দীপক দাস

‘খেয়েছেন?’ হোয়াটসঅ্যাপে প্রশ্নটা আসতেই প্রমাদ গুণলাম। ঘর জোটেনি। খাবার জুটবে কিনা সন্দেহ। দলের একজনের জঠরানল গলা পর্যন্ত উঠেছে। মাথায় উঠতে আর খানিক বাকি। মাথায় উঠলে বড় বিপদ। গালি খেতে হবে আমাকে। হাতাহাতিও হতে পারে। পেটের আগুন মাথায় উঠতে দিলে হবে না। খাবার দিয়ে ঠেকাতে হবে তার আগেই। কিন্তু খাবার পাই কোথায়?
আরাবাড়ি জঙ্গল থেকে চলেছি বগড়িতে। ইতিহাস প্রসিদ্ধ স্থান। মন্দির আছে। আর আছে শিলাবতী নদী। এই নদী দর্শনে আমাদের দীপুর আগ্রহ খুব। নদী অবশ্য সকলের কাছেই সুন্দর। দর্শন তো হবে। কিন্তু ভোজনের কী হবে? বিপত্তি শুরু হয়েছে আরাবাড়ি থেকেই। জঙ্গলের কাছে যে সোনালি রিসর্টে থাকব বলে ভেবেছিলাম সেটি বন্ধ। থাকার জায়গা মেলেনি। খাবারও তেমন পাইনি। আরাবাড়ি জঙ্গলের পাশে উন্মুক্ত চায়ের দোকানে মুড়ি তেলেভাজা আমার পেটে তখনও কিছুটা অবশিষ্ট রয়েছে। এই জ্বালানিতে দুপুরটা কাটিয়ে দিতে পাড়ি। কিন্তু মুশকিল হল ইন্দ্রকে নিয়ে। দুপুরে খাবার ওকে দিতেই হবে। দেওয়া তো যায়। কিন্তু পাই কোথায়!

মায়তায় কৃষ্ণরায়ের রাসমঞ্চ।
আমাদের এই সফরের অদৃশ্য পথপ্রদর্শকের কাছ করেছেন তরুণ সিংহ মহাপাত্র। বিদ্বান ও বিনয়ী মানুষটিকে দেখিনি কখনও। কিন্তু মতের আদানপ্রদান হয় অহরহ। আমি বেশির ভাগ সময়েই গ্রহীতা। নানা তথ্য সংগ্রহ করি। এই সফরে যেমন সংগ্রহ করেছি পুরো সফর-নির্দেশিকা। হোয়াটসঅ্যাপে। কথাবার্তা এই মাধ্যমেই চলছিল। সেই নির্দেশিকা অনুযায়ী, গড়বেতা বাসস্ট্যান্ড থেকে গোয়ালতোড়-হুমগড়গামী বাসে উঠেছি। নামব ঝাড়বনি। বাসে ওঠার তথ্য জানিয়েছিলাম। তার পরেই জিজ্ঞাসা, ‘খেয়েছেন?’
১০টার সময়ের মুড়ি তেলেভাজার কথা বললাম। পরের উত্তরটা এল আরও ভয়ঙ্কর। মায়তায় কিছু পাবেন না। গেটবাজারে খেয়ে নেওয়া ভাল। এই রে! ইন্দ্রর দিকে তাকালাম। তখন দেড়টা বেজে গিয়েছে। মুখ দেখে মনে হল, টাইমার চালু হয়ে গিয়েছে খিদে-বোমার। আর কিছুক্ষণ পরে বিস্ফোরণ হবে। গেটবাজারে নামিনি। খাওয়ার জন্য সময় নষ্ট করতে চাইছিলাম না। বিস্ফোরণের বিপদ মাথায় নিয়েই ঝাড়বনি নামলাম। সেখানে খাবার কিছু মিলল না। কিন্তু টোটো পাওয়া গেল। চটপট উঠে পড়লাম।

মায়তার মন্দির।
তরুণবাবু জানিয়েছেন, আমাদের প্রথমে মায়তায় যেতে হবে। সেখান থেকে বগড়িতে মূল মন্দির। মন্দির থেকে শিলাবতী পার করে দোলবাগান। এই তিনটি জায়গাই বগড়ি বিখ্যাত কৃষ্ণরায় মন্দিরের সঙ্গে সম্পর্কিত। টোটোচালক দাদাকে বুঝিয়ে দিলাম যাত্রাপথ। তিনি চেনেন বললেন।
মায়তা একেবারে পথের পাশেই। দূর থেকে দেখা যায় রাসমঞ্চ। খোলা চত্বরে। কিন্তু মন্দিরটি বন্ধ। স্বাভাবিক। একেবারে ভরদুপুর যে। কেউ কোত্থাও নেই। বন্ধ গেট থেকে উঁকিঝুকি দিয়ে মন্দির আটচালা দেখলাম। পরিপাটি, সুন্দর রং করা মন্দির। দীপু ছবি তুলল। তার পর আবার টোটো। পথে এক পাড়ায় বেশ একসঙ্গে তিনটি শিবমন্দির দেখলাম। দু’চারটে পল্লি পার করে পৌঁছনো গেল মূল মন্দিরে। জায়গাটির নাম কৃষ্ণনগর। মন্দিরের কাছে বেশ ভিড়। গাড়ি, টোটোর সারি। একেবারে শিলাবতী নদীর গা ঘেঁষেই মন্দির। ফেব্রুয়ারি মাসের শেষের দিকে শিলাবতীর প্রতাপ তেমন ছিল না। বহু লোক দেখলাম হেঁটে নদী পার করছেন। এর কারণটা তখন বুঝিনি।

মায়তা আর কৃষ্ণনগরের মাঝে দেখেছিলাম এই মন্দিরগুলো।
মন্দিরের কাছে গিয়ে দেখি, বন্ধ। কৃষ্ণরায় দর্শন হবে না। আমরা মন্দিরের চারিদিকে পাক খাব বলে ঠিক করলাম। সেই সঙ্গে আরেকটা বিষয় লক্ষ্য করলাম। মন্দিরের দুপুরে আগতদের জন্য খাবার ব্যবস্থা রয়েছে। অন্নভোগ। এখানেই তো খেয়ে নেওয়া যায়! টোটোচালক দাদাকে তো খেতে দিতে হবে। আমাদের যা সফরসূচি তাতে এই এলাকা ছাড়লে আবার কখন খাবার দোকান পাওয়া যাবে তার ঠিক নেই। ভাত আর পাওয়া যাবে না কোথাও। মুখরোচক কিছু দিয়েই পেট ভরাতে হবে। তার থেকে মন্দিরে খেয়ে নেওয়া যেতে পারে। কিন্তু তারও একটা মুশকিল আছে। ইন্দ্র যুক্তিবাদী। ও মন্দিরের ভোগ খেতে চাইবে না। জিজ্ঞাসা করলাম, ‘‘খাবি?’’ ও জবাব দিল, ‘‘তোমরা খাও।’’ এক যাত্রায় সেটা কি হয়?
ফিরে যাব বলেই মনস্থির করেছি। এর পরের গন্তব্য দোলবাগান। বা রঘুনাথবাড়ি। তার আগে আরেক জায়গায় যাওয়ার আছে। ভক্তদের নিয়ে এক গাড়ির চালকের সঙ্গে ভাব জমেছিল। তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিচ্ছিলাম। তিনি বললেন, প্যান্ট গুটিয়ে শিলাবতী পার করে চলে যেতে। জল গোড়ালি থেকে একটু বেশি। বুঝলাম, লোকজন কেন হেঁটে নদী পার করছিলেন। নদী পার করে গেলে দোলবাগান একটুখানি। কিন্তু রাস্তা দিয়ে গেলে অন্তত তিন কিলোমিটার ঘুরে যেতে হবে।

কৃষ্ণনগরে নিজমন্দিরে পাশে পরিক্রমা।
আবার ইন্দ্র নারাজ। নদী পার হবে না। ব্যাটা ক্যারাটে জানে। কিন্তু সাঁতার জানে না বোধহয়। সব কিছুতে না বলতে বলতে ওর হয়তো কিছুটা সঙ্কোচ হচ্ছিল। হঠাৎই মন্দিরের ভোগ খেতে রাজি হয়ে গেল। আমরা তো অবাক। এই জন্যই তো বলে, পেট আগে। পেটের জন্যই এত কিছু। পেট খালি থাকলে আদর্শ, বাদ সব কোথায় ভেসে যায়! যদিও পরে ইন্দ্র ব্যাখ্যা দিয়েছিল, ওর জন্য নয়, আমরা না খেয়ে থাকব সেটা নাকি সইতে পারছিল না। তাই যুক্তিবাদ পাশে সরিয়ে অন্নভোগকে খাবার হিসেবেই গ্রহণ করেছে। ওর মহানুভবতা!
মন্দিরের সামনেই একটা মিষ্টির দোকান আছে। সেখানেই জিজ্ঞাসা করলাম। তাঁদের একজন মন্দিরের কাউকে জিজ্ঞাসা করলেন। উত্তর এল, ভোগ বিতরণ শেষ। আর কিছু করার নেই। আজ কিছু জুটবে না ভেবে মিষ্টির দোকানের কিছু কাজ সেরে নিচ্ছিলাম। কিছু স্থানীয় মিষ্টি দেখেছি যে! কথাবার্তা চলছে। তার ফাঁকেই মন্দিরের একজন এলেন। জানতে চাইলেন, কত জন আছি? টোটোচালককে নিয়ে চারজন। উনি চলে গেলেন। কিছুক্ষণের মধ্যেই ফিরে এসে জানালেন, ব্যবস্থা হয়ে যাবে।

নিজমন্দিরের পাশে এক মন্দিরে রাখা অভিরাম গোস্বামীর পাদুকা।
বসে পড়লাম মন্দিরের পাশে আর ভোগ রান্নার ঘরের মাঝে পাতা বেঞ্চে। একটু এগিয়ে অনেকগুলো সিঁড়ি নেমে শিলাবতীর জল ছুঁয়েছে। রান্নাঘরের পাশে একটা বটগাছ। তার নীচে দাঁড়িয়ে বর-কনের ছবি তোলার পর্ব চলছে। বর-বধূর বন্ধুরাই বোধহয় ছবি তুলিয়ে। সে সব দেখতে দেখতে খেতে শুরু করলাম। আতপ চালের ভাত। দু’তিন রকম তরকারি। ভোগের রান্না যে রকম হয় আরকী! মন্দিরের কর্তাস্থানীয় একজন আক্ষেপ করছিলেন, আরেকটু আগে এলে পায়েস দিতে পারতেন। যা পেয়েছি তা কম কীসের! আমি আর দীপু পেট ভরে খেলাম। দুপুরে কিছু জুটবে না মনে হচ্ছিল। এখন এত খাবার পাতে সবটা খেতে পারছি না। আমাকে আবার পদ্মপাতায় খেতে দিয়েছেন। এই পাতটাই দারুণ লাগছিল।

শীতের শেষে শিলাবতীর রূপ।
এবার একটু মন্দিরের ইতিহাস। এই মন্দিরের সঙ্গে নানা কিংবদন্তি জড়িয়ে রয়েছে। সেই কিংবদন্তির দু’একটি মহাভারতের কালের সঙ্গে যুক্ত। খাওয়াদাওয়া শেষে দেখা হয়েছিল কৃষ্ণদাস রায়ের সঙ্গে। বছর তিয়াত্তরের মানুষটির বাড়ি মায়তায়। তিনি মন্দিরের পরিচালন কমিটির অ্যাসিস্ট্যান্ট ম্যানেজার। তাঁর কাছ থেকে শুনলাম মন্দিরের ইতিহাস। আমরা যেখানে খাওয়াদাওয়া করলাম অর্থাৎ কৃষ্ণনগরের এই মন্দিরটি কৃষ্ণরায় জীউয়ের নিজমন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরটি তৈরি হয়েছিল ১২৬২ বঙ্গাব্দে। গড়বেতা কোর্টের মুন্সেফ যাদবরাম চট্টোপাধ্যায় তৈরি করে দিয়েছিলেন মন্দিরটি। তবে শোনা যায়, মন্দির আরও পুরনো। সেই প্রাচীন মন্দির কোনও এক সময়ে শিলাবতীর বন্যায় ভেসে গিয়েছিল।

দুপুরের আহার। অন্নভোগ। দীপু, আমি আর টোটোচালক দাদা।
আমরা আসার সময়ে মায়তায় রাস্তার পাশে যে রাসমঞ্চ এবং বন্ধ মন্দিরটি দেখেছিলাম সেটিতে রথের সময়ে যান কৃষ্ণরায়। মায়তার মন্দির কৃষ্ণরায়ের মাসির বাড়ি। এখান থেকে রাসযাত্রা শেষে মূল মন্দিরে ফেরে বিগ্রহ। কোনও এক বছর বন্যার সময়ে মায়তায় রাখা হয়েছিল বিগ্রহ। কৃষ্ণরায়ের তৃতীয় মন্দির হল দোলবাগান বা রঘুনাথবাড়িতে। এটি কৃষ্ণরায়ের শ্বশুরবাড়ি হিসেবে পরিচিত। এখানে বিগ্রহ ১১ দিন রাখা হয়। বগড়ির কৃষ্ণরায়ের মন্দির সম্প্রীতি অনন্য নিদর্শন। দোলের সময়ে বিগ্রহকে পালকি করে নদী পার করে নিয়ে যাওয়া হয় রঘুনাথবাড়িতে। সেই শোভাযাত্রায় অংশ নেন ওই এলাকার মুসলমান বাসিন্দারাও। সে এক দেখার দৃশ্য হয়। জানিয়েছিলেন মন্দিরের কৃষ্ণদাস রায়। তিনি দোলের সময়ে মন্দিরে যেতে আমন্ত্রণও জানালেন। চেষ্টা করব বলে জানিয়েছিলাম। কৃষ্ণনগরের কৃষ্ণরায় জীউয়ের মন্দিরের সঙ্গে বৈষ্ণব ধর্মপ্রচারক অভিরাম গোস্বামীর স্মৃতি জড়িয়ে। তিনি এখানে এসেছিলেন। তাঁর পাদুকা এখনও এখানকার একটি মন্দিরে রাখা আছে।

দোলবাগানের মন্দির।
নিজমন্দির থেকে বেরিয়ে টোটো চলল রঘুনাথবাড়ির দিকে। কৃষ্ণরায় জীউয়ের তিনটি মন্দিরই বেশ কারুকার্যময়। সুন্দর। একটা জিনিস মনে হচ্ছিল, এই ধাঁচের মন্দির হুগলির খানাকুলের কৃষ্ণনগরেও দেখেছি। ঠিক মনে হচ্ছে কিনা জানি না।
কভারের ছবি— কৃষ্ণনগরে নিজমন্দির
ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)