পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

জীবন্ত সেতু, ডুমুরে খোঁজ আর বৃষ্টি ভেজা মৌসিনরাম

শ্রেয়সী সেনশর্মা

দু’দিন অন্তর অন্তর বড় মন খারাপ হয়। জঙ্গল, পাহাড় আমায় কেবল হাতছানি দেয়। অফিসের ডেস্কের ঝাপসা বৃষ্টি মাখা কাচ বড্ড মন কেমনের গল্প বলতে থাকে। সেই দিনগুলোতে আমার আর কাজে মন বসে না। আসল কথা থেকে দূরে যাচ্ছি। উত্তর-পূর্বের সাত সুন্দরী কন্যার মধ্যে সবচেয়ে আদুরি মনে হয় মেঘালয়। আগের বারের শিলং দেখে মন না ভরায় এবারের গন্তব্য পূর্ব খাসি পাহাড় আর জয়ন্তিয়া পাহাড়ের কিছু অংশ। নকরেক এবং বলপখরামও গন্তব্য ছিল। কিন্তু বনবিভাগের অনুমতি পাইনি এবারে। তা ছাড়া, বর্তমানে ওখানে কিছু রাজনৈতিক সমস্যাও চলছে।

২২ এপ্রিল ২০১৯

ভোর সাড়ে ছ’টায় তিনখান মালপত্তর-সহ কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেসের একখানি লোয়ার বার্থে জমিয়ে বসা গেল। প্রতিবারের মতো এবারও আমার সাথী আশাপূর্ণা দেবীর ‘সুবর্ণলতা’। কিছুক্ষণ বইয়ের পাতায় মন বসাতে না বসাতে দেখি, এক মিলিটারি দাদা আমার সামনে একটা প্লেট বাড়িয়ে। তাতে খানকয় মুরুক্কু, নারকেল নাড়ু। দাদা কন্নড় ভাষী। হিন্দিও ভালই বলেন। ইতস্তত করছিলাম। কানে বাজছিল বাবা মায়ের ছোট থেকে শেখানো অমোঘ বাণী ‘অচেনা কেউ খাবার দিলে খবরদার’’। তা-ও খেয়েই ফেললাম। আসলে সিকিম বর্ডারের ১১ হাজার ফুটের গপ্প শুনতে বেশ লাগছিল। জানলার পাশে বসে মহানন্দা দেখছিলাম। যদিও ঘুমের চোটে ফরাক্কা মিস হয়েছে। মহানন্দা বড়ো শান্ত, দু’পাশে বালি, তিরতির করে বয়ে চলা জল। আসলে মহানন্দা ঠিক পাশের বাড়ির ওই শান্ত ‘বুঁচকি’র মতো, যে কখনও বড়দের অবাধ্য হয় না। মালদা জুড়ে আমের বন, তখন সবে বোল ধরেছে, লাল শান বাঁধানো পুকুর ঘাটে মহিলার দল। সবুজের একশও রকম রং। কোনওটা গভীর, কোনওটা হালকা, আবার কোনওটা অভিমানী। সলজ্জ সবুজ নতুন বৌয়ের চুড়ির মতো স্বপ্ন ভরাও আছে।

শান্ত মহানন্দা।

সবুজ ধানের আগায় একটা সোনালি বিন্দু। মাথা মালিশের ডাক, আবেশে চোখ বুজে আসছিল। খাল পাড়ের রঙ বেগনি, আসলে খালগুলিতে পদ্মবনের রমরমা। বেশ দেখতে নূপুর পরা এক কিশোরী পদ্ম তুলছে। আর আছে Eurayle ferox (মাখনা) এর ঘন জঙ্গল। সার সার ভুট্টা খেতি। জায়গাটা বিহারের কাছের কোনও জায়গা। স্টেশনের নামগুলো সুন্দর, সূর্যকমল গুঞ্জরিয়া। সূর্যাস্তের পর কেবল অনন্ত প্রতীক্ষা, সামনে একজন বিহারি বউয়ের ‘মাইকে’র গল্প, তারপর পাশের কুপের ছোট পরি রানির সঙ্গে বকবক করতে করতে রাত ভোজন এবং নিদ্রাদেবীর আবির্ভাব। পরের দিন ভোর ৩টেয় ট্রেন থামবে গুয়াহাটিতে।

পুলিশ বাজার আর মেঘ।

আমার খুব একটা ভোর দেখার সৌভাগ্য হয়নি। শেষ ভোর দেখা বলতে পুরী। ঠিক তিনটের সময় ট্রেন থামল। স্টেশনে বসে দেখছি ঊষার আগমন অসমে। যে ঊষার কথা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি। নরম আলোয় ভরে উঠছে চারপাশ। এরপর সুইফট ডিজায়ার এবং শিলং রওনা। ঘণ্টা চারেকের পথ। সেই পাহাড়, সেই ব্যস্ততা, সেই ধাপে ধাপে বাড়ি, আচারের শিশি। এবার শিলং ঢোকার মুখে প্রচণ্ড জ্যাম এবং এত গরম। বাধ্য হয়ে এসি চালাতে হল। শিলং শহরে এসি! ভাবা যায় না। বিশ্ব উষ্ণায়নের কলকাঠি আর কী। গেস্টহাউসে নিজেকে সহ বোঝা নামিয়ে আপিসের একজন স্কলার কারলাংকে নিয়ে দৌড়লাম ফরেস্ট অফিসে। এ মাথা ওমাথা, আইএফএস-এর ঘরে হানা দেওয়া, শ্রান্ত, ক্লান্ত আমি শেষে বন ঢোকার পারমিট আধাআধি আদায় করলাম।

পুলিশ বাজার থেকে বেরিয়ে গেস্টহাউসে তথা নেপকো যাব বলে ট্যাক্সি ধরার জন্য বেরোতেই সেই পাহাড়িয়া বুনো বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিল আমায়। শিলংয়ের সেই ‘শেষের কবিতার’ বৃষ্টি। গেস্ট হাউসের ওই রহস্যময় উতরাই ভিজে রাস্তা থেকে একটা দোকানের দিকে গেলে তবে পেটে দানা পানি দুই পড়বে। সন্ধ্যে ৭টার সময় সব দোকান বন্ধ হয় ঝুপঝুপ। তাই সাতটার সময় ডিনার, বেশি কিছু না, ডিম ভাত, ভাজা আর লস্যি। আহা ঝপাঝপ মুখে পুরে কোনও দিকে তাকাচ্ছি না। এমন সময় দুই তামিল পরিবার পাশের টেবিলে মহা ‘আমা আমা’ জুড়েছে। এমন সময় আমার দিকে কেরম ভুরু কুঁচকে আমার পেশা , কি করা হয়, বিবাহিত কিনা এসব জিজ্ঞেস করতে শুরু হল। আসলে ওঁদের ডিম ভাজা ঠিক পছন্দ না হওয়াতে এই কেউমেউ। ভদ্রলোক হোটেল মালিককে (যার নিতান্তই বয়েস কম) ডিম কীভাবে ভাজে শেখাচ্ছিলেন। যাই হোক, কথায় কথায় বেরোল উনিও ঘাসপুসের শিক্ষক (বটানি) মাদ্রাজের কোনও কলেজের। এক গাদা গাছ দেখিয়ে প্রশ্ন করে আমায় গেছোভূত করে তোলবার আগেই আমি ‘ভাগ শ্রেয়সী ভাগ’ তাগাদা দেখিয়ে পালালাম। সারাদিনের ক্লান্তি বোঝাই করে শুতে যাওয়া। অবশ্যি ইমেল বিনিময় করে।

চা বাগিচা

২৪ এপ্রিল, ২০১৯

হেলতে দুলতে ন’টা নাগাদ গাড়িতে উঠলাম। আমার সারথি আজ অমর ছেত্রি ভাইয়া। ধু-ধু চুনাপাথরের মাঠ, সমাধির ক্রসগুলো সূর্যর আলো পড়ে বড় চমকাচ্ছে। চা বাগান, আর্মি বেস পেরিয়ে নীচে নামার পালা। কারণ চেরাপুঞ্জি অনেক নিচুতে। রাস্তার পাশে পাশে প্রচুর তুঁত ফল, তার স্বাদ বেশ মিষ্টি। কনকনে হাওয়া, রাস্তার পাশে পাশে রংবাহারি ফুল, খাদের পাশ থেকে বাঁচার কী আপ্রাণ চেষ্টা। পাঁচটা পাহাড়, বোনেদের মতও গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে। জায়গার নাম তূর্ণা। মসমাই গুহা আর ভারতের শিস গ্রাম ‘কংথাং’এর কাছেই। সোহরা আর পাইনুরশুলার বনের মাঝের এই নির্জন গ্রামের প্রতি শিশুর নিজস্ব সুর আছে। এই খাসি উপজাতি এদের নিজের মধ্যে শিস দিয়ে কথা বলে থাকেন। সময় না থাকায় দাঁড়ালাম না ওদিকে। না খেয়ে বেরনোয় পেট ‘খিদে খিদে’ রবে ডাকছে।

ধাপ চাষ যা পাহাড়ের প্রধান অবলম্বন

নংরিহাটায় গাড়ি দাঁড়াল। চারিপাশে কেবল হতদরিদ্র ক’টি টিনের চালের কুঁড়ে। তারই মধ্যে একটায় গিয়ে ডাকাডাকিতে বেরল এক মিষ্টি মুখের তরুণী। ভাঙা ইংরেজিতে জানাল, কেবল মাংস আর একটু ঝোল আর ভাত হবে। বেলা ১১টায় তাই সই। এক বাটি ভাত, দু’টো চিকেনের হাড়, দুটো আলুর টুকরো আর টমেটোর উদগ্র ঝাল একটা চাটনি। চেটেপুটে থালা সাফ, পেট খুশ। কন্যের নাম ইবানিদিভিয়াং। আবদার তার আর পাশের বাড়ির মাসিমণির সঙ্গে একটি ছবি তুলে দিতে হবে। দিলাম। হাসি মুখে তাদের সে কী পোজ। বেশিরভাগ বাড়িগুলি ধাপ কাটা। সিঁড়িগুলো বড় সুন্দর।

ইবানিদিভিয়াং ও তার মাসিমণি

সেলা ফরেস্টে ডুমুর (গো+এষণার বিষয়) তুলে এবার বেলা দু’টোর সময় চেরাপুঞ্জির ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে এসে থামলাম। পৃথিবীতে যে ক’টা ‘অবাক বিস্ময়’ আছে তার মধ্যে এই দোতলা ব্রিজটা অন্যতম। গজগজানি জন্মবৃতান্ত উইকিতেই পাওয়া যাবে। সেসবে গেলাম না। অমর ভাইয়া মানা করল এত বেলায় যাবেন না। ভুঁড়ি বাগিয়ে, গাইড ‘ফিবার’কে (খাসি ভাষায় অর্থ, নেই) সঙ্গে নিয়ে, চল্লুম ৪০০০ সিঁড়ি নীচে নামতে। হাতে বাঁশের লাঠি। আমার গাইড পেশায় কৃষক, অভাবের সংসারে বাড়তি রোজগার। দিনে দু’টো এরকম সফর করায়।

এই সেতু জীবন্ত শিকড়ের তৈরী

পাক্কা তিন ঘণ্টা লেগেছিল নামা আর ওঠাতে। পথে জুস, চকলেট, পাথুরে খরস্রোতা নদীর উপরে সরু তারের ব্রিজ, দু’টো এরকম ব্রিজ পরে। মনে সাহস নিয়ে একজন করে না পার হলে ব্রিজ বড় দুলতে থাকে। প্রচুর মধুচন্দ্রিমা করতে আসা রহস্যপ্রিয় দম্পতি, হাঁটুর সমস্যাওলা বয়স্ক মহিলা, বিদেশিনীদের দেখে মনে হতে পারেই না আমায় শেষ করতেই হবে এ পথের। প্রচুর হোম স্টে আছে। চাইলে থাকা যায় একদিন। আর রামধনু ফলস-এ যেতে হলে অনেক সকালে যাত্রা করাই শ্রেয়। অবশেষে Ficus elastic-র দোতলা ব্রিজে উঠলাম, ছবি তুললাম। আর ঠান্ডা জলে পা ডুবিয়ে বসে, কাচের স্বচ্ছ জলে পায়ে মাছ এসে একটা চুম্বন দেবে। উঠতে ইচ্ছা করছিল না, তা সত্ত্বেও বেলা বলছে, ‘ঘরকে চল’। আবার ওঠা, সেই দম ভরে। যখন সফর শেষ করলাম তখন ৬টা বাজে। খালি পেটে এক পেট ম্যাগিই সই। এইদিনের মত সফর শেষ।

ঝুলন্ত সেতু

২৫ এপ্রিল

গাইড ফিবার ও আমি

পায়ে অসম্ভব ব্যথা। বিশ্রামের দরকার ছিল। তা ছাড়া ঘাসপুস থুড়ি বটফলগুলিকে (বট আসলে ফিগ অর্থাৎ ডুমুর পরিবারের) একটু যত্ন করতে হত। তাই আজ আপাতত গার্ডেন ঘোরাঘুরি, orchidarium, সবুজ বৃষ্টি মাখানো লন আর ছাদে উঠে হাওয়া ওড়ানো শহর দেখাটাই স্থির করলাম। কাল যাব মওলিলং (এশিয়ার সবচেয়ে পরিচ্ছন্ন গ্রাম) আর ডাওকি সীমানা।

তূর্ণার পাঁচ পাহাড় বোন

(চলবে)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *