জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

ম্যানগ্রোভ অরণ্য, নোনা জলের জীবনের বিচিত্রপুর

দীপশেখর দাস

ম্যানগ্রোভ। শব্দটা শুনলেই মনটা আনচান করে উঠে। বাঙালি মন। তাকে দোষ দেওয়া যায় না। ঘরের কাছেই ম্যানগ্রোভের আস্তানা। অনেকবার যাই যাই করেও যাওয়া হয়ে উঠেনি। ওদিকে বান্ধবীরা বাঁধ ভাঙা উল্লাসে ম্যানগ্রোভের ডালে চেপে মুখপুস্তিকায় পোস্টায়। যদিও ওরা কাজের সূত্রেই ‘সোঁদরবনে’ যায়। তবুও তো যায়। আমার আর যাওয়া হয় না। তাই বান্ধবীদের উল্লাসে মন ব্যথিত হয়। মনে ঈর্ষাও জাগে প্রবল।

কিছুদিন আগে গেলুম আমার পুরনো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেই বান্ধবীদের সঙ্গে দেখা। গল্পে আলোচনায় আবার সেই ‘সোঁদরবন’। ওরা আবার নাকি ‘বেরোচ্ছে’। উৎফুল্লতা ঠিকরে পড়ছে ওঁদের ভাবভঙ্গীতে। বললুম সঙ্গে নিতে। পাত্তাই দিল না। কোনওদিনই দিত না যদিও। সুন্দরীদের পাত্তা সহজে পাওয়া যায়!

অভিযান শুরু।

একরাশ বিষণ্ণতা নিয়ে ফিরে এলুম। কাজে মন নেই। মাথায় ‘সোঁদরবন’ ঘুরছে। আমার এখনকার বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক (ডঃ দেবব্রত মাইতি) ব্যাপারটা লক্ষ্য করেছিলেন কিনা জানি না। একদিন ল্যাবরেটরিতে যেতে বললেন ‘‘চল ঘুরে আসি।’’ এককথায় সায় দিলুম। ঘোরাতে না নেই আমার।

কাহিনিটা কিছুদিন আগের। তখনও করোনার দ্বিতীয় ঢেউ ভারতের সৈকতে আছড়ে পরেনি। ল্যাবের সকলে মিলে বেরিয়ে পড়লুম সমুদ্রের ঢেউ খেতে। দিঘায়। স্যারও পুরো পরিবার-সহ আমাদের সঙ্গে বেরিয়ে পড়লেন। এই বেরিয়ে পরার উদ্দেশ্য ল্যাবের চার দেওয়াল ছেড়ে চোখ দু’টোর দৃষ্টি একটু প্রসারিত করা। আর ওই দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশিতে কেলি করে দেওয়াল বন্দি দগ্ধ মনে শীতলতা আনা।

মাছের আশায় ওত পেতে দুই শিকারি।

চাইলুম এক। হল এক। দিঘা ভিড়ে ঠাসা। দিগন্ত ছোঁয়ার আগেই গিজগিজ করা কালো মাথায় চোখ আটকাল। সাগরের ঠান্ডা বাতাসে হাজারো মানুষের নি:শ্বাস মিশে গরমের হলকা। প্রাণ জুড়ানোর বদলে আমাদের পালাই পালাই অবস্থা। কথা ছিল দু’রাত কাটানো হবে দিঘায়। বাগনান কলেজের শিক্ষক, আমাদের ল্যাবের সিনিয়র আক্রামুলদা সেরকমই সব ব্যবস্থা করে রেখেছিলেন। এই ‘ডে আউটের’ মাস্টারমাইন্ড তিনিই। দিঘার পরিস্থিতি বিচার করে প্রথম রাতেই আমরা গভীর আলোচনায় বসলুম বিকল্পের সন্ধানে। অনেকগুলো জায়গার নাম উঠে এল আলোচনায়। মন্দারমণি, লাল কাঁকড়া বিচ কিছুই বাদ গেল না তাতে। আক্রামুলদা বললেন ‘‘বিচিত্রপুর যাওয়া হোক। একটা অন্য রাজ্য ঘোরাও হবে। আবার সকালে বেরিয়ে সারাদিন ঘুরে রাতে এখানেই ফেরা যাবে। এমনিতেই দু’দিনের জন্য ঘর বুকিং করা আছে। অন্য কোথাও যেতে চাইলে খরচ বাড়বে।’’

মাছ শিকারি নৌকা। আছেন মেয়েরাও।

‘‘কী আছে বিচিত্রপুরে?’’ স্যার জানতে চাইলেন। ‘‘ম্যানগ্রোভ’’, আক্রামুলদার উত্তর।

আক্রামুলদা ল্যাবের পুরনো লোক। আমাদের সকলের নাড়ির গতি জানেন। ম্যানগ্রোভের নাম শুনলে স্যার যে সেখানে যাবেনই এটা ভাল করেই জানেন। ম্যানগ্রোভে আমাদেরও আপত্তি থাকবে না সেটাও বোঝেন। ফলে পরদিন সকালে প্রাতরাশ সেরেই বেরিয়ে পড়া হল। আমরা নিজেদের গাড়ি নিয়েই গিয়েছিলুম। তাই এদিক ওদিক যেতে কোনও অসুবিধা ছিল না। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমরা বঙ্গের সীমানা পেরিয়ে কলিঙ্গে প্রবেশ করলুম। একটু পরেই ওড়িশার খ্যাতনামা চন্দনেশ্বর মন্দির এল। আমরা এদিকে আসছি জেনে দেবত্রীর মা ওকে চন্দনেশ্বরে পুজো দিতে বলেছিলেন। তাই মন্দির দেখা মাত্রই দেবত্রীর পুজো দেবার বায়না শুরু হল। খুব ছটপটে মেয়ে। কিছু চাইলে সঙ্গে সঙ্গেই ওকে জুগিয়ে দিতে হয়। মৃন্ময়, সৌরভ ফেরার সময় পুজো দেওয়া হবে বলে বোঝানোর চেষ্টা করল। মৃন্ময়, সৌরভ প্রেম করেনি কোনওদিন। ফলে কোনও মেয়েকে কিছু বোঝানো ওদের পক্ষে সম্ভব নয়। শেষে জয়ন্ত ধমক দিয়ে দেবত্রীর বায়না থামাল। জয়ন্ত…। না, আমার জানা নেই।

এভাবেই ঢুকে আসে নোনা জল।

দেবত্রীর বায়না থামল। আমরাও চন্দনেশ্বর মন্দিরকে পাশ কাটিয়ে এগিয়ে চললুম বিচিত্রপুরের দিকে। মন্দির পেরোতেই আমরা গ্রামাঞ্চলে প্রবেশ করলুম। প্রকৃতিও অনেক শান্ত হয়ে গেল। ইট পাথরের জঙ্গল নিমেষে বদলে গেল সবুজের সমারোহে। মনোরম প্রকৃতির মধ্যে দিয়ে আমাদের পেটে নিয়ে যান দুটো বিচিত্রপুর পৌঁছল। বিচিত্রপুর ছিমছাম জায়গা। বাঁশের কাঠামোয় দাঁড়িয়ে থাকা দু’তিনটে খাবারের দোকান আর দু’একটা মনোহারি দোকান এখানের পর্যটক ‘পরিকাঠামো’ গঠন করেছে। এখানকার টিকিট ঘরটাই একমাত্র পাকা। বিচিত্রপুর আসলে একটা দ্বীপ। সমুদ্র, একটা নদী আর অনেকগুলো নদী-খাল জায়গাটাকে ঘিরে রেখেছে। সমুদ্রের নোনাজল আর নোনাবালির মাটির সঙ্গে সখ্য করে ম্যানগ্রোভেরা তাদের বসতি নির্মাণ করেছে। তাই ওই ম্যানগ্রোভকে ছুঁতে চাইলে জল পেরোতে হবে। আর সেই জল পেরোনোর নগদ আদায়ের জন্যই ওই টিকিট ঘর।

বাঁচার আশায় জেগে। শ্বাসমূলেরা।

দু’টো ছয় আসনের ‘ভুটভুটি’ নৌকা চলে এখানে। প্রত্যেকটির ভাড়া ১২০০ টাকা। আমরা দলে ১২ জন। দুটো ভুটভুটি চেপে রওনা দিলুম ম্যানগ্রোভ ছুঁতে। অবশ্য ভুটভুটি চাপাটা চটজলদি হয়ে উঠেনি। এখানের ভুটভুটি চলে টোকেন সিস্টেমে। আমরা ১৩ আর ১৪ নম্বর টোকেন পেলুম। যখন টোকেন পেলুম তখন ভাটা। ফলে বেশ কিছুক্ষণ পারাপার বন্ধ রইল। পারাপার শুরু হলে ৩-৪ নম্বর টোকেনধারীরা ভুটভুটি চাপলেন। ভুটভুটির মাঝিরা (নাকি চালক বলব) বললেন ঘণ্টা দেড়েক দেরি হবে ১৩য় পৌঁছতে। অগত্যা সময় কাটাতে আমাদের ফটোসেশন আর এদিক ওদিক ঘোরা চলল। স্যার অবশ্য বসে থাকেননি। মনোহারি দোকানে গিয়ে দরদাম করে দোলনা থেকে খেলনা কিনে ফেলেছেন অনেক কিছুই। জয়ন্তর হাতেও দেখি চিরুনি আর …। না আয়না নয়। খোঁপার কাঠি।

জলের দুনিয়ায়।

কেনাকাটার সব জিনিসপত্র গাড়ির ডিকিতে চালান করে আমরা ভুটভুটি চাপলুম। জলরাজির ঢেউয়ে ভেসে এগিয়ে চললুম ম্যানগ্রোভের আস্তানায়। খাল পেরিয়ে নদীতে পড়তেই ম্যানগ্রোভের দল ঘিরে ধরল আমাদের চারপাশ। তাদের কেউ কেউ যেন নদীতে ঝাঁপাতে উদ্যত। কারও শাখে বক, কারও বা পানকৌড়ি। কোথাও বা মাছরাঙা ডালে বসে নিবিড় দৃষ্টি রেখেছে নদীর জলে। আমরা তাদের দেখতে দেখতে নদীপথ ধরে এগিয়ে চললুম। কিছুক্ষণ পর ভুটভুটি থামল। মোহনার চরে একটা জায়গায় নামিয়ে দিলেন। জানিয়ে দিলেন তাড়াতাড়ি জঙ্গল ঘুরে নিতে হবে। আধঘণ্টা পর আমাদের ফেরাতে আসবেন। আমাদের আগে এখানে এসে জঙ্গল ঘুরে ফেলা অপেক্ষারত দলকে চাপিয়ে নিয়ে ওঁরা ভুটভুটির মুখ ঘোরালেন পরের দলকে আনতে।

আমাদের দল।

আমরা জঙ্গলে পা দিলুম। আমি ম্যানগ্রোভ প্রথম দেখলুম। তাই তারা সবাই আমার অচেনা। জয়ন্ত, মৃন্ময় অনেকবার ‘সোঁদরবন’ গেছে। সেখানকার ম্যানগ্রোভদের নিয়ে বই লিখেছে। তারাই আমার পরিচয় করাল হরকচ, খলসে, আমুরদের সঙ্গে। দেখলুম, নোনাজলের সঙ্গে যুঝে মূলের শ্বাসে তাদের বেঁচে থাকার সংগ্রাম। আমরা এগোতে থাকলুম। জঙ্গল ঘন হল। ম্যানগ্রোভের ঘন জঙ্গলে মাটি রোদ্দুর পায় না। তাই মাটিতে একটা নরম ভাব থাকে সবসময়। পরিবেশেও। ফলে গাছের ছালেও শ্যাওলা ধরে। ছত্রাক জন্মায়। জঙ্গলের ভিতরেও নোনাজল আসে। ছোট নালাগুলোতে জোয়ারের জল ছোটে। ছোট মাছেরা পথ ভুল করে আটকা পড়ে জীবিকার দিশা দেখায়। মাছ ধরার নৌকা দেখলাম কয়েকটা। মেয়েরা কোমরে হাঁড়ি বেঁধে ছাঁকনি জাল হাতে জীবনের রসদ খোঁজেন এই ম্যানগ্রোভের বাদাড়ে। সুন্দরবন যাওয়া হয়নি। কিন্তু, গল্প শুনেছি বিস্তর। সেখানেও নাকি নালায় জোয়ারের জল আসে। জাল হাতে মেয়েরা নদী-নালায় এমন ভাবেই ঝাঁপিয়ে পড়ে পেটের ভাত জোগাড় করেন। দৃশ্যে আশ্চর্য মিল! এখানকার দৃশ্যগুলোই আমায় ‘সোঁদরবনে’র জীবন দেখায়। তবুও পার্থক্য থেকে যায়। দিন শেষে এঁরা সবাই ঘরে ফিরে সন্ধ্যায় তুলসিতলায় দীপ জ্বালেন। ‘সোঁদরবনে’ অনেকেরেই ফেরা হয় না। তাঁদের দীপ নিভে যায় চিরতরে।

নোনা অরণ্য।

নানারকম ভাবনায় খানিক অন্যমনস্ক হয়ে পড়ি। জয়ন্তরা ডাক দেয়। আমাদের জন্য নির্ধারিত সময় পেরিয়েছে। দূরে ভুটভুটির আওয়াজ। আমাদের ফিরতে হবে। এই প্রশান্তির জায়গা ছেড়ে ফিরতে হবে কোলাহলে। ফিরতে হবে যান্ত্রিক জীবনে।

ভুটভুটি এল। আমরাও ফিরলুম। ফেরার পথে চন্দনেশ্বর মন্দিরে থামলুম। দেবত্রী পুজো দিল। বোধহয় স্যার-ম্যাডামেরাও দিলেন। সন্ধ্যার দিকে দিঘায় ফিরলুম। পরদিন প্রাতরাশ সেরে রওনা দিলুম।

ম্যানগ্রোভ, নোনাজলের নদী-নালার জীবনের স্পর্শে মন সতেজ হয়ে গিয়েছে তখন।

ছবি— ডঃ দেবব্রত মাইতি, জয়ন্ত ঘোষ, মৃন্ময় মিদ্দ্যে ও দীপশেখর দাস।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *