নন্দিতা দাস

আমিও ছুটলাম ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। হাঁফাতে হাঁফাতে উপরে উঠলাম। ওয়াচ টাওয়ার থেকে একটু দূরে জঙ্গলের ফাঁকা অংশে চৌকো করে কাটানো মিষ্টি জলের কৃত্রিম জলাশয়। বন্যপ্রাণীদের জল খাবার জন্য। সেখানে জল খেতে এসেছেন এক বন্য বরাহ। বরাতে তেনার দেখা পাওয়া কি তবে সত্যি নেই?
নেতা ধোপানি ক্যাম্পও দোবাঁকির মতো তারের জাল দিয়ে ঘেরা। ওয়াচ টাওয়ার থেকে একটু দূরে জালের বেষ্টনীর বাইরে ভাঙাচোরা ইটের স্তুপ। এটিই নাকি সেই মনসামঙ্গলের নেতা ধোপানির মন্দির। সামনে একটা ফলকে লেখা মন্দির সম্পর্কে কিছু কথা। এখানে বেশ খানিকক্ষণ ছিলাম। সূর্যদেব অনেকটাই পশ্চিমে ঢলেছেন। সন্ধ্যের আগেই কোর এরিয়া ছাড়তে হবে। গাইড তাড়া দিচ্ছেন বারবার। অগত্যা গুটিগুটি পায়ে ফেরার পথ ধরলাম আমরা।
লঞ্চের কাছে আসতে না আসতেই আবারও অশোকদার নির্দেশ, ”চুপচাপ থাকুন। ওই দেখুন টাইগার।“ ওঁর অঙ্গুলিনির্দেশ অণুসরণ করে তাকিয়ে দেখি, কী একটা প্রাণী সাঁতার কেটে আসছে নেতা ধোপানির ঘাটের দিকে। ভিতরে একটা বোর্ড দেখেছিলাম। তাতে বনকর্মীরা লিখে রেখেছেন বাঘ দেখতে পাওয়ার দিনক্ষণ। তা থেকেই জেনেছি এখানে বাঘের দেখা মেলে বেশ ঘনঘন। এবং আগের দিনই বিকেল ৪টে নাগাদ দেখা মিলেছে তাঁর। কাজেই ওটা বাঘ হওয়া অসম্ভব কিছু না। আমাদের কয়েক জোড়া চোখ তাকিয়ে আছে অধীর আগ্রহে। জলের উপর রোদ ঝিকমিক করছে। বেশিক্ষণ একটানা তাকিয়ে থাকা যায় না। তাও আমরা তাকিয়ে আছি। অবশেষে বোঝা গেল, ইনিও আর কেউ নন, অপর একটি বন্য শূকর।

এই আমাদের বন্যপ্রাণ দর্শন। জল খেয়ে ফিরছে শূকরটি।
আলো দ্রুত কমে আসছে। শুরু হয়েছে ভাটার টান। লঞ্চ ছাড়তে হবে। অথচ ইন্দ্রদা এবং আরও কয়েকজন তখনও আসেননি। বেশ কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর ওঁরা এলেন। লঞ্চও ছেড়ে দেওয়া হল সঙ্গে সঙ্গে। যাঁরা দেরিতে আসার কারণে বরাহের নদী পারাপার দেখতে পাননি, তাঁদের সঙ্গে একটু মজা করার জন্য আমরা বললাম, বাঘ এসেছে সাঁতার কেটে। পরে অবশ্য সত্যিটা তাঁদের জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। ফেরার পথে আরও একটা কুমির চোখে পড়ল। কাদা মাটিতে শুয়ে আছে লম্বা হয়ে। আকারে দোবাঁকিতে দেখা কুমিরটার প্রায় দেড় গুণ। আলো কম দেখে দাদা ক্যামেরা ব্যাগে ভরে দিয়েছিল। বার করতে করতে কুমির বাবাজি ঝাঁপ দিলেন জলে। ক্যামেরা বন্দি হল কেবল ওঁর লেজের আগাটুকু।
লঞ্চ ফিরছে বালিদ্বীপের দিকে। এবারে আর খাঁড়িতে ঢোকা যাবে না। চলেছে গোসাবা নদী ধরে। আশেপাশে মালবাহী লঞ্চের ভিড়। সব চলেছে বাংলাদেশের দিকে। নদীর বুকে সন্ধ্যে নামছে ধীরে ধীরে। লঞ্চের চারপাশ খোলা। হাওয়া দিচ্ছে হু হু করে। সবাই গল্পগুজবে মেতে আছে। আমি লঞ্চের ডেকে পা ঝুলিয়ে বসে সন্ধ্যে নামা দেখছি। শীতের সন্ধ্যের আবছায়া অন্ধকারে কী রকম যেন এক উদাসী মন কেমন মিশে আছে। পাখিরা ঘরে ফিরেছে দল বেঁধে। একটা গাঙচিল জলের উপর ভাসছে একা। সন্ধ্যার আঁধার ঢেকে দিচ্ছে তার সাদা ডানা। দেখতে দেখতে মাতলা নদীতে এসে পড়লাম। সেই মাতলা। আমাদের মতো শহর-ঘেঁষা লোকজনের কাছে মাতলা আর সুন্দরবন প্রায় সমার্থক। এখানে মাতলা যেন সমুদ্র। ‘কুল নাই, কিনার নাই, নাইকো দরিয়ার পাড়ি’। এমনিতে শান্ত। গ্রামবাংলার আর পাঁচটা নদীর মতোই। কিন্তু ভরা বর্ষায় বা অমাবস্যা-পূর্ণিমার কোটালে তার অন্য রূপ। মাতাল নদী পাড় ভেঙে নোনাজলে ভাসিয়ে দিয়ে যায় দু’কুল। তাই এর নাম মাতলা।

ক্যামেরা দেখে জলে ঝাঁপ দিয়েছিল। লেজের ডগাটি ফটোবন্দি হয়েছে।
সন্ধ্যে ৭টার দিকে এসে পৌঁছালাম বালিদ্বীপ। ফেরিঘাটে বাঁধা লঞ্চের মধ্যে বসেই সন্ধ্যার জলখাবার সেরে নেওয়া হল। কফি আর চিকেন পকোড়া। লঞ্চ থেকে নামার সময় জেটির নীচে পারের কাছে কয়েক জোড়া টর্চের আলো দেখতে পেলাম। উঁকি মেরে দেখি, কয়েকজন মিলে হাত জাল-ফেলে মাছ ধরছেন অন্ধকারে। বেশ খানিকক্ষণ তাঁদের মাছ ধরা দেখে ফিরে এলাম হোটেলে। তার পর রাতের খাওয়া সেরে বিশ্রাম। গ্রাম্য পরিবেশের মধ্যে ছিমছাম হোটেল। ঠিক হোটেল না বলে হোমস্টে বলা চলে। স্বামী-স্ত্রী এবং ওঁদের ছেলে দেখাশোনা করেন। মাটির মানুষ তিনজনেই। খেতে খেতে ওঁদের মুখে শুনছিলাম সুন্দরবনের গল্প। বেশ লাগছিল। ইন্দ্রদার সঙ্গে সন্দীপবাবু (হোমস্টের মালিক ভদ্রলোক) নির্দ্বিধায় শলাপরামর্শ করলেন কী ভাবে হোটেলটাকে আরও সুন্দর করে তোলা যায়।
রাতের আলোয় সুন্দরবনকে কাছ থেকে দেখার একটু ইচ্ছে হল। ভাবলাম কাছেই তো ফেরিঘাট। একটু ঘুরে আসি। কিন্তু মাতৃদেবী এবং ভ্রাতৃদেব কেউই রাজি হলেন না। অগত্যা ঢুকে গেলাম কম্বলে। পরের দিনের জন্য ব্যাটারিতে একটু চার্জ করে নিতে হবে।

এটি নেতা ধোপানির ঘাট।
২৯ জানুয়ারি সকাল। স্নান করে সব জিনিস গুছিয়ে বেরিয়ে পড়লাম আমরা। অদ্য শেষ দিন। এখান থেকে যাওয়া হবে ঝড়খালি বাঘ উদ্ধার কেন্দ্র ঘুরে দেখতে। নদীতে তখন জোয়ার। কাজেই লঞ্চ চলেছে জঙ্গলের খুব কাছ ঘেঁষে। জঙ্গল নাইলনের জাল দিয়ে ঘেরা। এক জায়গায় খুলি ও হাড় আঁকা সর্তকবাণীর বোর্ড ঝুলছে। দেখেই বোঝা যায়, বাঘমামার আনাগোনা আছে। বেশ কিছু গাছের গুঁড়ির গায়ে লাল গামছা বাঁধা। অশোকদা বললেন লৌকিক বিশ্বাসে বেঁধে দিয়ে যায় কেউ কেউ। নিজেই দেখালেন এক জায়গায় জড়ো হয়ে আছে অজস্র মাটির সরা জাতীয় পাত্র। বললেন এগুলো জঙ্গলের অনেক ভিতরে ছিল। পাড় ভাঙতে ভাঙতে চলে এসেছে নদীর ধারে। সম্ভবত কোনও মন্দির বা সভ্যতা ছিল একসময়। কালের গ্রাসে হারিয়ে গিয়েছে সব। পড়ে রয়েছে কেবল এই কিছু ভাঙা হাঁড়িকুড়ি সেই বিস্মৃত জনপদের স্মৃতিচিহ্ন আগলে। আমরা চলেছি বিদ্যা নদী ধরে। নদীতে তখন ব্যস্ততা। ইতিউতি বেশ কিছু নৌকা ঘুরে বেড়াচ্ছে। কোথাও চলেছে মাছ ধরার প্রস্তুতি। এইসব দেখতে দেখতে আমরা এগিয়ে চললাম ঝড়খালির দিকে।

নদীর পারে পড়ে থাকা মাটির পাত্রগুলো।
সকাল ১০টা নাগাদ এসে নামলাম ঝড়খালি ফেরিঘাটে। এখানে আছে সুন্দরবন ওয়াইল্ড আনিম্যাল পার্ক। অসুস্থ ও আহত বন্যপ্রাণীদের চিকিৎসা হয় এখানে। পরে জঙ্গলে ছেড়ে দেওয়া হয়। এখানে অবশেষে বাঘের দেখা পেলাম আমরা। খাঁচার মধ্যে যদিও। তাতে কী? সোঁদরবনের রয়্যাল বেঙ্গল তো বটে! কেন্দ্রটি নতুন করে সাজানো হয়েছে সম্প্রতি। ২০২৪ সালে মাননীয়া মুখ্যমন্ত্রী উদ্বোধন করেছেন। আমরা যখন গিয়েছিলাম তখন তিনটি বাঘ ছিল। সোহান, সোহিনী আর সুন্দর। কয়েকদিন পর খবরের কাগজ মারফত জানতে পারি সোহান মারা গিয়েছে বয়সজনিত কারণে। বাঘের খাঁচার চারপাশে পরিখা কাটা। সেখানে শুয়ে আছে বিশাল বিশাল নোনাজলের কুমির। ঠিক যেন মার্বেল পাথরে খোদাই করা মূর্তি। নট নড়ন-চড়ন। আমার মাকে তো প্রথমে কিছুতেই বিশ্বাস করানো যায়নি যে ওগুলো আসলেই জলজ্যান্ত কুমির। খানিক দূরে পাখির খাঁচা। সেখানে রয়েছে বেশ কয়েকটি ঈগল জাতীয় পাখি। আর আছে বাগান জুড়ে অজস্র প্রজাপতির ওড়াউড়ি।

ঝড়খালি ফেরিঘাট।
খানিক থেকে, ছবিটবি তুলে ফিরব লঞ্চে। ফেরিঘাট থেকে পার্ক পর্যন্ত সার সার অস্থায়ী দোকান। দলের কয়েকজন কেনাকাটা করলেন সেখানে। কয়েকজন গেলেন বাজারের দিকে। উদ্দেশ্য সুন্দরবনের কাঁকড়া যদি পাওয়া যায়। এখানে পর্যটকের ভিড় অনেক বেশি। প্রতি মিনিটে একটি করে লঞ্চ এসে ভিড়ছে ঘাটে। যে লঞ্চগুলো দাঁড়িয়ে আছে তাতে রান্না চড়েছে। আমরা কয়েকজন ফেরি ঘাটে অপেক্ষা করছিলাম বাকিদের জন্য। জোয়ারের জল নামছে। কাদায় কিছুর নড়াচড়া দেখে নীচে তাকিয়ে দেখি এক ঝাঁক মাড স্কিপার। স্থানীয় ভাষায় মেনো মাছ। উভচর প্রাণী। জোয়ারের সময় নদীর পাড়ে গর্তের ভিতর লুকিয়ে থাকে। জল নামলে বেড়িয়ে আসে বাইরে। শক্ত পাখনায় ভর দিয়ে হেঁটে বেড়ায় কাদায়। মাড স্কিপারের খেলা দেখতে দেখতে বেশ অনেকটা সময় কেটে গেল।

কাদার রাজ্য পেরিয়ে চলেছে মাড স্কিপার।
ইতিমধ্যে ফিরে এসেছেন সকলে। যাঁরা কাঁকড়া-অভিযানে গিয়েছিলেন তাঁরা কিছুটা হতাশ। কাঁকড়া মেলেনি। এবার লঞ্চে চড়ার পালা। এখানে লঞ্চ বেশিক্ষণ ফেরিঘাটে দাঁড় করানো যায় না। আসা মাত্র লাফ দিয়ে উঠে পড়তে হয়। লঞ্চ ঘাট ছেড়ে বেশ খানিক এগিয়েও গিয়েছে এমন সময় দেখি ঘাটে দাঁড়িয়ে হাত নাড়ছেন গৌতমদা। দিল্লি নিবাসী। ‘দেশের বাড়ি’ এলে দলের ভ্রমণসঙ্গী হন। দাদার সঙ্গে আমার পরিচয় গান্ধীগ্রামে ‘কেকার কথা’ শুনতে গিয়ে। ভেবেছিলাম সেবারে উনি সঙ্গে ছিলেন। জাতীয় পাখির দেখা পেয়েছি। এবারেও উনি সঙ্গে আছেন। জাতীয় পশুর দেখাও পাব হয়তো! সঙ্গে বৌদি। পিছিয়ে পড়েছিলেন। এবং আমরা ওঁদের না নিয়েই ছেড়ে দিয়েছি লঞ্চ। যাই হোক। আবার লঞ্চ ঘাটে ভেড়ানো হল। উঠলেন গৌতম দম্পতি। এই নিয়ে বেশ খানিকক্ষণ ইন্দ্রদার পা টানাটানি চলল।
আসার সময় জোয়ার ছিল। এখন ভাটা। দু’পাশের দৃশ্যপট বদলে গিয়েছে আমূল। যাওয়ার সময় জঙ্গলের গা ঘেঁষে গিয়েছি। জল তখন অনেক উপরে। ভাটার টানে সেই জলই নেমে গিয়েছে অনেক দূর। নদী আর জঙ্গলের মাঝে এখন কাদামাটির সীমানা। কোথাও নদীর বুকে জেগে উঠেছে চর। যেতে যেতে চোখে পড়েছিল জলের অনেকটা ভিতরে সার দিয়ে কঞ্চির বেড়া দেওয়া। জল নামতে এখন দেখলাম ওগুলোতে জাল বাঁধা আছে। বেশ কয়েকজন এক হাঁটু কাদায় দাঁড়িয়ে মাছ ধরায় ব্যস্ত। এই সব দেখতে দেখতেই ফিরছিলাম। ভাবছিলাম এই জলটুকু একবার পার হয়ে গেলেই আবার সেই গতানুগতিক জীবনের বন্ধন।

লৌকিক বিশ্বাস থেকে গাছে বাঁধা হয় কাপড়।
দুপুরের খাবারও সেরে নেওয়া হল লঞ্চেই। এই ফাঁকে বলে রাখি, সুন্দরবন ভ্রমণে এই খাওয়াদাওয়া ব্যাপারটা এমনিতেই বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তার উপরি আমাদের ট্যুর ম্যানেজার স্বয়ং ইন্দ্রদা। কাজেই খাওয়াদাওয়া এক এলাহি আয়োজন। আগের দিন মধ্যাহ্নভোজনে ছিল আলুভাজা, সব্জি ডাল, ভাত, ফুলকপি চিংড়ি, ভেটকি মাছ, আর গলদা চিংড়ি। আজকের মেনুতে খাসির মাংস। সব রান্নাই ভীষণ সুস্বাদু। রান্নার যে তিন দিদি ছিলেন তাঁরা অতিশয় দক্ষতায় রান্না করেছেন সব কিছু। তবে এর মধ্যেই বিপদ ঘটে যাচ্ছিল বড়সড়। ইন্দ্রদার ভাইপো অনীক খেতে গিয়ে গলায় খাবার আটকে ফেলেছিল। সৌভাগ্যবশত ইন্দ্রদার মামাবাবু সেটা দেখতে পেয়ে যাওয়ায় কোনও দুর্ঘটনা ঘটেনি।
হাসি–মজা করতে করতে আমরা ফিরে চলেছি যার যার জীবনে। ঝুলিতে দু’দিনের অজস্র সুখস্মৃতি। শুনেছি বাঘের দেখা না পেলে নাকি সুন্দরবন ভ্রমণ অসম্পূর্ণ। সত্যিই কি তাই? বাঘের দেখা আমরা পাইনি ঠিকই। কিন্তু এই দু’দিনের সফরে একদল সম্পূর্ণ অচেনা অজানা মানুষ হুট করে হয়ে উঠেছেন পরিচিত। সুন্দরবনকে দেখেছি কাছ থেকে। অশোকদা, রাজদা, সন্দীপবাবুদের কাছে শুনেছি তাঁদের জীবনের অভিজ্ঞতা। সমৃদ্ধ হয়েছি। ভ্রমণের সার্থকতা বোধহয় এখানেই।

আমাদের দুই সফরসঙ্গী।
জঙ্গল ফেলে আমরা ততক্ষণে ঢুকে পড়েছি লোকালয়ে। দূর থেকে দেখা যাচ্ছে বালিদ্বীপের ফেরি ঘাট। ফরেস্ট রেঞ্জের অফিস। আর দু’পাশে সুন্দরবনের জনজীবনের টুকরো টুকরো ছবি। জেটির উপর বসেছে আড্ডার আসর। অনুষ্ঠান বাড়ির গান ভেসে আসছে মাইকে। নৌকায় রং করা চলছে কোথাও। গাছপালার ফাঁক দিয়ে উঁকি দিচ্ছে মাটির বাড়ি। সূর্যদেব ঢলেছেন পশ্চিমে। শীতের বিকেল। অন্ধকার নামে চট করে। আবছায়া অন্ধকারে আমরা এসে নামলাম গোসাবা। আমাদের এই ভ্রমণের শেষ দর্শনীয়- বেকন বাংলো। সুন্দরবনে সমবায় ব্যবস্থার প্রসার ঘটিয়েছিলেন হ্যামিল্টন সাহেব। তাঁর আমন্ত্রণে স্বয়ং রবীন্দ্রনাথ এসেছিলেন এই বেকন বাংলোতে। বাংলোটি কাঠের। উপরে টিন দেওয়া। সুন্দর সাজানো বাগানের এক পাশে কবিগুরু ও হ্যামিল্টন সাহেবের প্রস্থর মূর্তি। চায়ের টেবিলে আলাপচারিতায় ব্যস্ত দুই ভদ্রলোক। সময় থমকে আছে এখানে।

ঘেরাটোপের মধ্য়ে ডোরাকাটা।
তবে আমাদের আর থেমে থাকার উপায় নেই। ফিরতে হবে এবার। যার যার নীড়ে। দিন ফুরোলে পাখিরা যেমন ঘরে ফেরে। লঞ্চে উঠে ফিরে চললাম গদখালি। গদখালি ফেরিঘাটে লঞ্চ এসে পৌঁছল সন্ধ্যে ৭টা নাগাদ। সুন্দরবন সফর যখন থেকে শুরু হয়েছে, ইন্দ্রদার মুখে শুনে আসছি, “তোদের আমোদি মাছ আর লটে মাছের চপ খাওয়াব।“ এক্ষণে সেই ক্ষণ। চলে এল গরম গরম কফি আর মাছের চপ। স্বাদে দু’টোই বেশ ভালো। তবে আমার কাছে মজার হল আমোদি মাছের নামটা। কেমন যেন আদর মাখানো নাম। খাওয়াদাওয়া শেষে বাক্স-প্যাঁটরা নিয়ে আমরা নেমে পড়লাম ফেরি ঘাটে। অশোকদা, রাজদা এবং রান্নার দিদিদের কাছে বিদায় নিয়ে চলে এলাম গাড়ির কাছে। ফেরিঘাটের উপরে যে বাজার আছে তারও এখন অন্যরূপ। দোকান-বাজার খোলা। গমগম করছে লোকজনের ভিড়। এবার আমাদেরও গাড়ি ছুটিয়ে ঢুকে পড়তে হবে ব্যস্ত জীবনে।

এরা প্রকৃতির নয়। বন্দি এরা।
ভাল থেকো সুন্দরবন। মানুষের লোভ গ্রাস করছে তোমাকে। ম্যানগ্রোভ কেটে মাথা তুলছে বিলাসবহুল রিসোর্ট। নদীর জলে যত্রতত্র ভাসছে প্লাস্টিকের বোতল ও অন্যান্য অপচনশীল আবর্জনা। এই ভাবে জঙ্গল নষ্ট করে আমরাও এগিয়ে চলেছি ধ্বংসের দিকে। সুন্দরবনের আয়তন যত কমবে আমপান, আয়লার মতো বিধ্বংসী ঝড়ের সামনে ঢাল হয়ে দাঁড়ানোর ক্ষমতাও তত কমবে। প্রকৃতির প্রাচীরের গুরুত্ব আমরা যত তাড়াতাড়ি হৃদয়ঙ্গম করতে পারব ততই মঙ্গল।
ছবি— লেখিকা, ইন্দ্রজিৎ সাউ ও দীপশেখর দাস
(সমাপ্ত)