অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ইতিউতি হাওড়ার জীবজগৎ— দ্বিতীয় পর্ব

যথা ইচ্ছা তথা যা

১। ইস্টিকুটুম

বাংলায় বহু পাখির সঙ্গে নানা কিংবদন্তী জড়িয়ে রয়েছে। ইস্টিকুটুম সেরকমই একটি। সারা গা হলুদ, ডানা আর মাথায় কালো রংয়ের পাখিটিকে অনেকে আবার বেনেবউও বলে থাকেন। বাংলার অতি পরিচিত পাখিদের মধ্যে একটি। দুপুরবেলা বা পড়ন্ত বিকেলে পাখিটির ডাক দারুণ লাগে। হাওড়া জেলায় যথেষ্টই দেখা যায়। তবে অনুমান, বছর কুড়ি আগের তুলনায়, পাখিটির সংখ্যা বেশ কমেছে।

ইস্টিকুটুম। বেনেবউ। ইন্দ্রজিৎ সাউয়ের তোলা।

লোকবিশ্বাস, ইস্টিকুটুম ডাকলে বাড়িতে অতিথি আসেন। তাই অনেকে কুটুম পাখিও বলেন। তবে কিংবদন্তী অনুযায়ী, ইস্টিকুটুম খুব দুখি পাখি। পাখি জন্মের আগে সে নাকি কোনও গৃহস্থের বউ ছিল। কিন্তু শাশুড়ি তাকে সব কাজে গঞ্জনা দিত। একদিন বেচারি হলুদ বাটছিল। শাশুড়ি সেদিন সাবধান করে দিয়েছিল, কোনও গড়বড় হলে তার কপালে কষ্ট আছে। কিন্তু বউটির দুর্ভাগ্য, সেদিন বাটার সময়ে হলুদ মাটিতে পড়ে যায়। ভয়ে বউটা সারা গায়ে হলুদ মেখে নেয়। তার পর পাখি হয়ে গাছে উড়ে যায়।

২। হরিয়াল

হরিয়ালের দল। ছবি— বিভাস বাগ

ইংরেজি গ্রিন পিজিয়নের বঙ্গানুবাদে বলা যায়, সবুজ পায়রা। তবে হরিয়াল নামটি বেশ কাব্যিক। ঝাঁক বেঁধে থাকে। যে গ্রামে বট, অশত্থ বা পাকুড় গাছ আছে সেখানকার গ্রামবাসী পাখিটি দেখে থাকবেন। ফল খেতে আসে। সংখ্যায় আগে প্রচুর দেখা যেত। দু’টো কারণে সম্ভবত এদের সংখ্যা কমেছে। এক, হরিয়ালের মাংস অতি সুস্বাদু। ফলে চোরাগোপ্তা মারা চলেই। দুই, এই ধরনের গাছের সংখ্যা কমে যাওয়া। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় জানালেন, হরিয়াল মহারাষ্ট্রের রাজ্য পাখি। এই পাখির ইংরেজি নাম, ইয়েলো ফুটেড গ্রিন পিজিয়ন।

৩। চেস্টনাট উইঙ্গড কাক্কু

চেস্টনাট উইঙ্গড কাক্কু। ছবি— দীপশেখর দাস।

আমাদের দলের দীপু একদিন খুশি হয়ে হোয়াটসঅ্যাপ করল, কুবো পাখির ছবি তুলে ফেলেছি। শুনে খুশি হলাম। অনেকদিন দেখিনি পাখিটাকে। মাঝে মাঝে ডাক শুনতে পাই। কিন্তু ছবিটা যখন পাঠাল কেমন যেন সন্দেহ হল। এটা তো কুবো পাখি নয়। ছবিটা পাঠানো হল ঝাড়গ্রামের পাখিপ্রিয় বিশ্বরূপ মণ্ডলকে। উনি জানালেন, এটা চেস্টনাট উইঙ্গড কাক্কু। দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় দেখা যায়। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় দেখা গিয়েছে। আমাদের গ্রামে পাখিটিকে দেখে খুশি হয়েছি খুবই।

৪। বুলবুলি

ঘরের মধ্যে সাধারণ বুলবুলি। ছবি— ইন্দ্রজিৎ সাউ।

হাওড়ায় দু’ধরনের বুলবুলি চোখে পড়েছে। এক, সাধারণ বুলবুলি। চলিত নামটায় একটু অশ্লীলতা আছে। স্ল্যাং যোগ আছে। তাই লেখা হল না। আরেকটি বুলবুলি আছে। সিপাই বুলবুলি। রাজকীয় দেখতে। জোড়ায় জোড়ায় প্রচুর দেখা যায় এখনও।

সিপাই বুলবুলি।

ঝোপেঝাড়ে বাসা বাঁধে সাধারণত। কিন্তু গৃহস্থের বাড়িতেও বাসা তৈরি করতে দেখা যায়। সাধারণ এবং সিপাই দু’ধরনের বুলবুলির বাসা ঘরের মধ্যে দেখা গিয়েছে। পাতিহালে একটি বাড়িতে সিপাই বুলবুলের তিনটি ছানা হয়েছিল। দু’টি বড় হয়। কিন্তু উড়তে শিখে বাইরে বেরোতেই হাঁড়িচাঁছা পাখি ধরে খেয়ে নেয় ছানা দু’টোকে।

৫। দাঁড়াশ সাপ

সাপের শঙ্খ লাগা নিয়ে এখনও বহু মানুষের ভুল ধারণা আছে। তারই প্রত্যক্ষদর্শী হওয়া গেল। একদিন ছবি তুলতে বেরনো হয়েছিল সাইকেল নিয়ে। তিন সঙ্গী, দীপু, বাবলা, দীপক। একটা মাঠে সাপের শঙ্খ দেখে সাইকেল থামল। দীপু ছবি তুলতে শুরু করল। আমাদের দেখে আরও কয়েকজন জড়ো হয়েছিলেন। দুই বাইক আরোহী বললেন, ‘‘আরেব্বাস! একটা খরিশ, আরেকটা ঢ্যামনা সাপ।’’ দাঁড়াশ সাপকে স্থানীয় ভাবে ঢ্যামনা সাপ বলা হয়। লোকে ভাবে সাপের শঙ্খ আসলে মিলন। প্রজনন। আর একটা খরিশ আরেকটা ঢ্যামনা সাপে যদি শঙ্খ লাগে সেটা দেখতে পাওয়া পুণ্যের কাজ। সেই সময়ে যদি গামছা ওদের উপরে ফেলে দেওয়া যায় তাহলে মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়। এটা একেবারেরই ভুল ধারণা।

সাপের শঙ্ক লাগা নিয়ে অনেক ভুল ধারণা প্রচলিত। দীপশেখর দাসের তোলা ছবি।

শঙ্খ লাগা আসলে এলাকা দখলের লড়াই। আসলে ওই এলাকায় দু’টো পুরুষ সাপের আবির্ভাব ঘটেছে। একটি আরেকটি তাড়িয়ে এলাকায় রাজত্ব কায়েম রাখতে চাইছে। সেদিন ভাল লেগেছিল একজনকে দাঁড়াশ-খরিশের শঙ্খ লাগার ভুল ভাঙাতে দেখে। তিনি গালাগাল করে বলেছিলেন, ‘‘ঢ্যামনা-খরিশে শঙ্খ লাগে কখনও!’’ দাঁড়াশ নির্বিষ সাপ। লম্বা আর স্বাস্থ্যবান বলে লোকে অহেতুক ভয় পায়। গাছে উঠে পাখির ছানা খায় বটে। ইঁদুর খেয়ে চাষির উপকারও করে। ঘরে ঢুকে পড়ে মাঝে মাঝে।

৬। ছাতারে

ছাতারে বা সাত ভাই।

অনেক নাম ছাতারের। মেদিনীপুরে বলে, সাত ভেয়ে। মানে সাত ভাই। হাওড়ায় ছাতারে বলে। ক্যাঁচম্যাচ করে ডাকে বলে বাংলাদেশে অনেকে ক্যাচক্যাচাইয়া বলেন। দল বেঁধে থাকে। বাড়ির উঠোনে হামেশাই দেখা যায়। ঝোপেঝাড়েও দেখা মেলে।

৭। হনুমান

হনুমান।

প্রায়ই শোনা যায়, হনুমানের দল অত্যাচার করছে। খবরও হয়, গ্রামবাসীরা হনুমানের অত্যাচার থেকে বাঁচতে বন দফতরের সাহায্য চাইছে। কিন্তু বেশির ভাগ সময়ে বলা হয় না, প্রচুর বড় গাছ নষ্ট হয়ে গিয়েছে। ওদের থাকার জায়গা ও খাওয়া কমেছে। জগৎবল্লভপুরবাসী অনেকেরই মনে পড়বে, নব্বইয়ের দশকের গোড়ায় হনুমান মারার দল আসত গ্রামে গ্রামে। জাল পেতে তাড়া করে হনুমান পিটিয়ে মারা হত। তখন সংখ্যায় প্রচুর কমেছিল। আবার বাড়ছে হনুমানের সংখ্যা।

৮। পেঁচা

বড় আকারের পেঁচা। বড়গাছিয়ায় তোলা।

অনেক রকম পেঁচার কথা পড়েছি আমরা। কুটুরে পেঁচা, ভুতুম পেঁচা, লক্ষ্মী পেঁচা। অন্তত দু’রকম পেঁচার ছবি তোলা গিয়েছে পাতিহাল আর বড়গাছিয়া মিলিয়ে। একটার আকার বেশ বড়। লকডাউন পর্বে বড়গাছিয়া খিরিশতলায় ইঁদুর ধরেছিল। আকারে বেশ বড়। রাতের অন্ধকারে বেশ ভয় লাগছিল।

ছোট আকারের পেঁচা।

আরেকটি পেঁচা আকারে ছোট। মাঠে সিমেন্টের তৈরি এক খাম্বায় বসেছিল। আকারে ছোট। এই আকারের পেঁচাকেই বোধহয় মাঠের উপর দিয়ে যাওয়া ইলেকট্রিকের তারে বসে থাকতে দেখা যায়। একটা পেঁচা রাতে কোন আড়াল থেকে ডাকে হুম…হুম…হুম। ফাঁকা মাঠে একা শুনলে ভয় ধরে যায়।

৯। ঘুঘু

ঘুঘু পাখি।

লোকের ভিটেয় এখনও ঘুঘু পাখি চরে। এটা খুবই খুশির খবর। না হলে যে ভাবে একসময়ে ধরে খাওয়া হত তাতে সংখ্যা কমার আশঙ্কা তো ছিলই। আর সেই প্রবাদ, ভিটেয় ঘুঘু চরলে অকল্যাণ হয়! তার জন্য বাড়ির মেয়েরা পাখিটিকে একসময়ে অপছন্দ করত। তবে সেই ভুল ধারণা ভেঙেছে। নির্জনতা প্রিয় বলেই কি পাখিটির সঙ্গে এমন ভুল ধারণা জড়িয়ে গিয়েছে? কে জানে! তবে এখনও নির্জন দুপুরে ঘুঘু পাখির ডাক মন কেমন করায়। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় জানালেন, বাংলায় ঘুগুর বেশ কয়েকটি প্রজাতি দেখা যায়। আমাদের ছবিটির ঘুঘু স্পটেড ডাভ বা তিলে ঘুঘু।

১০। পানকৌড়ি

পানকৌড়ি। দীপশেখর দাসের তোলা। পাতিহাল লস্করদিঘিতে।

প্রচণ্ড পরিশ্রমী পাখি। জলাশয়ে অনন্ত ডুব দিয়ে খাবার জোগাড় করা বেশ কষ্টের। তার উপরে মাংস নাকি খেতে ভাল। গ্রামাঞ্চলে লুকিয়েচুরিয়ে শিকার চলে এখনও। তবে পাখিটিকে এখনও পাড়ার পুকুরে দেখা যায়। ভাল লাগে। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় জানালেন, পানকৌড়ি আকার অনুযায়ী তিন ধরনের, লেসার (ছোট), ইন্টারমিডিয়েট (মাঝারি) আর গ্রেটার (বড়)। ছবির পানকৌড়িটি তাঁর মনে হয়েছে, ছোট প্রজাতির।

১১। ফিঙে

ফিঙে। দীপশেখর দাসের তোলা।

কালো লেজ ঝোলা পাখিটি পাহারাদার পাখি নামে পরিচিত। কিন্তু গলাটা ভারী সুরেলা। বেশ ভাল লাগে। সাহিত্যে পাখিটিকে আগে টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকতে দেখা যেত। এখন ইলেকট্রিকের বা কেবল টিভির তারে দেখা যায়। নিজের চেহারার থেকে বড় পাখিদের যখন তাড়া করে তখন সেটা দেখার মতো দৃশ্য।

কভারের ছবি— পানকৌড়ি ও ফিঙে। পাতিহাল লস্করদিঘি।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *