ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

পাতিহালের গুমোরাজ আর বেলের পিপীলিকেশ্বর

দীপক দাস

ঘোড়াগুলো খুব টানত। না, নেওয়ার লোভ জাগেনি। ঠাকুর রেগে গিয়ে পাপ দিতে পারে। পাপিষ্ঠ হওয়ার ভয়টা সেই বয়সেই মনের মধ্যে ভাল মতো গেঁথে গিয়েছিল। তখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ি। পাতিহাল সুধাময় আদর্শ বালিকা বিদ্যালয়ের একেবারে গাঁ ঘেঁষেই ঠাকুরের থান। এখনও আছে।

জেনেছিলাম, ঠাকুরের নাম গুমোরাজ। আর তাঁর নামানুসারেই এই এলাকাটির নাম হয়েছে গুমোতলা। ঠাকুরকে পুজো দেওয়া হয় ঘোড়া দিয়ে। ছোট ছোট মাটির ঘোড়া। তৈরি করেন পাতিহালের কুমোরেরাই। যাঁদের মাটির তৈরির জিনিসপত্রের খ্যাতি একদিন রাজধানী কলকাতা পর্যন্ত পৌঁছেছিল। তখন এত কিছু জানতাম না। পরে পাতিহালের ইতিহাস লেখার সময়ে কুমোরপাড়া এবং এই দেবতা সম্পর্কে আগ্রহ জাগে।

গুমোরাজ লৌকিক দেবতা। তাঁর মূর্তিহীনতা এবং মাটির ঘোড়া দিয়ে পুজো দেওয়ার রীতিই তা প্রমাণ করে। একখণ্ড পাথর গুমোরাজ হিসেবে কল্পিত। এরকম লৌকিক দেবতা গ্রামে অনেকজনই রয়েছেন। মন্দিরতলায় রয়েছেন শীতলা। একটি অশ্বত্থ গাছের নীচে একখণ্ড পাথর রূপে অবস্থান। রয়েছেন ধর্ম, শীতলা। এঁদের কারও মূর্তি নেই। কিন্তু ধর্ম, শীতলা সম্পর্কে জানা যায়। গুমোরাজ সম্পর্কে কোনও তথ্য তেমন মেলেনি। সেই ২০০৫ সাল থেকে চেষ্টা চলেছে। এই সেদিনও বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ভাই-বোনেদের দিয়ে খোঁজ নেওয়ার চেষ্টা করেছি। অন্তত যদি ‘গুমো’ শব্দটির উৎপত্তি জানা যায়। কিন্তু মেলেনি।

অশ্বত্থ গাছের নীচে গুমোরাজ।

তাহলে গুমোরাজ কীসের দেবতা? কী ভাবে পাতিহালে প্রতিষ্ঠা পেলেন? দেবতার উৎস সন্ধানে বছর ১৫ আগে কথা বলেছিলাম গ্রামের শ্রদ্ধেয় শিক্ষক রতনচন্দ্র বাগের সঙ্গে। আর কথা হয়েছিল শেঠ পাড়ার মানিক শেঠের সঙ্গে। দু’জনেই বর্তমানে প্রয়াত। এঁরা জানিয়েছিলেন, গুমো আসলে একধরনের প্রাণী। বাঘের মতো দেখতে। সেই প্রাণীটি মানুষ ও গরুকে আক্রমণ করত। হামলা থেকে বাঁচতে গ্রামবাসী গুমোরাজ প্রতিষ্ঠা করেন। আরেকটি মত হল, গুমোরাজ হলেন গো-রক্ষক। গ্রামের বাসিন্দাদের গবাদি পশু রক্ষা করতেন। কী থেকে রক্ষা করতেন? শোনা যায়, গোবাঘার হাত থেকে। জনশ্রুতি দু’টোর মধ্যে একটা মিল রয়েছে, কোনও একটা প্রাণীর আক্রমণ থেকে বাঁচতে এক দেবতাকে ঢাল করা হয়েছিল। যেমন, বাঘের হাত থেকে বাঁচতে দক্ষিণ রায়, কুমিরের মুখ থেকে বাঁচতে কালু রায়কে কল্পনা করা হয়েছে। অবিভক্ত মেদিনীপুরে বিভিন্ন বুড়ির থান রয়েছে। এই বুড়িরাও বিভিন্ন বিপদআপদ থেকে গ্রামবাসীদের রক্ষা করেন বলে বিশ্বাস। যেমন, ভর্তাবুড়ি, পুকুরিয়া বুড়ি, শিকারি বুড়ি। বাংলার লৌকিক দেব-দেবীর উৎপত্তির প্রবণতা বিচারে গুমোরাজের কল্পনা ও জনশ্রুতির সঙ্গে সংযোগ রয়েছে। মানুষের বাঁচার পথ ধরেই তিনি গ্রামে অধিষ্ঠিত হয়েছেন, ধরে নেওয়া যায়।

কিন্তু কোন প্রাণীর হামলা থেকে গুমোরাজ বাঁচাতেন? প্রথম জনশ্রুতির প্রাণীর নাম, গুমো। এরকম কোনও প্রাণীর সন্ধান পাইনি। কারও জানা থাকলে সমৃদ্ধ হব। গুমো শব্দের উৎসও জানতে পারিনি। অথচ শব্দটি অপরিচিত নয়। উত্তর ২৪ পরগনায় গুমা নামে একটি জায়গা রয়েছে। এমনকি পাতিহালের দু’তিনটি গ্রাম পরে গুমাডাঙ্গি নামে একটি জায়গা রয়েছে। গুমো স্থানভেদে গুমা হিসেবে উচ্চারিত হতে পারে। ২৪ পরগনার গুমায় এই নামে কোনও লৌকিক দেবতা আছেন কিনা জানা নেই। যে দু’টি সূত্র ছিল তা নেড়েচেড়ে নেতিবাচক ফলই মিলেছে। কিন্তু গুমাডাঙ্গিতে গুমো ঠাকুর রয়েছেন। আমি আর ইন্দ্র গিয়ে একদিন দেখেও এসেছি। সেদিন গুমো ঠাকুরের পুজো হচ্ছিল। কিন্তু প্রাণীর গল্প মেলেনি। পুজোয় বহু লোকের ভিড় হয়েছিল সেদিন। মালায় ঢেকে গিয়েছিলেন ঠাকুর। দ্বিতীয়বার গিয়ে সাক্ষাৎ পেয়েছি গুমো ঠাকুরের। এক বিশাল নিমগাছের নীচে তাঁর অবস্থান। থানের এক ফলকে তাঁকে গুমোরায় হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এখানেও কোনও মূর্তি নেই। ঘট পুজো হয়। গুমো ঠাকুরের সঙ্গে শীতলা, মনসাও পূজিত হন। তবে কোনও মূর্তি নেই তাঁদেরও।

গুমাডাঙ্গির গুমোরায়। এখানে ঘট পুজো হয়।

তাহলে গুমো কি প্রাণী? ২৪ পরগনার গুমার কথা বলতে পারব না। কিন্তু হাওড়া জেলার পাতিহাল আর গুমাডাঙ্গির গুমো সম্পর্কে একটা ধারণা করা যেতে পারে। হতে পারে গুমো আসলে বাঘরোল। পাতিহাল এক সময়ে জলা জায়গা ছিল। জলাভূমিতে চাষবাস করা শুরু করেন আশপাশের গ্রামের লোকজন। ধীরে ধীরে গ্রাম পত্তন হয়। জলা জায়গায় বাঘরোল থাকা অসম্ভব নয়। কিছু বছর আগেও গ্রামে একটা বাঘরোল মেরেছিল আদিবাসী শিকারিরা। গুমাডাঙ্গি এলাকাতেও বাঘরোল থাকা অসম্ভব নয়। অন্তত একসময়ে ছিল, এ কথা মেনে নিতে তেমন আপত্তি উঠবে বলে মনে হয় না। এলাকায় প্রচুর জলাশয়। আগে নিশ্চয় আরও ছিল। খাদ্যের অভাব থাকার কথা নয়। কিন্তু গুমোকে বাঘরোল ধরে নেওয়ায় একটা সমস্যা আছে। বাঘরোল কি মানুষকে আক্রমণ করে? যত দূর জানি, করে না। গবাদি পশুর উপরে হামলা চালায় না বলেই জানি। কিন্তু বাঘরোলকে বাঘ ভেবে নেওয়ার ভ্রান্তি ঘটেই থাকে। সেই ভয়েই কি?

বাকি রইল গোবাঘা। কিন্তু গোবাঘা মানে তো হায়না। চিতা বাঘও হয় অবশ্য। এই দু’টো প্রাণী কোনওদিন পাতিহাল এলাকায় ছিল, এমন তথ্য জানা নেই। তাহলে? এই দুই প্রশ্নের উত্তরেই হয়তো গুমোরাজের আবির্ভাব কাহিনি লুকিয়ে রয়েছে। কিন্তু উত্তর খুঁজবে কে?

গুমোরাজের সেবায়েত গুমোতলার বন্দ্যোপাধ্যায় পরিবার। আবির্ভাব যে কারণেই হয়ে থাক না কেন পাতিহালে গুমোরাজের গুরুত্ব কিন্তু দিন দিন বাড়ছে। থানটি এখন শ্বেতপাথর দিয়ে বাঁধানো। আগে শান বাঁধানো ছিল। এখন কেউ বিশাল আকারের মাটির ঘোড়াও গুমোরাজের কাছে উৎসর্গ করেছেন। হয়তো বিশেষ মানত ছিল। আগে ছোট ছোট পোড়া মাটির ঘোড়াই উৎসর্গ করা হত।

গুমোরাজের মতোই আরেক রক্ষাকর্তা রয়েছেন। তিনি পিঁপড়ের অত্যাচার থেকে বাঁচান। দেবতার নাম পিপিলেশ্বর। নিজবালিয়া গ্রামে পিপিলেশ্বরের মন্দির রয়েছে। গ্রামটি পাতিহাল গ্রাম পঞ্চায়েতের মধ্যেই পড়ে। বেলেবাজারে সিংহবাহিনী মন্দিরের কাছেই পিপিলেশ্বর মন্দির। ইনি শিব। তাঁর আবির্ভাব কাহিনি বেশ অন্যরকম।

পিপিলেশ্বর মন্দিরের ভিতরে।

কাহিনিটি এরকম, সিংবাহিনী মন্দিরের কাছেই একসময়ে ছিল নলখাগড়া ও বেতের ঘন জঙ্গল। সেখানে এক বেলগাছের নীচে মহাদেব গুপ্তভাবে অবস্থান করছিলেন। একদিন কোনও একজন বেত কাটতে গিয়ে অজান্তে শিবলিঙ্গে আঘাত করে ফেলেন। সারাদিন ও রাত ক্ষতস্থান থেকে গাঢ় দুধ বেরোতে থাকে। আর অসংখ্য পিঁপড়ে জমা হয়ে শিবলিঙ্গের উপরিভাগে। পরেরদিন জঙ্গলে কাঠ কুড়োতে গিয়ে পিঁপড়ে ঢাকা মহাদেবকে দেখতে পান কয়েকজন। তাঁরাই গ্রামের লোকজন ডেকে আনেন। পরে গ্রামবাসীরাই জঙ্গল পরিষ্কার করে মন্দির তৈরি করেন। পিপীলিকা দেবতাকে ঘিরে ছিল বলে তাঁর নাম হয়, ‘পিপীলিকেশ্বর ভৈরব’। পরে লোকমুখে হয়ে যায় পিপলেশ্বর বা পিপুলেশ্বর। এই কাহিনি সংগ্রহ করা হয়েছিল বিজয়কৃষ্ণ ভট্টাচার্যের ‘বালিয়াদেবী সিংহবাহিনীর অমৃত কাহিনি’ নামে একটি পুস্তিকা থেকে। তিনি নিজবালিয়া গ্রামের বাসিন্দা ছিলেন। মন্দিরের শিবলিঙ্গটির বৈশিষ্ট্য অন্যরকম। ক্ষত চিহ্ন রয়েছে। এবং তা ওই জনশ্রুতির আঘাতের ফলে বলে লোকবিশ্বাস।

পিপিলেশ্বর মন্দিরে শীতলাও রয়েছেন। তাঁর কোনও মূর্তি নেই। আর রয়েছেন শিবের বাহন নন্দী। বাড়িতে পিঁপড়ের অত্যাচার বাড়লে মন্দিরে পুজো দেন লোকে। মানত করেন। বৈশাখ মাসে ভক্তরা পুজো দিতে আসেন।

কভারের ছবি- গুমোরাজ

ছবি- ইন্দ্রজিৎ সাউ

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *