খাদ্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ছোলার সন্দেশের সন্ধানে

দীপক দাস

মিষ্টি ট্রেনে চড়েছি আমরা। আবার ট্রেনের মিষ্টিও খেয়েছি। ট্রেন তো বাস্তবে মিষ্টি হতে পারে না। পুরনো অনেক কিছুই মিষ্টি— এই সূত্র ধরে চললে হাওড়া-আমতা মার্টিন রেল মিষ্টি ট্রেন। ছবিতে বা ভিডিয়োয় বা কোনও সিনেমায় ছোট লাইনের এই ট্রেন দেখলেই মনটা মধুর হয়ে ওঠে। কিন্তু এ ট্রেন আমার জন্মের আগেই চলার গতি হারিয়েছে। ফলে সে মিষ্টইসুখে বঞ্চিত। অন্য কিছু মিষ্টি ট্রেন এখনও রয়েছে। যাঁরা পুরুলিয়া থেকে রাঁচি-হাতিয়া শাখার ট্রেনে চড়েছেন তাঁরা জানেন, ওই এলাকার সৌন্দর্য কী অসাধারণ। বা রামপুরহাট থেকে দুমকা শাখা। অসাধারণ সব স্টেশন। এগুলোই মিষ্টি ট্রেন। আমার মতে।

আর ট্রেনের মিষ্টি? চাখা চলছে। সঙ্গে খোঁজও। আবার আচমকাই সামনে এসে যাচ্ছে সন্দেশের সন্দেশ। ছোলার সন্দেশের খবরটা আচমকাই এসেছিল। তখন প্রথম লকডাউন শুরু হয়েছে। কোন লাইনের ট্রেনে কী খাবার মেলে, খোঁজ করা শুরু করেছিলাম। খড়্গপুর শাখায় তখন যাতায়াত শুরু করেছে দীপুর (মিস্টার ঘাসপুস) বোন নন্দিতা। আমাদের গ্রুপের সদস্য এবং লেখকও। ও বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ে। ওকে তাই খড়্গপুর-মেদিনীপুর শাখার দায়িত্ব দিলাম। নন্দিতা জানাল, ও ট্রেনে ছোলার সন্দেশ ফেরি হতে দেখেছে। খায়নি কোনওদিন। কিন্তু দেখেছে।

রামপুরহাট-দুমকা লাইন। মিষ্টি ট্রেন থেকে।

ছোলার সন্দেশ! ছোলারও সন্দেশ হয়? এ তো অন্যরকম আবিষ্কার! অজ্ঞানতাই যত বিস্ময়ের কারণ। মহাজনেরা বলে গিয়েছেন। অজ্ঞানতা মোচনে জ্ঞানরসে রসনা ভাসাতে শুরু হল খোঁজ। এদিকে নন্দিতা হাত তুলে নিয়েছে। ছোলার সন্দেশের বিষয়ে ওইটুকুই জানে ও। মেদিনীপুরের দিকের পরিচিতদের জিজ্ঞাসা করে তেমন কিছু মিলল না। শুধু সহকর্মী দিগন্ত মান্না একটু আলোকপাত করতে পারল। সন্দেশ বিক্রেতারা রাধামণি নামে একটা জায়গা থেকে আসেন। কিন্তু কোন স্টেশন থেকে ওঠেন বলতে পারল না। ওই শাখায় রাধামোহনপুর নামে একটা স্টেশন রয়েছে। মুগের জিলিপি খেতে (মুগের জিলিপির উৎস সন্ধানে) গিয়েছিলাম সেখানে।

দলে আলোচনা হল। বৈঠকে নয়, ফোনে। গ্রুপের সাপ্তাহিক বৈঠক তখন বন্ধ। ঠিক হল, লকডাউন উঠলে আমরা অভিযান করব। বাগনান থেকে মেদিনীপুর পর্যন্ত ট্রেনে অভিযান চলবে। যাতায়াতের পথে নিশ্চয় কোনও সন্দেশ বিক্রেতার সঙ্গে দেখা হয়ে যাবে। কিন্তু আনলক পর্ব শুরু হতে আমরা কেমন যেন ছন্নছড়া হয়ে গেলাম। আসলে সকলেই তখন যে যার বকেয়া কাজে ব্যস্ত। এদিকে বিধানসভা নির্বাচনের দামামা বেজে গেল। কেউ সময় দিতে না পারায় একদিন একাই বেরোতে হল। সেই আমাদের প্রিয় মঙ্গলবার। অবশ্য ব্যক্তিগত কাজও ছিল পাঁশকুড়ায়। আমতা থেকে বাগনানের বাসে চেপেছি, দীপুর ফোন। ওর আজ সময় আছে, বেরোতে পারবে। তখন আর কিছু করার নেই।…

মিষ্টি ট্রেনের মিষ্টত্ব। পুরুলিয়া-রাঁচি শাখা। বেগুনকোদর স্টেশনে।

পাঁশকুড়া স্টেশনে অনেকক্ষণ খোঁজ করলাম সন্দেশ বিক্রেতাদের। বিভিন্ন হকারদের কাছে। কেউ বলতেই পারলেন না। বলতে তো পারলেন না, উল্টে প্রশ্ন, কেন খোঁজ করছি? এরকম বেশ কিছুক্ষণ চলল। শেষে এক ঝালমুড়ি বিক্রেতার কাছে খোঁজ মিলল। ততক্ষণে আমি কৌশল পাল্টেছি জিজ্ঞাসার। ঝালমুড়ি দাদাকে জানিয়েছি, ‘‘সন্দেশের নাম শুনেছি। কিনতে চাই।’’ আগে বলছিলাম, সন্দেশ নিয়ে খোঁজখবর করতে চাই। খোঁজখবর করাটা লোকে ঠিকঠাক নেয় না। ঝালমুড়ি দাদা জানালেন, এই স্টেশন থেকেই সন্দেশওয়ালারা ওঠেন। দুপুর ২টো নাগাদ তাঁদের প্ল্যাটফর্মে পাওয়া যাবে। হাতে সময় আছে দেখে অন্য কাজগুলো সেরে নিতে বেরিয়ে পড়েছিলাম। কাজ শেষে দিগন্ত আর ওর ছেলে দেবব্রত এসে হাজির। দিগন্ত নিয়ে গেল ওদের বাড়ি। ফলে আর সময় মতো পাঁশকুড়া স্টেশনে ফেরা হয়নি।

ফিরতি ট্রেনে বেশ মন খারাপ নিয়েই বসেছিলাম। সন্দেশ না চেখেই ফিরতে হচ্ছে। কী করা যায় ভাবছিলাম। ট্রেনে একজন পাঁপড় বিক্রি করছিলেন। তাঁকে অনুরোধ করলাম, আমার নম্বরটা তিনি কি কোনও ছোলার সন্দেশ বিক্রেতাকে দিতে পারবেন? তাহলে আমি একটু কথা বলতাম। উনি রাজি হলেন। এক টুকরো কাগজে নাম লিখে দিলাম তাঁর হাতে। পাঁপড়ওয়ালা পরের স্টেশনে নেমে গেলেন। আবারও মন খারাপ। অচেনা কাউকে কি কেউ ফোন করতে চাইবেন? এরকমই সাতপাঁচ ভাবছি। হঠাৎ দেখি, বালতি হাতে একজন। ছোট ছোট প্যাকেটে বালতি ভরা। পলিথিনের প্যাকেটের ভিতরের জিনিসগুলো সন্দেশের মতোই। জিজ্ঞাসা করলাম বিক্রেতাকে। উনি বললেন, ‘‘এগুলো ছোলার সন্দেশ।’’ তখন আমার আনন্দ দেখে কে! বিক্রেতা নাম বললেন নকুল কায়েত। ট্রেনে অল্প কথাই জিজ্ঞাসা করেছিলাম। এখন কাজের সময়। একে ট্রেনে লোকজন কম। বিক্রিবাটা ভাল নয়। এই সময়ে আটকে রাখা ঠিক হবে না। নকুলবাবুর নম্বরটা নিয়েছিলাম। আর সন্দেশ কিনেছিলাম কিছু প্যাকেট। ১০ টাকা আর ২০ টাকার প্যাকেট বিক্রি হয়। পরদিন নকুলবাবুর সময় মতো ফোন করে জানলাম ছোলার সন্দেশের ইতিহাস।

ট্রেনে নকুল কায়েত।

মেদিনীপুর-খড়্গপুর শাখায় ট্রেনে মোট চারজন ছোলার সন্দেশ বিক্রি করেন। নকুলবাবু ছাড়াও রয়েছেন শ্রীকান্ত কায়েত, শ্যামল পাঁজা, রাধাকান্ত কায়েত। এঁদের বাড়ি রাধামণি গ্রামে। একটা আত্মীয়তার যোগও আছে পরস্পরের সঙ্গে। তাঁরা বাড়িতেই সন্দেশ তৈরি করেন। তার পর ট্রেনে বিক্রি করতে বেরোন। পূর্ব মেদিনীপুরের তমলুক ব্লকের বিষ্ণুবাড় ২ পঞ্চায়েতে পড়ে গ্রামটি। সেখান থেকে পাঁশকুড়া আসতে সময় লাগে। ভোর পাঁচটা থেকে কাজ শুরু হয়। নকুল হাঁফানির রোগী। তাই বেশি মালপত্র বইতে পারেন না। দিনে ৭০ প্যাকেট নিয়ে বেরোন। তিন-চার কেজি ওজন হয়। বছর ১৩ ট্রেনে ছোলার সন্দেশ বিক্রি করছেন তিনি।

নকুল জানালেন, তিনি আগে মিষ্টির দোকানে কাজ করতেন। ফলে সন্দেশ তৈরির কাজ জানতেন। কিন্তু কী ভাবে তৈরি হল ছোলার সন্দেশ? জানালেন, ওঁরাই তৈরি করেছেন। তৈরির প্রণালী সন্দেশের মতোই। ছোলা গুঁড়িয়ে ময়দার মতো করে নিতে হয়। তার পর ছানার সঙ্গে মিশিয়ে পাক করে নেওয়া। সুগন্ধের জন্য দেওয়া হয় এলাচ। পাকের বিশেষ পদ্ধতি রয়েছে। সন্দেশ খেয়ে দেখেছি। তাতে ছোলা স্বাদ আর অল্প হলেও গন্ধ পাওয়া যায়। মিষ্টি প্রিয় বাঙালির ট্রেন যাত্রায় টুকটাক মুখে ফেলে সময় কাটানোর বেশ নতুন ধরনের পন্থা। অখ্যাত কারিগরেরা মিষ্টি তৈরিতে যে কত রকমের নতুনত্ব দেখান!

ছোলার সন্দেশের রূপ।

ও হ্যাঁ, সেই পাঁপড়ওয়ালা এক সন্দেশওয়ালাকে আমার ফোন নম্বর দিয়েছিলেন। তিনি ফোনও করেছিলেন। তাঁর নাম শ্রীকান্ত কায়েত। নকুল এবং শ্রীকান্ত দু’জনেই জানিয়েছিলেন, লকডাউনের সময়ে বড় বিপাকে পড়েছিলেন তাঁরা। এখন আবার লকডাউন। ট্রেন বন্ধ। তাঁদের বিপাক বোধহয় আবার বেড়েছে। ছোলার সন্দেশ কি পাড়ার মিষ্টির দোকানে ঠাঁই পাবে? তাহলে ওই চারজনের কষ্ট কম হত। মিষ্টির দোকান খোলার অনুমতি আছে তো এখন।

ছবি— লেখক ও যথা ইচ্ছা তথা যা-র সৌজন্যে

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *