পাহাড়িয়া বাঁশি বিশেষ ভ্রমণ

ধূসর সিমলা, অচেনা কুফরি

দীপশেখর দাস

কোনও এক জায়গায় যেতে ইচ্ছা হল। বন্ধুরা মিলে জটলা করে অনেক প্ল্যানও হল। কিন্তু শেষমেশ যাওয়া হয়ে উঠল না। এমন তো হয়ই। অন্তত আমার ক্ষেত্রে এটা তো ‘রিপিট টেলিকাস্ট’। নিজেই যে কতবার এরকম প্ল্যান ভেস্তে দিয়েছি! আবার, কোথাও কিছু নেই হঠাৎ করে সুযোগ হল আর ছুটে বেড়িয়ে যাওয়া হল। এমনটাও হয়। এখনও পর্যন্ত যতটুকু ভারত দেখেছি তার বেশিরভাগটাই এমন ভাবেই। লাভ-ক্ষতি সমান সমান হয়ে যায়।

২০১৮ সাল, মার্চ মাস। সবে বসন্তের ছোঁয়া লেগেছে বাংলার গাছপালায়। কৃষ্ণচূড়া, শিমূল, পলাশেরা ফুল ফুটিয়েছে। ডালে ডালে বসন্তবৌরি, বেনেবউ, বুলবুলিদের আনাগোনা। শিশুরা বাগানে বাগানে গোলাপ-ডালিয়ার পাশে নেচে খেলে বেড়াচ্ছে। জোয়ানেরা ফড়িং হয়ে ঝাঁপ দিতে চাইছে প্রেমানলে। বয়স্করা জুবুথুবু শীত কাটিয়ে বিকেলের মনোরম দখিনা হাওয়ায় প্রাণ ভরে প্রশ্বাস নিচ্ছে। এমন সময় অফিসে সমন জারি হল সোলান যেতে হবে।

মল রোড। পিছনে বিখ্যাত চার্চ।

ইন্টারনেটের কল্যাণে এখন দূর আর দূর নয় মোটেই। একটা ক্লিকেই সব চোখের নাগালে। সোলান হিমাচলপ্রদেশে জানা ছিল। আর কিছু জানতুম না। খোঁজাখুঁজি করতেই খোঁজ পেলুম যে সোলান সিমলার কাছেই। পঞ্চাশ কিলোমিটারও দূরত্ব নয়। ঘণ্টা দেড় দুই গাড়ি চাপলেই পৌঁছে যাওয়া যাবে। ব্যাস আমাদের প্ল্যান রেডি। সোলান পৌঁছে হাতে একদিন সময় থাকবে। সেদিনই সিমলার সেরেনিটি উপভোগ করতে হবে।

আমি, অর্ণব ব্যানার্জী, নিকেশ কুমার আর নাতাশা শ্রীবাস্তব চারজনের দল। ১৯ মার্চ বিকেলে ট্রেন। পরদিন দুপুরে দিল্লি পৌঁছে রাতে বাস ধরলুম সোলানের। ঘণ্টা সাতেকের বাস জার্নি শেষে সোলান পৌঁছলুম ভোর ৪টে নাগাদ। পাহাড়ে অত ভোরে আলো ফোটে না। আমাদের থাকার জন্য একটা হস্টেলে তিনটে ঘর ঠিক করা ছিল। কিন্তু ৬টার আগে সেখানে যাওয়া বৃথা। ঘণ্টা দুয়েক কোথাও আশ্রয় নিতে হবে। বাংলায় বসন্ত এসেছে। এখানে এখনও হিমেল হাওয়া। ভারতীয় প্রাণী সর্বেক্ষণের সোলান শাখায় ভারতের জীববৈচিত্রের উপর অনুষ্ঠানের তোড়জোড় করতে আমাদের এখানে আসা। সোলান বাসস্ট্যান্ডের খুব কাছেই এই অফিস। কোনও উপায় না দেখে সেই অফিসেই আশ্রয় নিলুম।

র‍্যাঞ্চোর স্কুল।

সকাল ৬:৩০টা নাগাদ হস্টেলে পৌঁছলুম। ঠিক হল স্নান সেরে বেড়িয়ে পড়ব ঘণ্টা খানেকের মধ্যেই। কিন্তু, তারপর থেকেই শুরু হল প্রবল বৃষ্টি। প্রায় ঘণ্টা খানেক বৃষ্টি চলল। ঠান্ডাটাও কয়েকগুণ বেড়ে গেল। বৃষ্টি থামলে বেরিয়ে প্রাতরাশ সেরে সিমলার গাড়ির খোঁজ শুরু হল। ছোট গাড়ি আছে। বাসও আছে। আর আছে টয় ট্রেন। কালকা থেকে সিমলা ন্যারো গেজ লাইন ছুটেছে সোলানের উপর দিয়েই। এখন ট্রেন নেই। তাই আমাদের বাসে চড়তে হল। পকেট যে আমাদের ভারী নয়!

হিমাচলের রূপে আমি বারবার মুগ্ধ হয়েছি। এবারটাও তার ব্যতিক্রম নয়। পাহাড়ি পথের বাঁকে বাঁকে হিমাচল নতুন নতুন রূপে ধরা দেয়। ঋতুর রকমফেরে রঙ পরিবর্তন হয় পাহাড়গুলোর। বর্ষায় সবুজ হয়, শীতে ধূসর। আর বসন্তের পাহাড় রংবেরঙের। তখন হলুদ-সবুজ-সাদা-লাল একাকার হয়ে এক অনন্য রূপ ধারণ করে। এখনও শীত যায়নি। তাই রুক্ষ ধূসর পাহাড়গুলোতেও রং লাগেনি। তবুও বাসের জানালার ঝাপসা কাচে ওই পাহাড়গুলোই মুগ্ধতার আবেশ আনে।

দূর থেকে সিমলা।

ঘণ্টা দুয়েকের মধ্যেই সিমলা পৌঁছলুম। বাসস্ট্যান্ড মলের (কথ্যে ম্যাল) কাছেই। হেঁটেই পৌঁছলুম। জেনেছিলুম সিমলা সাহেবদের পছন্দের হিল স্টেশন ছিল। গরমকালে আসতেন ছুটি কাটাতে। আবার এও শোনা যায় গরমকালে তাঁরা নাকি রাজধানীটাই সরিয়ে নিতেন এখানে। সে যাই হোক। সাহেবরা আসতেন। তাঁদের সিমলা প্রীতির নিদর্শন এখানে অনেক। বলিউডি ‘থ্রি ইডিয়ট’এর কল্যাণে এখানের সুদৃশ্য চার্চ সবার চেনা। তারই কিছুটা আগে র‍্যাঞ্চোর স্কুল। মলের রাস্তায় তখন ছবি তোলার ভিড়। সবাই ফ্রেমে ধরে রাখতে চায় এই দু’টোকে।

আমাদের হাতে সময় বেশি ছিল না। তাই শুধু সিমলা ঘুরব বলেই এসেছিলুম। যদিও আমার ঠিক মন ভরল না। সাহেবদের সাধের সিমলার জনসংখ্যা বেড়েছে। পর্যটক বেড়েছে। পাল্লা দিয়ে গজিয়ে উঠেছে বহুতল। পাহাড় প্রকৃতি ঢাকা পড়েছে কংক্রিটের আবরণে। সিমলার সৌন্দর্য বরফে। এখন বরফ নেই। তাই সিমলা যেন বড়ই মলিন। চার্চ আর স্কুল ছাড়া এখানে দেখার বলতে কালী মন্দির আর পাহাড়ের উপরের হনুমান মন্দির। কিন্তু মন্দির দেখতে আমাদের বড় এলার্জি। অতএব ফেরাই স্থির। ফিরব ট্রেনে। আসার সময় বাসে চেপেই ঠিক হয়ে গিয়েছিল। স্টেশনের পথে পা বাড়ালুম। কিন্তু এগোনো গেল না। দাঁড়াতে হল। “সাইট সিন জানা হে?” অ্যালবাম হাতে পথ আটকেছে একজন। ‘না’ বলে এগিয়ে যাচ্ছিলুম। সে আবার বললে, “সস্তে মে দিখা দেঙ্গে।”

কুফরির পথে।

সস্তার কথায় আবার থমকালুম। মানুষ মনস্তত্ত্ব ভালই বোঝে বুঝলুম। আমাদের সাজে চাকচিক্য নেই। ট্যুরিস্টের বাবুয়ানাও নেই। তাই সাইট সিনের ‘না’ যে আর্থিক কারণেই অনুমান করেছিল বোধহয়। “কিতনা?” নিকেশ জিজ্ঞাসা করল। নিকেশ আমাদের দরবাজ। আসার পথে দিল্লি থেকে একশো টাকার হেডফোন কুড়ি টাকায় কিনে এনেছে। তাই আমরা ওকেই এগিয়ে দিলুম। “পঁচিশশো। আভি অফ সিজন হে। নেহি তো হাম চারকে নিচে নেহি যাতে” বলল লোকটা। আমরাও সেরকমই শুনেছিলুম। তবু নিকেশ ভজল না। দরদাম চলতে থাকল। শেষমেশ ১৪০০-য় রফা হল। চেপে পড়লুম তাঁর বাহনে।

আরেক টুকরো কুফরি।

আকাশ মেঘলা। সঙ্গে হিমশীতল হাওয়া আমাদের কাঁপিয়ে দিচ্ছে। গাড়ির মধ্যে বসেও ঠান্ডার পাশ বেশ উপলব্ধি করছি। ঘন কুয়াশা ছেয়ে ফেলেছে চারিদিক। ২০ ফুট দূরের দৃশ্যও ঝাপসা। রাস্তার দু’পাশের পাইন-দেওদারের বন। ধূসর কুয়াশায় গাছগুলো কালচে হয়ে এক মায়াবী চিত্রপট এঁকেছে যেন। সেই মায়াবী আধো অন্ধকার কেটে আমাদের যান এগিয়ে চলেছে কুফরির দিকে। যাত্রাপথে অনেক হাসি মজা খুনসুটি চলছিল। চার মাথা একসঙ্গে হলে যা হয় আর কী! যে যেমন সুযোগ পাচ্ছিল অন্যের পা টানছিল। মজাটা হল কুফরি পৌঁছে। ড্রাইভার দাদা এক জায়গায় নামিয়ে দিয়ে বলল ভিউ পয়েন্ট যেতে হলে এখান থেকে হেঁটে যেতে হবে নয়তো খচ্চর নিতে হবে। গাড়ি যাবে না। রাস্তা বেশি নয়, ৩ কিলোমিটারের মতো। আমরা হেঁটেই যাব ঠিক করলুম। ৬ কিলোমিটার যাওয়া আসা আমাদের কাছে কোনও ব্যাপার নয়। কিন্তু ভিউ পয়েন্টের পথে পা বাড়িয়েই থমকাতে হল। রাস্তা ভর্তি কাদা। খচ্চরে যাত্রী নিয়ে কয়েকজন নেমে আসছে দেখলুম। তাদের প্রায় হাঁটু পর্যন্ত কাদায় ঢুকে যাচ্ছে। আমাদের পায়ে ফ্যাশনেবল জুতো। কাদার ভার বহনের ক্ষমতা এ জুতোর নেই। অগত্যা যেতে হলে খচ্চরই ভরসা।

চিড়িয়াখানার ফেজ্যান্ট।

এবারেও দরবাজ নিকেশের কামাল। ৬০০ টাকা ভাড়ার খচ্চরকে তিনশোয় বেঁধেছে সে। চারজনের জন্য চারটে প্রাণী। আমার, নিকেশ আর নাতাশার জন্য তিনটে খচ্চর। অর্ণব বেশ শক্তিশালী, চেহারাবান। তাই তার জন্য হৃষ্টপুষ্ট ঘোড়া বরাদ্দ। সবাই লাগাম ধরলুম। প্রাণীগুলো চলতে শুরু করল। নামে খচ্চর হলেও প্রাণীগুলো বেশ কাজের। হেলতে দুলতে চড়তে লাগল তারা। বিগড়ল ঘোড়াটা। সে খচ্চরদের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে নারাজ। বেশ খানিকটা এগিয়ে গটগটিয়ে চলতে লাগল সে। চেনা পথ ছেড়ে মাঝে মাঝেই বেঁকে যেতে লাগল এদিক সেদিক। ঘোড়া যত বিগড়ল অর্ণবও তত বেসামাল হতে লাগল। তার ক্রমাগত ভয়ার্ত “উরি বাবা”, “ও মা” আওয়াজে ঘোড়াটা বোধহয় উৎসাহ পাচ্ছিল। সে যত চেঁচায় ঘোড়া তত জোরে পা বাড়ায়। শেষমেশ এক সহিস দৌড়ে গিয়ে লাগাম ধরে ঘোড়াকে পথে আনল। অর্ণবের আর্তনাদও বন্ধ হল। আমরাও নির্বিঘ্নেই পৌঁছে গেলুম ভিউ পয়েন্টে।

গ্রিন ভ্যালি।

এটা একটা ছোট হিল স্টেশন। ডিসেম্বর জানুয়ারিতে সাদা বরফের চাদরে ঢেকে থাকে জায়গাটা। কোনও কোনও বছর এরকম সময়ও বরফ পড়ে। আমাদের ভাগ্যে হিম নেই। শুধু হিমেল হাওয়ায় বিদ্ধ হওয়াই আছে। কুফরি সিমলার থেকে উপরে। জায়গাটা উন্মুক্ত। গাছের প্রাচীর নেই। ফাঁকা জায়গাটাতে পৌঁছতেই ঠান্ডা হাওয়া ছুঁচ ফোঁটাতে লাগল সারা শরীরে। এই ঠান্ডার জন্য প্রস্তুত ছিলুম না আমরা। কেঁপে গেলুম একেবারে। তবুও সেই কম্পমান অবস্থাতেই ঘুরে বেড়ালুম জায়গাখানি। বলার মতো কিছু নয়। হিমাচলের অন্যান্য ল্যান্ডস্কেপের তুলনায় এ নস্যি। তবুও কেন এত নাম এর! বরফ। শুধু বরফের জন্যই। আজ সাদা বরফ নেই, তাই কুফরি বড়ই ধূসর।

তবুও মুগ্ধ করে।

ভিউ পয়েন্ট থেকে নেমে চললুম চিড়িয়াখানার উদ্দেশ্যে। না, নামার সময় অর্ণব বা তার ঘোড়া বেসামাল হয়নি। চিড়িয়াখানা কাছেই। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই পৌঁছে গেলুম। বেশ সুন্দর করে সাজানো। পাহাড়ি পশু পাখিদের সংরক্ষণ করা হয়েছে এখানে। চিতা বাঘ, কালো ভালুক, বাদামি ভালুক, ভিন্ন রকম হরিণ রাখা আছে। আর আছে হরেক রকমের ফেজ্যান্ট। হিমাচলের অন্যতম আকর্ষণ ফেজ্যান্টেরা। তাদের রঙিন পালকের ছটার টানে বহু পর্যটক ঘুরে বেড়িয়েছে হিমাচলের দিগবিদিক। চিড়িয়াখানা লাগোয়া ছোট একটা মিউজিয়ামও আছে। তাতে সংরক্ষিত আছে মৃত অবস্থায় পাওয়া বিভিন্ন প্রাণীর স্টাফ।

চিড়িয়াখানা থেকে ফেরার পথ ধরলুম। একবার শুধু দাঁড়ালুম গ্রিন ভ্যালিতে। আমার মনের মত জায়গা। পাহাড়ি ঢাল বরাবর পাইন গাছের সারি। শুধু গাছ, গাছ, আর গাছ। পাহাড়ের পর পাহাড় শুধুই সবুজ। চিরসবুজ। সারাদিনের ক্লান্তি উধাও এক নিমেষেই। এরকমটাই তো চাইছিলাম। আপশোস হল এখানটায় যদি আর একটু আগে আসতে পারতুম।

ঐতিহ্যের সঙ্গে নিকেশ।

সন্ধ্যা ৬:৩০ টায় সিমলা-কালকা এক্সপ্রেস। ঐতিহ্যের পাহাড়ি রেলওয়ে। সাধারণ কামরার টিকিট কেটে স্টেশনে প্রবেশ করলুম। তখনও একটু সময় ছিল। প্রাতরাশের পর কিছু পেটে পড়েনি। স্টেশনে খাবারের দোকান যেন সেকথাটা মনে করিয়ে দিল। বিলাতি স্টেশন। তাই বেশিরভাগই বিলাতি খাবার। দুটো করে বার্গার নিমেষে পেটে সেঁধাল। হরেক পোজে ছবি তুলে আমরা ট্রেনে চাপলুম। মনে হল আরও একটু ইতিহাস ছুঁলুম যেন! ডিজেল ইঞ্জিন ধোঁয়া উড়িয়ে হেলিয়ে দুলিয়ে কামরাগুলোকে টানতে লাগল।

পাহাড়ের পেটে প্রবেশ।

একটু আগেই দূরে পাহাড়ের পিছনে সূর্য অস্ত গিয়েছিল। গোধূলির আকাশটাও মুগ্ধতা ছড়াচ্ছিল একরাশ। পাহাড় কেটে লাইন পেতে সিমলায় ট্রেন এনেছিল সাহেবরা। ক্ষণে ক্ষণেই ট্রেনটা পাহাড়ের পেটের মধ্যে সেঁধাচ্ছিল। ক্রমে অন্ধকার গাঢ় হল। জানালায় মাথা রেখে সিমলাকে দেখছিলাম। দিনের আলোয় কংক্রিটের জঙ্গল ভরা সিমলা অন্ধকারে বড়ই মায়াময়। ঘরে ঘরে বৈদ্যুতিক আলো জ্বলে উঠেছে। মনে হচ্ছে হাজার হাজার জোনাকি যেন ডানা মেলেছে দূর পাহাড়ে। পাহাড়ি ট্রেন পথের শোভা নাকি অতুলনীয়! অন্ধকারে তা দেখার সুযোগ হয়নি। তাতে কি! জানালার কাচে মাথা রেখে রাত্রের এমন শোভাই বা কজন দেখতে পায়।

রাতের সিমলা।

সোলান পৌঁছলুম ৮:৪০ নাগাদ। নেমেই সবাই দে ছুট। পাহাড়ে রাত হয় তাড়াতাড়ি। হস্টেল ৯টায় বন্ধ হবে। তার আগে পৌঁছতে না পারলে…।

ছবি— লেখক

কভারের ছবি— সিমলা স্টেশনে সিমলা-কালকা এক্সপ্রেস।

(সমাপ্ত)

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *