জলযাত্রা বিশেষ ভ্রমণ

সপ্ত দহে মজে ছয় ঘুরনচাকি

দীপক দাস

মন খারাপ? তা ঘুরতে গেলেই তো পারো! সুকুমার রায়ের বেড়ালের মতো কেউ যদি পরামর্শ দিতে আসেন তাহলে হাতাহাতি বাধার সম্ভাবনা প্রচুর। বললেই এখন বেরিয়ে পড়া যায় না। আগে পাঁজিতে শ্লেষা, মঘা, যাত্রা নাস্তি দেখে বেরনোর সিদ্ধান্ত হত। এখন হরবকত বদলে যাওয়া লকডাউনের তারিখের দিকে নজর রাখতে হয়। যে এলাকায় যেতে চাই সেখানকার পরিস্থিতি বুঝে নিতে হয়। তার পর এর ব্যবসা, তার অনলাইন ক্লাসের দিনক্ষণ দেখতে হয়। তার পরে তো বাইক নিয়ে সাঁই সাঁই।

কতদিন পরে যে দল বেঁধে ঘুরতে বেরোলাম! সেই মার্চের প্রথম দিকে তিন জেলা পেরিয়ে শুশুকের ডাইভ দেখে এসেছিলাম। তার পর থেকে ঘরবন্দি। সাপ্তাহিক আড্ডাও বন্ধ। কত মঙ্গলবার যে বিছানায় শুয়ে শুয়ে টিকটিকির নড়াচড়া দেখে কেটে গেল। অবশেষে পরিস্থিতির তালা একটু একটু করে খুলতে সাহস এল মনে। আইনরক্ষার ব্যাপারটাও ছিল। সব কিছু বিবেচনা করে দিনক্ষণ ঠিক করা হল। এক মঙ্গলবার আবার শুরু হবে অভিযান। যেতে রাজি ইন্দ্র, দীপু, বাবলা, রাজা আর আমাদের ‘প্যায়ারি বহেনা’ নন্দিতা।

ধোপা দহ।

দূরে তো যাওয়া যাবে না। জেলার মধ্যেই থাকা ঠিক হল। দীপু আর বাবলা প্রস্তাব দিয়েছিল, আমতায় পরপর সাত খানা দহ আছে। আমাদের দলের ‘দেখা হয় নাই দুই পা মেলিয়া’র গুরুবচনে ভীষণ আস্থা। ৮ সেপ্টেম্বর, মঙ্গলবার অভিযানের থিম ঠিক হল, ‘সপ্ত দহে মজিলা ছয় অভিযাত্রী’। মানে ছয় ঘুরনচাকি। ইউফো হল উড়নচাকি। আর আমরা ঘুরনচাকি। দীপু ওর জামাইবাবুর কাছ থেকে খোঁজখবর নিল। আর বাবলা নিল ওর দাদার শ্বশুরবাড়ি থেকে। আমতা এমনিতেই আমার খুব আগ্রহের জায়গা। অতি প্রাচীন এক জনপদ। এই জনপদের পথে পথে ইতিহাস। দামোদরের বাঁকে বাঁকে কাহিনি। আঞ্চলিক ইতিহাস তেমন গুরুত্ব পায় না বলে এই জনপদের তেমন কদর নেই। না হলে রাজধানীর কলকাতার সঙ্গে একই সময়ে বর্তমান থেকেও আমতার কলকাতার নামের সঙ্গে কখনও ছোট শব্দটা জুড়ে যায়!

ধোপা দহের আরেক রূপ।

যাত্রা শুরু হল। আকাশ মেঘলা। ফলে একটু গুমোট। তবে অনেকদিন পর বেরিয়ে সেসব কিছু মনেই হচ্ছিল না। আমতার এই রাস্তায় বহুবার গিয়েছি। যতবার গিয়েছি ততবারই রাস্তার দু’পাশের সৌন্দর্যের প্রশংসা করেছি। আজ করলাম। ভাল লাগাটা শোনালাম ইন্দ্রকে। ও সহমত হল। বাকিরা অনেকটা এগিয়ে গিয়েছে। প্রথম বাইকটা থামল আমতা শহরে ঢোকার ঠিক আগে। জায়গাটার নাম বালিপোতা। এখানে মিলল প্রথম দহ। নাম ধোপার দহ। নামকরণের কারণ অনুসন্ধান করতে তেমন বুদ্ধি লাগে না। দীপুও দেখাল, রাস্তার পাশে বেশ কিছু লন্ড্রি রয়েছে। এখানে রজক সম্প্রদায়ের বাস। তাঁরাই এই দহে জামা-কাপড় কাচেন। দহের জলে প্রচুর জলজ উদ্ভিদ। ওপারে একটা মন্দির হচ্ছে। তেমন ভাল লাগল না।

ধোপা দহের পাড়ে ভাবনাচিন্তা।

বালিপোতা থেকে আরও কিলোমিটারটাক গিয়ে মিলল মিল্কিদহ। এলাকায় যেটি মূল রাস্তা সেটি আসলে বাঁধ। আমতা বন্যাপ্রবণ এলাকা। বাঁধ এখানে নানা ভাবেই গুরুত্বপূর্ণ। মিল্কিদহের বাঁধের দিকে একটি বসত রয়েছে। কয়েকজনকে দেখে অবাঙালি বলে মনে হল। আমরা এগিয়ে গেলাম দহের দিকে। দু’পাশে বাড়ির গলিপথ দিয়ে। ছোটখাট দহ। দহের পাড়ে প্রচুর ভাঙাচোরা টিন জমে আছে। ওপারে কয়েকজন বাঁশের পাড়া করে ছিপ ফেলছেন। দহের চারপাশেই বসত ঘেরা। ফলে প্রচুর ঘাট। বেশিক্ষণ থাকার মতো নয়। এটা সম্ভবত সিরাজবাটি গ্রাম পঞ্চায়েত এলাকায়।

মিল্কি দহ।

প্রথম দু’টি দহের রূপ মোটামুটি ভাবে হতাশই করল। কিন্তু মনে জমা অল্প খেদ দূর হয়ে গেল শিবদহের পাড়ে গিয়ে। মনোরম পরিবেশ। জগন্নাথপুরে পড়ে শিবদহ। এক শিবমন্দির রয়েছে দহের পাড়ে। সেজন্যই এমন নাম। দহের চারপাশে প্রচুর গাছ। দহের মাঝেও বিশাল একটা মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে। এরই মধ্যে দীপু একটা গাছের ছবি দেখিয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে উঠল। গাছের ছবি দেখিয়ে আমাদের জ্ঞানের পরীক্ষাও নিল। ঘুরতে গেলে আমাদের এই ঘাসপুসের ডক্টরকে বিভিন্ন গাছের নাম জিজ্ঞাসা করে যা হেনস্থা করি। এবার ওর পালা। এবং যথারীতি আমরা ওর অন্য সফরের পদাঙ্ক অনুসরণ করলাম। মানে, ফেল। দীপু বেশ বুক উঁচিয়ে বলল, ‘‘এটা হিজল গাছ।’’ মুখস্থ বিদ্যের একটা মস্ত সুবিধে হল, কী প্রশ্ন এসেছে সেটা একবার ধরিয়ে দিলেই ঠিকঠাক ওগরাতে পারে। দীপু ধরিয়ে দেওয়ার পর আমি উচ্ছ্বসিত, ‘‘এ যে জীবনানন্দের গাছ। পৃথিবীর সব ঘুঘু ডাকিতেছে হিজলের বনে।’’

শিবদহ।

ঝাঁকড়া হিজল গাছ থেকে না হলেও সত্যি ঘুঘু ডাকছিল শিবদহ ঘিরে থাকা গাছগাছালির ফাঁক থেকে। অনেক পাখিই ডাকছিল। আমরা অনেকক্ষণ দাঁড়িয়েছিলাম। পাখি চেনার চেষ্টা করছিলাম। ফটোশ্যুট চলছিল। বাবলা আর রাজা, দুই দোস্ত পরস্পরের ফটো তুলছে। ফটোশ্যুটের জন্য নন্দিতা আর ইন্দ্র ততক্ষণে জার্সি চড়িয়েছে। দু’জনেই স্টাইলিশ পোশাকে বেরিয়েছিল। কোনও হঠাৎ পরিবর্তনে নন্দিতার ইদানীং স্টাইল বেশ বেড়েছে। এসবের মাঝেই প্রকৃতি দর্শনও চলছিল। শিবদহের ঠিক উল্টোদিকে বাঁধের আরেক পারেও অনেকখানি এলাকা জুড়ে জলাভূমি। অনেকরকম পাখি দেখতে পেলাম। অনেক জলপিপি। কয়েকটা জলপিপির কাচ্চাবাচ্চা নিয়ে সংসার। দূরে একটা শামুকখোল। আর হোগলা গাছের ফাঁকে ফাঁকে দেখতে পাওয়া একঝাঁক হাঁস জাতীয় পাখি। একদম সামনের বাবলা গাছে একটা নাম না জানা পাখি আনমনে বসেছিল। দেখতে দেখতে সময় বয়ে যাচ্ছিল।…

দীপুর হিজল গাছ।

শিবদহের পরে আমাদের খোঁজার কথা ছিল মানুষমারির দহ। কিন্তু ভুল করে আমরা পৌঁছে গেলাম দাদখালির দহে। আমতার এই দহটির বেশ নাম। কিছুদিন আগেই দহটি ফেসবুকে ভাইরাল হয়েছিল। জেলেদের জালে ধরা পড়েছিল কিলো পনেরোর একটি চিতল মাছ। এখানে বড় মাছ থাকা অসম্ভব কিছু নয়। বিশাল এলাকা। পাড়ের কয়েকটি জায়গায় বাঁশের পাড়া করা। ওখানে বসে ছিপ ফেলে মাছ ধরা যায়। শ্মশানের দিকে বিভিন্নজনের স্মৃতিতে করা তুলসীমঞ্চে বসে বৈকালিক আড্ডা জমিয়েছিলেন কয়েকজন। তাঁদের কাছে দহের নামকরণ নিয়ে জানতে চেয়েছিলাম আমরা। কিন্তু তাঁরা শোনালেন তাঁদের খেদের কথা। দাদখালির দহ ছোট মহরা গ্রামে অবস্থিত। এই দহটিতে বহু আগে থেকেই নাকি গ্রামবাসীদের মাছ ধরার অধিকার ছিল। কিন্তু দহের বর্তমান মালিক সেসব অধিকার কেড়ে নিয়েছেন। মাছ চাষের জন্য লিজ দেওয়া হয়েছে দহ। ফলে গ্রামবাসীরা মাছ ধরার অধিকার হারিয়েছেন।

শিবদহের উল্টোদিকের জলাশয় নিরীক্ষণ।

আড্ডাধারীরা আরও একটি আক্ষেপের কথা বললেন। এই দহের জলে এলাকাবাসী রান্না করেন। তাতে নাকি দারুণ ভাত হয়। ডাল সুসিদ্ধ হয়। আমাদের ছোটবেলার অভিজ্ঞতাও তাই বলে। পুকুরের জলে ভাত সত্যিই ঝরঝরে হয়। ফুটফুটে হয় ভাত। কলের জলে আয়রণ একটু বেশি থাকলেই ডাল সিদ্ধ হতে চায় না। দাদখালির দহ ঘিরে থাকা মানুষজন বছরের বেশির ভাগ সময়ে এই জল ব্যবহার করতে পারেন না। তাঁদের অভিযোগ, জলে কিছু মেশানো হয়। যার ফলে দহের জল হয়ে যায় সবুজ। প্রচুর শ্যাওলা হয়। আমাদের বাবলা পুকুর বিশেষজ্ঞ। ওকে ডেকে শোনানো হল অভিযোগের কথা। বাবলা বলল, ছিপে যাতে কোনও মাছ না খায় সেজন্য সম্ভবত কোনও ওষুধ দেওয়া হয় জলে। এই অভিযোগের সুরাহা আমাদের হাতে নেই। একবার মনে হয়েছিল দহের মালিকের কাছে গিয়ে কিছু জানা যেতে পারে। কিন্তু আমাদের ক্যামেরা, নোটবই অনেক জিজ্ঞাসার জন্ম দেবে। সমস্যারও।

দাদখালির দহ।

ফলে আমরা গিয়ে পৌঁছলাম মানুষমারির দহে। জোৎকল্যাণ গ্রামে। একেবারেই মজা একটি দহ। কচুরিপানায় ঠাসা। এই দহের নামকরণেও নাকি মজা দহের অনুষঙ্গ জড়িয়ে। নাম শুনেই বোঝা যাচ্ছে, একটি রোমাঞ্চকর গল্প এর সঙ্গে জড়িয়ে। সে গল্প শোনা গেল এলাকার প্রবীণা শোভা বাগের কাছ থেকে। তিনি তাঁর দাদাশ্বশুরের থেকে শুনেছেন সেই গল্প। দহে এমন কিছু ছিল যে মানুষকে টেনে এনে ডুবিয়ে মারত। একবার নাকি পালকি শুদ্ধ বউকে ডুবিয়েছিল। তাই এর নাম মানুষমারি। এই অলৌকিক জট থেকে সত্য ঘটনা টেনে বের করা মানুষমারি দহের কচুরিপানা সাফ করার মতোই কষ্টের।

দহের পাড়ে আড্ডা।

তবে দীপু বলল, ও নাকি শুনেছে, দহের উপরে আগাছা এত জন্মেছিল যে জলের উপরে তা জমাট বেঁধে গিয়েছিল। তার উপর দিয়ে মানুষ চলাচল করত। একবার রাতে কনে-সহ পালকি দহের উপর দিয়ে যেতে গিয়েই ডুবে যায়। দহের নাম হয়ে যায় মানুষমারি। এটা কিছুটা বিশ্বাসযোগ্য। শোভা বাগ আরেকটি গল্পও শোনালেন। একসময়ে নাকি লোকের প্রয়োজনে বাসনকোসন মিলত এই দহ থেকে। শুধু যাঁর প্রয়োজন তাঁকে কাগজে নিজের চাহিদার কথা লিখে দহের পাড়ে দিয়ে আসতে হত। আশ্চর্যজনক ব্যাপার হল, এই গল্প ঘাটালের একটি দহের সঙ্গেও প্রচলিত। লোককাহিনি এমন ভাবেই ডালপালা বিস্তার করে।

মানুষমারির দহ।

এর পর আমাদের গন্তব্য ছিল ছোটদহ। মানুষমারির দহের কাছেই নাকি সেটি। কিন্তু বিস্তর চেষ্টা করেও খুঁজে পাওয়া গেল না। একটা ছোটখাট দহকে ছোটদহ ভেবে নিয়ে আমরা নিজেদের সান্ত্বনা দিলাম। কালীদহের ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটল। লোকে বলতে পারল না ঠিক করে। কয়েকজন যেটা দেখাল সেটা ডোবা ছাড়া কিছুই নয়। ঘোরাঘুরিতে একটা লাভ হল। আরেকটি বড় দহ পেয়ে গেলাম। সেটার নামও ধোপার দহ। আমাদের প্রথম দেখা দহটির মতোই। তবে এটি অনেক বড়। দহে পোঁতা একটি বাঁশের গর্তে পাখির বাসা দেখলাম। বসন্তবৌরির মতো কোনও পাখি সম্ভবত সন্ধের আগে বাচ্চাদের খাইয়ে দিচ্ছিল। দেখে ভাল লাগল।

কালীদহ। ডোবার মতো।

সপ্তদহে ঘুরে একটা আন্দাজ হল। এই এলাকা দিয়ে একটা বিশাল কোনও প্রবাহ ছিল। তা অন্যদিকে সরে যেতে তার পরিত্যক্ত খাতে এত জলাশয়ের জন্ম হয়েছে। দীপু বলল, ওই প্রবাহটা দামোদরের ছিল। দামোদর একসময় এই এলাকা দিয়ে বইত। এখন অনেকটা সরে গিয়েছে। দহগুলো তার স্মৃতি বইছে। আরেকটা জিনিস মনে হল। দহগুলোর বহুদিন পর্যন্ত কোনও নাম ছিল না। একটু একটু মানুষের বসত হয়েছে। আর বিভিন্ন অনুষঙ্গে নামকরণ হয়েছে। পেশা অনুযায়ী, দেবস্থান অনুযায়ী। আবার কখনও বা কিংবদন্তী অনুযায়ী।

ধোপা দহ। দ্বিতীয়টি।

দহ-রম সেরে তিনটি বাইক ফিরছিল নতুন পথে। মেঠো পথ। কাঁচা, জল জমা। আকাশে তখন বজ্রলেখা। তাতে কী! ও যে দীর্ঘদিন পর আগল ভাঙার আড়ম্বর।

কভারের ছবি— শিবদহ।

ছবি— নন্দিতা, রাজা, ইন্দ্র।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *