ইতিহাস ছুঁয়ে বিশেষ ভ্রমণ

চিরস্মৃতির মন্দিরের গ্রাম মলুটি

সৌগত পাল

আবার এলাম মলুটি। আগেরবার এসেছিলাম দল বেঁধে। বছর তিনেক আগে। এবারেও দল বেঁধেই এসেছি। কিন্তু দু’টো দলের বিস্তর তফাৎ রয়েছে। তিন বছর আগের দলটায় ছিল ছয় নওজওয়ান। নির্ভার, কাঁধে কোনও জোয়াল ছিল না তাদের। বা বলা যায় হাফ জোয়াল ছিল। অনেকে সেই হাফ জোয়াল নামিয়ে রেখেছে। খালি আমার জীবনের হাফ সার্কলটা ফুল হয়ে গিয়েছে।

ডানদিকে এক রেখা মন্দির। বাঁদিকে চালা মন্দির।

মলুটির কথা তো সকলেই জানেন। ঝাড়খণ্ডের শিকারিপাড়া থানা এলাকার একটা গ্রাম। জেলাটা দুমকা। মলুটি গ্রামে কাছাকাছি প্রায় ঘেঁষাঘেঁষি করে ৭২টা মন্দির রয়েছে। লোকজন বলে, একসময়ে নাকি মন্দির ছিল ১০৮টা। এই গ্রামের আরেকটা বৈশিষ্ট্য হল, এখানকার বাসিন্দারা প্রায় সকলেই বাঙালি। ঝাড়খণ্ড হিন্দিভাষী ও আদিবাসী প্রধান হলেও এই গ্রামটি বাংলা গ্রাম। বাংলার সীমানায় এই গ্রাম।

প্রথমবারে। সেই মাইল ফলক।

প্রথমবার এসেছিলাম দীপু, বাবলা, কচি, ইন্দ্রদা আর দীপকদার সঙ্গে। উঠেছিলাম মৌলীক্ষা মন্দিরের কাছে একটা ধর্মশালার ডর্মিটরিতে। ভরদুপুরবেলা সেবার খাওয়া জোটেনি। সামনে প্রেমশঙ্করের দোকান ছিল। মুড়ি, চপ আর একটা করে ডিম সিদ্ধ খেয়ে পিত্ত রক্ষা করেছিলাম। আমি সেবার কাজ থেকে ফিরেছিলাম বলে এক বাক্স সীতাভোগ নিয়ে এসেছিলাম বর্ধমান থেকে। তাতে কিছুটা পেট ঠান্ডা হয়। এবার এসে দেখি প্রেমশঙ্করের দোকানটা বন্ধ।

এখনকার অবস্থা।

মন্দির ছাড়িয়ে গ্রামের দিকে ঢুকছি দেখতে পেলাম সেই মাইল ফলকটাকে। কিন্তু ফলকটা দেখে আনন্দ হওয়ার বদলে কষ্ট হল। ওই ফলকটার ওপরে বসেছিল বাবলা। আমরা ঘিরে দাঁড়িয়েছিলাম। এবার দেখি, রাস্তার কাজ হচ্ছে। স্টোনচিপ পড়ছে। সে জন্য রাস্তা উঁচু হয়ে গিয়েছে। ‘বঙ্গালসীমা ২ কিলোমিটার’ লেখা মাইল ফলকটা মাটির অনেকটা নীচে চলে গিয়েছে। অথচ এই ফলকে উঠতেই ভুঁড়িওলা দীপকদার কী কষ্ট হয়েছিল। খুব শখ ছিল, ফলকে বসে ছবি তোলার।

রাসমঞ্চ ও আরও মন্দির।

ধীরে ধীরে ঢুকলাম গ্রামে। মলুটি বিখ্যাত পর্যটন কেন্দ্র হলে কী হবে গ্রামটা এখনও ছিমছাম রয়েছে। পাকা বাড়ি, মাটির বাড়ি। পাকা দোতলা, মাটির দোতলা। আর মন্দির। রাস্তার পাশেই। রাস্তা থেকে একটু ভিতরে। চার পাশে। নানা ছাঁদের মন্দির। মলুটি আরেকটি কারণে বিখ্যাত। সাধক বামাক্ষ্যাপা প্রথম জীবনে এখানেই কাটিয়েছিলেন। তাঁর আসল নাম বামাচরণ চট্টোপাধ্যায়। বাড়ি ছিল তারাপীঠের আটলা গ্রামে। কম বয়সে তাঁর বাবা মারা যান। ফতেচাঁদ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আটলার পাশের গ্রাম মহুলার এক মেয়ের বিয়ে হয়। এক অনুষ্ঠানে বামাচরণের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হয়।

কেন মন্দিরের গ্রাম বলে বোঝা যায়।

গ্রামের কেউ একজন ফতেচাঁদকে অনুরোধ করেছিলেন বামাচরণের জন্য কাজ খুঁজে দেওয়ার। ফতেচাঁদ তাঁকে মলুটিতে আনেন। তার পর বাবা রামলালের সহায়তায় ছয় তরফের জমিদারদের নারায়ণ মন্দিরে ফুল তোলা ও মন্দিরে পুজোর কাজে সহায়তা করার কাজ পেলেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই তিনি কাজ ছেড়ে শ্মশানে গিয়ে বসে থাকতেন। রামলালের বাড়িতে রাতে থাকতেন। কিন্তু মাঝে মাঝেই পালিয়ে যেতেন মৌলীক্ষা মন্দিরে। লোকশ্রুতি, অবশেষে একদিন সিদ্ধিলাভ করে চলে গেলেন তারাপীঠে।

বামাক্ষ্যাপার স্মৃতিতে মন্দির।

মন্দিরগ্রাম মলুটির সঙ্গে মৌলীক্ষা মন্দিরও বেশ গুরুত্বপূর্ণ। আশপাশের ঝাড়খণ্ড-পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দারা নতুন গাড়ি কিনলে এই মন্দিরে পুজো দেন। কেউ কেউ মন্দিরে এসে বিয়েও করেন। মৌলী মানে মাথা। ঈক্ষার অর্থ দর্শন। এখানে মৌলীক্ষা দেবীর মাথাটাই দেখা যায়। তিনি মলুটির রাজবংশের কুলদেবী সিংহবাহিনী দুর্গা। তবে দুর্গার সঙ্গে এর কোনও মিল নেই। অনেকে আবার মৌলীক্ষাকে বজ্রযানী বৌদ্ধদের প্রতিষ্ঠিত দেবীও বলেন। মলুটির এই অঞ্চলে বজ্রযানী বৌদ্ধদের প্রভাব ছিল। ভাবছেন এত কী করে জানলাম? প্রথমবার যখন এসেছিলাম তখন গোপালদাস মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে আমাদের পরিচয় হয়েছিল। তিনি অনেক গল্প বলেছিলেন। তাঁর লেখা বই সংগ্রহ করেছিলাম আমরা।

মৌলীক্ষা মন্দির

এক এক করে মন্দিরগুলো পেরোচ্ছিলাম। থামছিলাম। মনে পড়ে যাচ্ছিল, এই মন্দিরগুলোর সামনে আমরা ছ’জনে ছবি তুলেছিলাম। ওই মাটির পাঁচিল ঘেরা বাড়ির সামনে কচি ছবি তুলছিল। গ্রামের শেষের দিকে গিয়ে ইন্দ্রদা একটা বাড়িতে দেশি মুরগি দেখেছিল। আর খালি ইশারা করে হাসছিল। দীপু আর বাবলা মিলে আমার পিছনে লাগছিল। কচি কথা বেশি বলে না। খালি হাসে। মন্দির দেখতে দেখতে পা ব্যথা হয়ে গেল। কত ধরনের শৈলীর মন্দিরই যে আছে এখানে। রেখ মন্দির, চালা মন্দির, বাংলা ছাঁদের মন্দির। সব জানি না। বুঝিও না। গোপালবাবুর কথাগুলো মনে ছিল। তিনি জানিয়েছিলেন, এই গ্রামে পরপর গায়ে লাগানো তিনটি মন্দির আছে। মন্দিরের চূড়ায় হিন্দু-মুসলিম-খ্রিস্টান ধর্মের ছাপ রয়েছে। রয়েছে একটা রাসমঞ্চও। আগেরবার যখন এসেছিলাম, কিছু মন্দিরের সংস্কার হচ্ছিল।

ধর্মীয় সংস্কৃতির সমন্বয়ের প্রতীক তিন মন্দির।

মন্দিরগুলো সব বিভিন্ন জমিদারদের আমলে তৈরি হয়েছিল। কিন্তু মলুটি নাম কেন? অনেকে বলেন, নামটি নাকি মহুলটি থেকে এসেছে। এলাকায় অনেক মহুল গাছ ছিল, তাই এমন নাম। পুরনো নথিতে মলুটি, মহুলটির উল্লেখ মেলে। কিন্তু মলুটি শব্দের আগে নানকার যোগ করা হয় কেন? তা নিয়ে একটা কাহিনি প্রচলিত আছে। সেটা বসন্ত নামে এক রাখাল ছেলের রাজা হওয়ার গল্প। গল্পটা এরকম, গৌড়ের নবাব আলাউদ্দিন হোসেন শাহ ওড়িশা থেকে ফেরার পথে বিশ্রামের জন্য শিবির ফেলেন ময়ূরাক্ষী নদীর তীরে। বেগমের পোষা বাজপাখিটি সেই সময়ে আচমকা পালিয়ে যায়। বেগম সাহেবার ভীষণ কষ্ট হয় তাতে।

মলুটির প্রকৃতি। তখন।

বেগমকে সান্ত্বনা দিতে হোসেন শাহ ঘোষণা করেন, যে বাজপাখি ধরে দেবে তাকে পুরস্কৃত করবেন তিনি। বসন্ত নামে এক বালক ফাঁদ পেতে বাজপাখি ধরে ফেলে। বাজটিকে সে এক সন্ন্যাসীর সাহায্যে নবাবের হাতে তুলে দেয়। গরিব রাখাল বসন্তের জন্য জমি চান সন্ন্যাসী। নবাব রাজি হয়ে জানান, সূর্য ওঠা থেকে অস্ত যাওয়া পর্যন্ত বসন্ত যতটা এলাকা ঘোড়ায় চড়ে ঘুরতে পারবে ততটাই তার অধিকারে চলে যাবে। ওই এলাকার জন্য তিনি কোনও খাজনা নেবেন না। নিষ্কর ভূসম্পত্তি। নিষ্কর অপভ্রংশ হয়ে দাঁড়িয়েছে নানকার।

এই নদীতে আমরা বন্ধুরা মিলে চান করেছিলাম।

মলুটি বহুদিন ধরে গবেষক ও পর্যটকদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে। খুব পুরনো জায়গা। প্রথমবারে গোপালবাবু জানিয়েছিলেন, চিলে নদীর পাড়ে প্রস্তর যুগের অস্ত্রও পাওয়া গিয়েছে। দীপকদা আর ইন্দ্রদা দেখেছিল। আমরা দেখেছিলাম ছবিতে। ইন্দ্রদা জোর করে আমাদের ধর্মশালায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। তাই দেখা হয়নি।

মলুটি। এখন।

দু’বার এলাম মলুটিতে। তাই মলুটির দু’রকম রূপ দেখতে পেলাম। আমরা প্রথমবার এসেছিলাম দুর্গাপুজোর দিনে। একেবারে সপ্তমীতে। তবুও অনেকটা ফাঁকা এলাকায় এ গ্রামের লোকেরা বাইরে থাকেন। এখানে নাকি দুর্গাপুজোর থেকে কালীপুজো বেশি বিখ্যাত। সেই সময়ে বাসিন্দারা ঘরে ফেরেন। পুজোর সময়ে প্রকৃতিটাও ছিল অন্যরকম। সবুজ অনেকটা বেশি। নদীতে চান করতে গিয়েছিলাম দল বেঁধে। ইন্দ্রদা যায়নি। ও তখন সীতাভোগ সাঁটানোর তালে ছিল। সেই নদীও এখন অনেকটা শুকনো। শীতের কারণ সবুজ অনেকটাই ফিকে। চাষের জমিতে শুধু সরষে।

চিলে নদীর পাড়ে পাওয়া পাথরের অস্ত্র।

মলুটি বড় সুন্দর জায়গা। দু’বার, দু’রকম দলের সঙ্গে এসে দু’রকমের মজা হল। প্রকৃতির দু’রকম রূপ দেখলাম।

কী ভাবে যাবেন— কোনও ভাবে রামপুরহাটে পৌঁছে যান। সেখান থেকে বাসে বা ভাড়ার গাড়িতে। কুড়ি কিলোমিটারের মধ্যে।

ছবি— শুভ বৈদ্য (কচি), দীপশেখর দাস (দীপু), ইন্দ্রজিৎ সাউ এবং লেখক।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *