পৌলমী রক্ষিত
ছোটবেলা থেকেই কোজাগরী লক্ষ্মী পুজোর প্রধান আকর্ষণ ছিল তিলের নাড়ু। হাঁ করে বসে থাকতাম প্রসাদের জন্য, কখন প্রসাদের থেকে তিলের নাড়ুটা পাব। আমাদের বাড়িতে কোজাগরী লক্ষ্মী পুজো না হওয়ায় বেশি নাড়ু ভাগে পেতাম না। তাই চেয়েচিন্তে খেতে হত। কিন্তু তিলের মিষ্টির প্রতি ভালবাসা ছিল অটুট।
উত্তরপ্রদেশ প্রবাসী কিছু আত্মীয়দের সুবাদে প্রথমবার তিলের একটা মিষ্টি খেয়েছিলাম। অত দূর থেকে নিয়ে আসার ফলে সে মিষ্টির তো দফা রফা হয়ে যাওয়ার জোগাড়। দেখি, অর্ধেকেই গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে গিয়েছে। যৌথ পরিবারের সদস্য হওয়ার সুবাদে ওই গুঁড়ো গুঁড়ো মিষ্টিও গুনে গুনে পেয়েছিলাম প্রথমে। পরে যতটুকু গুঁড়ো অবশিষ্ট ছিল আমি আবদার করে বাগিয়ে নিয়েছিলাম।
কিন্তু তখন সেই মিষ্টির নাম জানতাম না। এখন আমি নিজেই প্রবাসী। দু’বছর আগে শীতকালে দিল্লি ঘুরছি। একটা মিষ্টির দোকানে হঠাৎ চোখে পড়ল সেই ছোটবেলার তিলের মিষ্টিটা। চোখের সামনে গুঁড়ো গুঁড়ো মিষ্টি তিল মিলিয়ে তখন একটা আয়তকার চাকতি দেখতে পাচ্ছি। দে দৌড়! আমার হিন্দির দৌড় দিয়েই দোকানিকে বোঝালাম, আমি এই মিষ্টিটা চাই। তা তিনি বললেন, কমপক্ষে আড়াইশো গ্রাম নিতে হবে। ঠিক আছে, তাই নেব। দুর্জনে বলে, আমি নাকি খাই খাই করি। কিন্তু খাই পাখির মতো। পণ করেছি এই মিষ্টি আমাকে খেতেই হবে। দোকানিকে সেই দফায় জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম, এই তিলের মিষ্টির অফিশিয়াল নাম হল ‘গজক’।
শীতকালে পুরো উত্তর ভারত বিশেষত রাজস্থান, উত্তরপ্রদেশ, দিল্লি, পাঞ্জাব, হরিয়ানা, বিহারের বিস্তীর্ণ অংশে নানা স্বাদের, আকারের তিলের, বাদামের মিষ্টি পাওয়া যায়। প্রবল ঠান্ডা এবং বায়ুদূষণের হাত থেকে বাঁচতে এখানে শীতকালে তিল, গুড়, বাজরার রুটি খাওয়ার প্রচলন আছে। পৌষ পার্বণের দিন যেমন আমাদের ঘরে ঘরে নানারকম পিঠেপুলি তৈরি হয়, এখানে সেরকম তিলের লাড্ডু বা তিলের মিষ্টি, গুড় খাওয়ার রেওয়াজ আছে। সূর্যের রাশি পরিবর্তনের এই তিথিতে পূর্বপুরুষের উদ্দেশে অর্পণ করা হয়, তিল।
গজক আয়তকার হয়। গুড়, ঘি, তিল, পেস্তা, চিনি দিয়ে বানানো হয় এই খাস্তা মিষ্টিটি। তবে সব গজকে পেস্তা থাকে না। গজকের মধ্যে আবার যদি শ্রেণিবিভাগ করা হয় তাহলে বলব, রাজস্থানি গজক স্বাদে অতুলনীয়। গজকের ‘গজব’ স্বাদ। অন্য গজকের তুলনায় রাজস্থানের গজকগুলি আরও পাতলা, হালকা হয়। কামড় দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই তিল, ঘি, পেস্তা মেশানো একটা গন্ধ নাকে আসবে, আসবেই।
বিহার এবং উত্তরপ্রদেশের পূর্ব অংশে এই ধরণের তিলের মিষ্টি ‘তিলকুট’ নামে পরিচিত। তবে তিলকুটের আকার গোলাকৃতি। অনেকটা ছোট কানাউঁচু থালার মত। মাঘ মাসের শুরু হওয়ার আগের দিন পাঞ্জাবে হয় ‘লোরি’ উৎসব। আসন্ন আখ চাষের প্রস্তুতির সূচনা হয় এই উৎসবের মধ্যে দিয়ে। হিন্দি সিনেমার দৌলতে সবাই এই উৎসবের সঙ্গে পরিচিত। এই ‘লোরি’ উৎসবের প্রধান খাবার হল রেউড়ি, বাদাম আর ভুট্টা। এই রেউড়িও একধরনের তিলের মিষ্টি, গুড়ের ছোট ছোট বাতাসার মত চাকতির গায়ে ভর্তি থাকে তিল। লোরির দিন এই তিন খাবার খেতেই হয়, সঙ্গে থাকে গজক, সর্ষের শাক।
ছানার মিষ্টির দেশের লোক হওয়ায় এখানে আসা ইস্তক ক্ষীরের মিষ্টি খুব একটা পছন্দ ছিল না। তবে গজক আপাতত সব দুঃখ ভুলিয়ে দিয়েছে।
ছবি- লেখিকা
(সমাপ্ত)
পাঞ্জাবের ‘লোরি’ উৎসবের কথা জেনে একটা বিষয়ের কথা মনে পড়ে গেল। ‘গৌড়মল্লার’ উপন্যাসে শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায় একটা কৃষি উৎসবের বর্ণনা দিয়েছেন। আখ কাটার পরে কৃষক পল্লিতে আনন্দ উৎসব। সেই উৎসবের কোনও নাম দেননি। ‘লোরি’ও কৃষি উৎসব। আর আখের সঙ্গেই এর যোগ। তফাৎ শুধু সময়ের। একটা আখ চাষের প্রস্তুতির উৎসব। আরেকটা আখ কাটার সময়ের উৎসব। ভারতের কৃষি উৎসবগুলো নিয়ে আরও ব্যাপক চর্চা হওয়া দরকার।