জলযাত্রা

হেনরি সাহেব, লালমোহন, গুরুপদ এবং একটি সৈকতের গল্প

সৌমিত্র সেন

এক টাকা?

বিশ্বের বিস্ময় নিয়ে তাকালাম মাঝির দিকে।

এদিকে সামান্যতমও বিস্মিত না-হয়ে মাঝি ঝপাং করে লগি ফেলার শব্দে বললেন, হ্যাঁ, এক টাকা। ঘাটে নেমে আর এক টাকা দিয়ে দেবেন।

বলে কী লোকটা! এ ঘোর দুনিয়ায় এখনও এক টাকায় একটা আস্ত নদী পেরিয়ে যাওয়া যায়?

পেরলাম তো!

স্ত্রী-কন্যা-বন্ধু সমভিব্যাহারে জনপ্রতি এক টাকার চুক্তিতে পেরনো গেল হাতানিয়া-দোয়ানিয়া। মাথার ওপর শরতের আকাশ কিন্তু সঙ্গে ভাদ্রের বৃষ্টিনেশাভরা মেঘ ও ছায়া। চাপা গরমের মধ্যেও ঝিরিঝিরি হাওয়া।

চলেছি হেনরি সাহেবের দ্বীপে। বাসস্ট্যান্ড থেকে একটি শব্দযন্ত্রণাহীন গাড়ি ‘বুক’ করেছি। টোটো। কিন্তু তাঁকে বলাই রয়েছে, টো টো করে না ঘুরে যথাসম্ভব দ্রুত তিনি যেন আমাদের গন্তব্যে পৌঁছে দেন। সঙ্গে বাচ্চা রয়েছে। তার স্নান-খাওয়ার সময়ের দেরি হয়ে যাবে। যতই হোক, ছা-পোষা গৃহস্থ আগে তো তার ছা-য়ের কথাই ভাববে। দলে ছা মোট দু’টি। একটি আমার, অন্যটি বন্ধুর।

খুব সকালেই কলকাতা থেকে বেরনো গেছিল। শিয়ালদায় এসে টিকিট কেটে ট্রেনে উঠতে বিপত্তি কিছু ঘটেনি। ট্রেনও ছেড়েওছিল ঠিক সময়ে। কিন্তু ভিড় বেজায়। ট্রেনে বসেই ব্রেকফাস্ট করার কথা। এদিকে ভিড়ের চাপে সে সুযোগই মেলে না। যাই হোক, লক্ষ্মীকান্তপুর পেরনোর পরে কামরা একটু ফাঁকা হল। সেই অবসরে আমরাও জরুরি কাজটি সেরে নিলাম।

অবশেষে নামখানা। স্টেশনের বাইরে গিয়ে টোটো। সেটি চেপে নদীঘাট। নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছে একটি পাটা রিক্সা। সেটি চেপে বাসস্ট্যান্ড। সেই বাসস্ট্যান্ড থেকেই ফাইনালি টোটো ‘বুক’ করে আমরা হেনরি পৌঁছই। বড় খাটুনির যাত্রাপথ। কিন্তু মজারও।

সেই বাঁশের সাঁকো।

ফিশারিজের অফিসে কাগজপত্র দর্শিয়ে, (আপনাকে আপনি চিনিনে কিন্তু) পরিচয়পত্র-সহযোগে এঁদের কাছে নিজেকে চিনিয়ে, সইসাবুদ করে, ঘর-টর পাকড়ে তারপর সমুদ্র। ‘সুন্দরী’ গেস্ট হাউস থেকে একটিই সংকীর্ণ পথ সোজা সমুদ্রে। ইট-পাতা রাস্তা ধরে খাল-বিলের দিকে যাওয়া যায় বলেই বরাবর জানতাম। পাশাপাশি দু’জন চলা যায় না এমন পথটিকে জাপটে ঘিরে রয়েছে নানা গাছ-গাছালি (পরে জানব যে, সেখানে গরান, বানি, হেতাল আর কাঁটাবাবলার সাম্রাজ্য)। সেখানে সমুদ্রের জল ঢোকে। নোনতা সেই কাদাজলে মেলে হরেক কাঁকড়া, চিংড়ি। এহেন ইট-পথ একসময় শেষ হয়, একেবারেই বিশ্বাস রাখা যায় না, এমন একটি ভয়ানকদর্শন বাঁশের সাঁকোয়। কোনওক্রমে (কিন্তু সাঁকোটি মোটামুটি মজবুতই এবং বাকি দু’দিন বেশ ক’বার ওই পথেই দিব্যি সাগরপানে যাওয়া গেছিল) সেটি পার হওয়া গেল। সাঁকো পেরিয়ে খানিক হেঁটে গেলেই এক আশ্চর্য দৃশ্য!

চোখ-জুড়নো। মন-ভোলানো। গাছপালার ক্যানোপি’র মধ্যে দিয়ে দেখা যাচ্ছে দশ টাকার কয়েনের মতো গোল চকচকে সমুদ্র। চঞ্চল হয়ে উঠলাম। বাঃ! এই না হলে ট্যুরিস্ট স্পট! এত কষ্ট করে আসা তবে তো সার্থক!

কিন্তু তখন ভাটা চলছে। সমুদ্র দূরে। বিশাল উঠোনের এককোণে উনুনে দুধ জ্বাল দেওয়া হচ্ছে আর দুধের ফেনা উথলে উঠছে— দেখতে যেমন লাগে, ঠিক তেমনই লাগছে দূরের ঢেউয়ের মাথার ফেনার সরগুলিকে। সেই দূরের সমুদ্রের সামনে কোরা শাড়ির মতো পড়ে রয়েছে কাছের এক নদী। খাঁড়ির মতো। সেখানে হু হু করে জল বইছে। সৈকতের কোথাও কেউ নেই! খাঁ খাঁ চারদিক। দু’একটি পাখি শুধু। আর দূরে দূরে কিছু সবুজ ছোপ। ব্যস! এই অতি সামান্য আয়োজনে দু’টি বাচ্চাকে নিয়ে খরস্রোতা খাঁড়ি পেরিয়ে সমুদ্রের কাছে যাওয়ার সাহস দেখালাম না আর। কিন্তু স্নান আমাদের মন্দ হল না।

ফিরে এসে খাওয়া। এবং বিশ্রাম। তার পরেই একখানি মনোমুগ্ধকর বিকেল। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিমাখা সন্ধ্যা। চারিদিকে শুধু গাছ আর গাছ। আর বড় বড় ভেড়ি। দু’একটি মানুষের গুঞ্জন ব্যতিরেকে কোত্থাও কোনও শব্দ নেই। ‘সুন্দরী’তে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা মোটামুটি মন্দ না। রাতের খাওয়া সেরে ওই নির্বান্ধবপুরীতে, ওই ঘন অন্ধকারের পরতে (বিদ্যুৎসংযোগ রয়েছে যদিও, কিন্তু সন্ধে সাতটার পর দূরে হাঁটা-চলা নিষিদ্ধ), ওই বর্ষাস্নিগ্ধ রাত্রির কনসার্টে নিজের মধ্যে নিজে ডুবে যাওয়া চলে, বেশিক্ষণ গল্প-টল্প করে নিশিজাগরণ চলে না। ফলত একটি সুখনিদ্রা।

এবং পরের দিনের গোলাপি-নীল ভোরটি একটি মধুর সমুদ্রযাপন। সেই নড়বড়ে সাঁকো, সেই রোগা পথ, সেই আঙুলের কাছে কাঁকড়ার চলাচল, সেই গায়ে-লেগে-যাওয়া গাছপালা। আর তার পরই অনন্ত আকাশ, অফুরন্ত জল, অনিঃশেষ আলো আমার আলো। মোহানার দিকে হাঁটতে থাকলাম। বালির ওপর গরান গাছ। দশ-বিশটি গাছ এক-একটি জায়গায় শিবির পেতেছে। তারপর আবার বালি। ভিজে বালির ওপর হেঁটে বেড়াচ্ছে লাল কাঁকড়া। গরু। গরুগুলি সৈকতের ওপরের অংশে ঘোরাফেরা করছে। সেইখানেই জাল ঘাড়ে লালমোহন দাসের সঙ্গে দেখা।

মাছ ধরছেন। পেটের সঙ্গে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ বাঁধা। ধরা মাছ রাখার জন্য। তিরিশ বছর ধরে সমুদ্রে মাছ ধরেছেন। এখন আর সমুদ্রে যান না। মেয়ের বিয়ে হয়ে গিয়েছে। ছোট ছেলে হাইস্কুলের টিচার। দিব্যি চলে যায়। দেখলাম গলায় তুলসীর মালা। বললাম, বৈষ্ণব হয়ে মাছ ধরছেন? বললেন, খাই না, পেট চালাতে ধরতে হয় বইকী! কথায়-কথায় জানলাম, লালমোহনবাবুর মনে অনেকখানি নুন জমা আছে। দাম্পত্য ঝামেলার জেরে তাঁর বড় ছেলে আত্মহত্যা করেছেন! অসম্ভব একটা মনোকষ্ট নিয়ে তিনি এখনও হেনরির খাঁড়ির অলি-গলিতে মাছ খুঁজে বেড়ান। খুঁজে বেড়ান হয়তো নিজের ব্যর্থতাকে। অতীতকে। স্মৃতিকেও। এই লালমোহনবাবুই আমাদের বেশ কয়েকটি গাছ চিনিয়ে দিলেন। বানি, হেঁতাল, গরান। তারপর একটা জঙ্গুলে জায়গায় এসে ঝপ করে নেমে গেলেন খাঁড়ির মধ্যে।

লালমোহন দাস।

আমরা উল্টো দিকে হেঁটে সমুদ্রের দিকে বেরিয়ে এলাম। ততক্ষণে মেঘের ডিম ভেঙে আলোর কুসুম বেরিয়ে এসেছে। চকচক করছে বালি আর জল। গাছের পাতা, কাঁকড়ার পিঠ।

এদিন সমুদ্রস্নানটিও হল দারুণ। কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে সেই খাঁড়ি! পুরোটাই তো সমুদ্র! জল একেবারে পায়ের কাছে হুমড়ি খেয়ে পড়ছে। এখানে এসে পুরীর ঢেউ আশা করা অন্যায়। জলের সেই রংও নেই। কিন্তু সব মিলিয়ে ব্যাপারটা দিব্যি অন্যরকম ভাল।

হোটেলে ফিরতে গিয়ে এক বিপত্তি। যে পথ দিয়ে এসেছিলাম, সেটি প্রায় জলের তলায়। পা হড়কাচ্ছে। বাঁশের সাঁকোটি দুলছে না বটে, কিন্তু ভাসছে। দু’একটি বাঁশ আবার খোলা। সেখান দিয়ে পা ঢুকে যাওয়া কিছু অসম্ভব নয়। সেই অতি দুর্গম পথে কন্যাটিকে কোলে করে পা টিপে-টিপে, পথ হাতড়ে-হাতড়ে ফেরা। জলের তলায় যা হোক কিছু থাকতে পারে। কিন্তু উড়ে তো আর যাওয়া যাবে না! অগত্যা।

হেনরি সাহেবের কোলে কন্যা।

‘সুন্দরী’তেই আমাদের সঙ্গে আলাপ হল গুরুপদ পাড়ুইয়ের। ফিশারিজের ক্যাজুয়াল স্টাফ। ডায়মন্ড হারবারের বাসিন্দা। লিলুয়ায় একটা ছোট মিষ্টির দোকান ছিল ওঁর বাবার। সেই সূত্রেই ছোটবেলা থেকে কলকাতায় যাওয়া। পড়াশোনা উত্তরপাড়ায়। খুবই কষ্ট করে, দু’চোখে অনেক স্বপ্ন নিয়ে বড় হওয়া। সারা জীবন ধরে বহু জায়গায় চাকরির চেষ্টা করেছেন। একটু ভাল করে বাঁচার আকাঙ্ক্ষায়। কিন্তু মার খেয়েছেন ভাগ্যের হাতে। পরে ফিশারিজের এই চাকরিটি কোনওক্রমে জোটান। বিবাহিত। এক সন্তানের পিতা। পরিবার ছেড়ে এই নির্জন দ্বীপে পড়ে আছেন। মনে শান্তি নেই। আনন্দ নেই। ওঁর জীবনটা ওঁর কাছে যেন ওই লোনাজলে ডুবে যাওয়া সাঁকোর মতো। নড়বড়ে, ক্লিন্ন, ভরসাবিহীন, অবসাদগ্রস্ত।

হেনরি আসলে শুধু হেনরি সাহেবর কল্পকথাই নয়। না-পাওয়ার বেদনায় হতাশাগ্রস্ত, পীড়িত অনেক ছোট ছোট মানুষের জীবনের গল্পকথার আঁতুড়ঘরও।

এদিনই বিকেলে সৈকতের অন্যদিকটায় গিয়েছিলাম। সেদিকটিতে ওই গাছের খাপছাড়া আড্ডা ছাড়া প্রায় কিছুই নেই। আরও বেশি নির্জনতা, আরও বেশি জলের শব্দ, আরও বেশি বালি আর নুন। সূর্যের রঙের প্রাণলাবণ্যও কিছু বেশি। অনেক ভাঙা-ভাঙা প্রিজম, মুছে-যাওয়া বর্ণ ও বর্ণনা, কল্লোলমুখর দীপ্তি, অঙ্ক-ছাপানো প্রতিসরাঙ্ক এবং বাউল ছায়ারা। চারদিকটা যেন স্বর্গীয়। পাখিদের শব্দ থাকার কথা ছিল। নেই। একটি নিঃসঙ্গ শামুক নিতান্ত অনিচ্ছায় হেঁটে চলেছে মাত্র।

সমুদ্রের তীর দ্রুত অন্ধকার হয় না। কিন্তু বাতাসে আঁধারের হাত অনুভব করে ফেরার পথ ধরলাম। এবং সেই ‘ক্যানোপি’র কাছে এসে বুঝলাম, অন্ধকার মন্দ নয়। গাছ-গাছালিভরা সেই সরু ভেজা পথ ধরেই ফের যেতে হবে। দুপুরের সেই জলে-ডুবে-যাওয়া পথের কথা ভেবে এখন মজাই লাগছিল।

হেনরি আশ্চর্য সুন্দরী নয়। কিন্তু অপরূপ লাবণ্যময়ী। বৃষ্টিভেজা সৈকতের এই স্মৃতি ও বিস্মৃতি অনেকদিন পর্যন্ত মনের মরুতে ঠান্ডা আরাম পাঠাবে। সুন্দরবনের একটা মৃদু আভাস এখানকার প্রকৃতিতে। কিন্তু সমুদ্রকে একটু অন্য অ্যাঙ্গেলে দেখতে চাইলে হেনরি না-এসে উপায় নেই। সমুদ্রের নুনের সঙ্গে অচেনা-অজানা মানুষের মনের নুনকে ছুঁতে পারাটাও কি কম!

সমাপ্ত

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *