documentation
অন্য সফর বিশেষ ভ্রমণ

ইতিউতি হাওড়ার জীবজগৎ

যথা ইচ্ছা তথা যা

ঘুরতে গিয়ে আমরা তেমন জীবজন্তুর সাক্ষাৎ পাইনি। এক জঙ্গলে উড়ন্ত দুধরাজ তার বাহার দেখিয়ে অদৃশ্য হয়েছেন। দল বেঁধে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কুনকি হাতিদের চান করা দেখেছি। একটা শিয়ালের ছুটে যাওয়া। আর একবার প্রকৃতিতে ময়ূরের নাচ। এ ছাড়া এদিক সেদিক নাম না জানা পাখিদের হঠাৎ দর্শন। জঙ্গলে-পাহাড়ে ঘুরি আমরা। কিন্তু প্রাণীরা আমাদের মোটেও পাত্তা দেয় না। এ নিয়ে আমাদের দলের সদস্যদের প্রচুর মনোবেদনা। বেদনা মন্থন করেই হঠাৎ ভাবনা, আরে আমাদের হাওড়া জেলাতেই তো বহুরকম পাখি। কতরকম জীবজন্তু। নানা সময়ে পেয়েছি। সে সব দর্শনেও তো মন ভাল রাখা যায়। এখনও কেমন মুক্ত বিচরণ জীবগুলোর।সেই ভাবনা থেকেই আজকের জীবজগতে যাত্রা আমাদের। মনে হয় সব মিলিয়ে হাওড়ার জীবজগতের হালকা আভাস মিলতে পারে।

১। তাঁতিপাখি

নথিভুক্তি।
বাবুই। পাতিহালে খাঁদারঘাট রোডের কাছে দীপশেখর দাসের তোলা।

খুঁজতে যাওয়া হয়েছিল বাংলার প্রাচীন এক মিষ্টি-রাজকে। দ্বারিক ঘোষ। তাঁর বাড়ি থেকে ফেরার সময়ে প্রকৃতির মাঝে একটু দাঁড়ানো। দীপক, চিনি আর দীপশেখর অক্সিজেন নিচ্ছিল সেই প্রকৃতিতে। তখনই চোখে পড়ল ধানখেতে বেশ কিছু পাখি ঘুরছে, উড়ছে, বসছে। আর মাঝে মাঝে কিছুটা দূরে তালগাছে গিয়ে বসছে। দেখা মিলল বাবুই পাখির।

পাতিহালে বাবুই পাখির বাসা।

আগে পাতিহালে দেখা যেত তাঁতি পাখির শিল্পকর্ম। এখন আর চোখেই পড়ে না। তবে সম্প্রতি পাতিহাল এবং পাতিহালের পাশের গ্রাম শিবরামপুরে বেশ কিছু বাবুই-বাসা দেখা গিয়েছে।

২। হট্টিটি

নথিভুক্তি। documentation
পাতিহালের জমিতে হট্টিটি। দীপশেখর দাসের তোলা।

বাবলা, চিনি, রাজা আর দীপু গিয়েছিল চিকেন পকোড়া খেতে। হাওড়ার প্রায় শেষ প্রান্ত খিলায়। রাস্তায় পরে নরেন্দ্রপুর। কিছুটা এগিয়ে একটা মাঠে দেখা মেলে হট্টিটির। ইংরেজি নাম রেড ওয়াটলেড ল্যাপউইঙ্গ সম্ভবত। বাংলা উইকিপিডিয়ায় দেখছি, এর বাংলা করা হয়েছে ‘লাল লতিকা হট্টিটি’। খুব সুন্দর দেখতে পাখিটি। দীপুরা ছবি তুলে আনার পরে হঠাৎ দেখা যায়, পাতিহালের মাঠেও বেশ কিছু হট্টিটি আছে। একদিন ছবি তোলার চেষ্টা করা হল। কিন্তু নরেন্দ্রপুরের মাঠের মতো ছবি অত ভাল এল না।

৩। ফটকা

documentation
ফটকা বা লেসার পায়েড কিংফিশার। দামোদরের চর এলাকায়।

একধরনের মাছরাঙা। আমরা চারপাশে যেমন মাছরাঙা দেখি, পুকুর পাড়ে বাসা করে, গাছের ডালে অপেক্ষা করে ঝুপ করে জলে ঝাঁপায়, এগুলো সেরকম নয়। সাদা আর কালোর ছিটে। ফটকার শিকার ধরার সময়ে জলাশয়ের উপরে এক জায়গায় স্থির হয়ে ডানা ঝাপটাতে থাকে। তার পর ঝুপ করে জলে ঝাঁপ দিয়ে মাছ ধরে। ওই পকোড়া খেতে গিয়েই ফটকার দেখা পেয়েছিল চিনিরা। খিলার কল্যাণচকে, দামোদর নদের পাড়ে। ইংরেজি নাম সম্ভবত লেসার পায়েড কিংফিশার।

documentatiopn
সাদাবুক মাছরাঙা। ইংরেজিতে white breasted kingfisher। পাতিহালে তোলা। তথ্য সৌম্য চট্টোপাধ্যায়।

সাধারণ ভাবে হাওড়ায় আরও দু’ধরনের মাছরাঙা দেখা যায়। একটা একটু ছোট। আরেকটি আকারে বড়। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় আমাদের একটি তথ্য দিলেন। আমরা যে মাছরাঙার ছবিটি তুলেছি সেটা সাদাবুক মাছরাঙা। ইংরেজিতে white breasted kingfisher। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্য পাখি (state bird) এই পাখিটি। সাধারণ বা পাতি মাছরাঙা আকারে একটু ছোট আর বুকের দিকটা কমলা রঙের হয়। তবে রঙের জেল্লায় ফটকার কাছে কয়েক গোল খাবে এই দুই মাছরাঙা।

৪। কাঠ শালিক

documentation
কাঠ শালিক। পাতিহালে দীপশেখর দাসের তোলা।

এই পাখিটা কাঠ শালিক কিনা জানা নেই। গায়ের রঙের সঙ্গে ছাতারে পাখির খুব মিল। তবে ঠোঁট আর লেজ আলাদা রকমের। আমরা ইন্টারনেট দেখে মনে করছি, পাখিটি কাঠ শালিক। চেস্টনাট টেলড স্টার্লিং। পাতিহালে দেখা যাচ্ছে ইদানীং। একজনের বাড়ির গাছে বাসাও করেছিল। বাচ্চা বড় হওয়ার পরে আর ওই বাড়িতে দেখা যায়নি। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় নিশ্চিত করে জানিয়েছেন, এই পাখিটি কাঠ শালিখই। নতুন পাখির সন্ধানে আনন্দিত আমরা।

৫। মেটেঠোঁট ফুলঝুরি

documentation
মেটে ঠোঁট ফুলঝুরি। যথা ইচ্ছা তথা যা।

সত্যি বলতে কী, এই পাখিটার সম্পর্কে আমরা কিছুই জানি না। আগে কখনও দেখেছি বলেও মনে পড়ছে না। বছরখানেক আগে পাতিহালে একজনের বাড়িতে দেখা গিয়েছিল। এক পক্ষী বিশারদকে দিয়ে চিহ্নিত করা হল। তিনি ইংরেজি নাম জানালেন, ‘পেল বিলড ফ্লাওয়ারপেকার’। ভারী মিষ্টি পাখিটা। তবে আমরা আর কখনও দেখিনি পাতিহালে। প্রজাপতি বিশারদ সৌরভ দুয়ারী আমাদের জানিয়েছেন, এই পাখিটি ভারতের সবচেয়ে ছোট পাখি। যা শুনে আমরা রোমাঞ্চিত।

৬। শামুকখোল

documentation
উড়ছে শামুকখোল। পাতিহালে তোলা।

হাওড়া জেলায় প্রচুর দেখা যায়। দক্ষিণবাড়ির জলা জায়গায়, পাতিহালের মাঠে, দামোদর উপত্যকায় অনেকেই দেখতে পান।

শামুকখোল।

জগৎবল্লভপুরের কিছু মাঠে এখন দেখা যাচ্ছে শামুকখোল। একটা, দু’টো নয়। দল বেঁধে আসা যাওয়া করছে বিশালাকার পাখিগুলো। মাঠে খাবার খুঁজছে।

৭। অরেঞ্জ থ্রাশ

documentation
অরেঞ্জ থ্রাশ। যথা ইচ্ছা তথা যা।

পাতিহালে একজনের বাড়ির বাগানে দেখা গিয়েছিল। একটাই পাখি। আমরা চিনতাম না। ঝাড়গ্রামের পক্ষী বিশারদ বিশ্বরূপ মণ্ডল চিনিয়ে দিয়েছিলেন। ইন্টারনেটে দেখলাম, বাংলায় কমলা দামা বা কমলা ফুলি বলে। পরিবেশপ্রেমী সৌম্য চট্টোপাধ্যায় জানাচ্ছেন, ইংরেজিতে এই পাখির পুরো নাম ‘অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ’। তিনি পাখিটি সম্পর্কে আরও তথ্য দিলেন। ‘অরেঞ্জ হেডেড থ্রাশ’ মূলত ভারত-সহ দক্ষিণ এশিয়ার পাখি। এরা omnivorous বা সর্বভুক হলেও বিভিন্ন পোকামাকড় খেতেই বেশি পছন্দ করে। জঙ্গল আছে এরকম জায়গায় বেশি দেখতে পাওয়া যায়। সৌম্যর কথায়, ‘‘কলকাতার আশেপাশে সারা বছর দেখতে পাবার মতো দুটো জায়গা আমার জানা আছে, এক রবীন্দ্র সরোবর আর দুই চিন্তামণি কর সাংচুয়ারি। রবীন্দ্র সরোবরে কালী পুজোর পরে গেলে দেখতে পাবার সম্ভাবনা কম, কারণ বাজির আওয়াজে এরা পালায়।’’

আবার এসেছিল কমলাদামা বা কমলাফুলিটা।

করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বজুড়ে অতিমারি। সকলেই ঘরে। সেই সময়ে আবার দেখা যায় পাখিটিকে। এবার কিন্তু বেশ ছটপটে দেখাচ্ছিল পাখিটিকে। তবে ডাকপাখিতে তাড়া করায় প্রথমে জঙ্গলে ঢুকে যায়। তার পর উড়ে পালায়।

৮। ডাহুক বা ডাক পাখি

documentation
ডাহুক বা ডাকপাখি।

হাওড়ায় এখনও প্রচুর দেখা যায়। মাঝে কিছু কমে গিয়েছিল। কিন্তু এখন আবার দেখা যাচ্ছে। সুন্দর দেখতে।

৯। জলপিপি

documentation
জলপিপি। পাতিহালে তোলা।

হাওড়া-আমতা ট্রেন লাইনের পাশের খালগুলোয় এখনও মাঝে মাঝেই দেখা মেলে। রংবেঙয়ের পাখিগুলো ভারী সুন্দর দেখতে।

১০। পরিযায়ী পাখি

documentation
এগুলো কি পরিযায়ী? নাম কী? পাতিহালে তোলা। দীপশেখর দাস।

হাওড়ার সাঁতরাগাছিতে আসে সকলেই জানেন। এক সময়ে পাতিহালে প্রচুর আসত। এখানকার লস্করদিঘিতে আস্তানা গাড়ত। তবে এখন সংখ্যায় অনেক কমেছে। কোন ধরনের পাখি আসে জানি না আমরা।

১১। দাগি কাঠঠোকরা

documentation
দাগি কাঠঠোকরা। পাতিহালে তোলা। যথা ইচ্ছা তথা যা

এক বাড়িতে মাঝে মাঝে দেখা যায়। জল খেতে আসে।

১২। বক

documentation
হাওড়া জেলার পশপুরে।

নানা ধরনের বক দেখা যায়। কুঁড়ো বক, গো-বক। রয়েছে নাইট হেরনও।

১৩। মুনিয়া

documentation
হোয়াইট রাম্পড মুনিয়া। পাতিহালে তোলা। যথা ইচ্ছা তথা যা।

অনেক রকম প্রজাতি আছে। হাওড়ার দেখা যায়। পাতিহালে প্রকৃতির মাঝে মুনিয়া আমরা দেখিনি। লকডাউন পর্বে চারটি মুনিয়া দেখা গিয়েছিল এখানে। মোবাইল ক্যামেরায় দু’টির ছবি তোলা হয়। বিশ্বরূপ মণ্ডল জানিয়েছেন, এগুলো হোয়াইট রাম্পড মুনিয়া।

১৪। নেউল বা বেজি

documentation
নেউল। পাতিহালে তোলা।

মাঝে কম দেখা যেত। এখন আবার সংখ্যায় বেড়েছে। রাস্তাঘাটে মাঝে মাঝেই দেখা যাচ্ছে। ব্যাঙ, মুরগির বাচ্চা ধরে খেতে দেখেছি আমরা। আবার পচা দইও ভাঁড় থেকে খেতে দেখা গিয়েছে।

১৫। গোসাপ

documentation
গোসাপ।

ডোমজুড়ের সরস্বতী নদী, গ্রামের জলাশয় ও খালে প্রচুর দেখা মেলে।

১৬। শিয়াল

documentation
পাতিহালে শিয়ালের ছবি তুলেছেন ইন্দ্রজিৎ সাউ।

হাওড়ায় শিয়ালের সংখ্যা আবার বেড়েছে। দিনের বেলাতেও মাঝে মাঝে বেরিয়ে পড়ে। পাতিহাল একসময়ে শিয়াল শূন্য হয়ে গিয়েছিল। এখন আবার দেখা যাচ্ছে।

১৭। গন্ধগোকুল

documentation
পাতিহালে নবারুণ ক্লাবের কাছে গন্ধগোকুলের ছবি তুলেছেন দীপশেখর দাস।

হাওড়ায় দু’ধরনের গন্ধগোকুল আমরা দেখতে পেয়েছি। একটা ডোরাকাটা। আরেকটা পুরো কালো। পাতিহালেও কালো ও ডোরাকাটার দেখা মেলে।

documentation
আরেক ধরনের গন্ধগোকুল। পাতিহালে ছবিটি তুলেছেন দেবাশিস দাস।

১৮। চাতক

documentation
প্রায় বোঝা না যাওয়া চাতকের ছবি। বড়গাছিয়ায়।

কবিতায় ছোটবেলা থেকে পড়ছি। বড় হয়ে জেনেছি, বাংলার পাখিই নয় চাতক। আমরা কোনও দিন দেখিনি। একবার বড়গাছিয়া ফিডার রোডে টেলিফোন এক্সচেঞ্জ অফিসের সামনে টিভি চ্যানেলের কেবলে একটা পাখি দেখা গিয়েছিল। মোবাইল ক্যামেরায় কোনও মতে একটা অবয়ব ধরা হয়েছে।

১৯। ফ্যানটেল বা ছাতাঘুরনি

documentation
মোবাইলে তোলা ফ্যানটেলের ফ্যান।

খুব চঞ্চল পাখিটা। সারাক্ষণ ওড়ে আর লেজটা ছাতার মতো মেলে ধরে। মোবাইলে কোনও রকমে লেজের ছবি তোলা গিয়েছে পাখিটির।

এগুলো ছাড়াও হাওড়ায় বেশকিছু পাখি ও জীবজন্তু রয়েছে। পাখিদের মধ্যে বেশির ভাগই পরিচিত। ঘুঘু, সিপাই ও সাধারণ বুলবুলি, ছাতারে, গাং শালিক, ময়না শালিক, বাঁশপাতি। বাঁশপাতি ছাড়া অন্য পাখির ছবি আমাদের কাছে আছে। কিন্তু অতি পরিচিত প্রাণীদের মধ্যে আছে বনবিড়াল, বাঘরোল। কিন্তু ছবি নেই আমাদের কাছে।

কভারের ছবি— নরেন্দ্রপুরের হট্টিটি। দীপশেখর দাসের তোলা।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *