অন্য সফর জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

নদীর নামে স্টেশন- কুন্তীঘাট

দীপক দাস

প্রথম পড়া ভ্রমণ সাহিত্য কোনটা? রবি ঠাকুরের রেলগাড়ি চড়ার অভিজ্ঞতা। বাবার সঙ্গে বোলপুর যাত্রার সেই কাহিনি। সেই রেলগাড়িতে উঠতে গিয়ে পা ফসকে যাওয়ার ভয়। ছিটকে পড়ার আতঙ্ক। এটাই যে প্রথম সে বিষয়ে একমত হবেন অনেকেই। প্রাথমিক স্কুলে ‘কিশলয়’ নামের পাঠ্যবইয়ে ছিল লেখাটি। কোন ক্লাসের পাঠ্য ছিল তা আজ আর মনে নেই। দ্বিতীয় শ্রেণির সম্ভবত। বেশ লাগত পড়তে। ওই লেখা পড়েই বোধহয় ট্রেনে উঠলে জানলার ধারে বসার ইচ্ছেটা তৈরি হয়েছিল। কু-ঝিকঝিক করে যাচ্ছে রেলগাড়ি। খাল, বিল, নদী, মাঠ, মানুষ শনশন করে পিছনের দিকে চলে যাচ্ছে। আবার নতুন দৃশ্য চলে আসছে চোখের সামনে। বড় মধুর সফর।

জানলার ধারে বসেই একদিন দেখে ফেলেছিলাম কুন্তীঘাট স্টেশনটি। সেই কোন ছোটবেলায়। মনে গেঁথে গিয়েছিল। হাওড়া-কাটোয়া শাখার ট্রেন সফরটাকে সেই কবে যেন আধাআধি করে ফেলেছিলাম মনে মনে। একটা ভাগ ব্যান্ডেল পর্যন্ত। ব্যান্ডেল থেকে আরেকটা ভাগ। কেন এমন মনে হত জানি না। কিন্তু হত। হাওড়া থেকে ব্যান্ডেল পর্যন্ত স্টেশনগুলো একটু শহুরে বলে? স্টেশনের চারপাশে বাড়িঘর দৃষ্টিপথে বাধা দেয় বলে? হবে হয়তো।

কুন্তী নদী। ট্রেন থেকে তোলা।

সেদিন আবার গেলাম ট্রেন থেকে কুন্তীঘাটকে দেখব বলে। দেখলাম। স্টেশনটাকে তেমন আহামরি বলে মনে হয়নি। গ্রামাঞ্চলের স্টেশন যেমন হয় আর কী। নি:সঙ্গ ওভারব্রিজ। বেশিরভাগ যাত্রী তো রেললাইন পেরিয়েই যাতায়াত করেন। ট্রেন থামলে একটু চাঞ্চল্য বাড়ে। তার পর আবার শুনশান। তবে স্টেশনের কাছাকাছি প্রচুর গাছপালা রয়েছে। এই শাখার ট্রেনে হুগলি জেলার ভাগে পড়া এলাকাগুলোয় একটা জিনিস চোখে পড়ে। প্রচুর কলাবাগান। কলার চাষ হয় প্রচুর। অন্য চাষের জমিও রয়েছে। দু’পাশের আদিগন্ত জমি দিয়ে ছুটে চলা ট্রেন থেকে দেখতে ভালই লাগে।

ওভারব্রিজের বাঁকে।

এবার ভাল লাগল কুন্তী নদীটাকে। সেতুর উপর দিয়ে নানা রকম ঝঙ্কার তুলে ছুটে চলেছে ব্যান্ডেল-কাটোয়া লোকাল। নীচ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কুন্তী। বেশি চওড়া নয় নদী। সুন্দরীও নয়। ঘোলাটে জল তার। কিন্তু পাড়ের দৃশ্য ভাল লাগল। অল্প সময়ের দেখা। তবুও। নদীর উঁচু পাড়ে অনেক বাড়ি। প্রতিটি বাড়ি গাছে ঘেরা। চলন্ত ট্রেন থেকে ছবি তুলতে পেরেছিলাম। ছবিতে দেখতে পাচ্ছি, গাছের জটলা থেকে উঁকি দেওয়া প্রতিটি বাড়ির সামনে থেকে নদীর কিনারা পর্যন্ত যাতায়াত চলে। কোথাও বাঁধানো সিঁড়ির ধাপ, কোথাও বাঁশের সাঁকো রয়েছে। আর সিঁড়ি বা সাঁকোর কাছে নদীতে ভাসছে একটা করে নৌকা। অনেকগুলো নৌকা। এই নৌকাগুলো ব্যক্তিগত না ফেরির জানি না। তবে নৌকা যে নদীর পাড়ে বসবাসকারীদের অন্যতম বাহন, সেটা বোঝা যায়। কোনওদিন ওই পাড়ায় গিয়ে দেখে আসতে হবে নদী-নৌকা আর জীবনের যোগ।

পিকনিকের সময়ে দেখা নদীর রূপ।

কুন্তী নদীকে নানা ভাবেই দেখেছি। নানা রূপে। বড় পরিচিত এ নদী। প্রথমবার দেখা রাজহাটে ময়ূর দেখতে গিয়ে। ব্যান্ডেল থেকে যেতে হয়। গ্রামটার নাম গান্ধীগ্রাম। কুন্তী নদীর পাড়ে। গ্রামে প্রকৃতির মধ্যে চড়ে বেরানো ময়ূরগুলোকে দেখভাল করেন উপেনদা। উপেন কল্লা। ময়ূর দেখে গিয়েছিলাম কুন্তী নদীর ধারে। বাঁশঝাড়, চাষের জমি, আমবাগান পাশে পাশে নিয়ে এগিয়েছে নদী। কিন্তু তখন ছিল সে শুকনো। এতটুকু জল নেই। যেন মনে হচ্ছিল পঞ্চপাণ্ডব আর একমাত্র পুত্রবধূকে নিয়ে রাজমাতা, রাজকন্যা কুন্তী অজ্ঞাতবাসে রয়েছেন। ময়ূর, বেণুবন, কদলী দঙ্গল নানা ছদ্মবেশে লুকিয়ে থাকা তাঁরই আত্মজ-আত্মীয়। নদীর কুন্তী নাম কি মহাভারতীয় অনুষঙ্গ থেকেই? জানি না।

সেই কাঠের সেতু।

নদীর কাছে আবার গেলাম। এবার দলবল নিয়ে বনভোজনে। সে মহা সমারোহ। নদীর পারে আড্ডা বসেছিল। কাঠের নড়বড়ে ভাঙা সেতু দিয়ে পারাপার নিয়ে মজা হল। পার হওয়ার আতঙ্কের মজা। তখন নদীতে জল দেখেছি। অল্পই জল। কিন্তু কচুরিপানায় রুদ্ধ পথ।

এমন ছিল কুন্তী নদী। রাজহাটের গান্ধীগ্রামে।

তৃতীয় বারের জন্য কুন্তী নদীর পাড়ে গিয়েছিলাম বছর দুয়েক আগে। এবার ময়ূরদের খেতে দিতে। খবর এল, ময়ূরগুলো বিপদে পড়েছে। খেতে পাচ্ছে না। চাল-গম জোগাড় করা হল। দিয়ে এলাম উপেনদাকে। গিয়ে বুঝলাম, কেন ময়ূরগুলোর এমন হাঁড়ির হাল। উপেনদাই বললেন। কুন্তী নদী সংস্কার করা হয়েছে। তাতে নদীর পাড়ের ঝোপঝাড় পরিষ্কার করতে হয়েছে। নদী হয়ে গিয়েছে নি:সঙ্গ। সেই সঙ্গে পোকামাকড়ও সব শেষ। ময়ূরদের খাবারে টান। অনেকেই উড়ে গিয়েছে পাশের গ্রামের দিকে।

সংস্কারের পরে এমন হয়েছে নদী।

আর কুন্তী? প্রায় সবুজহীন। কুরুক্ষেত্রের ভয়ঙ্কর আত্মীয়ঘাতী যুদ্ধের পরে রাজামাতা কুন্তীর মনের দশা বোধহয় এরকমই হয়েছিল।

ছবি— দীপু, শুভ, ইন্দ্র

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *