব করাতাম সেটার ছাত্র যারা ছিল তাদের কাছে এই কোর্সটা কলেজে ঢুকেই প্রথম কোর্স হওয়ায় আমার মত তাদের কাছেও অ্যারিজোনা স্টেট ইউনিভার্সিটি আর তার নিয়মকানুন ব্যাপারটা মঙ্গলযানের মত বস্তুই ছিল। তার মধ্যে তাদের অবস্থা খানিকটা সায়েন্স গ্রুপে ২৫% মার্কস পেয়ে নেতৃস্থানীয় পিতৃদেবের ডোনেশনের জোরে মেডিক্যালে ভর্তি হয়ে যাওয়ার মতই ছিল (বিশদে লিখব ‘শিক্ষা’ সংখ্যায়)। সেমেস্টারের প্রথম অর্ধে এই উভয়ত অনভিজ্ঞতার সাথে সাথে গোঁদের ওপর বিষফোঁড়ার মত যোগ হয়েছিল এই Error 404 অর্থাৎ আদবকায়দার পার্থক্যজনিত কারনে ভুল বোঝাবুঝি ও সমন্বয়ের অভাব। ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা এবং কিছুটা শোনা কথা ও ইন্টারনেট থেকে সংকলিত কিছু উদাহারণের মাধ্যমে ব্যাপারটা তুলে ধরার চেষ্টা করছি।

১। একই শব্দের আলাদা অর্থ/উচ্চারণঃ এই সমস্যাটার সম্মুখীন বোধহয় বেশিরভাগ বিদেশি বিশেষ করে সব ভারতীয়ই হয়েছে কখনও না কখনও। কখনও একই ইংরেজি শব্দের সম্পূর্ন আলাদা মানে কখনও আপাত-সঠিক ভারতীয় উচ্চারণের কারণে আমেরিকানদের বোধগম্য না হওয়া এই দুইয়ের ঠেলার অভিজ্ঞতা না হলে বিরক্তির পরিমাণটা ঠিক বলে বোঝানো যাবে না হয়ত।

উদাহারণ এক। Scale

আমরা ভারতে দৈর্ঘ্য মাপার রুলার দন্ডকে সাধারণত স্কেল বলে থাকি। তো শুরুর দিকের একদিন ল্যাবে আমার নিমোক্ত কথোপকথন হয়-

Student: “So you said we have to weigh the chemicals. Are we supposed to use the scales over there?”

Me: “Wait! How can you weigh something by a scale? You’ve to use the balance right? Let me show you.” তারপর তুলাযন্ত্র দেখিয়ে – “Go ahead and measure there”

Student 1 & 2 (two more joins them): “Ya so that’s what! You are the one to create confusion”

বুঝলাম স্কেল মানে এরা তুলাযন্ত্র বা দাঁড়িপাল্লাকে বুঝিয়ে থাকে। এখানকার ব্যবস্থায় শিক্ষক মোটেই ছাত্রের গুরু-ফুরু নয়, বরং শিক্ষককেই ছাত্রের কাছে হাতজোড় করে থাকতে হয়। কোনওমতে “I just wanted to show you and make sure” বলে চাপা দেওয়ার চেষ্টা করতে হল অগত্যা।

উদাহারণ দুই। Soft copy

এবারের ঘটনাটা অনেকবেশি বোধবুদ্ধিসম্পন্ন লোকের সাথে হওয়ায় অপ্রস্তুত তো লেগেছিল কিন্তু আগেরবারের মত অতটা নয়।

আমরা সাধারণত ভারতে কাগজের দস্তাবেজকে “Hard copy” ও তার ডিজিটাল ভার্সনকে ‘Soft copy’ বলে থাকতাম। তো ল্যাব রিপোর্ট ‘Hard copy’ হিসেবে জমা দেওয়া যাবে না এই ছিল নিয়ম।

বারবার ঘোষণা করার পরেও এক ছাত্রীর ধন্দ থেকে যাওয়ায় সে ক্লাসের পর জিজ্ঞেস করে,- “So how do you want us to submit the report then?”

আমি বললাম যে “As I told, hard copies won’t be accepted, so, obviously you should submit the soft copy.”

Student: “Wait! What’s soft copy? You mean electronic copy?”

সৌভাগ্যক্রমে ‘electronic copy’ নামটাও জানা ছিল তাই সেই ছাত্রী জানেনা ভেবে তাকে ‘Yes’ বলে বিদায় দিলাম।

প্রত্যেক সপ্তাহে ক্লাসে কি কি পড়ানো হবে এবং কিভাবে পড়ানো হবে তা আলোচনার জন্য TA এবং সংশ্লিষ্ট কোর্সের প্রধান Instructor বা শিক্ষক এবং TA co-ordinator সবাই এক জায়গায় জড়ো হয়ে আলোচনা করা হয় যার পোশাকি নাম TA meeting. এই TA meeting এ সাধারণত ছাত্রছাত্রীরা কোন্‌ কোন্‌ জায়গায় ভুল করতে পারে সেটা নিয়ে co-ordinator এবং Instructor রা TA দের অবহিত করে থাকে।

সেই সময় ছাত্রছাত্রীরা কি অতি সাধারন সব ভুল করে থাকে এই প্রসঙ্গে আলোচনাচক্রে আমি আমার ছাত্ররা যে অনেকে ‘soft copy; নামটাও জানেনা এটা বলে অংশগ্রহণের চেষ্টা করতেই যখন শুনলাম “Actually we call that electronic copy” নিজের ওপর রাগ করব না আমেরিকানদের ওপর রাগ করব নাকি যার মুখ থেকে প্রথম soft copy শব্দটা শুনেছিলাম সেই সায়নের ওপর রাগ করব ঠিক করে উঠতে পারছিলাম না।

উদাহারণ তিন। Rubber

আমরা পেন্সিলের দাগ মোছার জন্য যা ব্যবহার করে থাকি তাকে রবার বলে থাকি। আই আই টিতে পড়ার সময় ইরেজার শব্দটি ব্যবহার করলেও রাবার কথাটার ব্যবহারও করেছি। এখানে ল্যাবে একদিন একটি গ্রুপকে এক্সপেরিমেন্ট করার সময়কার নোট নেওয়ার খাতায় কলমের পরিবর্তে পেন্সিল ব্যবহার করার সাজেশন দিতে গিয়ে “I’d recommend not to use pen and use pencil because you can use a rubber and correct it later if you use pencil” বলতেই দেখি ছাত্রীরা তো বটেই ছাত্ররাও অনেকে মুখ টিপে হাসছে। তবে ততদিনে আমার বন্ধুস্থানীয় কিছু ছাত্র তৈরি হয়ে গেছে, তাদেরই একজন, ইথান সলোমন এগিয়ে এসে বলল, “Oh Swarup I know you meant an eraser but we use the term rubber for condoms.”

উদাহারণ চার। Printer

ভারতীয় তথা অন্যান্য বিদেশিদের, এমনকি ব্রিটিশদেরও কথায় টান আছে এটা বোঝাতে গিয়ে আমেরিকানরা যে বাক্য ব্যবহার করে তা’র আক্ষরিক অর্থ খুবই অদ্ভুৎ – “দে হ্যাভ অ্যান আক্সেন্ট” মানে ভাবটা এমন যেন ভগবান বলে দিয়েছেন যে ওদেরটাই আসল আর বাকি গুলো সব “আক্সেন্ট”, এমনকি English দের টাও। এই উচ্চারণের তারতম্যের কারনে বেশিরভাগ জায়গাতেই অসুবিধা না হলেও কিছু কিছু জায়গায় মারাত্মক অসুবিধার সম্মুখীন হতে হয়।

যেমন printer কে প্রিন্টার internet কে ইন্টারনেট উচ্চারণ করেই আমরা অভ্যস্ত, কিন্তু আমেরিকান অ্যাকসেন্টে printer হল ‘প্রিনাড়’ (ড় টাও খুব গুরুত্বপূর্ন, মানে R টাকে তালু বা মূর্ধাতে জড়িয়ে না বললে এরা অনেকসময়ই বুঝতে পারে না) internet হল ‘ইনড়ন্যাট’। তো একবার ল্যাবের ঠিক আগে দ্রুত কিছু প্রিন্ট করানো দরকার ছিল। আমি অফিসে গিয়ে দায়িত্বে থাকা ভদ্রমহিলাকে যতবারই বলি “ক্যান আই ইউস দ্য প্রিন্টার?” ততবারই সে বলে “ইউজ দ্য হোয়াট?” এদিকে ল্যাবের সময় পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে অবশেষে কাগজ বের করে বড় করে লিখলাম “CAN I USE THE PRINTER?” সে তখন বলে “Oh! I see! So you wanna use the প্রিনাড়’. আমি তখন মনে মনে বলছিলাম, “তোর বাবার…” এখানে লেখা না গেলেও পরবর্তী শব্দটি ‘ড়’ দিয়েই শেষ হয়।

উদাহারণ পাঁচ। Rest room

সিয়াটেলে নেমে ৩-৪ ঘন্টা লে ওভার কাটানোর জন্য ওয়েটিং রুম জাতীয় কিছু একটা খুঁজছিলাম। তা ঘুরতে ঘুরতে হঠাৎ চোখে পড়ল “Rest Room” যার আবার তিনরকম ভাগ- “Gents”, “Ladies” আর “Family Restroom.” ভাবলাম Gents টায় তো যেতেই পারি, কিন্তু Family Restroom টা বোধহয় পুরো ফ্যামিলি নিয়ে আরাম করার, কাজেই ফার্স্টক্লাস ওয়েটিং রুম জাতীয় হবে হয়ত। এই ভেবে বেশ আয়েশ করে ঢুকে পড়তেই দেখি এক মা তার বাচ্চার প্রাতঃকৃত্য সম্পন্ন করাচ্ছে এবং আমাকে একা একা ঢুকে পড়তে দেখে বেশ অসন্তুষ্ট। কিছু বলার আগেই সরি বলে বেরিয়ে আসলাম আর অনুভব করলাম যে Rest Room এখানে বিশ্রামাগার নয়, শৌচাগারের নাম।

উদাহারন ছয়। ফুটবলঃ

“সব খেলার সেরা বাঙালির তুমি ফুটবল?” ওহে ওসব ভুলে যান। সারা পৃথিবী যাকে ফুটবল বলে চেনে তাকে এরা ডাকেন সকার বলে। আর ফুটবল বলে গুঁতোগুঁতির যে খেলা এদের সবচেয়ে জনপ্রিয় তার সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত অঙ্গ হল হাত ও মাথা। দৌড়ানো ছাড়া পায়ের ব্যবহার নেই, অথচ তার নাম কেন ফুটবল তা বিশ্বাস করুন আমার এখনও মাথায় ঢোকেনি, খেলাটাও যে খুব ভাল বুঝি তাও নয়। তবে বিশেষ রুচি নেই।

উদাহারন সাত। Gum

আমাদের ল্যাবের Business Operation Manger মিস জেনেটের অভ্যাস সারাক্ষণ মুখে চিউইং গাম নিয়ে চিবানো। ওটা না করলে নাকি ওর কাজে মন বসে না। তো একদিন জেনেট সকালবেলা ‘যথেষ্ট’ পরিমাণ চিউইং গামের সম্ভার নিয়ে আসতে ভুলে যাওয়ায় দুপুর নাগাদ জাবর কাটার স্টক ফুরিয়ে যায়। বাইরে বেরোলে দেরি হয়ে যাওয়ার ভয়ে আমাদের এক বাঙ্গালী দাদাকে বলতে আসে, Hey Palash! Do you have some Gums?”

দাদার উত্তরঃ “No, but I have cello tape. Will that work?” 😀 😀

২। উচ্চারন ও ভাষার সরলীকরণঃ

ইংরেজি যে সমৃদ্ধতম ভাষা আমেরিকানদের ইংরেজি শুনলে তাতে সন্দেহ জাগতে বাধ্য। তাই কোনও বিশেষ স্বরবর্ণ বা ব্যঞ্জনবর্ণের সর্বত্র প্রায় একই উচ্চারণ করে থাকে। তাই Semi-র উচ্চারণ এখানে সেমাই, Anti-র উচ্চারণ অ্যান্টাই, Multi-র উচ্চারণ মাল্টাই। সবচেয়ে অদ্ভুৎ হল এদের অব্যাকরণসম্মত, সরলীকৃত ইংরেজির ব্যবহার এবং তাকেই সঠিক বলে দাবি করা। ছোটবেলায় শিখেছিলাম যে Infintive ‘to’ এর পর verb এর present participate অর্থাৎ -ing রূপ ব্যবহৃত হয় না, সেই কারণেই “We want to achieve this” কখনও “We want to achieving this” হয় না। এই ভুল এখানকার লোককে বলার সময় তো বটেই, অফিসিয়াল ইমেল বা এমনকী সায়েন্স জার্নালেও লিখতে দেখেছি। তারপর ভবিষ্যৎ সূচক ‘be verb’ এর হিসেব সরল করার জন্য Shall এর ব্যবহার তুলেই দিয়েছে, কিন্তু Will এর সাথে সাথে Shall কেও যে be verb হিসেবে ব্যবহার করা ব্যাকরণ সম্মত তা অনেকেই মানতে চায় না দেখেছি।

৩। শৌচকর্মঃ

আমাদের গ্রাম থেকে অনেকে ভুটানে কাজ করতে যেত। প্রভাস কাকুর কাছে একবার শুনেছিলাম যে ভুটানে শীতের দিনে জলের খুব সংকট থাকে বলে শৌচকর্মের পর ইয়ে মানে কাগজ ব্যবহার করতে হয়। বলেছিলাম “এ বাবা! আমি কখনও যাব না এরকম বাজে জায়গায়।” যে দেশ সারা বিশ্ব থেকে যেনতেন প্রকারেন তেল, সোনা, খনিজ এনে নিজের দেশ বোঝাই করে, যে কলরাডো নদীর ওপর নেভাদার হুভার ড্যামের মত অজস্র অমানবিক বাঁধ তৈরি করে নদীর গতিপথ ঘুরিয়ে মরুরাজ্য অ্যারিজোনায় গ্রীষ্মের বিকেলে এত জলের ফোয়ারা ছোটায় যে সেই কলোরাডো যখন ক্লান্ত কলেবরে মেক্সিকোর উঠানে হাজির হয় তার দেবার মত আর কিছু অবশেষ থাকে না – সেই দেশে আর যাই হোক ভুটানের মত জলের অভাব যে নেই তা তো স্পষ্ট।

তবে হাইজিনের পরাকাষ্ঠা আমেরিকানরা যে ঠিক কি যুক্তিতে সুলভ ও স্বাস্থ্যসম্মত মাধ্যম জলের পরিবর্তে টিস্যু পেপার ব্যবহার করে তা আমি এখনও বুঝে উঠতে পারি নি। শুধু ল্যাব বা ডিপার্ট্মেন্ট থেকে যখন বাড়ি আসা সম্ভব হয় না তখন পুরো জাতিটার গুষ্ঠি উদ্ধার আর ভারতে নিয়ে গিয়ে কখনও না কখনও এদের কাউকে অসুবিধায় ফেলে “this is what we do” বলব এই ভেবে মন ঠান্ডা করি। তবে মোটের ওপর যা আন্দাজ করেছি তা হল এরা জলের সঙ্গে জড়িত বা ভেজা সব কিছুকেই নোংরা অতএব ব্রাত্য মনে করে আর সেটাই বোধহয় এই জলাতঙ্কের কারণ।

৪। সম্মান প্রদর্শনঃ

পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করা তো দূরের ব্যাপার কারও সম্মানে উঠে দাঁড়াতে পর্যন্ত এদের আলস্য। একবার একটি ভিডিওতে দেখেছিলাম যে এক রেস্তেরায় রাষ্ট্রপতি ওবামা হঠাৎ কোনও কারণে হঠাৎ হাজির হয়ে সবার সাথে হাত মেলাচ্ছেন। ওবামা সাহেব পুরো রেস্তেরায় ঘুরে ঘুরে সবার সাথে হাত মেলালেন কিন্তু একটিবারের জন্য কাউকে উঠে দাঁড়িয়ে সম্মান জানাতে দেখলাম না।

শুধু তাই নয়, যদি কখনও কোথাও বসে থাকেন আর আপনার সাথে কথা বলতে বলতেই টেবিলে আপনার উলটোদিকে বসে থাকা ব্যক্তি পা তুলে দেন, আপনাকে বুঝে নিতে হবে যে সে ব্যক্তি নিতান্তই অভ্যাসবশে তা করেছেন, আপনাকে অসম্মান প্রদর্শনের অভিপ্রায়ে নয়।

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *