পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ছানা ফড়িংয়ের দল আর একমুঠো নিজস্ব নির্জনতা

রবিশঙ্কর দত্ত

কুঞ্জবিহারীর প্রসিদ্ধ পাটালি আর খেজুরগুড়— পাকা দোকানঘরের গায়ে আঠায় সাঁটানো কাগজ। তাতে ছাপানো ওই একটি লাইন। চোখে পড়তে কাকভোরেই জিভের আড়মোড়া ভাঙতে লাগল। নরম সকালে বাঁশির সুরের মতো ভেসে গেল রসের গন্ধ।

মাটি যত শুকনো হয়, খেজুর নাকি তত মিষ্টি হয়। মানুষের ক্ষেত্রে এমন হয়?

কিন্তু এমন নাম যাঁর সেই মানুষটি, সেই কুঞ্জবিহারী কেমন? আলুথালু এ সব ভাবতে ভাবতে এগোচ্ছিলাম। কুয়াশায় ভিজে সামনের রাস্তা। দু’পাশের গাছ, খড়ের গাদা, টিনের চাল গড়িয়ে জলের ফোঁটা। গোটা তল্লাট ফাঁকা। বড়াইসিনির চোখে তখনও ঘুম জড়িয়ে। এই রাস্তা ধরে সোজা এগিয়ে ডান দিকে মিনিট দশ হাঁটলে লেক। আসলে বাঁধ দিয়ে, পাড় বাঁধিয়ে জল ধরে রাখা। সকালে সূর্য ওঠা দেখতে ভিড় জমে যায় জলের ধারে। মেঘ না থাকলে একটু একটু করে ফুটতে থাকা আলো এসে পড়ে জলের গায়ে। সেই আলো এসে পড়ে জলের গা ঘেঁষে দাঁড়ানো মুড়াডি পাহাড়ের সবুজে। এলোমেলো বসে-ছড়িয়ে থাকা পাখির দল সজাগ হয়।

সুনীল মাহাতোর লেখা বিখ্যাত ঝুমুর গান।

সে সকালে আমার যাওয়া হল না। খানিক এগিয়ে চা দোকানের উনুন জ্বালা দেখে দাঁড়াতে প্লাস্টিকের চেয়ার দেখিয়ে দিলেন ভদ্রলোক। দোকানের দিকে তাকিয়ে আঁচের অবস্থা জানতে চেয়ে বললেন, ‘‘জামাই উঠেছে গো? দাদাকে চা খাওয়াও।’’ দোকানি সকালের ধোওয়া মোছা সারছিলেন। এ দু’জনের সম্পর্ক আছে। হয় পারিবারিক নয়তো পাড়াতুতো।

চা আর চেয়ার এক করে নিতে নিতে ছাগলের বাচ্চা দু’টো চোখে পড়ল। কালো উলের বলের মতো লাফিয়ে বেড়াচ্ছে। বারবার জ্বলন্ত কাঠের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল আর ভদ্রমহিলা হাত দিয়েদিয়ে সরিয়ে দিচ্ছিলেন। মায়ের সঙ্গে বাচ্চা দু’টো এসেছিল এ বাড়িতে। দিন সাতেক হবে। চব্বিশশো টাকা উঠে আসবে দুধ বেচে। কিন্তু মা’টা মারা গেছে। তাকিয়ে দেখি, আরেক মায়ের চোখে জল।

শিউলি সকাশে সকালে।

ষষ্ঠীপদবাবুর সঙ্গে দেখা হয়েছে? হালকা রোদে আলো-ছায়া-ছাপা পিচের রাস্তায় রংচটা সাইকেলে যাচ্ছিলেন ভদ্রলোক? পাঁচের ফারাকে দু’টো সংখ্যা বলে নিজের বয়স আন্দাজ করে নিতে বলেছিলেন? বলেছিলেন, পঞ্চান্ন। না হয় ষাট হবে? ভদ্রলোকের সঙ্গে দেখা না হলে প্রকৃতি যে নিষ্প্রাণ থেকে যাবে। জঙ্গলের গাঁ-পাড়া, গাছগাছালি, মালিকানাহীন কুকুরের সঙ্গে মায়াময় সম্পর্ক ষষ্ঠীপদর। না দেখেই চিনতে পারেন, শুকনো পাতার কাঠবেড়ালি পরিবারের পায়ের শব্দ। গাছের নীচে দাঁড়িয়ে পরিচয় করিয়ে বলতে পারেন, ‘‘ও তো পিয়াল।’’

কথা রেখে এক সকালে দেখলাম পরিষ্কার সাদা খোলের ধুতি লুঙ্গির মতো জড়ানো। তাতে যে রাস্তা ঝেঁটিয়ে এসেছেন সরু পাড়ে সেই প্রমাণও রয়েছে। গায়ে একটা কাপড়ের হুডি-জ্যাকেটের মতো।

জীবন পথের সঙ্গীসাথী এরাও।

রিসর্টের গেটের কাছে পিঠ, পায়ে রোদ নিয়ে সামনের দিকে ঝুঁকে দাঁড়িয়েছিলেন ষষ্ঠীপদ। বি়ড়ি জ্বলছিল হাতে। এগিয়ে যেতে সেটা ফেলেদিলেন। বললেন, ‘‘বাবু, নমস্কার।’’ পাল্টা নমস্কার জানাতে হেসে বললেন, ‘‘দশ মিনিট সময় দিবেন..।’’ দেওয়ার অপেক্ষা না করেই গোড়ালি থেকে হ্যাঁচকা টানে ধুতিটা এক বারে হাঁটুর উপরে ছুটলেন। খানিকক্ষণ চোখ তাঁকে অনুসরণ করল ঠিকই কিন্তু সাড়ে পাঁচ ফুটের হালকা-পাতলা মানুষটা মুহূর্তে মিলিয়ে গেল শাল-পিয়ালের আড়ালে। আগের দুপুরে এই মানুষটি ফাঁকা রাস্তায় বাইরের লোক দেখে সাইকেল থামিয়ে আলাপ করেছিলেন। প্রথম দেখায় কিছুটা আলগা মনে হয়েছিল। দু’এক কথার পরে এগিয়ে গিয়েছিলাম।

সে দিন বলেছিলেন রিসর্টে দেখা করতে আসবেন, এসেছিলেন। আবার এই যে বনে গিয়েছিলেন সময় নিয়ে, সেখান থেকেও ফিরে এলেন। সময়ের আগেই। ধুতির কোচরে এক গাদা হরিতকী আর বহেরা। আমার জন্য নিয়ে এসেছেন। বললেন, ‘‘সন্ধ্যাবেলায় ভিজিয়ে রাখবেন। সকালে সেই জল খাবেন। পেটের কোনও কমপ্লেন থাকবে না।’’

কোঁচড় ভরা হরিতকী-বহেড়া।

শতাব্দী কলকাতা থেকে আসানসোল পৌঁছে দিয়েছিল সাড়ে আটটা নাগাদ। সেখান থেকে হস্তিশাবকের মতো একটা এসইউভি। শিল্পনগরী ছেড়ে যেতে যেতে ফিকে হচ্ছিল রুক্ষ্ম ভাব। সবুজ ফিরছিল চোখে। সামনে রাস্তা সেখানেই চায়ের দোকানে উদাস যুবক বলছিলেন, এখানে কাজও তৈরি হয়েছে প্রচুর। আগে স্থানীয়রা ছিল। এখন ঝাড়খণ্ড বিহার। একতারার তার টেনে সেখানেই ছেড়ে দিয়েছিলেন তিনি।

জল-পাহাড়ের টানে।

থাকার জায়গা এখন অনেক। আমি ছিলাম তারই একটার ত্রিপলের তাঁবুতে। সে তাঁবু রাতে ভেজে হিম আর পাখির ডাকে। দিনে শুকোয় রোদ আর হৃদয়ের উষ্ণতায়। তাই আর কিছু আলাদা করে মনে করতে পারছি না। তা ছাড়া পুরুলিয়ার এই বরন্তি তো আর নতুন নয়। যাওয়া-আসা সবই তো মুঠোফোনে সুলভ।

শুধু যা পাওয়া যাবে না তা হল, লড়াইয়ে যাওয়ার পরে ব্যাগ থেকে জুলজুল চোখে তাকিয়ে থাকা বিশাল কালো মোরগ। বুড়োগুড়ো মিলে তার পিছনে ছুটতে ছুটতে এ বাড়ি ও বাড়ি পেরিয়ে পাড়া মাথায় করলেও কেউ মুখ ভার করবেন না।

তাহাদের বসত।

তবে আরও একবার যেতে হবে আমাকে। বাপিদের ক’জনকে কলকাতার কথা বলতে হবে। পুরুলিয়ার প্রান্তিক গ্রামে জন্ম ওদের। দু’একজন আসানসোল পর্যন্ত এসেছে বটে কিন্তু এই কল্লোলিনীকে দেখেনি। যেতে হবে কোনও এক পার্বণের আগে। তা না হলে সেই চোখগুলোর সঙ্গে দেখা হবে না। মাটির রাস্তায় গাছের ডাল আড়াআড়ি রেখে হাসিহাসি ফড়িংয়ের মতো লাফাতে থাকা মুখগুলোতে শুনতে হবে, ‘‘সরস্বতী পুজোর চাঁদা দাও।’’

গাঙপুর প্রাইমারির ক্লাস ফাইভ ক্লাস সিক্সকে ঠেলে এগিয়ে দিয়ে বলবে— ‘‘তুই তো উঁচুতে পড়িস… বল না।’’

কুয়াশা মোড়া পথে।

আর হ্যাঁ, বিকেলের দিকে ভিড় হবে ঠিকই তবু ওই যে লাল হয়ে ওঠা লেক তার পাড়ে যদি তাঁকে চোখে পড়ে, খেয়াল করবেন, তিনি একা। শোরগোলের মধ্যেও এক চূড়ান্ত নীরবতা তৈরি করে রেখেছেন নিজের চারপাশে। অন্তত সেই বৃত্তে শব্দ করবেন না, প্লিজ।

ছবি—লেখক

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *